মালয়েশিয়ার লোকায়ত থিয়েটার ও বিশ্ব-ঐতিহ্য ‘মাক উয়ং’

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও তার সমৃদ্ধির খ্যাতি পৃথিবীতে বেশ প্রসিদ্ধ। এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকতার সাথে একসময় ভারতীয়, চীনা ও অন্যান্য আদিবাসী উপাদান মিশ্রিত হয়ে বিভিন্ন ধারা তৈরি করেছিলো। এসব ধারা একসময় এ অঞ্চলের ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাংস্কৃতিক পিপাসা মিটিয়েছে। এমনই একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারা হচ্ছে মালয়েশিয়ার ‘মাক উয়ং’ থিয়েটার। মূলত মালয়েশিয়ার ঐতিহ্য হলেও ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের কোনো কোনো স্থানেও এর প্রচলন দেখা যায়।

Image Source: en.unesco.org

‘মাক উয়ং’কে মূলত একপ্রকার ড্যান্স থিয়েটার বা নৃত্যনাট্য বলা চলে। এর মধ্যে প্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চিহ্নসহ বাদ্য, সঙ্গীত, গল্প বলার বিশেষ ভঙ্গি ও অনবদ্য অভিনয় শৈলী ব্যবহৃত হয়। মালয়েশিয়ার কেলান্তান প্রদেশে এই থিয়েটার বিশেষভাবে দেখা যায়। এছাড়া থাইল্যান্ডের পাতানি অঞ্চল ও ইন্দোনেশিয়ার রিয়াউ দ্বীপে এই থিয়েটার পরিলক্ষিত হয়। প্রধানত এসব অঞ্চলের মালয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর বিস্তার দেখা যায়।

‘মাক উয়ং’কে মূলত দুই প্রকারে দেখা যায়। একপ্রকারে শুধুমাত্র নান্দনিক বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ মঞ্চনাটক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। অন্য প্রকারে কয়েক ধাঁচের প্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই অনুষ্ঠানের ধর্মীয় গুরু ‘সেমাহ গুরু’ নামে পরিচিত। তিন দেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘মাক উয়ং’ এর বিভিন্ন দিকে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।

‘মাক উয়ং’ এর ইতিহাস নির্ণয় করা কিছুটা শক্ত। কারণ স্থানীয় ইতিহাসের কোনো লিখিত উৎসে এর বিবরণ পাওয়া কঠিন। তবে স্থানীয় ওরাল ট্রেডিশন বা মৌখিক ঐতিহ্য থেকে কিছু কিছু অনুমান করা সম্ভব। জানা যায়, স্থানীয় শস্যের দেবী ‘সেমাঙ্গাত পদি’কে সন্তুষ্ট করার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ‘মাক হিয়াং’ নামে পরিচিত ছিলো। অন্য এক মতে, ‘মাক হিয়াং’ নামে খোদ এক দেবতার নামে উৎসর্গ করা অনুষ্ঠান থেকে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উদ্ভব হয়েছিলো। আরেকটি মত অনুসারে বলা হয়, স্থানীয় ভূ-দেবী দেবী ‘বুমি’ (সংস্কৃত ‘ভূমি’ শব্দের কাছাকাছি)-কে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে সমৃদ্ধ কৃষি জীবন পাওয়ার জন্য গান, বাদ্য ও নাচ সহযোগে ধর্মীয় আচার পালিত হতো। সেখান থেকেই ‘মাক উয়ং’ এর উৎপত্তি।

Image source: ich.unesco.org

পরিষ্কার কোনো সূত্র না পাওয়া গেলেও অনেকে ধারণা করেন, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন রাজবংশ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ‘মাক উয়ং’কে সমাদর করতেন। তবে এই ধারণার পেছনে মৌখিক ঐতিহ্য থাকলেও কোনো লিখিত সূত্র পাওয়া যায় না। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লিখিত উৎস ‘হিকায়াত পাতানি’তে দরবারী ঐতিহ্য হিসেবে ‘মাক উয়ং’ এর কোনো উল্লেখ নেই। টেংকু তেমেঙ্গং আবদুল গফফারের উৎসাহে আধুনিক সময়ে এর প্রসার বৃদ্ধি পায়। সত্তরের দশকে খাতিজাহ আওয়াংয়ের নেতৃত্বে ‘মাক উয়ং’ থিয়েটারে আমূল পরিবর্তন আসে। এ সময় এর কস্টিউম, বাদ্য, নৃত্য ও গানে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা সুলভ হয়ে ওঠে। মজার ঘটনা হচ্ছে, শুধু ‘কুমপুলান সেরি তামাঙ্গং’ ছাড়া অন্য কোনো গ্রুপ থিয়েটার এই অভিনব ‘মাক উয়ং’ গ্রহণ করেনি। এমনকি গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেকাংশে ধর্মীয় রিচুয়াল হিসেবেই ‘মাক উয়ং’ এবং ‘মাই পুতারি’ একত্রে পালিত হয়।

Image Source: malaymail.com

‘মাক উয়ং’ সাধারণত ১২টি প্রধান ও জনপ্রিয় গল্প বা উপাখ্যানের মঞ্চায়নের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বলা হয়, ‘দেওগা মুদা’ নামক প্রাচীন এক উপাখ্যান এই থিয়েটারের প্রথম গল্পের মধ্যে অন্যতম। অন্যান্য গল্পের মধ্যে ‘দেওগা পেচিল’, ‘আনাক রাজা গনদাং’ ও ‘রাজা তঙ্কাই হাতি’ অন্যতম। এই উপাখ্যানগুলোর উৎস নিয়েও মতভেদের শেষ নেই। কারণ ভারতবর্ষের রামায়ণ ও মহাভারত অথবা চীনের ‘জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’ এর মতো এর কোনো সাহিত্যিক উৎস পাওয়া যায় না।

বর্তমানে প্রদর্শিত ‘মাক উয়ং’কে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে রাখা হয় শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা অনুষ্ঠানকে। দ্বিতীয় ভাগে থাকে শুধু বিনোদনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত অনুষ্ঠান। নিছক বিনোদন ও শিল্প হিসেবে ‘মাক উয়ং’ এর আবির্ভাব বেশ পরে হয়েছিলো। গ্রামাঞ্চলে আয়োজিত ‘মাক উয়ং’-এ এখনও রিচুয়াল ও আর্ট আলাদা হিসেবে থাকে না।

ধর্মীয় আচার হিসেবে আয়োজিত ‘মাক উয়ং’ মালয়েশিয়ার কেলান্তান অঞ্চলে এখনও বহুলাংশে প্রচলিত। এটি মূলত অসুস্থদের রোগ নিরাময় কেন্দ্রীক ধর্মীয় আচার হিসেবে পালিত হয়। মজার ঘটনা হচ্ছে- বিনোদন ও শিল্পের জন্য আয়োজিত থিয়েটারের শুরুতেও ধর্মীয় আচার কিছু পরিমাণে পালন করা হয়। টানা তিন দিন ধরে রিচুয়াল হিসেবে পালিত পশু উৎসর্গের ব্যবস্থাও থাকে। উৎসর্গ ও তারপরে আয়োজিত ভোজের কার্যক্রমকে ‘জামুয়াহ’ বলা হয়। উৎসর্গের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করা অদৃশ্য আত্মাকে ‘হান্তু’, ‘জাম্বালাং’ ও ‘জিন’ বলা হয়। সন্তুষ্ট করা দেবতাকে স্থানীয় ভাষায় ‘দেও’ (বাংলা উপকথার দেও-এর মতো) বলা হয়।

Image Source: msn.com

আধুনিক বিনোদনমূলক মাক উয়ং ধর্মীয় আচার থেকে পৃথক হয়েই জন্ম নিয়েছে। প্রথমেই মঞ্চশিল্প হিসেবে এর জন্ম হয়নি। গ্রামাঞ্চলের আচার অনুষ্ঠান তার ধর্মীয় গভীরতা কিছুটা ছেড়ে শহরাঞ্চলে এসে সাধারণ চিত্তবিনোদনে রূপ নেয়। পরে এতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে এবং নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হয়ে এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে।

মঞ্চে অভিনয়ের সময় এই থিয়েটারে বেশ কিছু বর্ণীল চরিত্র ও তাদের শৈল্পিক উপস্থাপন দেখা যায়। মূল পুরুষ চরিত্র ‘পাক উয়ং’ এবং মূল নারী চরিত্র ‘মাক উয়ং’ নামে পরিচিত। নাটকের ভাঁড় চরিত্র ‘পেরান’ নামে পরিচিত।

‘মাক উয়ং’ থিয়েটার শুরু হবার বর্ণীল আনুষ্ঠানিকতাকে ‘মেঙ্গাদাপ রেবাব’ বলা হয়। অতুলনীয় শৈল্পিক নাচ এই আনুষ্ঠানিকতার মূল বৈশিষ্ট্য। যে ধারার গানের সাথে এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়, তা ‘লাগু মেঙ্গাদাপ রেবাব’ নামে পরিচিত। গান ও নাচের সাথে যে বাদ্য বাজতে থাকে, স্থানীয় ভাষায় তাকে ‘রেবাব’ বলে (মধ্যপ্রাচ্যের ‘রবাব’ শব্দের সাথে তুলনীয়)। এটি আনুষ্ঠানিকতার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ‘রেবাব’ নামের এই বাদ্যযন্ত্র উৎস হিসেবে ধর্মীয় আচারের শিক্ষক ‘সেমাহ গুরু’র সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ‘মেঙ্গাদাপ রেবাব’ সাধারণত ১০-১৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এটি মোটামুটি ৬টি পর্যায়ে বিভক্ত থাকে। পর্যায়গুলোকে সহজ ভাষায় ‘উদ্বোধন’, ‘নত হওয়া’, ‘কৃতজ্ঞতা’, ‘মূল চরিত্রে যাওয়া’, ‘দাঁড়ানো’ ও ‘হাঁটা’ বলা যেতে পারে। নামে সাধারণ মনে হলেও বিশেষ ভঙ্গিমার জন্য এসব পর্যায় অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ওঠে। 

Image Source: star2.com

এ থিয়েটারে তিনটি ছাড়া অন্য সব চরিত্র নারী পারফর্মাররা করে থাকে। মূল নারী চরিত্র ‘মাক উয়ং’ কেন্দ্রীয় গল্প বিশেষ স্টাইলে বলতে থাকে। পুরুষ চরিত্র ‘পাক উয়ং’ সাধারণত কোনো রাজার ঘটনা ফুটিয়ে তোলে। সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজা চরিত্র ‘দেবরাজা’ বা স্বর্গের দেবতাদের সম্রাট হিসেবে মান্যতা পায়। গল্পের মধ্যে দুঃখ ভারাক্রান্ত রাজকন্যা, স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের কার্যকলাপ ইত্যাদি ফুটে ওঠে। বিশেষ পর্যায়ে ভাঁড় ‘পেরান’কে বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রহার করার দৃশ্যে হাস্যরস ফুটে ওঠে।

সাধারণত ১৬ জন অভিনেতা অভিনেত্রী নিয়ে ‘মাক উয়ং’ এর দল গঠিত হয়। থিয়েটারে বাদ্য বাজানোর জন্য আরেকটি দল গং, ড্রামস ও রেবাব নিয়ে একত্রিত থাকে। নাটকীয়তা, গান ও নাচের মাধ্যমে এক ভিন্নধর্মী শৈল্পিক আবহ তৈরি হয়।

Image Source: msn.com

‘মাক ইয়ং’ এর মতো অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি মালয়েশিয়া সরকার সবসময় সদয় আচরণ দেখাতে পারেনি। আদিবাসী সংস্কৃতির প্রভাব থাকায় ১৯৯৮ সালে একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। এছাড়া তখন মালয়শিয়ার ক্রমাগত বেড়ে চলা ধর্মীয় গোঁড়ামি স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ফলে অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন।

২০০৫ সালে ইউনেস্কো ‘মাক উয়ং’কে ‘ওরাল অ্যান্ড ইন্ট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। শুধু শিল্পকলা হিসেবে নয়- মালয়শিয়ার জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষ্য হচ্ছে এই থিয়েটার। বিভিন্ন বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও মালয়শিয়ার গ্রামাঞ্চলে এখনও লৌকিক ও শৈল্পিক উৎসব হিসেবে এর আবেদন কিছুমাত্র কমেনি। বরং এর আন্তর্জাতিক আবেদন আরো প্রশস্ত হয়েছে।

This Bangla article is about traditional 'Mak Yong' theatre of Malaysia. 

References:

01. Mak Yong: A rich artistic heritage - New Straits Times

02. Indigenous Traditions: Main Puteri and Mak Yong - disco.teak.fi

03. Mak Yong theatre - ich.unesco.org

Related Articles

Exit mobile version