আজকাল ফেসবুক চালাতে বসলে প্রায়ই একটা জিনিস সামনে আসে, যেটার অভিজ্ঞতা বোধহয় সবারই কম-বেশি হয়েছে। “দিস ইমেজ/ভিডিও কন্টেইন্স ম্য্যচিউর কন্টেন্ট: সিন’স অফ ভায়োলেন্স”, যার পেছনে কালো পর্দা দিয়ে সেই ইমেজ বা ভিডিওটি ঢেকে রাখা হয়েছে। সাথে আবার ক্লিক করলে সেটি দেখতে পারার অপশনও থাকে, অর্থাৎ মূলত সেই লেখাটি একটি সতর্কবাণী, আপনি দৃশ্যটি দেখবেন কি না, তার চাবি তুলে দেয়া হয়েছে আপনার হাতে।
সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, আপনি জানেন যে এই কালো পর্দার অন্তরালে কী থাকতে পারে এবং আপনি এটাও জানেন যে সেটা দেখে আপনি ভয় পাবেন। এবার হয়তো নির্ঘুম রাতের সংখ্যা দুদিন ছেড়ে চারদিনে গিয়ে দাঁড়াবে। তা-ও আপনি সব জেনেশুনে সেখানে ক্লিক করলেন এবং ভয়ও পেলেন। এমনটা নিশ্চয়ই অনেকের সাথেই হয়েছে।
গ্রাঁ গিঁনল থিয়েটার
কেন আমরা বীভৎসতা এড়াতে পারি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটি শতাব্দী প্রাচীন থিয়েটারের গল্প বলা যাক, তাতে হয়তো অনেক কিছু পরিষ্কার হবে আপনার কাছে। অনেকে মনে করেন এই প্রবণতা পুরোই আধুনিক এবং এর জন্য দায়ী আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন- টিভি ও ইন্টারনেট। কিন্তু এটা যে পুরোপুরি ঠিক নয়, তা-ও বুঝতে পারবেন।
থিয়েটারটির নাম ‘লে দিয়াত্রে দ্যু গ্রাঁ গিঁনল’ বা সংক্ষেপে গ্রাঁ গিঁনল, যার অর্থ বিশাল পাপেটের থিয়েটার। পারির পিগাল এলাকায় ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় থিয়েটারটি। ফরাসি নাট্যকার অস্কার মেতেন্যির নিজের বিতর্কিত নাটকগুলোর মঞ্চায়নের জন্য থিয়েটারটি কেনেন। ২৯৩টি সিট নিয়ে এটি তৎকালীন ফ্রান্সের সবচেয়ে ছোট থিয়েটার হলেও ছিল সবচেয়ে মৌলিক।
আর গিঁনল নামটি মেতেন্যির নিয়েছিলেন ফরাসি পাপেট শো’র চরিত্র গিঁনল থেকে। গিঁনলকে সেখানে দেখানো হয় একজন সুবক্তা হিসেবে, যে খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলে। নেপোলিয়নের আমলে গিঁনলের পাপেট শো বিতর্কিত বলে বন্ধ করে দেয়া হয়, যার কাহিনী থেকে মেতেন্যির নিজের বিতর্কিত নাটকগুলো প্রচার করার প্রেরণা পেয়েছিলেন।
তবে মেতেন্যিরের নাটকগুলো বীভৎসতার জন্য বিতর্কিত ছিল না। তার কাজে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা উঠে আসতো বলে তা সমাজের কর্তাব্যক্তিদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। মেতেন্যিরের পর ১৮৯৮ সালে গ্রাঁ গিঁনলের দায়িত্ব হাতে আসে ম্যাক্স মউরির, যার হাত ধরেই গ্রাঁ গিঁনল থিয়েটার হয়ে ওঠে বীভৎসতা শিল্পায়নের কারখানা।
মউরির হাতে যেসব নাটক প্রস্তুত হতো গ্রাঁ গিঁনল থিয়েটারে, কথিত আছে, তা দেখে দর্শকেরা বমি করে দিতো, অজ্ঞান হয়ে যেতো ভয়ে, তা-ও বার বার ফিরে আসতো প্রতিটি মঞ্চায়নে। প্রতি শোতে কমপক্ষে দুজন জ্ঞান হারাবে বলে ধারণা করা হতো। থিয়েটারের ব্যালকনির নিচে কিছু বাক্স রেখে দেয়া হতো, চার্চের স্বীকারোক্তি বাক্সের মতো, যেসব দর্শক আর নিতে পারতো না, তাদের জন্য।
মউরি এই সময়ই খুঁজে পান বিখ্যাত নাট্যকার আঁদ্রে দে লোরেকে, যিনি পরবর্তীতে গ্রাঁ গিঁনলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকারদের একজন হন। তার নাটকগুলো বর্তমানে ফরাসি নাট্যসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি ১৯০১ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত গ্রাঁ গিঁনলের জন্য লিখে গিয়েছেন। শুধু গিঁনলের জন্য লেখা তার নাটকের সংখ্যাই শতাধিক।
১৯৩০ এর পর জ্যাক জোভিনের হাতে গিঁনলের ধারা পরিবর্তন হয়। হরর ও বীভৎসতা থেকে মনস্তাত্ত্বিক নাটকের গুরুত্ব বাড়ে। এতে গ্রাঁ গিঁনলের নিজস্বতা ও জনপ্রিয়তা দুটোই কমে যায় এবং ১৯৬২ সালে থিয়েটারটি বন্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি।
গিঁনলের নাট্যদর্শনে বীভৎসতা ও গিঁনলের দর্শক
গ্রাঁ গিঁনলের নাট্যদর্শন ছিল মেতেন্যিরের প্রকৃতিবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে। শুরু থেকেই গিঁনলের নাটকের জীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বর্ণহীন ও হতাশাপূর্ণ এবং কঠোরভাবে বাস্তববাদী। মউরির আমল থেকে মূলত হরর নাটকের চলই ছিল বেশি, যাতে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতা থাকতো প্রচুর পরিমাণে। এর বাস্তব মঞ্চায়নে গ্রাঁ গিঁনলের কর্মীরা ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। খুন, ধর্ষণ ও অন্যান্য বীভৎসতার দৃশ্য অভিনয় বলে মনেই হতো না। তবে আধভৌতিক এবং অবাস্তব নাটক খুব বেশি মঞ্চায়িত হতো না গ্রাঁ গিঁনলে, যেহেতু তা মেতেন্যিরের প্রকৃতিবাদী দর্শনের পরিপন্থী।
গিঁনলের দর্শকেরা, এই ইন্টারনেট এবং আধুনিক প্রযুক্তির বহু আগেই পর্দার পিছনের বীভৎসতায় অভ্যস্ত হয়ে আসছিলেন। তারা অনেকে ছিলেন বাঁধা দর্শক, একই নাটকের বিভিন্ন মঞ্চায়নেও বারবার যেতেন। তাদের কাছে এটি শুধু নাটক ছিল না, এটি ছিল একটি অভিজ্ঞতা। তবে এই অভিজ্ঞতা তারা পারতেন না আর কারো সাথে ভাগ করে নিতে। কারণ গ্রাঁ গিঁনল দেখা সমাজে ঘৃণিত ছিল। পাঠক কি এর সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? গ্রাঁ গিঁনল তার দর্শকদের সুবিধার্থে নাটক মঞ্চস্থ করতো সন্ধ্যার পর, দর্শকেরাও বেশিরভাগ আসতেন আপাদমস্তক ঢেকে, ছদ্মবেশে। তারাও কেন এড়াতে পারতেন না এই বীভৎসতার মঞ্চায়ন?
বীভৎসতা দেখার প্রবণতা: অসুস্থ বিনোদন নাকি প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রবৃত্তি?
অনেকেই নিজের এমন বীভৎসতা এড়াতে না পারার প্রবণতা নিয়ে নানা রকম ভাবনা ভাবেন। যেমনটা ভাবতেন গ্রাঁ গিঁনলের দর্শকেরা। এটা নিয়ে বেশিরভাগের চিন্তা একটা ভিক্টোরিয়ান আড়ালিকরণের আবরণে থাকে। আমরা কারো সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পাই। মনে করি, অন্যরা আমাদের অসুস্থ ভাববে, আমরা নিজেরাও অনেক ক্ষেত্রে ভাবি এই প্রবণতা অসুস্থ। কিন্তু আমরা এটা সবাই এড়াতেও পারি না। অনেক কমেন্ট সেকশনে অনেককে দেখা যায়, এসব বাজে জিনিস না দেয়ার হুমকি দিতে। অথচ তারা এই ব্যাপারটি এড়িয়ে যান যে একটি পাবলিক মাধ্যমে তারাই প্রকারান্তরে এটি দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একটি ব্যাপার এই ক্ষেত্রে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। সাধারণত এ ধরনের ছবি বা ভিডিও দেখে কেউ বিনোদন লাভ করে না, যে আবেগগুলো আমরা অনুভব করি সবগুলোই নেতিবাচক; যেমন রাগ, ঘৃণা, হতাশা। যদি কেউ বিনোদন লাভ করে আসলেই, সেই ক্ষেত্রে অসুস্থতার বিতর্কটা একটু ধোঁয়াশা হয়ে যায়, কারণ মনোবিকারের অন্যতম লক্ষণ বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতা দেখে বিনোদন লাভ।
তাহলে এই প্রবণতার কারণ কী? উত্তরটা সহজ নয়। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে। মনোবিদ গেইল সাল্টয বলেন,
স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে ধর্ষকামী ও মর্ষকামী দুই ধরনের বৈশিষ্ট্যই থাকে।
তার মতে, আমরা এসব প্রবণতা দমিয়ে রাখি। কারণ এসব প্রবণতা সমাজে নিন্দনীয়। কিন্তু দমিয়ে রাখা মানেই ভুলে যাওয়া নয়। আমরা সমাজে সমর্থিত উপায়ে রুপান্তর করি নিজেদের।
ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা এবং ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে, আমাদের মস্তিষ্ক বীভৎসতার আশঙ্কা করে। আমরা যখন পর্দায় বীভৎসতা দেখি তখন বীভৎসতা ঠিকই আমাদের মধ্যে বমন উদ্রেক করে, কিন্তু বীভৎসতা হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা তার প্রতীক্ষা করতে থাকি। এই প্রতীক্ষা অলঙ্ঘনীয়, আমরা এটা এড়াতে পারি না। এজন্য প্রতীক্ষার পরের ফলাফলটাও আমাদেরই দেখতে হয়।
কিন্তু কেন এই প্রতীক্ষা? গবেষকদের মতে, এটা বিবর্তনের ফলে তৈরি হওয়া একটি রক্ষামূলক প্রবৃত্তি। অর্থাৎ, আমরা বেঁচে থাকার জন্য বিবর্তিত হয়েছি এমনভাবে যে, আমরা অচেতনভাবেই যেকোনো প্রকার বীভৎসতার বা নিষ্ঠুরতার জন্য প্রস্তুত থাকতে চাই। অনেকেই খেয়াল করবেন যে, আমাদের গা গুলিয়ে ওঠার অন্যতম কারণ আমরা নিজেদের ওই পরিস্থিতিতে কল্পনা করতে থাকি পর্দায় বীভৎসতা দেখার সময়। এবং আমরা চাই এই পরিস্থিতি থেকে কোনোভাবে বেঁচে, অক্ষত ফেরত আসা যায় কি না।
আমরা এসেছি বনে জঙ্গলে থাকা শিকারি যাযাবর পূর্বপুরুষ থেকে। বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতা ছিল যাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। তাই পরেরবার যখন এরকম আরেকটা দৃশ্য এড়াতে না পেরে ভয় লাগবে আর মন খারাপ হবে আপনার, অন্তত নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন যে, আপনি মানসিক বিকারগ্রস্ত নন।
ফিচার ইমেজ: agefotostock.com