পর্যটকদের জন্য থাইল্যান্ড সবসময়ই খুব বেশি আকর্ষণীয় একটি স্থান। থাইল্যান্ড শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকেই নয়, বরং নিজেদের ১০০ বছরের পুরনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যও বেশ বিখ্যাত। পুরনো থাই সংস্কৃতি, বিনয়ী আচার-আচরণ এবং তাদের বিশ্বাস বহিরাগতদের কাছে অনেক সময় বেশ অদ্ভুত লাগে; বিশেষ করে পশ্চিমা দেশের অধিবাসীদের নিকট। এসকল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে কিছু কুসংস্কারেও অপার বিশ্বাসী এই থাই জাতি, যা আসলেই চমকে দেওয়ার মতো। একুশ শতকে শিক্ষা এবং প্রযুক্তির উন্নতির ফলে নতুন প্রজন্মে কুসংস্কারগুলোর প্রতি বিশ্বাস কমে গেলেও সমগ্র থাই জাতি থেকে সেগুলো এখনও পুরোপুরি যায়নি।
চলুন, আজকে তাহলে থাইল্যান্ডের কয়েকটি কুসংস্কার সম্পর্কে একটু জেনে নিই।
১. বুধবারে চুল কাটা নিষিদ্ধ
এই সম্পর্কে তিনটি কারণ প্রচলিত রয়েছে। যেমন-
অতীতে বুধবারকে উন্নতি এবং বৃদ্ধির দিন হিসেবে ধরা হত। এই দিনে রাজ পরিবার এবং বিশেষ সম্মানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ নিজেদের চুল কাটতেন। তাই প্রতি বুধবারে সাধারণ জনগণের চুল কাটা নিষিদ্ধ ছিল। শুধু তা-ই নয়, একে অশুভও ধরা হতো। কেননা, বুধবারে রাজপরিবারের সাথে একই কাজ (চুল কাটা) করার মাধ্যমে আপনি নিজেকেও তাদের সমতুল্য সম্মানের অধিকারী হিসেবে অভিহিত করতে চাচ্ছেন।
আরেকটি কারণ হিসেবে প্রচলিত আছে যে, প্রতি বুধবারে রাজপরিবারের সদস্যদের চুল কাটার জন্য নাপিতদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হতো এবং এ কাজ শেষ করতে অনেকসময় লাগত। কেননা, নাপিতদের অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ও যত্নের সাথে কাজটি করতে হত। ফলে এই দিনে সাধারণ কোনো ব্যক্তি নাপিতের দেখা পেত না।
অন্য এক প্রচলিত মতানুসারে, পূর্বে একটি সেলুনে শুধুমাত্র একজন নাপিতই থাকতেন, তাই প্রতি সপ্তাহে তার একটি ছুটি আবশ্যক ছিল। যেহেতু বুধবার সপ্তাহের মধ্যম দিন, সেহেতু এ দিনে সাপ্তাহিক ব্যস্ততার জন্য অনেকেই সেলুনে আসতেন না। এজন্যই নাপিতেরা এই দিনে ছুটি নিতেন।
২. লেমন গ্রাস দিয়ে বৃষ্টি বন্ধ করা
থাইল্যান্ডে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, কুমারী নারীদের বৃষ্টি বন্ধ করার বিশেষ শক্তি রয়েছে। এজন্য একজন কুমারী নারীকে কয়েকটি লেমনগ্রাস দিয়ে বেঁধে লম্বালম্বিভাবে ধানক্ষেতের মাঝে একটি স্থানে গেঁথে দিতে হবে। এরপরও যদি অঝোরে বৃষ্টি হয়, তাহলে তারা ধরে নিতেন সেই নারী কুমারী নন। থাই সংস্কৃতিতে অনেকে একে প্রকৃতির সহায়তায় নারীর কুমারিত্ব পরীক্ষা করার একটি মাধ্যম মনে করতেন। তবে বর্তমানে এই প্রথার প্রচলন সাধারণত দেখা যায় না।
৩. কোনো শিশুকে সুন্দর বলা যাবে না
নিজের অজান্তেই আমাদের মন অনেকসময় কোনো শিশুকে দেখে ভালো হয়ে যায়। ফুটফুটে কোনো বাচ্চার চেহারা দেখলে যে আকস্মিক আনন্দ পান, তা প্রকাশের জন্য আদর করে শিশুটিকে সুন্দর বলতেই পারেন। তবে থাইল্যান্ডে ভুলেও এ কাজ করতে পারবেন না। সেখানকার বিশ্বাস অনুসারে, কোনো শিশুকে যদি সুন্দর বলা হয়, তাহলে তা কোনো ভূত বা খারাপ প্রেতাত্মা শুনে ফেলবে এবং তাকে নিয়ে যাবে। আচ্ছা সুন্দরের কথা না হয় বাদই দিলাম; আপনি যদি কোনো শিশু বিশেষ করে নবজাত শিশুকে দেখেন তাহলে বলতে হবে, “শিশুটি কি অসুন্দর!” পর্যটকদের নিজেদের সন্তানদেরকে নিয়ে অনেকসময় এরকম উদ্ভট অবস্থায়ও পড়তে হয়। থাইল্যান্ডে অনেকের মতে, কারও নামকরণ করা উচিত মন্দ এবং অপ্রাসঙ্গিক নাম দিয়ে, যেমন- ‘ওয়ান’ (Ouan– মোটা), ‘পু'(Poo– কাঁকড়া) ইত্যাদি।
৪. বিভিন্ন পশু-পাখি দেখে কিংবা তাদের শব্দ শুনে ভালো-মন্দ কিছুর আশঙ্কা করা
বাইরে বের হওয়ার সময় কোনো টিকটিকি যদি আপনার পেছন থেকে আওয়াজ করে, তাহলে বাইরে গেলে আপনার সাথে খারাপ কিছু হতে পারে। আর সামনে এসে আওয়াজ করলে অবশ্যই ভালো কিছু হতে যাচ্ছে আপনার সাথে। তবে ‘গেককো‘(Gekko) ইনফ্রাওর্ডারের টিকটিকি ‘গেকো’ (Gecko) যদি দিনের বেলা জোরে জোরে শব্দ করে, তা কোনো খারাপ ঘটনার আগাম বার্তা ধরে নেওয়া হয়। অবশ্য কোনো বৃহদাকার টিকটিকি অর্থাৎ ‘মনিটর লিজার্ড’ আপনার বাসায় আসলে তার সাথে ভালো করে কথা বলবেন; এতে করে আপনার ভাগ্য খুলবে। কিন্তু কীভাবে কথা বললে আপনার ভাগ্য খুলবে, তা কারো জানা নেই। এমনকি কোনো হিংস্র পশু আপনার বাড়িতে ঢুকে গেলে তাবিজ ও ফুলসহ মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে অত্যন্ত নম্রভাবে পশুটিকে চলে যেতে বলবেন। তবে কথা হলো, আপনার ভাগ্য যদি অত্যন্ত ভালো হয় এবং এ সময়ের মধ্যে সেই প্রাণী আপনাকে আক্রমণ না করে, তবেই আপনি এই নিয়ম-কানুন শেষ করতে পারবেন।
পেঁচাকে থাই জাতি সকল অভিশাপের প্রতীক হিসেবে ধরে নেন। কারো বাড়ির ছাদে এর আগমনকে ভবিষ্যতে আসা বিপদের সংকেত ধরা হয়। এমনকি প্রকৃতির ডাকে কোনো পাখি যদি কারো মাথার উপর মলত্যাগ করে, তা অশুভ লক্ষণ হিসেবে ব্যক্ত করবে থাইবাসী। বাড়ির আশেপাশে কোনো মৌমাছি এসে মৌচাক তৈরি করলে তা ধ্বংস করা যাবে না। কেননা, মৌমাছি অত্যন্ত পরিশ্রমী জীব এবং এটি সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। ঘরে কোনো ব্যাঙের আগমন শুভ ঘটনার সংকেত। আপনার পোষা পাখি রাতের বেলা জোরে আওয়াজ করার অর্থ হলো- আপনি খুব শীঘ্র কারো সাথে ঝগড়া করবেন।
৫. তাবিজ সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে
বেশিরভাগ থাই অধিবাসী বিশ্বাস করেন যে, গলায় ‘Phra Kreuang’ বা বুদ্ধ পবিত্র তাবিজ (Buddist holy amulet) পরা থাকলে যেকোনো বিপদ হতে বাঁচা সম্ভব। এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় যে এমন অনেক পুলিশ আছেন যারা বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট এবং ড্রাইভাররা সিটবেল্ট পর্যন্ত ব্যবহার করেন না। তাদের মতে, এসকল তাবিজের শক্তিই তাদের রক্ষা করবে। এগুলো সাধারণত সোনা, রূপা, এমনকি পাথর দ্বারাও তৈরি করা হয় এবং এতে গৌতম বুদ্ধের চিত্র খচিত থাকে। থাইল্যান্ডে এসকল তাবিজ কম দামেও পাওয়া যায়, আবার খুব চড়া মূল্যেও বিক্রি করা হয়। যেমন- কোনো তাবিজের মূল্য এক লাখ বাথ বা ৩০৩৩ ইউএস ডলার পর্যন্তও হতে পারে।
৬. দেহের বিভিন্ন অংশ দেখে কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে ধারণা করা
যেসকল শিশুদের জন্ম-দাগ থাকে, তাদের পূর্বজন্ম ছিল। ঠোঁটের নিচের অংশে তিল থাকা মানে সেই ব্যক্তি বিবেকহীন। কারও বড় কান থাকলে সে অত্যন্ত উৎফুল্ল জীবন উপভোগ করবে। আর কারও মোটা কান হলে সে সবসময় খুব একাকী জীবনযাপন করবে।
৭. কোনো কাজের পূর্বে সন্ন্যাসী বা জ্যোতিষীর পরামর্শ নেওয়া
অনেক থাই অধিবাসীই কোনো নতুন কাজ করার পূর্বে জ্যোতিষী বা সন্ন্যাসীদের পরামর্শ নিয়ে একটি শুভ তারিখ ঠিক করে নেন। যেমন- বিয়ের তারিখ, ক্রয়কৃত নতুন গাড়ি বের করা, বাড়ি তৈরীর প্রথম পিলার স্থাপন করার জন্য। নতুন প্রজন্মের অনেকে এগুলো বিশ্বাস না করলেও এখনও থাইল্যান্ডের বেশ কিছু পরিবারের নিজস্ব জ্যোতিষী থাকেন, যাদের কাছ থেকে তারা সবসময় পরামর্শ নেন।
৮. ‘তিন’ এর সকল গুণিতক শুভ লক্ষণযুক্ত
থাইল্যান্ডে তিন বা তিনের সকল গুণিতককে মঙ্গলজনক সংখ্যা হিসেবে ধরা হয় এবং তন্মধ্যে ‘৯’-কে সর্বোত্তম ধরা হয়। এর কারণ হলো- থাই ভাষায় উন্নতি বা ‘Progress’ -এর উচ্চারণ অনেকটা নয়ের ইংরেজি অনুবাদ, অর্থাৎ ‘নাইন’ (Nine) এর মতো। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে কিংবা জন্মদিনে গুনে গুনে নয়জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর হাতেই পূজা করানো হয়।
প্রতিটি দেশে, জাতি কিংবা গোষ্ঠীতে কোনো না কোনো কুসংস্কার থাকেই। শত বছরের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে ভরা থাইল্যান্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। যেখানে কোনো সংস্কার আছে, সেখানে কুসংস্কার থাকবেই। তবে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে কোনটা কুসংস্কার তা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং এসকল কুবিশ্বাস বর্জন করতে হবে।
ফিচার ইমেজ: TourRadar.com