হলিউডের দৌলতে আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিস নিয়ে হাজারো রকম মিথ প্রচলিত হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। অবশ্য এই সিক্রেট সার্ভিস আদতেই সিক্রেট বা গোপন। আর তাই একে নিয়ে বাস্তবেও ধোঁয়াশার কমতি নেই। দামি স্যুট, চকচকে বুট, চোখে গাঢ় কালো সানগ্লাস, কানে ব্লুটুথ ইয়ারফোন, এভাবেই আমরা সিক্রেট সার্ভিসের একজন সদস্যকে চিনতে অভ্যস্ত। কিন্তু শুধুমাত্র এই বাঁধাধরা পোশাকি নিয়মের আওতায় যদি একজন সিক্রেট এজেন্টকে চিহ্নিত করতে চান, তাহলে ভুল করবেন। আমেরিকার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আপনার এই পোশাক বিষয়ক জ্ঞান কোনো কাজেই লাগবে না। আপনার দৃষ্টি শতভাগ এড়িয়ে তারা আপনার উপর নজরদারি করার মতো দক্ষতা রাখে। হলিউডি জাঁকজমকের দৌলতে সিক্রেট সার্ভিস নিয়ে কৌতুহল ও আগ্রহের শেষ নেই। সেই আগ্রহের তৃষ্ণা কিছুটা মেটাতে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। চলুন জানা যাক, আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের অজানা কিছু ব্যাপার স্যাপার।
সংখ্যা ভ্রম
সাধারণত বেশিরভাগ মানুষের ধারণা এই অভিজাত সৈনিকদের সংখ্যা বড়জোর শ’খানেক হবে। কিন্তু আসলে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার দক্ষ ও কুশলী সদস্য রয়েছে সিক্রেট সার্ভিসে। এর মধ্যে ৩,২০০ জন স্পেশাল এজেন্ট, ১,৩০০ জন ইউনিফর্মওয়ালা ডিভিশন অফিসার এবং প্রায় ২,০০০ জনেরও বেশি কারিগরি, পেশাদার ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ইউনিটে নিয়োজিত রয়েছে আরও অনেক।
নিরাপত্তা দানের পরিধি
সিক্রেট সার্ভিসের মূল কাজ প্রেসিডেন্টকে নিরাপদ রাখা। তবে শুধু প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা দানেই সিক্রেট সার্ভিস নিয়োজিত থাকে না, প্রেসিডেন্টের পরিবারের সদস্যবৃন্দ, সাবেক প্রেসিডেন্টগণ ও তাদের প্রত্যেকের পরিবারের সদস্যবৃন্দও তাদের সেবাপরিধির অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া প্রেসিডেন্টের অতিথিগণকে ও প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুযায়ী যে কাউকে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখা তাদের দায়িত্ব।
ছেলেখেলা নয়
একদমই নয় ছেলেখেলা। সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যদের দুনিয়ার তাবৎ সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। খুনের চেষ্টা, অপহরণ, সম্মুখযুদ্ধে গোলাগুলি সবকিছুর জন্যই কৃত্রিম প্রেক্ষাপট তৈরি করে তাদের উপর্যুপরি প্রশিক্ষণ দিয়ে অভ্যস্ত করে তোলা হয় এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের আগে সম্ভবপর সকল দুর্ঘটনা ও আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য তাদের একইভাবে ড্রিল ও টেস্ট করানো হয়। ট্রেনিং সেশনে তারা বিশেষভাবে তৈরি বুলেট ব্যবহার করে, যাতে কারো আঘাত না লাগে। প্রতি ৮ সপ্তাহ অন্তর এজেন্টদের স্কিল ডেভলপমেন্ট কোর্সের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
মেডিক্যাল প্রশিক্ষণ
এজেন্টরা প্রাথমিক মেডিক্যাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে এটি খুবই উপকারী কোর্স। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে বা ভিকটিমকে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তার জীবন বাঁচিয়ে রাখতে এজেন্টদের এই দক্ষতা খুবই প্রয়োজনীয়। এছাড়া প্রেসিডেন্টের রক্তের গ্রুপবিশিষ্ট রক্তের ব্যাগ সবসময় তাদের সঙ্গে থাকে, যাতে জরুরী প্রয়োজনে বা দুর্ঘটনার শিকার হলে তৎক্ষণাৎ তাকে রক্ত সরবরাহ করা যায়।
সাংকেতিক নামকরণ
আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিস তাদের কাজের গোপনীয়তা রক্ষার্থে প্রেসিডেন্ট, তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ, ভাইস প্রসিডেন্টগণ ও রাজনৈতিক প্রার্থীদের জন্য বিভিন্ন কোড নেইম ব্যবহার করে থাকে। কোনো প্রসিডেন্টের সমগ্র পরিবারের নামকরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট আদ্যক্ষর বেছে নেয়া হয়; যেমন সাবেক প্রসিডেন্ট বারাক ওবামার নাম ছিল ‘রেনিগেড’, ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা ছিলেন ‘রেনেঁসা’, মালিয়া ও সাশা ওবামা ছিল যথাক্রমে ‘রেডিয়্যান্স’ ও ‘রোজবাড’। বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম ‘মোগুল’, মেলানিয়া ট্রাম্পের নাম ‘মিউজ’, ইভাঙ্কা ট্রাম্প ‘মার্ভেল’, ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র ‘মাউন্টেনিয়ার’ ও এরিক ট্রাম্প ‘মার্কসম্যান’। এছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জন্যেও তারা কোড নেইম ব্যবহার করে। যেমন, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তারা ডাকে ‘কিটিহক’ বা ‘রেডফার্ন’, আর প্রিন্স চার্লসকে ডাকে ‘প্রিন্সিপাল’ বা ‘ইউনিকর্ন’। নিঃসন্দেহে এসব নামকরণের পদ্ধতি ও ধরণ যথেষ্ট মজাদার।
সার্বক্ষণিক সঙ্গ
সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের প্রেসিডেন্টকে কখনো একা ছাড়ার নিয়ম নেই। তাই প্রেসিডেন্ট যেখানে, তারাও সেখানে যেতে বাধ্য। আর সে কারণেই প্রেসিডেন্টের শখ-আহ্লাদকেও নিজেদের শখ বানিয়ে নিতে বাধ্য। প্রেসিডেন্ট সকালে দৌড়তে যান, উপায় নেই, নির্দিষ্ট সংখ্যক এজেন্টকেও দৌড়তে হবে। প্রেসিডেন্ট হাইকিংয়ে যেতে চান, তাদেরও বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রেসিডেন্ট স্কেটিং করতে চান, কিছু করার নেই, এজেন্টদেরও পায়ে নী-ক্যাপ লাগাতে হবে। তবে প্রেসিডেন্ট চাইলে তার ওভাল অফিসে একা থাকতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ওভাল অফিসের মেঝেতে মোশন সেন্সর লাগানো আছে।
দায়িত্ব পালনে জীবনপণ
এতসব তথ্য বিবরণী শুনে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা প্রেসিডেন্টের জন্য মরতে বাধ্য। তাদের এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে প্রেসিডেন্টকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে এসেছেন এমন অনেক এজেন্ট আছেন সিক্রেট সার্ভিসের ইতিহাসে। তবে এখনও পর্যন্ত শুধু একজন এজেন্টের নাম জানা যায় যিনি এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। ১ নভেম্বর ১৯৫০, প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানকে (জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয় যার নির্দেশে) রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন এজেন্ট লেসলি কোফেল্ট। মৃত্যুর আগে তিনি আততায়ীকে গুলি করতে সক্ষম হন। সুতরাং দেখা যায়, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনোকিছুই তোয়াক্কা করেন না এজেন্টরা।
কাকতালীয় তারিখ
কাকতালীয়ভাবে সিক্রেট সার্ভিসের জন্মলগ্নেই মৃত্যু হয় আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের। তৎকালীন ট্রেজারির সেক্রেটারি হিউ ম্যাককুলোচ ১৪ এপ্রিল ১৮৬৫, লিঙ্কনের কাছে সিক্রেট সার্ভিসের আইডিয়াটি উত্থাপন করেন। সেই রাতেই থিয়েটার দেখতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন নিহত হন। এ এক কাকতলীয় ট্র্যাজেডি বলা যায়।
চারিদিকে চোখ
সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা উন্নততর প্রযুক্তি দ্বারা সর্বদা বেষ্টিত থাকেন। তাদের চোখ ফাঁকি দেয়া সাধারণ মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভবই। যুগোপযোগী প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের সবরকম জটিল পরিস্থিতি সমাধানে ও অপরাধ সংঘটনকারীকে দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত করতে করতে সাহায্য করে। প্রেসিডেন্ট কেনেডির খুনের পর প্রেসিডেন্টের অনুচরদের সার্বক্ষণিক ভিডিও রেকর্ডিং এর আওতায় রাখার জন্য একটি বিশেষায়িত গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। কিঞ্চিৎ বিলম্বিত, কিন্তু পরবর্তী প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার জন্য বেশ যুতসই ব্যবস্থা, বলতেই হয়।
FBI এর উত্থান
১৯০৮ সালে তৎকালীন অ্যাটর্নী জেনারেল সিক্রেট সার্ভিসের ৯ জন এজেন্টকে নিয়ে ‘Special Agents of The Justice Department’ নামে নিয়োজিত করেন। ধীরে ধীরে এই ৯ জনই ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর অন্তঃস্থল হয়ে ওঠে, আর তারই পরিবর্ধিত রূপ আজকের Federal Bureau of Investigation বা FBI।
হাতের আঙুলে সংকেত
প্রেসিডেন্টদের সাথে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের যত ছবি দেখবেন, তার অধিকাংশেই একটা জিনিস আপনার চোখে পড়বে, আর তা হলো তাদের হাতের অবস্থান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এক হাতের আঙুল অন্য হাতের আঙুল দিয়ে ধরে রাখে। একেক সময় একেক আঙুল ধরা থাকতে পারে, কিন্তু এই পজিশনের মানেই হলো “আমি প্রস্তুত মহারাজ, হুকুম করুন!” ইশারা করা মাত্র অস্ত্র বের করে অ্যাকশন নিতে প্রস্তুত বুঝাতে এই চিহ্নটি ব্যবহার করে এজেন্টরা।
সততা
যতটা দক্ষতা ও ক্ষমতা সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা ধারণ করে, তারা চাইলে পারে না এমন কাজ নেই। যাদের হাতে রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তার সকল ভার, তারা চাইলেই পারে এক নিমেষে চোখের পলকে রাষ্ট্রপ্রধানকে অরক্ষিত করে ফেলতে। প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর চেয়ে কোনো অংশে কম না, বরং বেশিই তারা। কিন্তু তারপরেও আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের ইতিহাসে একটিও বিশ্বাসঘাতকতার নজির নেই। বছরের পর বছর অগণিত বহিরাগত গোয়েন্দা ও এজেন্টদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তারা, কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানা যায় না। ক্ষমতা ও সততার এই সন্নিবেশই তাদের স্থান দিয়েছে সেরাদের মধ্যে।
ফিচার ইমেজ- adn.com