একজন সাধারণ মানুষের জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা কখনো আনন্দের, কখনো বেদনাবিধুর। সুফি মতাদর্শে, বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত অনেক বেশী শৈল্পিক, অনেক বেশী নান্দনিক। সুফিবাদ পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করে হৃদয়কে মহাজাগতিক সম্পর্কের দিকে ধাবিত করে। কল্পনার একীভূতকরণ, শরীর ও মনকে পৃথিবীর সমস্ত শক্তির কেন্দ্রবিন্দুর কাছে সমর্পিত করার মাধ্যমে সুফিবাদের আত্মশুদ্ধি পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা অনেক বড় বড় শহরের গঠন, স্থাপত্যিক নকশা এমনকি সঙ্গীতের মৌলিক ধারা- এসব কিছুর সাথে মহাবিশ্বের বিন্যাসের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। আজ যেই বিষয় নিয়ে এই লেখা, তার সঙ্গেও রয়েছে মহাজাগতিক বিন্যাসের অদ্ভুত সম্পর্ক!
সুফি নৃত্য
এই ব্যপারটা আমার প্রথম নজরে আসে এক বিখ্যাত ফার্সি কবি এবং দার্শনিকের জীবনাচরণ সম্পর্কে জানতে শুরু করার মাধ্যমে। এরপর খানিকটা কৌতুহল, বিস্ময় আর ভালোলাগা থেকেই সুফি নৃত্য নিয়ে জানাশোনার শুরু হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আমাদের প্রায়ই সেই বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি শেয়ার করার অভিজ্ঞতা হয়। অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছি তিনি কে। তার পুরো নাম জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি। এছাড়াও তিনি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ বালখী, মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি নামেও পরিচিত।
তবে শুধু মাত্র রুমি নামে বেশি জনপ্রিয় এই সুফি সাধক ছিলেন ১৩ শতকের একজন মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও ধর্মতাত্ত্বিক। তিনি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের বালাখে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং সুফি। ঐশ্বরিক ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিক বন্ধন সম্পর্কিত প্রায় ৩০,০০০ কবিতার স্তবক ছন্দোবন্ধ করে রেখে গিয়েছেন রুমি। দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে উদাহরণ উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি মানবাত্মার নিগূড় রহস্য অত্যন্ত সাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। ২৫ হাজার শ্লোক নিয়ে রচিত তার সংকলনের নাম মসনবি। মসনবি হলো শিক্ষামূলক নীতিবাক্যের সমাহার। এর লক্ষ্য ছিল মানুষকে নীতিবোধে উৎসাহিত করা। রুমি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত, কবিতা এবং নাচ- সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছানোর একেকটি পন্থা। তার এই বিশ্বাসের পথ ধরেই কালক্রমে সুফি নৃত্য অনুশীলন থেকে অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। সুফি নৃত্যের সূচনা করেন রুমি ভক্তরা যারা মেভলভি নামে পরিচিত।
নিজস্ব ভঙ্গিতে পরিচালিত হয় সুফি নৃত্যশৈলী। শুরুতেই একজন দরবেশ অন্য একজন দরবেশের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে সম্মান প্রদর্শন করেন। এরপর একজন গুরু মনোনীত করা হয়, যাকে অনুসরণ করে অন্যেরা নিজেদের পথ খুঁজে পাবে। এরপর তারা কয়েক মিনিটের জন্য একটি কেন্দ্র তৈরি করে তার চারদিকে বৃত্তাকারে আবর্তিত হতে থাকেন। এভাবে ঘূর্ণনের ফলে সুফি নৃত্য সর্পিলাকারে মহাজাগতিক ছন্দের আকার ধারণ করে। সুফির দুই হাত আড়াআড়িভাবে অবস্থান করে সৃষ্টিকর্তার একাত্মবাদের জানান দেয়। কখনো আবার তারা আরবী হরফ আলিফের সাদৃশ্যে দু’হাত কাঁধের কাছে নিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে হাত ছড়িয়ে ওপরের দিকে তোলেন। ঘূর্ণনের সময় দরবেশের ডান হাত প্রসারিত হয় সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ অর্জন আর বাম হাত প্রসারিত হয় ধরণীর সাথে যোগসূত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে। বাম পা একই জায়গায় রেখে, ডান পায়ের সাহায্যে ঘুরতে থাকেন তারা। এভাবে দুই হাত প্রসারিত করে ক্রমাগত ঘূর্ণনের ফলে দরবেশরা আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা অর্জন করেন।
সুফি জার্নাল থেকে জানা যায়, সুফি নৃত্যের ঘূর্ণায়মান আবর্তনের এই একক নৃত্য বিন্যাস প্রণয়ন করা হয় পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহসমূহের তাদের নিজস্ব কক্ষপথে থেকে সূর্যকে আবর্তন করার নমুনা অনুসরণ করে। আমাদের হৃদপিণ্ডের আবাসস্থল- বামদিকের সাথে মিল রেখে দরবেশ গ্রহের ন্যায় কল্পিত গ্রহপথে ঘুরতে থাকেন এক মনোনিবেশে।
বিশুদ্ধতার প্রতীক বলেই হয়ত সুফি নৃত্যের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিলো সাদা রঙের দীর্ঘাকৃতির পোশাক। দরবেশ তার ঘূর্ণনের গতি বাড়ানোর সাথে সাথে বর্ণহীন, বিশুদ্ধ এক অদৃশ্য আলোকশিখা চারিদিক ঘিরে ফেলে; ঠিক আয়না থেকে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হবার মতো! সূর্যের আলো প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথে যেভাবে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ে, দরবেশের সাদা পোশাকের ঘূর্ণনের জ্যোতিঃ সেভাবেই চারপাশ আবিষ্ট করে ফেলে নিবিড়ভাবে। তাই বলাই বাহুল্য, সুফি নৃত্যের পরিবেশ কতটা স্বর্গীয় আর পবিত্র হয়ে ওঠে।
সুফি নৃত্য কখনও সুফি সঙ্গীত আবার কখনো শক্তিশালী জিকিরের পুনরাবৃত্তির সাথে সাথে পরিচালিত হয়। জিকিরের আওয়াজ সময়ের আবর্তনের সাথে সাথে হৃদস্পন্দন স্মরণ করিয়ে দেয়। এক রহস্যময় মোহে আচ্ছন্ন করে রাখে দেহ এবং মন।
অবিরত ঘূর্ণনের ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা বিবমিষা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সুফি নৃত্যের মূল কথাই হল, শরীর এবং মনের আত্মসমর্পণ। ক্রমাগত ঘূর্ণনের মাধ্যমে দরবেশ তার সমস্ত চিন্তাচেতনা একটি কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার মাধ্যমে রহস্যময় উন্মাদনার জালে আবদ্ধ হন। সময়ের সাথে সাথে দরবেশ নিজের শরীর এবং মনকে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হন এবং পরিপূর্ণতার স্বাদ আস্বাদন করতে থাকেন।
রুমির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মেভলভিরা ডিসেম্বেরের ১৭ তারিখ রুমির প্রয়াণদিবসের দিন ‘মেভলভি ফেস্ট’-এর আয়োজন করে থাকেন, যা সাত থেকে দশ দিন অব্দি চলে। এই ফেস্ট শুরু হয়েছিল এখন থেকে প্রায় ৭৫০ বছর আগে। তুরস্কের কনিয়ায় আয়োজিত এই উৎসবটিকে UNESCO ‘মাস্টারপিসেস অফ ওরাল এন্ড ইন্ট্যাঞ্জিবল হ্যারিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ তালিকাভুক্ত করেছে। ২০১২ সালে লন্ডনে শফিক ইব্রাহীম এক ঘন্টায় ২,৯০৫ বার ঘুরে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এর তালিকায় ‘মোস্ট সুফি ওয়ারলিং ইন ওয়ান আওয়ার’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হন। এছাড়াও ক্রমাগত দীর্ঘতম ঘূর্ণনের রেকর্ড এখন অব্দি প্রায় চার ঘণ্টা যাবতকাল স্থায়ী হয়।
অনেকেরই কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সত্যিই কি নির্দিষ্ট স্থানে সর্পিলাকারে ঘূর্ণায়মান একটি নৃত্য পারে আধ্যাত্মিকতার সন্ধান দিতে? এর উত্তর হলো, না! সুফি নৃত্যের মুল উদ্ধেশ্য জাগতিক লোভ লালসা থেকে নিজেকে মুক্তি তথা আত্মসমর্পণ। তাই যতক্ষণ না অব্দি নিজের দেহ এবং মনের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ না আনা যায়, ততক্ষণ নিঃসন্দেহে আধ্যাত্মিকতার সন্ধান মেলা ভার।
সুফিবাদ অনুযায়ী, জ্ঞান হলো আধ্যাত্মিক বিষয়, যা শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমেই নয়, অনুশীলনের মাধ্যমেও অর্জন করতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই সুফি নৃত্যের মাধ্যমে একজন দরবেশ প্রতীকি অর্থে নিজের সমস্ত অহঙ্কারকে পরিত্যাগ করেন এবং সত্যের দিকে ধাবিত হয়ে নিজের আত্মা ও মনকে পরিপূর্ণ করার প্রয়াস লাভ করেন। ধীরে ধীরে শরীরের চেতনা পরিবর্তনের মাধ্যমে মন পার্থিব দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায় আর হৃদয় ভরে ওঠে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাবার আনন্দে।
বেঁচে থাকার সত্যিকার সৌন্দর্য উপভোগ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে ভালোবাসা। রুমি বিশ্বাস করতেন, সৌন্দর্য মানব মনের চিরন্তন কাম্য। কেননা, সৃষ্টিকর্তা নিজেই সুন্দর এবং তিনি সকল সৌন্দর্যের উৎস। সুফি নৃত্য এমনি এক আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান দেয়, যার মাধ্যমে দরবেশ হিংসা, আকাঙ্ক্ষা, ভয়, লোভ সহ সকল জাগতিক বিষয়াদি বিসর্জন করার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসায় বিভোর হন, খুঁজে পান আত্মশুদ্ধির পরিতৃপ্তি।
ফিচার ছবিসূত্র: vocklersentertainment.in