ফুল ভালবাসেন না, এমন মানুষ এই পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে ফুল। মানুষের আবেগ, ভালবাসার প্রতীকরূপে, জাতীয় জীবনের চেতনার প্রকাশ হিসেবে এবং নানা সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানে সেই প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ ফুল ব্যবহার করে আসছে।
প্রতিবছর নানা বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ফুল উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এ উৎসবগুলো যেমন জমকালো, তেমনি বৈচিত্রপূর্ণ। নানা বিনোদনে ভরপুর আকর্ষণীয় এ উৎসবগুলোতে মূলত সেসব অঞ্চলের বৈচিত্রময় নানা ফুলের প্রদর্শনী হয়ে থাকে। এসব উৎসবে আগত দেশ-বিদেশের পর্যটকগণ উৎসবে একাত্ম হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় সংস্কৃতির এক অনন্য অভিজ্ঞতাও অর্জন করে থাকেন। আজ বিশ্বের তেমনি কিছু বৈচিত্রপূর্ণ ও নান্দনিক ফুল উৎসব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
ফেস্টিভ্যাল অফ ফ্লাওয়ার, মেডেলিন, কলম্বিয়া
মেডেলিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর মধ্যে এই উৎসবটি অন্যতম। এই উৎসবকে ঘিরে পুরো শহরজুড়ে নানা আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কোথাও চলে ঘোড়াদের নিয়ে প্যারেড, আবার কোথাও চলে গানের কনসার্ট। ১৯৫৭ সালে এই উৎসবটি প্রথম শুরু হয়। মে মাসের দিকে আয়োজিত এই উৎসবটি পাঁচদিনব্যাপী চলতো। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর থেকে ১৯৫৮ সালের দিকে উৎসবটি মে মাসের পরিবর্তে আগস্ট মাসে আয়োজিত হতে থাকে।
এই উৎসবকে ঘিরে বের হয় বর্ণিল ফুলের শোভাযাত্রা। স্থানীয় অধিবাসী থেকে শুরু করে আগত বিদেশীরাও নিজেদের সাজিয়ে তোলেন নানা ফুল দিয়ে। তাদের পিঠের উপর থাকে নানা বৈচিত্রময় ফুলের বোঝা। এটি প্রতীকি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। একসময় ক্রীতদাসরা তাদের প্রভুদেরকে পিঠে বহন করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যেতো। সেইদিনের সেই প্রতীকিরূপ এবং ক্রীতদাসের মুক্তির উদযাপন হিসেবে স্থানীয়রা উৎসবে এই ফুলের বোঝা বহন করে নিয়ে যায়। এ যেন ফুলের মধ্য দিয়ে দাসত্ব শেষের এক ইঙ্গিত।
দ্য ফ্লাওয়ার কার্পেট, ব্রাসেলস, বেলজিয়াম
পৃথিবীর সবচেয়ে অনন্য এক ফুল উৎসব বলে বিবেচিত বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের এই ফ্লাওয়ার কার্পেট ফেস্টিভ্যাল। প্রতি দু’বছর পর পর আয়োজিত এই ফুল উৎসবটি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উদযাপিত হওয়া অন্যান্য ফুল উৎসব থেকে একেবারেই ভিন্ন। বিশ্বের সব ফুল উৎসবে যেমন ফুলের প্যারেড হয়ে থাকে, এই উৎসবে তেমন কিছু হয় না। বরং পুরো শহরের রাস্তা জুড়ে নানা ফুল দিয়ে ফুলের গালিচা বানিয়ে ফেলা হয়।
শহরের প্রধান কেন্দ্রস্থল সিটি হলের মেন স্কয়্যারের সামনে থেকে শুরু করে আশেপাশের জায়গা নানা রঙের ফুল দিয়ে ফুলের গালিচা বানিয়ে ফেলা হয়। এই আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন ফুলের শিল্পকর্ম দেখতে ছুটে আসেন দেশী-বিদেশী বহু পর্যটক।
চিয়াং মাই ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল, থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরে আয়োজিত হয় এই বর্ণিল ফুল উৎসব। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় এই ফুল উৎসবটি উদযাপিত হয়ে থাকে। এই উৎসবে থাইল্যান্ডের নানা স্থানীয় ফুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রঙের গোলাপ, নানা প্রজাতির অর্কিডের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত হয় ফ্লাওয়ার প্যারেড, থাইল্যান্ডের ঐত্যিবাহী নাচ, সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ নানা বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান।
দ্য রোজ প্যারেড, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
প্রতিবছর পহেলা জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষকে উদযাপন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের পেসিডোনা শহরে এই গোলাপ ফুলের প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৯০ সালে প্রথম এই উৎসবটি পালিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পালিত হওয়া জনপ্রিয় ফুল উৎসবগুলোর মধ্যে এটি পঞ্চমতম আকর্ষণীয় ফুল উৎসবের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পেসিডোনা শহর জুড়ে চলে নানা অনুষ্ঠান।
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ফুলের প্যারেড। এই প্যারেডে স্থান পায় ফুলের তৈরি ৪০-৫০টি ফ্ল্যোটস, যাতে স্থান করে নেয় নানা ভাস্কর্য। ঐতিহাসক ভবন থেকে শুরু করে রাজা-রানীর প্রতিকৃতি- সবকিছুই তৈরি করা হয় ফুল দিয়ে। সাত লক্ষেরও বেশি মানুষ এই প্যারেডে অংশ নেয়। সরাসরি এই প্যারেড অনুষ্ঠান বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রত্যক্ষ করে দেশ-বিদেশের প্রায় ৭০ মিলিয়নেরও অধিক লোক।
হানামি উৎসব, জাপান
জাপানকে বলা হয় চেরি ফুলের দেশ। মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সারা জাপান যেন রঙ-বেরঙের চেরি ফুলে সাজতে থাকে। চেরি ফুল নিয়ে জাপানিদের মধ্যে একধরনের উন্মাদনা কাজ করে। এসময় জাপানের প্রতিটি অঞ্চলে চেরি ফুলের গাছগুলো ছেয়ে যায় গোলাপি, সাদা ও লালসহ রঙ-বেরঙের চেরি ফুলে।
সর্বত্র বিচিত্র চেরি ফুলের সম্ভার। প্রায় ১৩শ বছর ধরে জাপানীরা এই ফুলকে ঘিরে নানা উৎসব পালন করে আসছে। তার মধ্যে হানামি উৎসব অন্যতম। দৃষ্টিনন্দন চেরি ফুলের রূপ-রস ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে জাপানিরা এই হানামি উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এই উৎসব দেখার জন্য দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এই সময়টায় জাপানে ভ্রমণ করতে আসে। প্রতিবছর মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই উৎসব চলতে থাকে।
নানা আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে জাপানের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন দিনে এই উৎসব পালন করে থাকে জাপানীরা। উৎসবকে ঘিরে শহরের সড়ক, পার্ক, গুরুত্বপূর্ণ ভবনসহ বিভিন্ন স্থান চেরি ফুলে ছেয়ে যায়। ফুটন্ত চেরি ফুলের গাছের নিচে বসে পিকনিক করা, প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো- এ যেন জাপানীদের কাছে এক অন্যরকম ভাললাগার মুহূর্ত। জাপানিদের কাছে এ যেন এক মিলন তীর্থ।
ফ্লোরিয়াড ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার বসন্ত উদযাপনের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন থিম নিয়ে মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর এক মাস জুড়ে ক্যানবেরাতে এই ফুল উৎসব উদযাপিত হয়। উৎসব জুড়ে চলে বৈচিত্র্যময় ফুলের প্রদর্শনীসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফুল দিয়ে ভাস্কর্য প্রতিযোগিতা, লাইভ মিউজিক্যাল পারফরম্যান্স, গেইম শোসহ নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান।
বাতাল্লা দে ফ্লোরস, ভ্যালেন্সিয়া, স্পেন
প্রতিবছর জুলাই মাসের শেষ রোববার স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে জনপ্রিয় ফুল উৎসব ‘বাতাল্লা দে ফ্লোরস’। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ফুলের প্যারেড, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ’পাজো দে লা আলেমেদা’। প্যারেডে ফুল দিয়ে সাজানো হয় রঙ-বেরঙের ফ্ল্যোটস।
যুবতীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে এবং ফলের তৈরি নানা গহনায় নিজেদের সজ্জিত করে ফুলের ফ্ল্যোটেলে করে শহরের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো বা প্যারেড অংশগ্রহণকারীরা ফ্ল্যোটেলে থাকা যুবতীদের লক্ষ্য করে ফুল নিক্ষেপ করে আর সুন্দরী যুবতীরা র্যাকেটের সাহায্যে তা প্রতিহত করে তার জবাব দেয়।
কানাডিয়ান টিউলিপ ফেস্টিভাল, অটোয়া ,কানাডা
বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিউলিপ ফুলের উৎসবগুলোর মধ্যে কানাডিয়ান টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল অন্যতম। প্রতিবছর মে মাসে কানাডার রাজধানী অটোয়াতে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ১৯৫৩ সালে প্রথম এই উৎসবটি পালিত হয়। এই উৎসব পালনের পিছনে রয়েছে এক মজার ইতিহাস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডাচ রাজপরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ডাচ রাজকুমারী জুলিয়ানা কানাডা সরকারকে ১ লক্ষ টিউলিপের চারা উপহার দেন। আর সেই থেকেই টিউলিপ ফুলের চাষ এবং এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে কানাডা জুড়ে। পরবর্তীতে এই ফুলকে কেন্দ্র করে পালিত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল। এই উৎসব উপলক্ষে শহরের কমিশনার্স পার্কে আয়োজিত হয় এক বিশাল টিউলিপ ফুলের প্রদশর্নী। উৎসব উপলক্ষে আবার কোথাও চলে কনসার্ট, রন্ধন প্রতিযোগিতা, কোথাও নানা খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
ফিচার ইমেজ – dreamflowersbyisabel.com