চট্টগ্রামকে বলা যায় বলীখেলার অঞ্চল। জানা যায়, কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর মধ্যবর্তী গ্রামগুলোতে বসবাস ছিল মল্লদের, যারা অত্যন্ত তাগড়া ও সুঠামদেহী সুপুরুষ হিসেবে সুবিদিত ছিল। তখনকার উঠতি বয়সী যুবকদের মাঝে বলীখেলা নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য কাজ করতো। প্রত্যেক বলী নিজ নিজ এলাকার জন্য ছিল গর্ব ও সাহসিকতার প্রতীক। রাজা-বাদশা এবং জমিদারদের কাছে বলীরা মর্যাদা পেতেন। তাই, বংশানুক্রমিক পেশা হিসেবেই মল্লরা পেশীশক্তির প্রদর্শন করে এসেছেন।
সেকালে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী কংগ্রেস ও স্বদেশী আন্দোলনের সংগঠক। আন্দোলনকে বেগবান করতে তরুণ-যুবাদের শক্তিশালী দৈহিক গঠনের গুরুত্ব দেখা দেয়। সাহসী যুবকরা যেন শক্তি সঞ্চয় করে স্বদেশ রক্ষার আন্দোলনে নিজেদের সর্বোচ্চ প্রস্তুত রাখে, এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সমাজসেবক আব্দুল জব্বার ১৯০৯ সালে (১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ) নগরীর লালদিঘী ময়দানে বলীখেলার আয়োজন করেন।
পরবর্তীতে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মানুষের মাঝে তীব্র জাতীয়তাবোধ জন্ম নেয়, বিলেতী দ্রব্য বর্জন করে তারা দেশীয় পণ্যের ব্যবহার শুরু করে। স্বদেশী পণ্যের মেলা এবং বিদ্রোহী সাহিত্য রচনার মাধ্যমে সমাজের সর্বত্র এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাড়া জাগানিয়া এ খেলা সূচনা করায় ব্রিটিশ সরকার আব্দুল জব্বারকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে, তবে তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখান করেন। তার মৃত্যুর পর স্বাধিকার রক্ষায় সচেতন বাঙালি তার চেতনায় উদ্বুদ্ব হয়ে প্রতিবছর ১২ বৈশাখ একই তারিখে এ কুস্তিখেলার আয়োজন করে আসছে, যা বর্তমানে ‘জব্বারের বলীখেলা’ নামে পরিচিত।
জব্বারের বলীখেলা শতাব্দী প্রাচীন চট্টগ্রামের সার্বজনীন এক উৎসবের নাম। সেকালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান থেকে বলীরা খেলতে আসত। ‘বলী’ মূূূলত আঞ্চলিক শব্দ, এর মাধ্যমে কুস্তিগীরদের বুঝানো হয়।
ধান কাটা শেষ হলে চৈত্র্য ও বৈশাখে গ্রাম-গঞ্জে বলীখেলার ধুম পড়ত। খোলা মাঠ, দিঘির পাড় কিংবা ফসলের শুকনো মাঠে খেলার আয়োজন হতো। হাঁটবাজার, পাড়া-মহল্লায় বংশীবাদকরা সাড়া জাগাত। সানাই-ঢোল পিটিয়ে সমগ্র মহল্লায় এলান করা হতো। যে গ্রামে খেলা হতো তার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামে খবর হয়ে যেত।
মাঠের চারপাশ ছেয়ে যেত রংবেরঙের পতাকায় আর খেলার দিন সকাল থেকেই দর্শকদের আনাগোনায় মুখরিত হতো অনুষ্ঠানস্থল। রোমান সাম্রাজ্যে প্রচলিত ঘুষাঘুষি ও রক্তারক্তির পাশবিক চিত্তবিনোদন এখানে পরিত্যাজ্য। হাঁত-পায়ের কসরতে অপর বলীকে ঘাঁয়েল করাটাই এখানে মূখ্য। শক্তি খাটিয়ে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পিঠ ঠেকাতে পারলেই কেউ একজন বিজয়ী নির্বাচিত হন।
দুপুরের পর শুরু হয় মূল খেলা। দুপুর গড়িয়ে বিকালের দিকে হাজার হাজার দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে খেলা বেশ জমে উঠে। উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে, সমর্থকদের মুহুর্মুহু করতালি তখন বলীদের সাহস যোগায়। বলীদের মাঝে কয়েক পর্বের রূদ্ধশ্বাস লড়াই চলে। শেষে চূূূড়ান্ত বিজয়ীকে সোনার মেডেল এবং অন্যদের রূপার মেডেলে পুরষ্কৃত করা হয়।
বর্তমানে, প্রতিবছর চট্টগ্রাম শহরের লালদিঘী ময়দানে দেশের সর্ববৃহৎ কুস্তি খেলার আয়োজন হয়। ‘আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগীতা ও বৈশাখী মেলা কমিটি’র উদ্যোগে প্রতিবছর এ উৎবের আয়োজন হয়। মূল আসর বসে প্রতি বাংলা সনের ১২ বৈশাখ। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫০ জন বলী এ খেলায় অংশ নেন। সেমিফাইনালের পর ফাইনালের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় কাঙ্ক্ষিত চ্যাম্পিয়ন।
বিপুল দর্শকের উপস্থিতিতে রমরমা পরিস্থিতি বিরাজ করে। কক্সবাজারের দীদার বলী এযাবৎ টানা ১২ বার চ্যম্পিয়ন হয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ধরে রেখেছেন। চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দান ছাড়াও আরো কয়েকটি স্থানে বলীখেলা বর্তমানে প্রচলিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী, সাতকানিয়ায় মক্কার বলী, আনোয়ারায় সরকারের বলী, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী এবং চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী। জব্বারের বলীখেলা শুধু কুস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কালের পরিক্রমায় এটি পরিণত হয়েছে বৃহৎ লোকজ উৎসবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলাও এটি।
লালদিঘী ময়দানের আশপাশে আন্দরকিল্লা, সিনেমা প্যালেস, কোতোয়ালি মোড় এবং জেল রোড পর্যন্ত তিন-চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সপ্তাহব্যপী বসে এ মেলা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দোকানিরা শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে, কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। রমরমা বিক্রি হয় কুটিরশিল্পীদের তৈরি নকশীকাঁথা, শীতলপাটি, হাতপাখা, বেতের তৈরি চালুনি, মাছ ধরার চাঁইসহ আরো কত কী! গৃহকর্ত্রীরা সংগ্রহ করেন গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্র। যেমন, কারুকাজ করা পিঠার ছাঁচ, রুটি বেলার বেলুনি ও পিঁড়া, পোড়ামাটিতে তৈরি বিভিন্ন মৃৎপাত্র, মটকা, মাটির কলস, ফুলদানি ইত্যাদি।
মেলার পাশাপাশি লালদিঘি ময়দানে নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন উৎসবে বাচ্চাদের কসরত তো থাকেই। এখানেও তারা বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে মাটির খেলনা, বাঁশি ইত্যাদি কিনে দেওয়ার জন্য। অনেক শিশু আবার নাড়ু, মু্ড়ি-মুড়কি, মুরালি ইত্যাদি খাওয়ার জন্য টাকা জমায়। মৌসুমি ফল, বিশেষ জলখাবার ইত্যাদি এমন কিছু জিনিস মেলা উপলক্ষেই পাওয়া যায়। বৃহত্তর এ উৎসব ভাগাভাগি করতে প্রতিবেশীদের মাঝে বিলি করা হয় বিশেষ এ খাবার।
কুটুম্ব বাড়িতেও বিরাজ করে মেলা উপলক্ষে আনন্দ। বিবাহিত মেয়েরা বাবার ঘরে নাইওঁর আসে। ফিরে যাওয়ার সময় সেখান থেকে সৌজন্যতা করে বেয়াইবাড়িতে পাঠানো হয় মেলার খাবারদাবার।
তবে এখন বলীখেলার আগের জৌলুস আর নেই। অন্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং আধুনিকতার সয়লাবে বলীখেলার জোয়ারে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তদুপরি কিছু শৌখিন বলী বংশানুক্রমিক পেশা হিসেবে এ খেলা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু উৎসবের কোনো কমতি নেই। কারণ, এখন বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। খেলার আমেজ কিছুটা কমলেও লালদিঘীর বৈশাখী মেলা সগৌরবে জানান দেয় তার অতীত ঐতিহ্যের কথা।
জব্বারের বলী শত বছরের পুরনো এক ঐতিহ্য। বঙ্গভঙ্গ রদের পর স্বাধীনতার স্বপ্নে বাঙালি মনে যে তীব্র জাতীয়তাবাদ জন্ম নেয় সে ইতিহাস অবিস্মরণীয়। অধিকন্তু, সওদাগর আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে লোকজ মেলার আড়ালে বীর চট্টলা যেভাবে শক্তি যুগিয়েছে, প্রতিবছর বলীখেলার স্মারকে তা চিরজাগরূক থাকুক।