ফ্যাশনে ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ফ্যাশন যদি হয় উদ্ভট ও ভয়ঙ্কর রকমের তাহলে কেমন হয় বলুন তো? চলুন দেখে নেয়া যাক বিভিন্ন সময়ের উদ্ভট ও অস্বাভাবিক সব ফ্যাশন নিয়ে।
উদ্ভট ভ্রু: প্রাচীন চীন
ভ্রু তুলে তার উপর আবার ভ্রু আঁকা চীনা অধিবাসীদের মাঝে বেশ সাধারণ ও জনপ্রিয় একটি বিষয় ছিলো। তাদের এই সব ভ্রুর কারুকার্য ছিলো অনেকটা আজব, হয় একেবারেই গোলগোল বা অস্বাভাবিক রকমের সোজা। এই কারুকার্যগুলোর আবার ছিলো নানা ধরনের নাম, যেমন- ফারঅ্যাওয়ে হিলস্ (দূরবর্তী পাহাড়), উইলোজ লিভস্ (ক্রিকেট ব্যাটের পাতা) ও মথস্ অ্যান্টেনাস্ (পোকার শুঁয়ো)। এছাড়াও এখনকার মতোই ভ্রুর ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলও জনপ্রিয় ছিলো।
হাসির ট্যাটু: আইনু গোষ্ঠী
রহস্যময়ী আইনু গোষ্ঠীর বসবাস ছিলো জাপানের দ্বীপে এবং রাশিয়ার কিছু কিছু অংশে। এই গোষ্ঠীর নারীরা মুখে এক ধরনের ট্যাটু বানাতো, যা দেখতে ছিলো অনেকটা সঙ বা জোকারের হাসির মতো। আইনু গোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্বাস ছিলো, এই ট্যাটুগুলো তাদের নারীদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। শুধু তা-ই নয়, মৃত্যু পরবর্তী জগতেও এই ট্যাটু রীতি শান্তি আনতে পারে বলে তাদের ধারণা ছিলো। এই ট্যাটু আঁকার প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত ছিলো যা শুরু করা হতো ৭ বছর বয়স থেকে।
সম্প্রসারিত খুলি: পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়
অবাস্তব ও উদ্ভট মনে হলেও এই উদ্ভট ফ্যাশনটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলো বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা। যদিও তারা কেউই একই গোত্রের বা চিন্তাধারার মানুষজন ছিলেন না! হান (পূর্ব ইউরোপে বসবাসকারী যাযাবর প্রকৃতির মানুষ), ইতালির অধিবাসী, সারমাতিয়ান (ইরানের এক বিশাল সংঘ), মায়া গোষ্ঠী এবং আফ্রিকার কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে এই ধারার প্রচলন ছিলো বেশি। এমনকি বিংশ শতাব্দীর দিকেও ফ্রান্সে এই রীতির প্রচলন লক্ষণীয় ছিলো। মাথার খুলির আকৃতি পরিবর্তনের জন্য অভিভাবকেরা তাদের বাচ্চাদের মাথা ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখতো অথবা বিশেষ কোনো বেবি কটে রাখতো।
কালো দাঁত: প্রাচীন জাপান
ওহাগুরু হলো জাপানের একটি রীতি যাতে মূলত দাঁত কালো করা হয়ে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই রীতিটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো, যদিও আজকাল থিয়েটার নাটকগুলোতে দাঁত কালো করার প্রচলনটির দেখা মিলে। তবে সেসময়ে দাঁত কালো করার পিছনে শুধু কারুকার্যই মূল কারণ ছিলো না, বরং এটি দাঁতকে রক্ষা এবং শরীরে আয়রনও সরবরাহ করার কাজও করতো। কারণ যে রঙ দিয়ে দাঁত কালো করা হতো, তাতে থাকতো আয়রন এবং সামাক গালনাটস্ (এক ধরনের চীনা গুল্ম), যাতে অ্যাসিডিক এসিডও মেশানো থাকতো।
চেঁছে ফেলা ভুরু: মধ্যযুগীয় ইউরোপ
ইউরোপে চুল খুব বেশি একটা জনপ্রিয় ছিলো না, তাই সেখানকার কপাল শেভ করা, ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি তুলে ফেলার প্রচলন ছিলো। এই ঐতিহ্যবাহী স্টাইলটি জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো রিকেটস্ রোগ, যার ফলে চুল পড়ার সমস্যাটি দেখা দিতো। মুষ্টিমেয় কিছু ভদ্র সমাজ এই স্টাইলটিকে হাল ফ্যাশনে পরিণত করার পর অন্যান্যরা এর অনুকরণ শুরু করে।
বড় নখ: প্রাচীন চীন
প্রাচীনকালে চীনে অত্যাধিক বড় নখ রাখাকে দারুণ একটি ফ্যাশন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এই ধরনের নখ বিত্তবৈভব এবং অলসতার প্রতীক ছিলো। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো মানুষের পক্ষে এরকম অস্বাভাবিক বড় নখ রেখে কোনো ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। মানুষের ধারণা ছিলো, এই ফ্যাশনটি দেবতাদের সাথে কথোপকথনের সহজ উপায়। এছাড়াও চীনারা তাদের এই বিশেষ নখের জন্য স্বর্ণ দিয়ে বিভিন্ন অলংকার তৈরি করতো।
মুখের ট্যাটু: মাওরি জাতি
মাওরি জাতির বসবাস ওশেনিয়ায়, যারা তাদের মুখোমণ্ডলে আঁকা ট্যাটুর জন্য সুপরিচিত। পুরুষেরা শুধুমাত্র তাদের মুখেই নয়, বরং সারা শরীরে নানান ঢঙে ট্যাটু আঁকতো। আর মহিলারা তাদের চিবুক, ঠোঁট ও গলার উপরে ট্যাটু করাতো। এই ট্যাটুগুলো কিন্তু বর্তমানে আঁকা ট্যাটুগুলোর মতো সুই দিয়ে করা হতো না, এতে ব্যবহার করা হতো একটি বিশেষ ধরনের বাটালি।
বিগ মেল কাভস্: ইউরোপ
মধ্যযুগীয় সময়ে নারীরা তাদের পা বড় স্কার্টের আড়ালে লুকিয়ে রাখতো। কিন্তু পুরুষেরা বড়সড় মোজা পড়ে তাদের পায়ের বেশ খানিকটা অংশ দেখাতে পছন্দ করতেন। অপেক্ষাকৃত কম সৌভাগ্যবান পুরুষেরা পায়ের পাতায় মোজাবিশেষ পরতো যা পা পর্যন্ত দড়ির মতো কিছু দিয়ে জড়ানো থাকতো।
পৌত্তলিক ট্যাটু: বলকান জাতি
বলকান জাতির বয়োজ্যেষ্ঠদের ট্যাটু দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়ার মহিলারা তাদের হাতে সৌর চিহ্ন দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ট্যাটু বানাতেন। এটি তাদের পৌত্তলিক অতীতের কথা এবং এটি পরিবেশন করা হতো তাবিজ-কবজ হিসেবে। এই ট্যাটুগুলো মানুষ করাতো মহাবিষুবের সময়ে। এই ট্যাটু করার আরও একটি সুবিধা এই ছিলো যে, তুর্কির লোকেরা এই ট্যাটু করা মেয়ে লোকদের চুরি করে অন্তঃপুরে নিয়ে যেত না।
নাকে একাধিক ফুটো: ভারত
এখন শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বেই বিভিন্ন জায়গায় নাকে একাধিক ফুটো করার জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। তবে ভারতের কোনো কোনো জায়গায় মেয়েরা নাকে একাধিক ফুটো করে থাকে। সাধারণত একটি চেইনও লক্ষ্যণীয় যাতে নাকের দুলের সাথে কানের দুলও সংযুক্ত থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, এই স্টাইলে নাক ফুটো করতে হয়ে বিয়ের আগে। এছাড়াও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুসারীরা মনে করেন, বাম নাকে ফুটো থাকলে তা যেকোনো ধরনের ব্যাথার লাঘব করে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যেরও উন্নয়ন ঘটায়।
পুরুষদের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা: ওয়াদাবে আদিবাসী, নাইজেরিয়া
ওয়াদাবে জাতির পুরুষেরা নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য রূপচর্চা করে। মজার বিষয় হলো, গেরেওয়াল নামে পুরুষদের একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হয়। সেখান থেকে নারীরা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনসাথীকে বেছে নিতে পারে। পুরুষেরা তাদের চোখ ও ঠোঁটকে কালো রঙে রাঙিয়ে নেয়, যাতে করে তাদের চোখের সাদা অংশ এবং দাঁতের সাদাভাব ভালো মতো ফুটে ওঠে। এছাড়াও তারা উদ্ভট ও জটিল প্রকৃতির টুপি মাথায় দেয় এবং মুখে রঙ মাখে। পুরো আফ্রিকার মধ্যে এই আদিবাসী নারীদের সবচেয়ে সুন্দরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
লম্বা চুল: ইয়াও জাতি, চীন
চীনের হুয়াংলুও গ্রামের নারীদের চুল অবিশ্বাস্য রকমের বড় হয়। তারা শুধুমাত্র ষোল বছর বয়সে পা রাখার প্রাক্কালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চুল কাটে। প্রাচীনকালে সেখানে একটি নিয়ম ছিলো যে, কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীর খোলা চুল দেখে ফেলতো, তাহলে সেই মেয়েটিকে তার বিয়ে করতে হতো। তবে এখন আর এই নিয়মটি নেই এবং সেখানকার নারীরা তাদের চুল সবাইকে দেখাতে পারে।
নাক নকশা: আপাতানি জাতি
এ পর্যন্ত যতগুলো উদ্ভট ও ভয়ংকর স্টাইলের কথা বলা হলো, সেগুলোর সবটাই ছিলো সৌন্দর্যের সাধনা। তবে ভারতের আপাতানি জাতির মহিলাদের স্টাইলের বিষয়টি এরকম ছিলো না। একসময় এই জাতি প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিলো। আপাতানির নারীরা বেশ সুন্দর হওয়ায় অন্যান্য উপজাতীয় লোকেরা তাদের হরণ করে নিয়ে যেত। তাই আপাতানি জাতির নারীদের সৌন্দর্য কম প্রকাশ করার জন্য তাদের নাকের ফুটোয় এক বিশেষ ধরনের ছিপি ব্যবহার করতো এবং মুখে ট্যাটু আঁকতো। তাদের এই উদ্ভট স্টাইলটি বেশ কাজে দেয় এবং নারীরা হরণ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।