বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি আমরা? দেশে দেশে কত জাতের মানুষ, বিচিত্র তাদের জীবনাচরণ। আরও বৈচিত্র্যময় তাদের উৎসব। কোনো কোনো উৎসবের বৈচিত্র্যময়তা এতটাই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে, সেটা আর সেই জাতির মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তামাম দুনিয়ার আমুদে লোকেরাও এখন ভিড় জমান সেখানে। আসুন জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হওয়া কিছু বর্ণিল উৎসবের কথা। সময়-সুযোগ মিললে না হয় কোনোটা থেকে একবার ঢুঁ মেরে আসলেন।
নাগাল্যান্ডের হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাত রাজ্যের এক রাজ্য নাগাল্যান্ড। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যে বহুসংখ্যক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বাস। তাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, উৎসব আর জীবনযাপন পদ্ধতি। নাগাল্যান্ডের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী। তাদের উৎসবগুলো তাই কৃষি আর প্রকৃতিকে ঘিরেই। নাগাল্যান্ডের সবচেয়ে জমকালো উৎসব হল ‘হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল’ বা ‘হর্নবিল উৎসব’।
হর্নবিল উৎসবের নামকরণ করা হয়েছে ভারতের বিশাল ও রঙিন হর্নবিল পাখির নামানুসারে। ‘Hornbill’ ইংরেজি শব্দ। বাংলাদেশে আমরা একে ধনেশ পাখি বলে থাকি। হর্নবিল পাখি নাগাল্যান্ডবাসীর বীরত্ব, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে। নাগাল্যান্ডের সেরা যোদ্ধাদের মুকুটে গোঁজা থাকতো এই হর্নবিল পাখির পালক। ২০০০ সাল থেকে ভারত সরকার উৎসবটির আয়োজন শুরু করে। মূলত নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করা এবং তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরাই এই উৎসবের লক্ষ্য। নাগাল্যান্ডের সকল নৃগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ দেখতে চাইলে এই উৎসবে আপনাকে যেতেই হবে।
নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কিসিমা গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল। প্রতি বছর ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ১০ তারিখ পর্যন্ত এই উৎসব চলে। আয়োজন করা হয় নানারকমের নাচ, গান, খেলাধুলা আর বর্ণিল পোশাক প্রদর্শনীর। তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে তাদের বাড়িঘরের ছোটখাটো মডেল ও উপস্থাপন করা হয়। স্থানীয় বাহারি খাবার আর পানীয়ের ব্যবস্থাও থাকে। উৎসবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন খোদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
যদি কেউ যেতে চান, আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখতে হবে সবকিছু। উৎসবের তিনমাস আগে থেকেই কোহিমা, কিসিমা সহ আশেপাশের সব হোটেল-মোটেলগুলো বুকিং হয়ে যায়। আগে বাংলাদেশীদের জন্য নাগাল্যান্ডে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এখন সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। উৎসবে যোগ দিতে চাইলে পর্যটন অধিদপ্তরে আগে থেকেই নাম রেজিস্ট্রেশন করিয়ে ইনার লাইন পারমিট নিতে হবে। হর্নবিল ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে চাইলে এই লিঙ্কটি দেখতে পারেন।
লন্ডনের নটিং হিল কার্নিভাল
ইউরোপের অতীত ও বর্তমান সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মিলনমেলা হলো নটিং হিল কার্নিভাল। বলা হয়ে থাকে, এটিই ইউরোপের সবচেয়ে জমকালো আর বড় পরিসরের স্ট্রীট কার্নিভাল। ১৯৬৪ সালে সূচনা হয়েছিলো দু’দিনব্যাপী চলা এই উৎসবের। প্রথম দিকে আফ্রো-ক্যারিবিয়ান জাতিগোষ্ঠী এই উৎসবের আয়োজক ছিল। উৎসবে তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য তুলে ধরা হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এই উৎসব ধীরে ধীরে সার্বজনীন হয়ে উঠে। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে নটিং হিল কার্নিভাল।
দীর্ঘ প্রস্তুতি চলতে থাকে উৎসব শুরুর অনেক আগে থেকেই। অনুষ্ঠানে যোগদানকারীরা বর্ণিল পোশাক আর বাহারি রঙে নিজেদের রাঙিয়ে উৎসব মাতিয়ে তোলেন। কারো কারো মাথায় থাকে বাহারি পালকের মুকুট, কারো হাতে থাকে রঙিন ব্যানার আর ফেস্টুন। নাচ, গান, সালসা সহ নানান ধরনের আনন্দ আয়োজন তো থাকেই। মুখরোচক বিভিন্ন খাবারেরও দেখা মিলবে এই উৎসবে। সময় সুযোগ মিললে ঘুরে আসতে পারেন উৎসবপ্রিয় ইউরোপবাসীর এই আনন্দযজ্ঞ থেকে।
বাঙালির পহেলা বৈশাখ
পহেলা বৈশাখ হল বাঙালির প্রাণের উৎসব। এপার বাংলা কি ওপার বাংলা কিংবা কোনো বিদেশ বিভুঁই; বাঙালি মাত্রই পহেলা বৈশাখ পালন করবে। পহেলা বৈশাখ হলো বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি বাঙালি নানা উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে পুরনো দিনের জরাজীর্ণতাকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। ব্যবসায়ীরা হালখাতা খোলে। চলে মিষ্টি বিতরণ। গ্রামে-গঞ্জে বসে বৈশাখী মেলা।
মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষের প্রচলন করেন। সে সময়ে হিজরি সন প্রচলিত ছিল, যা চাঁদের উপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলের কৃষির ফলনের সাথে চন্দ্রবর্ষের অসামঞ্জস্য থাকায় কৃষকেরা সময়মতো খাজনা দিতে পারতো না। পরে এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সম্রাটের নির্দেশানুসারে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও আরবি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের হিসাব ও নিয়ম প্রণয়ন করেন। তখন থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। বর্তমানে এই উৎসবটি দেশে-বিদেশে বাঙালির জীবনে একটি আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। এই দিনে বাঙালি নারীরা সাধারণত তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক লাল-সাদা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পড়ে।
উৎসবটির উদযাপনে এলাকাভেদে ভিন্নতা রয়েছে। ঢাকায় পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হলো রমনার বটমূল এবং চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। রমনার বটমূলে নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাই বর্ণিল সাজে সেজে নাচ-গান সহ বিভিন্ন আয়োজন উপভোগ করে থাকেন। আরও থাকে ঐতিহ্যবাহী পান্তা ইলিশ সহ বিভিন্ন গ্রামীণ পিঠাপুলি, ভর্তা আর মিষ্টান্নের আয়োজন। আর মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার চিরাচরিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেই এই শোভাযাত্রার আয়োজন। এ বছর ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছে।
পহেলা বৈশাখের আয়োজন হয় পশ্চিমবঙ্গেও। কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে ভোর থেকেই ব্যবসায়ীরা গঙ্গাস্নান করে দেবীর উদ্দেশ্যে পূজা ও অর্ঘ্য নিবেদন করে হালখাতা খোলা শুরু করেন। বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনায় সেখানে পূজা দেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে উৎসব হয় আরও প্রাণবন্ত। বাংলাদেশেও বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব লোকাচারের মাধ্যমে বর্ষবরণ করে থাকেন। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের সম্মিলিত এই উৎসবের নাম বৈসাবি।
ব্রাজিলের রিও কার্নিভাল
বিশ্বের বর্ণিল আর জমকালো উৎসবগুলোর মাঝে প্রথম সারিতে নির্দ্বিধায় স্থান করে নেবে ব্রাজিলের রিও কার্নিভাল। ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডিও জেনিরোতে প্রতি বছর আয়োজিত হয় গিনেস বুকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে নাম করে নেয়া এই উৎসব। সাধারণত ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাসেই রিও কার্নিভালের আসর বসে। উৎসবের মূল আকর্ষণ সাম্বা নাচ। উৎসবের প্রতিদিনই প্রায় ২০০ সাম্বা স্কুল তাদের প্রদর্শনী নিয়ে হাজির থাকে উৎসব মাতাতে। প্রতি আসরের বিজয়ী দল পরবর্তী আসরের সাম্বা নাচের নেতৃত্ব দেয়।
সাধারণভাবে রিও কার্নিভালের স্থায়িত্ব চারদিন। কিন্তু উৎসব শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই জাঁকজমকের ঘনঘটা শুরু হয়ে যায়। আর সেই রেশ থাকে উৎসবের পরবর্তী টানা কয়েক দিন যাবৎ। সারা দুনিয়ার উৎসবপ্রিয় লোকেদের আড্ডায় মুখরিত হয়ে ওঠে রিও শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি। সাম্বা নাচের সাথে থাকে বাহারি সব ইন্সট্রুমেন্টের মিউজিক। মুখরোচক খাবার আর পানীয়ও থাকে। এই উৎসব দেখতে সারা দুনিয়ার প্রায় বিশ লাখেরও বেশি মানুষ জমায়েত হন। আর উৎসব শেষে সাথে করে নিয়ে যান অফুরন্ত গল্পের ঝুড়ি এবং সারা জীবন মনে রাখার মতো সুখস্মৃতি।