Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমার এ গান: ফিনিক্স হয়ে বেজবাবা সুমনের ফেরা

বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই সময়ের আপেক্ষিকতা নিয়ে ধারণা রাখেন। সময় যে আপেক্ষিক, এই বিষয়টি প্রাকৃতিক নানান ঘটনা আর বিজ্ঞানের তত্ত্বের সমন্বয়ে প্রমাণিত। সময়ের আপেক্ষিকতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রমাণসহ বুঝতে না পারলেও, বিষয়টির অন্তর্নিহিত অর্থ অনুভব করা যায় কিছু কিছু মুহূর্ত দিয়ে, যখন আমরা বলতে বাধ্য হই- “সময়টা যে কীভাবে কেটে গেল…”! তেমনই এক মুহূর্তের জন্ম দেবে অর্থহীনের নতুন গান ‘আমার এ গান’। কখনো একটা গান যে কেবল তার দৃশ্যায়ন আর অর্কেস্ট্রার ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে দর্শক-শ্রোতাকে সময়ের এমন এক চক্রে আটকে দিতে পারে, সে কথা ভাবা যায় না। সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, ভক্তদের কাছে যার পরিচয় ‘বেজবাবা সুমন’- তার ফিরে আসার এই গান দিয়ে দর্শককে তেমন একটা চক্রে যেন আটকে দিয়েছেন। সোয়া আট মিনিটের এই গান, এই গানের ভিডিও- সবকিছু যেন মুহুর্তের ভেতরেই শেষ হয়ে যায়। মনে হতে থাকে, ঘড়ির কাঁটা যেন ঘুরতে থাকে স্বাভাবিকের চেয়েও দ্রুত।

একদিকে নতুন গানের জন্য দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান, অন্যদিকে এই এক গানেই অর্থহীন ও সুমনের দীর্ঘ সঙ্গীতযাত্রার ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের ঘুরে আসার সুযোগ- দুইয়ে মিলে ‘আমার এ গান’ এসেছে এক অভূতপূর্ব শিল্প হয়ে। এই গান অর্থহীনের চার বছর পর ফিরে আসার গল্প। অর্থহীনের আর সব গানের মতো নিজস্বতা বজায় রেখে, এই গানটিও অর্থপূর্ণ, পিপাসা বাড়ানোর গান।

পুরো গানের ভিডিওটি একটি ‘রিভার্স মোশনে’ তৈরি। সাধারণত কোনো গল্প বলা হয় ‘শুরু থেকে শেষ’ এই অভিমুখে। এই গানের ভিডিওটি তৈরি যেন ‘শেষ থেকে শুরু’ এই ধাঁচে। বেজবাবা সুমন যেমন বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত জগতে এক ধ্রুবতারার নাম, তেমনই এক নাম তার ব্যান্ড অর্থহীনও। ১৯৯৮ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে ব্যান্ডটি উপহার দিয়েছে অসমাপ্ত, ত্রিমাত্রিক, ক্যান্সারের নিশিকাব্য, নতুন দিনের মিছিল- এমন বিখ্যাত সব এলবাম। সেই সুমন অসুস্থ বহু বছর ধরে, চোয়ালের সমস্যা, মেরুদণ্ডে ক্যান্সারসহ নানান অসুস্থতার সাথে লড়াই করছেন, এর মধ্যেও ফিরেছেন গানে, বের করেছেন অ্যালবাম। সর্বশেষ এক দুর্ঘটনার পর আবার সবকিছু থেকে দূরে ছিলেন প্রায় চার বছর। এই চার বছর একের পর এক যুদ্ধ করে গেছেন সুস্থ হয়ে উঠতে। ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকা এক যোদ্ধার কাছে জীবনে ফিরে আসার প্রতীক কী? অবশ্যই, গ্রিক রূপকথার পাখি ফিনিক্স। অক্টাভিয়া বাটলার তার প্যারাবল অব দি ট্যালেন্টস বইয়ে বলেছিলেন, “In order to rise from its own ashes, a Phoenix first must burn”। সুমন পুড়লেন, দগ্ধ হলেন, তারপর যেন এক ঐশ্বরিক কন্ঠে গেয়ে উঠলেন:

যে গানটা লিখব বলে বেঁচে থাকা,

সে গানটা শুনবে কে?

কোনো এক থমকে যাওয়া রাতের পরে

আমার কথা ভাববে কে?

সুমন কি শঙ্কায় ছিলেন কতটুকু ফিরতে পারবেন তাই নিয়ে? কিংবা তার কি মনে হচ্ছিল, তার অগণিত শ্রোতারা তাকে ভুলে যাবেন? আমাদের শহর-মফস্বলের কৈশোর পেরুনো কত মানুষ এখনও তার গানের লাইন লিখে টি-শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ায়। কত কিশোর মনে মনে নিজেকে কল্পনা করে ‘নিকৃষ্ট’ হিসেবে। সুমন কি ভেবেছিলেন, এসবকিছুই একটা সময় ফিকে হয়ে আসবে? হতে পারে। কিংবা গানের শুরুর দিকে সুমন নির্বাণ লাভের মতো কোনো নীল নির্বাসনের কথাও হয়তো ভেবেছেন। মনে হয়েছে, নতুন এক জগতে তিনি চলে যেতে শুরু করেছেন, যেখানকার অধিবাসীদের তিনি শোনাতে চান ‘সব আলো নিভিয়ে দিয়ে’ মৃত্যুর ধ্যানের গল্প। কতকিছুই তো হতে পারে।

‘আমার এ গান’-এর মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার সাথে জড়িত এর সিনেমাটিক মিউজিক ভিডিও। এই ভিডিও এক গল্প বলে যায়, গল্পটা অন্যরকম। কোনো এক এপিটাফে লেখা আছে অর্থহীনের অনন্য সৃষ্টি ‘এপিটাফ’ গানের সেই লাইনগুলো:

আমি তো দিয়েছিলাম

তোমায় কৃষ্ণচুঁড়া ফুল

তুমি তো গেয়েছিলে

সেই নতুন গানের সুর

তবে কেন গেলাম আমি চলে

তোমায় ফেলে বহুদূর

সেই এপিটাফের সামনে বসে আছেন একজন। কবরে রাখা কৃষ্ণচূড়া ফুল। বসে থাকা ব্যক্তিটির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ, আমাদের দেশের এসময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পীদের একজন। বর্ষণ যেন সেই তরুণ, যাকে ভেবেই বেজবাবা সুমন গেয়েছিলেন:

যুদ্ধ শেষে আজ ঘরে ফিরে

দেখি নাই তুমি যে পাশে,

ভেবেছিলাম তুমি থাকবে

দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া ফুল হাতে।

তবে কি যুদ্ধে গেলাম

তোমায় হারাতে?

এপিটাফ এর লেখা গুলো

পড়ি ঝাপসা চোখে।

পরের দৃশ্যেই দেখা যায়, সেই তরুণ হেঁটে যাচ্ছেন যুদ্ধের ময়দানে। এরপর তা পেরিয়ে ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি’র মতো সাদা শার্ট আর লাল অ্যাকুস্টিক হাতে তরুণটির এক ছন্নছাড়া ক্যানভাস:

অদ্ভুত সেই ছেলেটি আবার শুরু করল হাঁটা

কালো লম্বা এলোমেলো চুলে চোখ দুটো তার ঢাকা

হাতে তার অ্যাক্যুস্টিক, পকেটে হারমনিকা

কষ্টে ভরা এ জীবনের বহু গান যে তার শোনা।

প্রিয়জনকে কৃষ্ণচূড়া সমেত বিদায় দেওয়া তরুণ যুদ্ধশেষে তার অদ্ভুত জীবন কাটাতে কাটাতে, বৃষ্টি নামে। বর্ষণ; সুমনের সেই অদ্ভুত ছেলেটি ভিজতে শুরু করে।

বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে।

অদ্ভুত সেই ছেলেটির যুদ্ধ শেষ হয়। এবার তার নির্বাণ লাভের পালা। সে এগিয়ে যায় সুইসাইড নোটে সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার কথা লিখতে। তারপর সুমন ও গোটা অর্থহীন দল শুভ্র কোনো দূতের বেশে এসে হাজির হন বর্ষণের কাছে। এই দৃশ্য যে কত ভাবনার জন্ম দেয়! ফিনিক্স পাখি হয়ে সুমন কি অদ্ভুত ছেলেদের আবারো জাগাতে চেয়েছেন? নাকি দিতে চেয়েছেন নতুন এক পৃথিবীর সন্ধান? সুমন কেন শুভ্র দূত? অর্থহীনই বা কেন? তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে কিছু উপসংহার দাঁড়ায়। তা নিয়ে বলছি একটু পর। আগে ভিডিওর কথা শেষ করি।

এই যে গল্পটা বলা হলো, গল্পটার শেষাংশকে শুরু ভাবুন তো একবার। আর শুরুটাকে ভাবুন শেষ। স্ক্রিনপ্লেতে ঠিক এইভাবেই গোটা গানের দৃশ্যায়ন হয়েছে। এই দৃশ্যায়ন নিজেই এক নতুন গল্প বানিয়ে ফেলে। গোটা ভিডিওটা হয়েছে মনোক্রোমাটিক রঙে। সাদাকালো নয়, মনোক্রোমাটিক। গ্রাফিক্সের দারুণ খেলা দেখা গেছে গোটা গানে। ৬ মিনিটের মাথায় মেঘের ভিএফএক্স কিছুটা মেকি লেগেছে অবশ্য। সেটগুলো একেকটি অনবদ্য আর্ট যেন। ফ্রেম আর সিনেমাটোগ্রাফি মিলে গোটা সময়টা একজন দর্শককে আটকে রাখবে অর্থহীনের নিজস্ব জগতে। সেখানে সুমনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সব। সেখানে অদ্ভুত ছেলেরাই রাজত্ব করে চলে।

‘টেকনিক্যালি’, নির্মাণের দিক থেকে, সাউন্ড আর মিউজিকের মিশেলে এই মিউজিক ভিডিও বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্যই একটা বড় প্রাপ্তি। ‘স্টোরিটেলিং’-এর দিক থেকেও এই কাজটি অত্যন্ত উঁচু মাপের। এই মিউজিক ভিডিও পরিচালনা করেছেন আশফাক বিপুল। কত যত্ন নিয়ে এই কাজ করেছেন তিনি, তা দর্শকই ভালো বলবেন। চিত্রনাট্য লিখেছেন সুমন নিজেই। ডিওপি মোর্শেদ বিপুল গোটা গানের চিত্রগুলোকে এত সূক্ষ্মভাবে ক্যামেরায় বন্দি করেছেন, আপনি সোয়া আট মিনিটের ভিডিওর যেকোনো একটি মুহূর্তের যদি দৈবভাবেও কোনো স্ক্রিনশট নেন, একটা নান্দনিক ওয়ালপেপার পেয়ে যাবেন!

বেজবাবা সুমন লাইফ সাপোর্টে থাকাবস্থায় ডাক্তাররা একবার তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি একবার অপারেশনের সময় একপাশের ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রমও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। মৃত্যুদূতের এত কাছাকাছি থাকা এই সুমন আবারো ফিরেছেন। অদ্ভুত সেই ছেলেটিই আসলে সুমন নিজে যেন। অর্থহীন তার সেই ফিনিক্স পাখি, যারা বাঁচার আহবান জানায় সব অদ্ভুত ছেলেদের। এ তো সেই অর্থহীন, যাদের গানকেই উপজীব্য করে বেঁচে থাকে অজস্র তরুণ-তরুণী। সেই অর্থহীনের বেজবাবা সুমন ফিরলেন।

গেয়ে গেয়ে গানের শেষ কোরাসে এলেন। সুমন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই গান কেবলই তাদের ভক্তদের জন্য। ভক্তরা এই গোটা বছর চারেক কী আশা করে ছিলেন? সুমন যুদ্ধ শেষ করবেন হয়তো। হয়তো বা না। সুমন ফিরেছেন। এবার সুমন দীপ্ত হয়ে উঠলেন। ঘোষণা দেওয়ার পালা; সুমনের চিরঞ্জীব হয়ে উঠার ঘোষণা। যুদ্ধ জয় করে আসা সুমন তার গলার সব দরদ আর তীব্র জেদ ঢেলে দিয়ে কোরাসে গাইতে লাগলেন:

আমার এ গানটার জন্য তোমার আমায় মনে রাখতে হবে

রাত গভীরে ঘুম ভাঙলে আমার কথা ভাবতে হবে

জোছনাটা দেখলে পরে আমায় তোমার খুঁজতে হবে

আমার গাওয়া গানের সাথে তোমার মিশে থাকতে হবে

সুমন গান গাইতে থাকবেনই। আমরাও তাকে ভুলে যাই, সেই সাধ্য কই?

Related Articles