ধর্মীয় চিত্রকলার মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্মের মাহাত্ম্য তুলে ধরা হয়। “ধর্ম যার যার উৎসব সবার”– এর মতো এই সকল চিত্রকলাও যার যার ধর্মের, কিন্তু ছবির সৌন্দর্য সবাই অবলোকন করতে পারে। হ্যাঁ, গুরুত্ব হয়তো সবার কাছে সমান নয়, তবে ধর্মের পবিত্রতা সকলকেই স্পর্শ করে। আবার একেক ধর্মের একেক রীতি। সনাতন ধর্মে নাচ-গানকে আরাধনার মতো ভাবা হয়। ইসলাম ধর্মে আবার এসব হারাম বলে বিবেচিত। খ্রিষ্ট ধর্মে চিত্রাঙ্কনকে আরাধনা না মনে করা হলেও ধর্মের মর্মকে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অনেক শিল্পীই। চৌদ্দ-পনেরো শতক কি তার আগে থেকেই চলছে এই সকল চিত্রকর্ম। পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয় চিত্রকলা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে, বিভিন্ন নবজাগরণের সময় কিংবা প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সময়। তবে দেখে নেওয়া যাক সেই সকল চিত্রকলার মধ্যে বিখ্যাত দশ ধর্মীয় চিত্রকলা।
দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাড্যামস
ভ্যাটিকান সিটির সিস্টাইন চ্যাপেলের শিলিংয়ে ইতালিয়ান শিল্পী মাইকেল্যাঞ্জেলো বুয়োনারোতির আঁকা ‘দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাড্যামস’ সব বিখ্যাত ধর্মীয় চিত্রের মধ্যে অন্যতম। ছবিটি ফ্রেস্কো ঢঙে আঁকা একটি মাস্টারপিস। সিস্টাইন চ্যাপেলে ১৫০৮-১৫১২ সালের মধ্যে এটি সম্পন্ন করা হয়। চিত্রটি ‘বুক অফ জেনেসিস’ এর একটি চিত্রণ, যেখানে ঈশ্বর এই ধরার প্রথম মানব আদমকে জীবনদান করছেন। ছবিতে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে আছেন ঈশ্বর, অন্যদিকে সদ্য সৃষ্ট মানব আদম সম্পূর্ণ নগ্নরূপে দেখা যাচ্ছে। ছবিটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। তবে ইংরেজি শিল্প সমালোচক ওয়ালটার প্যাটারের ব্যাখ্যাটিই সবচেয়ে প্রচলিত এবং গ্রহণযোগ্য। তার মতে, ছবিতে উপস্থিত ঈশ্বর এবং আদম। ঈশ্বরের আশেপাশে দেখা যায় আরও প্রায় বারোটি প্রাণ। কিন্তু তার বাম বাহুর মধ্যে একজন নারীদেহ দৃশ্যমান, যে হয়তো আদমের পরেই সৃষ্ট দ্বিতীয় মানবী ইভ আর বাকি এগারোটি চরিত্র তাদের ভবিষ্যতের অনাগত সন্তান বা মানবযুদ্ধের সূচনার প্রতীক। ঈশ্বর এবং মানুষের এই ধর্মীয় চিত্রকর্মটি জগদ্বিখ্যাত।
দ্য লাস্ট সাপার
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি- নামের সাথে পরিচিত প্রায় সকলেই। অসম্ভব গুণধর এই শিল্পীর বিচরণ শিল্পের অনেক শাখাতেই তাই তাকে ‘ইউনিভার্সাল জিনিয়াস’ও বলা হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ রহস্যময়ী হাসির চিত্রকর্ম মোনালিসার পর ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রটি ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত। ১৪৯৮ ইতালির সান্তা মারিয়া দেল গ্রেইজে চিত্রটি অঙ্কন করেন তিনি।
লিওনার্দো তাঁর শিল্পগুণের সম্পূর্ণ ব্যবহার করে ছবিটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন। চিত্রে দেখা যাচ্ছে, যিশু খ্রিষ্ট তাঁর বারোজন বাণী প্রচারকের সাথে বসে রাত্রের শেষ আহার গ্রহণ করছেন। যখনই যীশু বলে ওঠেন, তাঁর উপস্থিত শিষ্যের যেকোনো একজন তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ঠিক তখনই সেই বারোজনের বিহ্বলতা-অভিঘাত দেখা যায় একেকজনের মধ্যে। ঠিক সেই প্রতিক্রিয়াগুলোই লিওনার্দো ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রে।
দ্য রিটার্ন অফ দ্য প্রডিগাল সন
নাম শুনেই আঁচ করা যায় চিত্রের পটভূমি। এক পাগল ছেলের ঘরে ফিরে আসার দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে চিত্রে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বাবা স্নেহার্দ্র হয়ে জড়িয়ে ধরছেন তার গৃহফেরত পুত্রকে। এবার ঘটনার বর্ণনায় যাওয়া যাক। এক বাবার দু’টি পুত্রসন্তান। ছোট সন্তানটি ভাগ্যের অন্বেষণে একদিন ঘর ছেড়ে চলে গেলো বহুদূর। নিজের ভুল বুঝতে পেরে খালি হাতে ফিরে এলো বাবার কাছে। এসেই বাবার পা জড়িয়ে ক্ষমা চায় সে এবং তার একজন ভৃত্য হয়ে থাকার আকুতি জানায়। কিন্তু বাবা কি আর সন্তানের ওপর রাগ করে থাকতে পারেন? হারিয়ে যাওয়া পুত্রকে কাছে পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং কীভাবে পুত্রের আগমনকে উদযাপন করবেন সেই চিন্তা করেন। তার এই শুভচিন্তায় বাধা দিতে যায় বড় ভাই, কিন্তু বাবার এক কথা- উদযাপন হবেই!
ছবিতেও আলো-রঙের খেলায় ফুটে উঠেছে বাবার তৃপ্তি, বড় ভাইয়ের সংশয়পূর্ণ অবস্থান এবং ফেরত আসা ছোট সন্তানের মুখে অপরাধবোধের চিহ্ন। রেমব্রান্ট হারমেন্সজুন ভ্যান রিজন চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন দুই সহোদর এবং বাবার সম্পর্কটি। ধর্মীয় অনুশাসনের ধারণা পাওয়া যায় চিত্রে। অনেকের মতেই রেমব্রান্টের এই চিত্রকর্মটি তার সেরা চিত্রকর্মের একটি।
দ্য ব্যেরিয়াল অব দ্য কাউন্ট অফ অরগাজ
ডমেনিকস থিওটোকোপৌলস বা ‘এল গ্রেকো’ নামে পরিচিত আঁকিয়ে, স্প্যানিশ রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান চরিত্র। সাথে একজন শিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিও বটে। প্রথম থেকেই ধর্মীয় চিত্রকলায় আগ্রহী ছিলেন তিনি, এছাড়াও পোর্ট্রেট এবং ল্যান্ডস্কেপে তাঁর ছিল সমান দক্ষতা।
১৫৮৬-১৫৮৮ সালের মধ্যে তৈলচিত্র দ্য ব্যেরিয়াল অব দ্য কাউন্ট অফ অরগাজ আঁকেন স্পেনের সান্তো তোমে চার্চে। বিশাল এই চিত্রকর্মটি দু’ভাগে বিভক্ত। উপরে ঐশ্বরিক, নিচে স্থলজ অংশ দৃশ্যমান। এটি একজন জনপ্রিয় স্থানীয় কিংবদন্তিকে চিত্রিত করে, যিনি টলেডো শহরের অধিবাসী ছিলেন এবং লোকহিতৈষী মানবপ্রেমের জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি দ্য কাউন্ট অফ অরগাজ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। কথিত আছে, এমন পবিত্র আত্মাকে কবর দেয়ার জন্য স্বর্গ থেকে সেইন্ট অগাস্টাইন এবং সেইন্ট স্টিফেন স্বয়ং এসেছিলেন এবং উপস্থিত সবাইকে অবাক করে অলৌকিকভাবে নিজ হাতে সমাহিত করেছিলেন তার দেহ। অন্যদিকে, ছবির উপরিভাগে দেখা যায় এক আধ্যাত্মিক দুনিয়া, যেখানে সবাই সানন্দে অপেক্ষা করছে এই ধার্মিক পুণ্যাত্মাকে গ্রহণ করার জন্য। ছবিটি ম্যানারিজম ধারার একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ।
তৈলচিত্রটি বিশ্বনন্দিত এক চিত্রকর্ম, যা সর্বজনস্বীকৃত এবং সম্ভবত স্প্যানিশ নবজাগরণের সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্মীয় চিত্রকলা।
দ্য কলিং অফ সেইন্ট ম্যাথিউ
যিশু খ্রিষ্টের যে বারোজন শিষ্য ছিলেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন ম্যাথিউ। ম্যাথিউ পেশায় একজন কর সংগ্রহকারী ছিলেন এবং যিশুও তাকে কর সংগ্রহ করার স্থানেই বসা দেখতে পান। যে-ই না যিশু বলে ওঠেন, “অনুসরণ করো আমায়”, তখনই ম্যাথিউ উঠে তাঁকে অনুসরণ করতে শুরু করেন।
চিত্রে কারভাইজ্ঞও যিশুর ম্যাথিউকে ডাক দেওয়ার সেই মুহূর্তটিকেই শিল্পের রূপ দিয়েছেন। চমৎকারভাবে আলো-ছায়ার রহস্য সৃষ্টি করে ছবিটির ধর্মীয় তাৎপর্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।
ইউরোপিয়ান শিল্পের ইতিহাসে কারভাইজ্ঞ একজন প্রভাবশালী শিল্পী ছিলেন। তিনি চিত্রকর্মের ভিন্ন একটি কৌশল সৃষ্টি করেছিলেন যার নাম টেনেব্রিজম, যেখানে আলো-আঁধারের এক উদম প্রতিতুলনা তুলে ধরা হয়। ‘দ্যা কলিং অফ সেইন্ট ম্যাথিউ’ও সেই ভাব ধারার একটি তৈলচিত্র।
ম্যাইকেল্যাঞ্জেলো মেরিসি দ্য কারভাইজ্ঞ ১৫৯৯-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে চিত্রটি আঁকেন রোমের স্যান লুইগি দেই ফ্রান্সিস চার্চের কনটারেলি চ্যাপেলে।
দ্য লাস্ট জাজমেন্ট
দীর্ঘ চার বছর, ১৫৩৬-১৫৪১ ধরে করা ম্যাইকেল্যাঞ্জেলোর দ্বিতীয় বিখ্যাত ধর্মীয় চিত্রকর্ম দ্য লাস্ট জাজমেন্ট। এই ছবিটিও তিনি ভ্যাটিকান সিটির সিস্টাইন চ্যাপেলেই করছিলেন, তবে এবার অলটার দেয়ালে। অলটার দেয়াল, অর্থাৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেই অংশ যেখানে অনুসারীরা অর্ঘ্য প্রদান করে থাকে। সেই পবিত্র স্থানে ফ্রেস্কো ধারায় এঁকেছিলেন এটি।
এই ছবিতে ম্যাইকেল্যাঞ্জেলো দেখিয়েছেন যিশু খ্রিষ্টের প্রত্যাবর্তন এবং ঈশ্বরের শেষ বিচারের দিনটি। ধরণীর সকল মানুষের জাগরণ আর তাদের ভাগ্য এখন কোনদিকে বর্তাবে, তার স্পষ্ট রূপ দিয়েছেন শিল্পী। মাঝে অঙ্কিত স্বয়ং যিশু এবং মাতা মেরি। আশেপাশে আছে আরও প্রায় ৩০০টি মানবদেহ এবং স্বর্গীয় আত্মারা।
এই শিল্পকর্মটি যেমন অন্যতম, তেমনই বিতর্কিত।
সিস্টাইন ম্যাডোনা
ইতালিয়ান শিল্পী র্যালফ স্যানজিওর তৈলচিত্র সিস্টাইন ম্যাডোনা। ১৫১২ সালে ছবিটি তিনি ইতালির পিয়াসেনজা শহরের রোমান ক্যাথলিক স্যান সিসতো চার্চে আঁকেন৷
ম্যাডোনা আসলে মাতা মেরিরই একটি রূপ। শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে মেরি ওরফে ম্যাডোনা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন সাধুসন্ত সিক্সটাস এবং বারবারা। নিচে আছেন পাখাওয়ালা আরও দুই স্বর্গীয় দূতেরা, যারা এই ছবির ধর্মীয় বার্তায় এমনভাবে তৃতীয়মাত্রা যোগ করেছেন, যা এটি ভিন্ন আর কোনো ছবিতে দেখা যায়নি। ইতালিয়ান স্থপতি, ভাস্কর, এবং চিত্রশিল্পী জর্জিও ভাসারি বলেন, “সত্যিকার অর্থেই একটি বিরল এবং অসাধারণ চিত্রকর্ম এটি”।
ছবিটি বর্তমানে পাওয়া যাবে জার্মানির ড্রেসডেনের ‘ওল্ড মাস্টারস গ্যালারিতে’।
ক্রাইস্ট অফ সেইন্ট জন অফ দ্য ক্রস
কালো অন্ধকার আকাশে ক্রুশবিদ্ধ যিশু দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে একজন মাঝি তার নৌকায়। ছবিটির মর্মোদ্ধার করাটা কঠিন, তবে সালভাদর ডালি ছবিতে দেখিয়েছেন প্রতীকী অর্থে একটি ত্রিভুজ এবং বৃত্ত। যিশুর বাহুর কারণে সৃষ্টি হয়েছে ত্রিভুজ এবং মাথাটা গোলাকার। এর অন্তর্নিহিত অর্থ, ত্রিভুজটি ত্রিত্ব বা ত্রয়ী, যেখানে আছে ঈশ্বর, ঈশ্বর রূপী পুত্র ঈশ্বর (যিশু খ্রিষ্ট) এবং ঈশ্বরের তৃতীয় রূপ, আর মাথার গোল আকৃতিটি একতার প্রতীক। অর্থাৎ খ্রিষ্ট ধর্মের সকল বিশ্বাসকেই তুলে ধরা হয়েছে এক ছবিতে।
চিত্রটির নাম ‘ক্রাইস্ট অফ সেইন্ট জন অফ দ্য ক্রস’, কারণ এটি ষোড়শ শতকের স্প্যানিশ ভিক্ষুর ‘জন অফ দ্য ক্রস’ এর আদলে অঙ্কিত। ক্রুশবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রক্তের কোনো ছাপ নেই ছবিতে। ছবিটি আঁকার উৎসাহের একটি ব্যাখ্যা দেন ডালি। তিনি বলেন,
“প্রথমদিকে, ১৯৫০ সালে আমার একটি ‘মহাজাগতিক স্বপ্ন’ ছিল, যেখানে আমি এই ছবিটি এই রঙেই দেখেছি এবং আমার স্বপ্নটি ‘পরমাণুর নিউক্লিয়াস’ প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এই নিউক্লিয়াস পরে একটি আধ্যাত্মিক অর্থ গ্রহণ করে, আমি এটিকে ‘মহাবিশ্বের একতা,’ খ্রিষ্ট বলে বিবেচনা করি!”
যিশু খ্রিষ্টের আকৃতি আঁকার জন্য তিনি হলিউডের স্টান্টম্যান রাসেল স্যান্ডারসের সাহায্য নেন। যিশু খ্রিষ্টের মতো তাকে ঠিক এভাবে ঝুলিয়ে উপর থেকে কীরকম হতে পারে, সেটি ধারণা করে নেন। নিচের মাঝি এবং পানির দৃশ্যটি তার বাসস্থান পোর্ট লিগাতের সাথে সাদৃশ্যকরণ করা হয়।
বর্তমানে ছবিটি পাওয়া যাবে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরের কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারি এবং মিউজিয়ামে। ২০০৬ সালে সালভাদার ডালির এই চিত্রকর্মটি স্কটল্যান্ডের নির্বাচিত সেরা ছবির সম্মান লাভ করে। অনেক চিত্র সমালোচকের কাছেই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় চিত্র ‘ক্রাইস্ট অফ সেইন্ট জন অফ দ্য ক্রস’।
ট্রান্সফিগারেশন
৩৭ বছর বয়সী ক্ষণজন্মা শিল্পী র্যালফ স্যানজিওর শেষ চিত্রকর্মটি ছিল ‘ট্রান্সফিগারেশন’।
১৫২০ সালের এই ছবিটি আঁকা শেষ করে সে বছর তিনি মারা যান। ‘দ্য ট্রান্সফিগারেশন’ ষোড়শ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম বলে বিবেচিত ছিল।
এই চিত্রকর্মটি দু’ভাগে বিভক্ত। উপরিভাগে দেখা যায়, যিশু খ্রিষ্টের রূপান্তর আর দুই পাশে দুই ধর্মপ্রবক্তা এলিজাহ এবং মোজেস। অন্যদিকে নিচের অংশে রয়েছে মানব সমাজের অবস্থান। একটা বালককে অপদেবতা থেকে দূর করতে ব্যস্ত যিশুর শিষ্যগণ। আবার যিশুও কিন্তু বালককে অপদেবতা মুক্ত করছেন।
ছবিটিতে আছে ঈশ্বর এবং মানব সমাজের দুই বিপরীত দৃশ্য। উপরে নিখাদ এবং পবিত্র ঈশ্বর বসবাস করছেন, নিচে রয়েছে অন্ধকার, বিশৃঙ্খলা।
র্যাফেলের চিত্রকর্ম সবসময় সর্বাধিক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই ছবিটিও বাদ যায়নি। নেপোলিয়ন বলেছিলেন,
“ইতালির সকল শিল্পীদের মধ্যে র্যাফেল অন্যতম” এবং ”ট্রান্সফিগারেশন’ তার সেরা কর্ম।”
দ্য এঞ্জেলাস
এঞ্জেলাস ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীদের একধরনের আরাধনার বিষয়। রোম্যান ক্যাথলিক উপাসনালয়ে দিনে তিনবার, ভোর ৬.০০টা, দুপুর ১২.০০ টা এবং সন্ধ্যা ৬.০০ টায় ধর্মীয় গীত গাওয়া হতো৷ বর্তমানে অনেক ক্যাথলিক চার্চে এই চর্চা দেখা যায়। এঞ্জেলাস প্রার্থনাটি উপাসকদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
সেই গুরুত্ববহনকারী মুহূর্তটির ছবিই এঁকেছেন জীন ফ্রানকোইস মিলেট। সূর্য ডুব ডুব, লাল কমলা আভা ছড়িয়ে গোধূলির চিহ্ন চারপাশে। দূরে চার্চের অবয়ব উপলব্ধি করা যায় মাত্র৷ আর সেখান থেকেই ভেসে আসছে চার্চের ঘণ্টাধ্বনি, সময় এখন প্রার্থনার, এঞ্জেলাস। যে কারণে দুই ভক্ত পাশেই ফসলের বাহন রেখে ঠিক সময়মতো প্রার্থনা করে নিচ্ছে। অর্থাৎ, ছবিতে দিনের কাজ শেষে দুই চাষী এখন উপাসনায় মগ্ন।
ফ্রেঞ্চ রিয়েলিজম মুভমেন্টের একজন সক্রিয় বিখ্যাত শিল্পী মিলেট। তার চিত্রকর্মে সবসময়ই শোভা পেয়েছে বাস্তবতা। দ্যা এঞ্জেলাসই মিলেটের শেষ ত্রয়ী ছিল, ‘দ্য শাওয়ার’ এবং ‘দ্য গ্লিনার্স’ এর পর। রিয়েলিজম ধারার একটি অসাধারণ এবং অতুলনীয় তৈলচিত্র দ্য এঞ্জেলাস। উনিশ শতকে ফ্রান্সের সব চিত্রকর্মের মধ্যে এই ধর্মীয় চিত্রকলাটি অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
তৈলচিত্রটি তিনি ১৮৫৭-১৮৫৯ এর মধ্যে শেষ করেন বলে জানা যায়। বর্তমানে এর ঠাঁই হয়েছে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে।