Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রাঞ্চ কালচার: ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রি’র নব্য ‘দাসপ্রথা’

রোহান রাহমান একজন গেমপ্রেমিক মানুষ। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হওয়ায় কম্পিউটারের সাথে তার সখ্য অনেক পুরনো। সে সুবাদে, অবসরে কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলাটাও তার নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজ প্রায় কুড়ি বছর ধরে তিনি গেমিংয়ের সাথে জড়িত আছেন, প্রায় সবরকমের গেমই খেলেন তিনি। প্রিয় তালিকায় রয়েছে ‘গ্র্যান্ড থেফ্ট অটো’, ‘অ্যাসাসিন’স ক্রিড’, ‘গড অভ ওয়ার’, ‘নিড ফর স্পিড’, ‘কল অভ ডিউটি’র মতো অনেক গেম। অবসরে এসবের দুনিয়ায় ডুবে যান তিনি।

কম্পিউটার প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে রোহানের মতো আরও অনেকেই অবসরে তাদের পছন্দের গেমের দুনিয়ায় ডুব মারতে পছন্দ করেন। এদের বাইরে আবার অনেকেই আছেন, যারা এসব গেম খেলে জীবিকানির্বাহ করেন। এই গেমিং ওয়ার্ল্ড তাদের কাছে এক স্বপ্নরাজ্যের মতো। কিন্তু এদের অনেকেই জানেন না, এই ‘ডিজনিল্যান্ড’-এ হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে খোদ ভিডিও গেম ইন্ড্রাস্টিতে অনেক মানুষকেই এক অসহনীয়, অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। গেম-মেকিং ইন্ডাস্ট্রির এই করুণ অধ্যায়টি ‘ক্রাঞ্চ কালচার’ নামে পরিচিত। 

Image Source: gamesindustry.biz

ক্রাঞ্চিং কী?

ক্রাঞ্চ বা ক্রাঞ্চিং বলতে মূলত গেম ডেভেলপারদের দীর্ঘসময় ধরে কাজ করাকে বোঝায়। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। আমেরিকায় একজন মানুষ সপ্তাহে গড়ে ৪৪/৪৫ ঘণ্টা কাজ করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মানুষের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টাও সপ্তাহে ৪০ এর কাছাকাছি। কিন্তু একজন গেম ডেভেলপারকে সাপ্তাহিক স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার চেয়ে অনেকসময়ই বিভিন্ন কারণে বাধ্য হয়ে বেশি কাজ করতে হয়। তাদের এই বাড়তি কাজের চাপ কখনো কখনো সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা বা তার বেশিও অতিক্রম করে। একজন ডেভেলপার অনেক সময় সাপ্তাহিক ছুটিটুকুও উপভোগ করতে পারেন না; কাজের চাপে তাদের আর অন্যদিকে মন দেওয়ার ফুরসতও মেলে না। এই বাড়তি শ্রমের জন্য তারা অনেকসময় মাইনের বাইরে বেশি কিছু পান না। ডেভেলপারদের এই মাত্রাতিরিক্ত বাধ্য শ্রমই গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে ‘ক্রাঞ্চ’ নামে পরিচিত। ক্রাঞ্চ যে শুধু মাত্রাতিরিক্ত কাজকেই বোঝায়, তা নয়; বরং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য বৈষম্যও ক্রাঞ্চের পর্যায়ে পড়ে। এর আরও কিছু রকমফের নিম্নরূপ।

মজুরিবিহীন ওভারটাইম: ওভারটাইম কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি না দিয়ে তার বদলে অনেক কোম্পানি তাদের কর্মীদের ভবিষ্যত-ছুটি ও ফ্রি-মিল অফার করে।

ন্যূনতম মজুরির অভাব: গেম ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করার জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকেন। তাই তারা অনেকসময় তাদের পদের জন্য বরাদ্দ বেতনের চেয়ে কম টাকা নিয়ে থাকেন। ফলে, বেশি ঘণ্টা কাজ করেও তারা ঘণ্টার হিসেবে অনেক কম মজুরি পান।

কন্ট্রাক্ট ওয়ার্ক: অনেক ডেভেলপার ইন্ডাস্ট্রিতে স্বাধীন চুক্তির মাধ্যমে প্রবেশ করলেও দিনশেষে তাদেরও বেতনভুক কর্মচারীর মতো বিবেচনা করা হয়। তারাও ওভারটাইমের জন্য বেতন পান না।

টিপসই ব্যবস্থা: আগেকার দিনের কৃষকেরা বাধ্য হয়ে জমিদারের কাছে টিপসই দিয়ে ভিটেজমি হারাতো। গেম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকসময় কর্মীদের সমরূপ দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হতে হয়। অনেক কোম্পানি কর্মীদের এমন সব চুক্তি করতে বাধ্য করে, যেখানে লেখা থাকে, কর্মীরা বাড়তি ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার (স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা) বেশি কাজ করবেন।

অবসরে অনেকেই তাদের পছন্দের গেমের দুনিয়ায় ডুব মারতে পছন্দ করেন; Image Source: Getty Images/TNS

কেন হয় ক্রাঞ্চিং?

সেই সত্তরের দশকে গেম ডেভেলপারদেরকে সাধারণ টেক্সটাইল কর্মী বৈ অন্যকিছু ভাবা হতো না। তখন তারা ছিলেন সাধারণ কর্মী, সৃজনশীল নির্মাতা নয়। দ্য ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাস অ্যট অস্টিন-এর অধ্যাপক ডেভিড কোহেন বলেন, সে সময় কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে এমন আচরণ করতেন, যেন তাদেরকে চাকরি দিয়ে উদ্ধার করেছেন। এসবের ফলে ক্রাঞ্চ কালচারের পথ সুগম হয়েছে। বর্তমান সময়ে ক্রাঞ্চ বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি পথ না থাকার ফলে তরুণ নির্মাতারা শোষণ ও ক্রাঞ্চের হরহামেশা শিকার হচ্ছেন।

অধ্যাপক কোহেনের অভিজ্ঞতা বলে, কিছু মানুষ গেম-মেকিং নিয়ে এতটাই প্যাশনেট হয়ে যান যে, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওভারটাইম খাটেন। জরিপে দেখা গেছে, বছরে একাধিকবার ক্রাঞ্চের স্বীকার হন নির্মাতারা। সাপ্তাহিক ৪০ ঘণ্টা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি কাজ করতে হয় তাদেরকে। কখনো কখনো তা ১০০ ঘণ্টাও পেরিয়ে যায়।

ক্রাঞ্চ কখনো অভ্যন্তরীণ কারণ, কখনোবা বাহ্যিক চাহিদার কারণে হয়ে থাকে। বিখ্যাত গেমগুলোর নতুন নতুন ভার্সন রিলিজের জন্য গেমাররা মুখিয়ে থাকেন। তাই শিডিউল মোতাবেক গেম মুক্তি দেবার জন্য নির্মাতাদের বেশি সময় ধরে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হয়। আবার কখনো দেখা যায়, মুক্তির কিছুদিন আগে হঠাৎ করে কর্তৃপক্ষ গেমের গঠনে আগাগোড়া পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। প্রিভিউ ফুটেজ বা প্রি-রিলিজ বেটা টেস্টিংয়ের মাধ্যমে প্লেয়ারদের কাছ থেকে ফিডব্যাক পেয়ে সে অনুযায়ী চূড়ান্ত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। যেমন কোনো মোড বাদ দেওয়া বা তার স্থলে নতুন কোনো মোড ইনস্টল করা, নতুন কারেক্টার বা ইভেন্ট যোগ করা ইত্যাদি। এতে করে গেম ডেভেলপারদের অল্প সময়ের মধ্যে নতুন করে প্রোগ্রাম লিখতে হয়, সম্পাদনা করতে হয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়, ওভারটাইম, বাড়তি কর্মঘণ্টা ইত্যাদির চাপে নাভিশ্বাস ওঠে গেইম ক্রিয়েটরদের, অন্যদিকে মান কমে যায় গেমের।

বছরে একাধিকবার ক্রাঞ্চের শিকার হন নির্মাতারা; Illustration: Hannah Wertz 

কয়েক দশক আগেও ক্রাঞ্চের পরিমাণ এখনকার তুলনায় বেশ কম ছিল। বিশেষত, তখন কনসোল গেমগুলো তৈরিতে ক্রাঞ্চ হতো শুধু গেম মুক্তির কয়েক সপ্তাহ আগে। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে গেমের ধরন পাল্টাচ্ছে। গ্রাহকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমের চাহিদাও বাড়ছে, তাই গেম ইন্ডাস্ট্রির পরিসরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের তুলনায় গেম নির্মাণের বেশি প্রাযুক্তিক দক্ষতা ও রিসোর্সের প্রয়োজন হচ্ছে। ক্রাঞ্চের হারও দিন দিন বেড়েই চলছে। এর সাথে ইন্টারনেটের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আগে কম থাকায় বেশিরভাগ গেমেরই নিয়মিত কোনো আপডেটের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু বর্তমানে গেম কনসোলগুলোর ৯০ শতাংশেরও বেশি অংশ ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত। তাই একটি গেম সারা বছরই আপডেট হতে থাকে। আবার এর সাথে সাথে রয়েছে, ‘ডাউনলোডেবল কনটেন্ট’ বা ডিএলসি, যা গেমে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায়। ডিএলসি হতে পারে নতুন অস্ত্র, চরিত্র, অ্যাভাটার, ম্যাপ ইত্যাদি।

কর্মীদের ওপর প্রভাব

“আপনার পছন্দের প্রতিটি গেমই নির্মাতাদের কঠোর শ্রমে তৈরি।”

ভিডিও গেম নিয়ে এমনটাই ভাষ্য নাথান অ্যালেন ওর্তেগা’র। তিনি টেলটেইল-এ কাজ শুরু করেন ২০১৫ সালে। নিজের স্বপ্নের চাকরি পেয়েছেন ভেবে আনন্দে আত্মহারা হলেও খুব শীঘ্রই তার ভুল ভাঙে। তিল তিল পরিশ্রমে তার শরীরে আলসার বাসা বাঁধে। ওর্তেগা’র মতে,

“আমি এমন সব ক্ষুন্নমান গেম নিয়ে কাজ করেছিলাম, যেগুলোর নির্মাতারা মাসের পর মাস তাদের কর্মক্ষেত্রের এই প্রকারান্তর বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাঁপিয়ে মরছিলেন।”

কোনো একটা সময় ইন্ডাস্ট্রিতে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে পারাটাকে একপ্রকার অর্জন বলে বিবেচনা করা হতো। গেমিং ইন্ডাস্ট্রির সাথে অনেক বছর যাবৎ জড়িত মাইক উইলসনের মতে, এটি শুরু হয়েছিল নার্ডদের হাত ধরে। নব্বইয়ের দশকে ক্রাঞ্চকে ‘ব্যাজ অভ প্রাইড’ হিসেবে দেখা হতো। আর যারা এই ‘বাহাদুরি’র স্রোতে গা মেলাতে চাননি, তারা ক্রমশ ইন্ডাস্ট্রি থেকে হারিয়ে গিয়েছেন।

আপনার পছন্দের প্রতিটি গেমই নির্মাতাদের কঠোর শ্রমে তৈরি; Image Source: glassdoor.co.uk

ক্রাঞ্চ সমস্যা প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোড়ন তোলে ২০০৪ সালে। সে বছর নভেম্বরে লাইভজার্নাল-এর একটি ব্লগে গেইম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রনিক আর্টসের একজন কর্মী’র স্ত্রী এরিন হফম্যান তার স্বামীর কর্মক্ষেত্রের ক্রাঞ্চ কালচার নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন-

“আমার স্বামী গভীর রাতে ঘরে ফেরে মাথাব্যথা নিয়ে। এমন নিদারুণ ব্যথা, যা কখনো দূর হবে না। সাথে আছে হজমের সমস্যা। সেটিও দীর্ঘদিনের। এদিকে তার দিকে চেয়ে চেয়ে আমার পাশে থাকার নিশ্চয়তাসূচক হাসিটাও দিনে দিনে একঘেয়ে আর ম্লান হয়ে আসছে।”

এছাড়া ২০১০ সালে, রকস্টার গেমসের কয়েকজন কর্মীর স্ত্রী তাদের স্বামীর কর্মক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খোলেন। এই স্পাউজ লেটারেও কোম্পানির অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, ওভারটাইম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অথচ ‘ইএ স্পাউজ লেটার’ প্রকাশের প্রায় ১৬ বছর পরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি গেম ইন্ডাস্ট্রিতে।

টেলটেইল কোম্পানির সাবেক একজন ডেভেলপার, ব্র্যান্ডন কেবেঙ্কা, টুইটারে তার সহকর্মীদের অবৈতনিক ওভারটাইম না করার জন্য আহ্বান জানিয়ে লেখেন-

“নিজেদের শরীরের দিকে খেয়াল রাখুন। কোম্পানি আপনাদের দু’ পয়সার মূল্যও দেয় না।”

গেম ডিজাইনার বায়রন অ্যাটকিনসন-জোন্স ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সময় ক্রাঞ্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

“গেম ইন্ডাস্ট্রিতে আমার প্রথম চাকরিজীবনে আমি পাগলের মতো কাজ করেছিলাম। তো একরাতে আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম, যথাসময়ে বাড়ি ফিরব। কিন্তু কপালের ফেরে, সেদিনই কোম্পানির একজন ডিরেক্টর আমাদের কাজের ঘর খালি দেখে ফেলেন। তখন সন্ধ্যা সাতটা। পরদিন সকালে আমাদেরকে মিটিং রুমে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হলো- যদি আমরা রাতে তাড়াতাড়ি কাজ ছেড়ে ফিরে যাই, তাহলে চাকরিটা আর বেশিদিন করতে পারব না।”

অ্যাটারি’র আরেকজন প্রাক্তন কর্মী জ্যারেড রিয়াকে তার প্রথম চাকরিতে দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছিল। এর বাইরে আরও দু’ ঘণ্টা নষ্ট হতো যাতায়াতের জন্য।

“সকাল সাতটায় ঘর থেকে বেরোতাম, রাত ১১টার আগে ফিরতে পারতাম না। কয়েক সপ্তাহ পর আমার খাওয়া-দাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেল। ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতাম না। মনে হচ্ছিল, শরীর আর কাজ করছে না। গাড়িতে বসে লাঞ্চ ব্রেক কাটাতাম; ওই সময়টুকু কখনো একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম, নয়তো বসে বসে কাঁদতাম।”

জ্যারেড চেয়েছিলেন ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে, এটি ছিল তার স্বপ্ন। তাই শত কষ্ট হলেও তিনি মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছেন। নিজের দুর্দশা কাউকে দেখতে দেননি। এভাবে কাজের চাপের মুখে অনেক কর্মী মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। জিল মুরে নামক একজন গেম-স্টোরি রাইটার জানান, মানসিক সমস্যা শুরু হলেও তার ম্যানেজাররা মোটেই তা বিশ্বাস করেননি। বরং কর্তৃপক্ষ মনে করত, যাদের এ চাপ নেওয়ার মুরোদ নেই, এ ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের কোনো জায়গা নেই।

২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফোর্টনাইট’ প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা না পেলেও পরে ‘ব্যাটল রয়াল’ মোড যোগ করার পর গেমটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় গেমে পরিণত হয়। কিন্তু এ বিশাল সাফল্যের পেছনে যে একগাদা মানুষের অক্লান্ত শারীরিক পরিশ্রম আর মানসিক অস্বস্তি রয়েছে, তা নিয়ে বেশিরভাগ গেমারেরই বিন্দুবৎ ধারণা নেই। পলিগনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একজন কর্মী জানিয়েছেন, তিনি সপ্তাহে গড়ে ৭০ ঘণ্টা কাজ করেছেন। ওই ইন্ডাস্ট্রিতে তার মতো আরও শ’খানেক লোক রয়েছে, যাদেরকেও একই দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, এমন কর্মীও তার চেনা আছে, যারা সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টাও কাজ করেছেন। আরেকজন জানিয়েছেন, তিনি কদাচিৎ ঘুমোতেন, বাসায় সবসময় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। কোনো সপ্তাহান্তে ছুটি পাওয়া তার কাছে বিশাল কিছুবলে মনে হতো।

ক্রাঞ্চের অভিযোগ

‘ফোর্টনাইট’ থেকে ‘রেড ডেড রিডেম্পশন’, সব গেমের পেছনেই রয়েছে ডেভেলপারদের ঘাম আর অশ্রু দিয়ে লেখা এক করুণ অধ্যায়। কয়েকটি প্রথম সারির গেম ইন্ডাস্ট্রি’র ওপর উঠা ক্রাঞ্চ কালচারের অভিযোগ ও তাদের প্রতিক্রিয়া এখানে দেওয়া হলো।

রকস্টার গেমস

২০১৮ সালের অক্টোবরে মুক্তি পাওয়া ‘রেড ডেড রিডেম্পশন ২’ গেমটি তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় সাত বছর! হাজার রকমের অ্যানিমেশন, অসংখ্য সংলাপ, আর দীর্ঘ ৬০ ঘণ্টার গল্প নিয়ে তৈরী গেমটি তৈরিতে অনেককেই সপ্তাহে শতঘণ্টা কাজের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। ভালচারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনেকটা বড়াই করেই এমন সব তথ্য জানান রকস্টার গেমস-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড্যান হাউজার।

হাউজারের এমন মন্তব্যের জেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় ওঠে। গেমিং ওয়েবসাইট কোটাকু এরপর ৭৫ জনেরও বেশি সাবেক ও বর্তমান কর্মী’র সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কর্মীরা সপ্তাহের ছয়দিন দৈনিক ৫৫ থেকে ৬০ ঘণ্টা কাজ করার অভিযোগ করেন। তারা আরও জানান, তাদেরকে যতদূর সম্ভব বাড়তি ওভারটাইম খাটার জন্যও বাধ্য করা হয়েছিল। এ সময় কর্মীরা কাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া বা চাকরি হারানোর ভয়ে থাকতেন। ফলে তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয়।

প্রতিক্রিয়া

ড্যান হাউজার পরে জানান, তিনি শুধু নিজে ও গুটিকয় কর্মী’র কথা বলেছিলেন, যাদেরকে শতঘণ্টা কাজের মধ্য দিয়ে গেছে। রকস্টার তাদের ‘অন্য কোনো কর্মী একইভাবে কাজ করুক’ তা চায় না।

রেড ডেড রিডেম্পশন ২; Image Courtesy: Rockstar Games

বায়োওয়্যার

২০১৯ সালের প্রথমদিকে ‘অ্যানথেম’ ও ‘মাস ইফেক্ট: অ্যান্ড্রোমিডা’ গেমগুলোর নির্মাতা বায়োওয়্যার ক্রাঞ্চের জন্য অভিযুক্ত হয়। ‘অ্যানথেম’ তৈরির সময় দুর্বল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা এ ক্রাঞ্চ সৃষ্টি করে। গেমটি নির্মাণের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসেও গল্পে অনেক পরিবর্তন আনা হয়, যা ডেভেলপারদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। ফলে, কর্মীদের রাত জেগে কাজ করতে হয়।

প্রতিক্রিয়া

নিজেদের ব্লগপোস্টে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ স্টুডিওটি জানায়- তারা মনে করে, তাদেরকে অভিযুক্ত করা প্রতিবেদনে কিছু কর্মীকে অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। এ প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা শুরু হলে বায়োওয়্যার-এর জেনারেল ম্যানেজার কেসি হাডসন তার কর্মীদের কাছে এক অভ্যন্তরীণ বার্তায় সমস্যাটি স্বীকার করে নিয়ে এটি সমাধানের আশ্বাস দেন।

ট্রেয়ার্ক

অ্যাক্টিভিশন-এর ট্রেয়ার্ক স্টুডিও ‘কল অভ ডিউটি: ব্ল্যাক অপস ৪’ বানাতে গিয়ে অনেকেই ক্রাঞ্চের শিকার হন। ‘ক্যাম্পেইন মোড’ বাদ দিয়ে তার স্থলে ‘ব্যাটল রয়াল মোড’ চালু ও অগমেন্টেশন ইত্যাদি কারণে কর্মীদের কর্মঘণ্টা বেড়ে যায়।
কোটাকু-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতে করে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন গেমটির মান-নিশ্চায়ক দল (QA Testers)। তাদেরকে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়।

প্রতিক্রিয়া

ডিজিটাল ট্রেন্ড অনুসারে, কোম্পানিটি ওই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় কোনো সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে আরেকটি বিবৃতিতে তারা কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নের সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা উল্লেখ করে।

ফোর্টনাইট; Image Courtesy: Epic Game

এপিক গেইমস

এপিক গেইমস-এর মাস্টারপিস ‘ফোর্টনাইট’-এর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে গিয়ে কর্মীরা ক্রাঞ্চের শিকার হন। পলিগন-এর রিপোর্ট অনুযায়ী- আপডেট, ডিএলসি, প্যাচ-রিপোর্ট ইত্যাদির জন্য কর্মীদের সপ্তাহে ৭০ থেকে ১০০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছিল।

প্রতিক্রিয়া

এপিক গেইমস তাদের কর্মীদের জন্য দু’ সপ্তাহব্যাপী ছুটির ব্যবস্থা করে।

টেলটেইল

ভ্যারাইটিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টেলটেইল-এর সাবেক কর্মী জব স্টফার জানান, কোম্পানিটিতে ‘চিরস্থায়ী’ ক্রাঞ্চ বিদ্যমান। প্লেয়ারদের ফিডব্যাকের ওপর নির্ভর করে কোম্পানিটি নিয়মিত গেমের সংস্কার করত।

প্রতিক্রিয়া

টেলটেইল-এর সাবেক সিইও কেভিন ব্রনার ক্রাঞ্চকে অস্বীকার না করে বরং সমর্থন করেছেন। তার মতে, কম বাজেটের কারণে কোম্পানিটির কাছে ক্রাঞ্চের বিকল্প কিছু ছিল না।

নেদাররিয়ালম

মর্টাল কমব্যাট-এর জনক এ কোম্পানিটিতে ২০১১ সাল থেকেই ক্রাঞ্চ কালচারের অভিযোগ ওঠে। একজন কর্মী জানান, তিনি নেদাররিয়ালম-এ কাজ করার সময় দিনে ১৪ ঘণ্টাও কাজ করেছিলেন।

প্রতিক্রিয়া

স্টুডিওটি ক্রাঞ্চের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় কিছু না জানালেও এক বিবৃতিতে জানায়, তারা কর্মক্ষেত্রে অসহনীয় পরিবেশের ব্যাপারে খুঁটিয়ে দেখবে। বিবৃতিতে কর্মীদের প্রকাশ্য অভিযোগ প্রসঙ্গে অসন্তোষ প্রকাশ করে নেদাররিয়ালম জানায়, কর্মীরা ইচ্ছে করলেই ‘গোপনভাবে’ তাদের অভিযোগের কথা কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারত।

কল অভ ডিউটি: ব্ল্যাক অপস ৪; Image Courtesy: Activision

ক্রাঞ্চমুক্তির পথ

ক্রাঞ্চের কারণে যে শুধু কর্মীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা নয়; বরং ব্যবসায়িকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত কর্মীদের কর্মক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যায়। এছাড়া পরিশ্রান্ত কর্মীদের কাজে অনেক ভুল থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। অনেকসময় তারা প্রোগ্রাম লিখতে গিয়ে ভুল করেন। ফলে, বাড়তি পরিশ্রম আর সময় দুটোরই দরকার হয়।

  • কখনো কখনো অতিরিক্ত কাজ করা প্রয়োজন হতে পারে। যেমন, ডেডলাইনের আগে স্বভাবতই ডেভেলপারদের ওপর বাড়তি চাপ থাকে যথাসময়ে গেম সম্পূর্ণ করার। ওই সময় অতিরিক্ত বা একাধিক শিফটে কাজ করা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু যখনই এই বাড়তি রুটিন নিয়মিত হয়ে যায়, তখনই তা ক্রাঞ্চিংয়ে পরিণত হয়। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত নয়, ক্রাঞ্চকে উৎসাহ দেওয়া। বরং তাদের ডেভেলপার, প্রোগ্রামাররা যেন নির্বিঘ্ন সাপ্তাহিক ছুটি উপভোগ করতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সপ্তাহশেষে ছুটির দিনগুলোতে কোনো অফিশিয়াল ইমেল কর্মীদের না পাঠানোই শ্রেয়। কারণ, সপ্তাহশেষে একজন কর্মী নতুন করে পুনরোদ্যমে কাজ করার শক্তি পান। তেমনি করে কর্মীদের নিয়মিত ছুটিও মঞ্জুর করতে হবে।
  • বড় বা দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে কাজ করা হলে ক্রাঞ্চের ঝুঁকি কমে যায়। এক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মীদের ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে কাজ বণ্টন করলে ক্রাঞ্চের যাঁতাকলে পড়ার আশঙ্কা কমে যায়। এছাড়া, কর্মীদের নিজের উপযুক্ত সময় ও পছন্দসই পরিবেশে কাজ করার সুযোগ দিলেও ক্রাঞ্চ ঘটার সম্ভাবনা কম হয়।
  • যারা সরাসরি গেম নির্মাণের সাথে জড়িত থাকেন, যেমন- ডেভেলপার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, প্রোগ্রামার; তারা যদি প্রজেক্ট সমাপনের সময় নির্ধারণ করেন, তাহলে ক্রাঞ্চ কমে আসে। কারণ, তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তারা একটি গেম নির্মাণে কতদিন সময় লাগতে পারে, তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখেন। তারা সে অনুপাতে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে পারেন।
  • ক্রাঞ্চ কেবল তখনই হয়, যখন অনিচ্ছুক কর্মীরা গত্যন্তর হয়ে বাড়তি কাজ করেন। কিন্তু, কখনো কখনো অনেক কর্মীই স্বেচ্ছায় ওভারটাইম বা পে-রোলের বাইরে কাজ করেন। আবার অনেকসময় ডেভেলপার, ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে বাড়তি সহায়তার প্রয়োজন হয়, যা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। এসব ক্ষেত্রে সবসময় নির্দিষ্ট কয়েকজনকে ব্যবহার না করে পালাক্রমে সবার সহায়তা নেওয়া উচিত।
  • ভিডিও গেমের ক্রাঞ্চ দূর করার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে গেমের ভোক্তা তথা প্লেয়াররা। অনেক কর্মীই মনে করেন, প্লেয়াররা চাইলে গেম কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন তাদের কর্মপরিবেশ পাল্টানোর জন্য। আর এতে কাজ হবে বলেও তারা বিশ্বাস করেন। এছাড়া গ্রাহক চাইলে এমন সব গেম ইন্ডাস্ট্রির পণ্য ব্যবহার করতে পারেন, যারা ক্রাঞ্চ দূর করার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করে যাচ্ছে আর তাদের লাভের একটা অংশ কর্মীদের জন্য বরাদ্দ রাখছে।

এপিক গেমস-এর ‘ফোর্টনাইট’ তৈরির সময় ক্রাঞ্চের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন পলিগন-এর সাংবাদিক কলিন ক্যাম্পবেল। পরে আরেকটি ফলোআপ স্টোরিতে তিনি তার সেই অভিজ্ঞতার কথা জানান। ক্যাম্পবেল মনে করেন, এই ঘটনাগুলো নিয়মিত আলোয় আসলে তবেই পরিবর্তন সম্ভব। তিনি জানান, তার সাথে তখন অনেক কর্মীই কথা বলতে চায়নি। ক্যাম্পবেলের মতে, অধিকাংশ কর্মীই ভয়ে ছিলেন যে, সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুললে তাদের চাকরি চলে যাবে। ক্যাম্পবেল চান, আরও অনেকেই গেম ইন্ডাস্ট্রি’র এই অন্ধকার অধ্যায়গুলো নিয়ে কথা বলুক। কারণ, এসব ঘটনা প্রকাশিত হলে ইন্ডাস্ট্রি’র রাঘব-বোয়ালরা একসময় বাধ্য হবেন এ সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে। সবমিলিয়ে, কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে খুব স্বল্প সময়ের জন্য, চাহিদার সাপেক্ষে ক্রাঞ্চ কাজ করলেও এটি দীর্ঘস্থায়ী কোনো গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া নয়।

গেম ওয়ার্কার্স ইউনাইট; Image Source: pcgamer.com

ক্রাঞ্চ কালচারের শিকার ডেভেলপাররা ক্রমশ তাদের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ্যে আনছেন। কিন্তু এ দুর্বিপাক থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য কোনো আইন এখনো তৈরি হয়নি। ফলে, ডেভেলপারদের এখন প্রাথমিক কাজ হলো কোনো সংগঠনের ছায়ায় এসে একত্রে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কেননা, এককভাবে প্রতিবাদ করতে গেলে কাজ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তবে ‘গেম ওয়ার্কার্স ইউনাইট’ নামে একটি সংগঠন ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এটি কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিয়ন নয়, একটি তৃণমূল সংগঠন। এটি বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কর্মীদের ইউনিয়ন গঠনে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করা যায়, কোনো এক সুদূর ভবিষ্যতে গেম ডেভেলপারদের একীভূত সাংগঠনিক শক্তির দ্বারা হয়তো ক্রাঞ্চ কালচারে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব।

This is a Bangla language article. This is about the crunch culture of video game industry.

Necessary references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: RIT Reporter; Illustration: Hannah Wertz 

Related Articles