Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অনার কিলিং: পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে মেয়েটিকে খুন করাই যখন প্রথা!

২০১৫ সালের ১৪ জুলাই, মঙ্গলবার। দিনটিকে সারা বিশ্বব্যাপী ‘ফার্স্ট অনার কিলিং মেমোরিয়াল ডে’ বা প্রথম সম্মান রক্ষার্থে প্রাণনাশ স্মৃতি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শাফিলিয়া আহমেদের ২৯ তম জন্মদিন ছিল সেদিন। মাত্র ১৭ বছর বয়সী পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মেয়েটি ২০০৩ সালে খুন হয় নিজের বাবা-মায়ের হাতে। তাদের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হয়নি অবাধ্য মেয়েটি। পরিবারকে বদনামের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ছোট্ট এই বিসর্জনটুকু দিতে তাই একটুও হাত কাঁপেনি তাদের। ছোট দুই ছেলেমেয়ের সামনে বড় মেয়ের গলা টিপে ধরে বাবা। মুখে প্লাস্টিক ব্যাগ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে তাকে। তারপর স্বামী-স্ত্রী মিলে আপদটার লাশ ফেলে দিয়ে আসে পার্শ্ববর্তী লেকের পানিতে। মেয়ে মারা যায় যাকগে, লোকে তো তাদের নিয়ে কোনো কটু কথা বলতে পারবে না!

ঘরের লোকজনের কাছেও নিরাপদ নয় মেয়েরা; Source: outlookindia.com

দুর্ভাগ্যবশত, শাফিলিয়া কোনো বিরল দৃষ্টান্ত নয়। শুনতে খুব বীভৎস মনে হলেও ব্রিটিশ কিংবা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এটি খুব সাধারণ একটি বিষয়। অনার কিলিংয়ের শিকার হয়ে মারা যাওয়া নারীর সঠিক সংখ্যা কত তা জানা না গেলেও, প্রকৃত সংখ্যাটি যে কারো পিলে চমকে দিতে পারে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাজ্যের পুলিশ বাহিনী ২০১০-১৪ সাল পর্যন্ত ১১,০০০ এরও বেশি অনার কিলিংয়ের মামলা রেকর্ড করেছে বলে জানা গেছে। কিশোরী শাফিলিয়ার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দিনটিকে অনার কিলিং মেমোরিয়াল ডে হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অনার কিলিং মেয়েদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নের নাম।

অনার কিলিং কী?

অনার কিলিং বা শেইম কিলিং হলো পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে অবাধ্য সদস্যের প্রাণনাশ করার প্রক্রিয়া। অপরাধী ব্যক্তি পরিবারের জন্য অসম্মান বা লজ্জা বয়ে আনলে কিংবা তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকলে, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নিয়ম-নীতি অস্বীকার বা অমান্য করলে, বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্র/পাত্রীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে অস্বীকৃতি জানালে, পরিবারের অপছন্দের কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে কিংবা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে আবদ্ধ হলে, ধর্ষণের শিকার হলে, ধর্মীয় রীতিনীতি মোতাবেক পোশাক পরিধান না করলে কিংবা সমকামিতায় আসক্ত হলে সে অনার কিলিংয়ের শিকার হতে পারে।

এভাবেই শেষ হয় ভালোবাসার গল্পগুলো; Source: happinessandfood.com

‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ নামক একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘অনার কিলিং’কে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে-

‘পরিবারের জন্য অসম্মানজনক সন্দেহে পুরুষ সদস্য কর্তৃক অপরাধী নারী সদস্যকে হত্যা বা তার প্রতি সহিংস আচরণের নাম অনার কিলিং। বিভিন্ন কারণে নারী সদস্যটি এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারে, যার মধ্যে স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানানো থেকে শুরু করে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনও কারণ হতে পারে। মোটা দাগে বলা হয়, নারী যখন নিজের জীবনের লাগাম নিজের হাতে তুলে নিতে চায় তখনই গোটা সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে চলে যায়। আর সেই নারীকে চরম শিক্ষা দিয়ে বাকি মেয়েদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পরিবার তুলে নেয় তার প্রাণনিধনের দায়িত্ব।’

বিরল ঘটনা হলেও কিঞ্চিৎ-কদাচিৎ পুরুষদেরও শিকার হতে হয় অনার কিলিংয়ের। কোনো নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অপরাধে নারীটির পাশাপাশি অমানবিক এই প্রথায় খুন করা হয় পুরুষ সদস্যটিকেও। কোনো যথাযথ কারণ ছাড়াই পরিবারের কারো যদি মনে হয় অমুক সদস্যটি তাদের জন্য অসম্মানের কারণ হতে পারে, তাহলেও তাকে মেরে ফেলার রেকর্ড রয়েছে।

অনার কিলিং বেশি দেখা যায় যে দেশগুলোতে

অনার কিলিং মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বেশি দেখা যায়। ইউরোপের আলবেনিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যে অহরহ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে। ব্রাজিল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকার পুলিশও এ সংক্রান্ত মামলা সামলাতে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায়। আর ওশেনিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া।

বিশ্বের অনার কিলিং প্রবণ দেশগুলো; Source: behance.net

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনার কিলিংয়ের জন্য বিশেষভাবে কুখ্যাত। মিশর, ইরান, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, সিরিয়া, তুরস্ক, ইয়েমেন এদিক থেকে বেশ এগিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান, ভারত আর পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে যে তা একেবারে অপরিচিত কিছু, তা ঠিক বলা যায় না। এখানে ভিন্ন নামে, ভিন্ন পন্থায় পারিবারিক কারণ দেখিয়ে নারীদের খুন করার ঘটনা ঘটেছে।

যেভাবে ঘটে অনার কিলিং

জোরপূর্বক অতিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ প্রদান, মারধর করা, গুলি করা, পানিতে ডুবিয়ে দেয়া, পাথর নিক্ষেপ, ছুরিকাঘাত, আগুনে পুড়িয়ে মারা, শিরশ্ছেদ করা, ফাঁসিতে ঝোলানো, অ্যাসিড নিক্ষেপ, শ্বাসরোধ করা আরও অনেক অমানবিক উপায়ে অনার কিলিং সম্পন্ন করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তা জনসম্মুখেও নিষ্পন্ন করা হয় যাতে একজনকে দেখে বাকিরা শিক্ষা নিতে পারে। মৃত্যুর তরিকা আলাদা হলেও, উদ্দেশ্য তাদের একই- ‘পরিবার আর গোত্রের সম্মান রক্ষা’।

এ যেন সম্মানকেই খুন করা; Source: happinessandfood.com

অপরিণত বয়সে একটি ছেলের একটি মেয়েকে ভালো লাগতেই পারে। সহজাত প্রবৃত্তির উপর কারো হাত না থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কালো হাতের কোনো অভাব নেই। ভুল মানুষকে ভালোবাসার অপরাধে প্রাণ বিসর্জন দেয়া নারী-পুরুষের অজানা গল্প সবাইকে জানানোর মতো গল্পকথকও খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষ মারা গেলে দু’ফোঁটা চোখের পানি ঝরায় পরিবারের সদস্যরা। আর সেই পরিবারের সদস্যরাই যদি হয় মৃত্যুর কারণ, তাহলে সেই মৃত্যুর চেয়ে আফসোসের আর কিছু হতে পারে না। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর অন্তত ৫,০০০ অনার কিলিং ঘটে বিশ্বব্যাপী। সংখ্যাটি নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই, কারণ মৃতদেহ এত যত্ন সহকারে লুকিয়ে ফেলা হয় কিংবা নষ্ট করে ফেলা হয় যে তা চিহ্নিত করারই আর কোনো উপায় থাকে না। তাছাড়া অনেক সময় দেশের বাইরে গিয়েও হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে তাকে দুর্ঘটনার নামে চালিয়ে দেয়ার রেকর্ডও রয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যাটি এর চেয়ে বেশি বৈ কম হবে না।

কারা করে অনার কিলিং?

বহুল প্রচলিত একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, ইসলাম ধর্মের সাথে মিশে আছে অনার কিলিংয়ের অস্তিত্ব। তবে কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা শিখ, হিন্দু আর খ্রিস্টান পরিবারগুলোতেও অনার কিলিংয়ের রেকর্ড রয়েছে। ভারত বা পাকিস্তান এলাকায় এই প্রথার প্রচলন মাত্রাতিরিক্ত হলেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তা কম-বেশি দেখা যায়।

নাহ, মেরে ফেলার মধ্যে আদতেই কোনো সম্মান নেই! Source: samaa.tv

“অনার কিলিংয়ের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, পুরো ব্যাপারটাই নিয়ন্ত্রণ আর আধিপত্য বিস্তারের সাথে জড়িত,” জানান প্রখ্যাত ডকুমেন্টারি নির্মাতা শারমিন ওবায়েদ চিনয়। তার অস্কারজয়ী ফিল্ম ‘অ্যা গার্ল ইন দ্য রিভার’ অনার কিলিং থেকে বেঁচে যাওয়া এক পাকিস্তানী তরুণীর সত্যিকারের গল্প বলে। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলেও পারিপার্শ্বিকতার চাপে বাধ্য হয়ে নিজের হত্যার চেষ্টাকারীদের ক্ষমা করে দিতে বাধ্য হয় মেয়েটি। আইনের ফাঁককে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। সে কারণেই তো প্রকৃত অপরাধীরা প্রকাশ্য দিবালোকে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে একটু স্বাধীনতা ভোগ করতে চাওয়া অবাধ্য মনের অধিকারী তরুণ প্রাণগুলো।

অনার কিলিংয়ের শিকার কয়েকজন হতভাগ্যের গল্প

অনার কিলিং নামক কুপ্রথার বিচার হওয়ার নজির খুব কমই আছে। তার চেয়ে বরং শুনে আসা যাক কয়েকজন ভিক্টিমের গল্প।

সুরজিত কর আথওয়াল

সুরজিতের ভাবী সার্বজিত শুনিয়েছিলেন তার ননদের সাথে ঘটে যাওয়া বর্বরতার কাহিনী। মাত্র ১৯ বছর বয়সে শিখ পরিবারে বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে হয় সার্বজিতের। এই বিয়েতে খুব একটা মত ছিল না তার, কিন্তু অগ্রজদের মুখের উপর কথা বলার সাহস হয়নি। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখা পান সুরজিতের, তার মতোই অসুখী একটা মেয়ে। আরও কম বয়সে বিয়ে হয় মেয়েটির, নিজের মতো খেলনা-বাটি নিয়ে থাকার বয়সে দায়িত্বশীল বৌ হয়ে সংসার সামলাতে হতো তাকে। কয়েক বছর পর আরও একটু পরিণত হয় সুরজিত। ঘর থেকে বেরিয়ে নতুন নতুন লোকজনের সাথে পরিচিত হতে থাকে সে। হিথ্রোতে কাস্টম অফিসার হিসেবে চাকরি নিয়ে বেশ খুশি ছিল মেয়েটা। দেরি করে ঘরে ফেরা, সহকর্মীদের সাথে পার্টি করা- অবশেষে নিজের মতো করে বাঁচতে শিখছিল সে। কিন্তু আশপাশের মানুষদের তা সহ্য হবে কেন? বাড়িয়ে-চাড়িয়ে সে কথাগুলো তারে সুরজিতের শ্বাশুড়ির কানে লাগানো হলো।

ভাবী সার্বজিতের সাথে সুরজিত (বাঁয়ে) ;Source: dailymail.co.uk

ফলশ্রুতিতে সুরজিতের স্বামী এবং শ্বাশুড়ি তার গায়ে হাত তোলা শুরু করে। বাধ্য হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জানায় সে। এর প্রতিবাদে পারিবারিক আলোচনা সভায় বসে দু’পক্ষ। সুরজিতের অবাধ্যতা আর পরিবারের জন্য অপমানজনক ব্যবহারের কথা অকপটে মেনে নেয় তার পরিবার। কর সাহেব, সুরজিতের বাবা, সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে নিয়ে ভারতে চলে যাবেন। ভারতে যাওয়ার পথে, জিপের ভেতরে বসেই মারধর করে, গলা টিপে মেরে ফেলে তার লাশ নদীতে নিক্ষেপ করে সুরজিতের বাবা-মা। ২৭ বছর বয়সী সুরজিতের রেখে যাওয়া দুই ছেলে-মেয়েকে জানানো হয়- তাদের রাক্ষসী মা পালিয়ে গেছে! সুরজিতের মা একা ফিরে এলে সার্বজিত জিজ্ঞেস করে তাদের মেয়ে কোথায়? একটিই উত্তর দেয় সুরজিতের মা, “জন্মের তরে আমাদের পরিবারের আর কোনো ক্ষতি করতে না পারার মতো দূরে চলে গেছে ও”।

সুন্দরী

সন্দেহের বশে খুন হওয়া সুন্দরী নামক এক পাকিস্তানী নারীর দুঃখগাথা এটি। সফদারের বোন ছিল সুন্দরী। একবার সফদারের এক বন্ধু এসে জানায় তাদের আরেক বন্ধুর ভাইয়ের সাথে সুন্দরীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। এ কথা জেনে তাদের উপর গোয়েন্দাগিরি শুরু করে সফদার। স্থানীয় লোকজনের কানকথায় পাত্তা দিয়ে বোনের উপর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় তার। সফদারের বড় ভাই অবশ্য এসব কথায় একদম গুরুত্ব দিতেন না। বোনের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। কাজেই সফদারকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন সুন্দরী নির্দোষ, তার নামে মিথ্যা অপবাদ রটানো হচ্ছে। গোঁয়ারের মতো সেসব কথা উপেক্ষা করে সুন্দরীকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সফদার।

সুরজিতের ভাই সফদার; Source: amazonaws.com

একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর সুন্দরীকে পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে সফদার। লম্বা এক লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে বোনকে। কিচ্ছু বলার সুযোগ দেয়া হয় না তাকে। তার বড় ভাই যে ঘরে ঘুমাচ্ছিল, সেটিও বাইরে থেকে তালা মেরে বন্ধ করে দেয় সফদার। কাজেই সুন্দরীকে সাহায্য করার মতো আর কেউ ছিল না। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে বোনকে মারতে মারতে সে টেরও পায় না কখন মারা গেছে সুন্দরী। ভাই যখন জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করে তখনই প্রথমবারের মতো মারধর থেকে বিরতি নিয়ে সফদার দেখতে পায় সুন্দরী মারা গেছে। বোনের লাশ দাফন করে সুন্দরীর বড় ভাই সব জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে প্রমাণ করে তার নামে রটানো গুজব সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল। যে বন্ধুটি তাকে সুন্দরীর প্রেমের কথা বলেছিল, সে-ও পরবর্তীতে স্বীকার করে সুন্দরীর নামে বানোয়াট কথা বলেছিল সে। সে যা-ই হোক, সুন্দরীর মৃত্যু নিয়ে মোটেও আফসোস ছিল না সফদারের। তবে বোনকে হারানোর দুঃখ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে তার বড় ভাই। আর সফদার? বিপুল পরিমাণ অর্থের জোরে দিব্যি সাজা থেকে বেঁচে যায় সে।

ফারজানা পারভীন

ফারজানা পারভীন; Source: telegraph.co.uk

“কাকরা কারো চেহারা ভোলে না,” বলছিল বাচ্চাটা। সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কীভাবে জানো?” বাচ্চাটা উত্তর দিল, “মা বলেছে”। তাজ নামের সেই ৮ বছরের বাচ্চাটির মায়ের নাম ফারজানা পারভীন, মারা গেছেন তিনি। ঠিক করে বলতে গেলে, মেরে ফেলা হয়েছে তাকে। তার অপরাধ? মুহাম্মদ ইকবাল নামক এক বিপত্নীক লোকের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাকে বিয়ে করা ও তাজের জন্ম দেয়া। নিজের বাবাসহ ভাইয়েরা এসে তার ঘরে ফেলে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে করে মেরে ফেলে তাকে। ২৫ বছর বয়সী ফারজানা তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ফারজানার স্বামী আর ছেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তার কবরের পাশে। এই হত্যার বিচার চাওয়ার মতো কোনো জায়গাও তাদের জানা নেই।

আরাশ ঘোরবানি-জারিন

২০০৪ সালে আরাশের বয়স ছিল ১৯ বছর। তার বন্ধুরা প্রচণ্ড ভালবাসত তাকে। রাতের বেলা সে বাইরে থাকলে বন্ধুরাও সবাই তার সাথেই থেকে যেত। পরিচিত-অপরিচিত যে কারো মন জয় করে নেয়া বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটি ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। যে জিনিসটি পড়তে অন্যান্যদের দুই সপ্তাহ লাগে, মেধাবী আরাশ তা মগজে গেঁথে নিতে পারতো মাত্র দুই ঘণ্টায়! বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক ইঞ্জিয়ারিং পড়তে গিয়ে এক মেয়েকে ভালোবেসে ফেলে সে। আরাশের বাবা তাকে বোঝায় পড়ালেখা শেষ করার আগেই কোনো সম্পর্কের জালে জড়িয়ে পড়াটা খুব একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না। কিন্তু ততদিনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে মেয়েটি।

আরাশ ঘোরবানি; Source: telegraph.co.uk

আরাশ সাধারণত মেয়েটির বাড়িতে যেত না, বাড়ির আশেপাশেই কোথাও দেখা করতো তারা। নভেম্বরের ২০ তারিখে মেয়েটির সাথে দেখা করতে যায় সে। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার জন্য অপেক্ষা করছে মেয়েটির বাবা এবং ভাই। তারা জেনে ফেলেছিল তাদের মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা। কাজেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দেয় আরাশকে। ৪৬টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে আরাশের শরীরজুড়ে। আরাশের বাবা এই হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করে সেই মামলা চালাতে গিয়ে বাড়ি, অফিস, কম্পিউটার, এসি সব বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু এখনো কোনো বিচার পাননি। এমনকি খুনিরা তার কাছে মাফ পর্যন্ত চায়নি। তাদের ভাষ্যমতে, তারা যা করেছে পরিবারের সম্মান রাখতে গিয়েই করেছে। এর জন্য মাফ চাইতে হবে কেন? এটি তো তাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ।

আরাশদের পরিবারে ছুটির দিন বলে আর কিছু নেই। বাইরে গিয়ে খাওয়া, সিনেমা দেখা এসবের কথা তো তারা ভুলেই গেছে। বাঁচতে হবে বলেই কেবল তারা বেঁচে আছে। তাদের জীবন থেকে সুখের দিনগুলো ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, আর কখনো ফিরে আসবে না তা।

ফিচার ইমেজ – Times of India

Related Articles