অনুবাদকের কথা
এই প্রবন্ধটির মূল রচয়িতা ড. আলি উসমান কাশমি। প্রবন্ধটি প্রথম 1971 war: Witness to history শিরোনামে ছাপা হয়েছিল পাকিস্তানের ডন পত্রিকা হতে প্রকাশিত মাসিক রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ভিত্তিক ম্যাগাজিন হেরাল্ডে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হেরাল্ড ম্যাগাজিনের অনলাইন সংস্করণে প্রবন্ধটিতে কিছু হালনাগাদ তথ্য সংযোজন করা হয়। সেই হালনাগাদ সংস্করণ থেকেই প্রবন্ধটির অনুবাদ করা হয়েছে দুই পর্বে, আজ থাকছে যার প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখান থেকে।
ড. আলি উসমান কাশমি লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের ইতিহাস বিষয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক। ২০০৯ সালের মার্চে তিনি দক্ষিণ এশিয়ান ইতিহাস বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অফ হাইডেলবার্গ, জার্মানি থেকে পিএইচডি লাভ করেন। এছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের রয়্যাল হলোওয়ে কলেজে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের একজন নিউটন ফেলোও ছিলেন। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে লেকচার দিয়েছেন।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এই লেখার অনুবাদ? এই অনুবাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলাভাষী পাঠকদের সামনে একজন পাকিস্তানি ইতিহাসবিদের ভাষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা।
আমাদের অনেকেরই জানা আছে, সাধারণ পাকিস্তানিদের মনে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কী ধরনের ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে একে ভারতের ষড়যন্ত্র মনে করা, মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বাসঘাতক কিংবা ভারতের দালাল, ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তানের ভাঙন ইত্যাদি ধারণা এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে দেশটির মানুষের মাঝে।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পাকিস্তানের যে শিক্ষাবিদরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটনেরও চেষ্টা চালিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের কী মতামত? আমার বিশ্বাস, এই একই কৌতূহলের উদয় হয়েছে আরও অনেকের মনেই। এই প্রবন্ধটি সেই কৌতূহল কিছুটা হলেও মেটাতে পারে।
তবে একটি বিষয়ে শুরুতেই বলে রাখা দরকার: এই প্রবন্ধের সকল বক্তব্যের সাথে আপনারা একমত না-ও হতে পারেন। এমনকি আমি নিজেও এই প্রবন্ধের অনেকাংশের সাথেই একমত নই। প্রবন্ধের কিছু কিছু অংশ আমার মনেও প্রবল বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তারপরও, অনুবাদের সময়ে কোনোকিছুই আমি বাদ দিইনি। কেননা এই অনুবাদের উদ্দেশ্য কেবল আমি বা আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরা, যেসব বক্তব্যের সাথে একমত, সেগুলোই তুলে ধরা নয়; বরং পাকিস্তানের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবেন, সেটি জানার চেষ্টা করা।
পুরো প্রবন্ধটি পড়ার পর নিঃসন্দেহে আপনাদের মনোজগতে ছোটখাট ঝড় উঠবে, অনেক বিষয়ের সাথে আপনারা একমত হবেন, আবার যুক্তি দিয়ে অনেক বিষয়কে উড়িয়ে দিতেও সমর্থ হবেন। সোজা কথায়, স্বাস্থ্যকর আলোচনা-সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত থাকল। আর কথা না বাড়িয়ে, চলুন ঢুকে পড়া যাক মূল প্রবন্ধে। এরপর থেকে যা পড়বেন, সেগুলো সবই মূল রচয়িতা ড. আলি উসমান কাশমি।
একটি ঢাকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আপনাকে অভিভূত করতে পারে- শুধু তীব্র যানজট, দূষণ, মানুষের ভিড় আর স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার জন্যই নয়, এর ইতিহাসের জন্যও। একজন পাকিস্তানি হিসেবে আমি যখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিগলি ধরে হেঁটে যাই, এক ধরনের মনস্তাপ, অপরাধবোধ ও লজ্জা অনুভব করি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেসব শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের নাম, যারা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের কাছে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এছাড়া আরো কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শনেরও অবস্থান রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই, কিংবা অদূরে।
শহীদ মিনার হলো ভাষা শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ; যে শহীদেরা ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। দিনটি বাংলাদেশে পালিত হয় অমর একুশে হিসেবে, আর জাতিসংঘ একে গোটা বিশ্বব্যাপী উদযাপন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আবার বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৫০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি। এই দুটিই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলা একাডেমির বিপরীতে রয়েছে রমনা রেসকোর্স ময়দান (যেটি বর্তমানে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে)। এখানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। ভাষণটি তিনি শেষ করেছিলেন এই ভয়জাগানিয়া কথাগুলোর মাধ্যমে: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানও হয়েছিল এখানেই, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গা ঘেঁষেই রয়েছে আরেকটি স্থাপনা, যা বর্তমানে অধিকাংশ বাংলাদেশির কাছেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। সাধারণভাবে তিন নেতার মাজার নামে পরিচিত এই স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৬০ এর দশকে, যেখানে চিরশায়িত আছেন তিন বাঙালি রাজনীতিবিদ: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩), এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) এবং খাজা নাজিমুদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪)। সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দিন ১৯৫০ এর দশকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া ফজলুল হক ছিলেন ১৯৪০ সালের মার্চে লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম উত্থাপনকারী, পরবর্তীতে যেটির নামকরণ হয় পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে। এই মাজারটির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহের অভাব থেকেই প্রতিফলিত হয় ১৯৭১-পূর্ববর্তী ইতিহাসের ব্যাপারে বাংলাদেশিদের অনীহার বিষয়টি।
১৯৭১ সালের পর থেকে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যক্তিত্বদের সম্মানার্থে নামকরণ করা সবকিছুই অপসারিত করা হয়, নয়তো সেগুলোর নাম বদলে ফেলা হয়। এমনকি জিন্নাহকেও এখানে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয় না, কারণ তিনিই ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এক গণজমায়েতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে জিন্নাহ কলেজ হয়ে যায় তিতুমির কলেজ, আর জিন্নাহ এভিনিউয়ের নাম হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ (বঙ্গবন্ধু অর্থ ‘বাংলার বন্ধু’, যে খেতাবটি তাকে দেওয়া হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার ও বিচারের পর তিনি মুক্তি পেলে)। যে বিশাল এলাকাজুড়ে বর্তমানে রয়েছে অসংখ্য সরকারি দালানকোঠা – এমনকি জাতীয় সংসদও – সেটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬০ এর দশকে। আইয়ুব খানের নামানুসারে সেটির প্রকৃত নাম ছিল আইয়ুব নগর। ফজলুল হকের সম্মানে একে বর্তমানে ডাকা হয় শেরেবাংলা নগর।
এই পরিবর্তনগুলো সাক্ষ্য দেয় একধরনের নির্বাচিত ঐতিহাসিক বিবরণ প্রবণতার, যেখানে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ের অনেক ঘটনাকেই। কিন্তু এ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে কেন এবং কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠেছিল জরুরি ও অনিবার্য। এই পরিবর্তনগুলোর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ওই সময়কার রাজনৈতিক জীবনেরও সিংহভাগ অংশ। যেমন সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক, এবং, প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তানের আরো অনেক প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের মতো – তিনিও সবসময়ই একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, যেভাবে তিনি প্রদর্শিত হন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই দেশেই। ১৯৬০’র দশকে তার আওয়ামী লীগের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল পাকিস্তানের মূলধারার রাজনীতিতে, আইয়ুব খান বিরোধী জোটের অংশ হিসেবে। তিনি সোহরাওয়ার্দীর একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম দেড় দশকে, এবং ১৯৬৫ সালে ফাতিমা জিন্নাহর রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রচারণায়ও তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী। এমনকি তার বিখ্যাত ছয় দফা দাবিও প্রথম পেশ করা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে লাহোরেই, বিরোধী দলের আয়োজিত এক সভায়।
এটি তর্কসাপেক্ষ যে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন কেবল ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে, যখন এই অঞ্চলের রাজনীতির তিন স্তম্ভ – সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক ও নাজিমুদ্দিন – মারা গিয়েছিলেন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে, যা এখানকার রাজনীতিতে একটি বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল। তিনি (শেখ মুজিব) বেশ ভালোভাবেই সচেতন ছিলেন যে, তার একার পক্ষে, এই শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে। ১৯৫০ এর দশকে ইব্রাহিম হাই কোর্টের ঢাকা বেঞ্চের একজন বিচারক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন, এবং তারপর ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খানের অধীনে আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে লেখা তার দিনলিপির বেশ কিছু ভুক্তি থেকে জানা যায় যে শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বারবার তার দলের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
যদিও তিনি আইয়ুব খানের সামরিক সরকারে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু আদতে ইব্রাহিম ছিলেন একজন পুরোদস্তুর বাঙালি জাতীয়তাবাদী। আইয়ুব খান তাকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় তার কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছিলেন। ইব্রাহিম কেবিনেট মিটিংগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে হওয়া অবিচারগুলোর ব্যাপারে শুধু জোরালো প্রতিবাদই করতেন না, তিনি সেগুলোর বিভিন্ন সমাধানেরও পরামর্শ দিতেন। এমন একটি সমাধানের সাথে পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবির একটি দাবির বিশেষ সাদৃশ্য দেখা গিয়েছিল: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা তৈরি করতে হবে। প্রসঙ্গত ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’ নামে পরিচিত এই ধারণাটি প্রথম উৎসারিত হয়েছিল যখন পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদরা ঢাকায় সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রথম পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে। যেমনটি লিপিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ রওনক জাহানের ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বই Pakistan: Failure in National Integration-এ, বাঙালি অর্থনীতিবিদরা পূর্ব পাকিস্তানের অনুন্নয়নের ঐতিহাসিক শেকড় সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, এবং তারা তাদের অঞ্চলের দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার জন্য কখনোই কেন্দ্রীয় সরকারকে এককভাবে দোষারোপ করেননি। তারা শুধু দাবি জানিয়েছিলেন যেন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়, যেন তাদের অর্থনৈতিক একককে পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে বিশেষ ও স্বকীয়ভাবে দেখা হয়। কিন্তু তাদের এ দাবিতে কখনো কর্ণপাতই করা হয়নি।
ইব্রাহিম এই উদাসীনতার পেছনে পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্রকে দায়ী করেছিলেন, এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পাঞ্জাবি আমলাদের একগুঁয়েমি ও লোলুপতার কারণেই ভেঙে যাবে পাকিস্তান। তিনি তার ডায়রিতে লিখেছিলেন, “পাঞ্জাবিরা পাকিস্তানকে শাসন করতে চায়, এবং তারা মনে করে তাদের সে অধিকার আছে।” এছাড়া আরেক জায়গায় তিনি স্মৃতিচারণ করেন ১৯৪৭ সালে তাঁ এক বন্ধুকে বলা কথার, “পাঞ্জাবিরা হলো পাকিস্তানের ঝোপার কুড়াল (একধরনের কুঠার যা ব্যবহৃত হয় বাঁশঝাড় কাটতে)।” তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হলো, পাকিস্তানিরা নতুন প্রতিষ্ঠিত এ দেশের শেকড় কেটে দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে গিয়ে আমি কথা প্রসঙ্গে চৌধুরী রহমত আলীর নাম উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তারা তাকে চেনে না। আমি যখন শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা আলীর ব্যাপারে জানে কি না, তারা সকলেই বলেছিল তারা জানে না। এ থেকেই অনেক কিছু বোঝা যায় যে ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, সেখানে ১৯৪৭-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে আমলেই নেওয়া হয় না। এ থেকে আরো ব্যাখ্যা করা যায় কেন আলীর মতো মানুষেরা বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হন না, যদিও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা চাইলেই তার উদাহরণ ব্যবহার করতে পারত তাদের স্বাধীন দেশের দাবিকে শক্তিশালী করার জন্য। হাজার হোক, তার প্রণীত ‘পাকিস্তান’ শব্দটিতে বাংলার কোনো উল্লেখই ছিল না। একইভাবে, পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ না থাকায়, বাংলাদেশি ইতিহাসবিদরা কদাচিৎ লক্ষ্য করেন যে লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষের মুসলিমদের জন্য একটি নয়, একাধিক রাষ্ট্রের দাবি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক এবং জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিবরণগুলো সেই ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে বাঙালিদের একটি নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টির ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিপাত করতে চায় না। এবং সেগুলো স্বীকার করতে চায় না ১৯৪০’র দশকের পাকিস্তান আন্দোলনের অবদানগুলোকেও। এ কারণেই বাংলাদেশে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যে দেশটির মানুষেরা বাঙালি নাকি বাংলাদেশি।
এদিকে পাকিস্তানিদের মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানার ও বোঝার দুর্বলতা রয়েছে। তারা কেবলই দেশটিকে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের ফলাফল হিসেবে মনে করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতেই যে বাঙালি পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য গড়ে উঠেছিল, এবং ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এই বিষয়টি মাথার উপর দিয়ে যায় সকলের। এর কারণ, পাকিস্তানে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক বই পাওয়া খুবই দুরূহ। প্রকাশকরা কেবল ওই সমস্ত বই-ই পুনর্মুদ্রণ ও অনুবাদে আগ্রহ দেখান, যেগুলোতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ বিষয়ে পাকিস্তানি মতবাদকে সমর্থন করা হয়েছে। সেসব বই তারা এড়িয়ে যান, যেখানে সামগ্রিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ওই বছরটির দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছে।
এ বিষয়ে একটি পরিপূর্ণ চিত্র লাভের জন্য ফিরে দেখা দরকার সুফিয়া আহমেদের Muslim Community in Bengal, 1884-1912 এবং রাফিউদ্দিন আহমেদের The Bengal Muslims, 1871-1906 বইগুলো। এই লেখকেরা উনবিংশ শতকের শেষের দিকের ইতিহাসগুলো নানা আঙ্গিকে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন, যখন বাংলায় মুসলিমদের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচিতি গড়ে উঠছিল। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত সেরা দুটি বই হলো নীলেশ বসুর Recasting the Region: Language, Culture and Islam in Colonial Bengal এবং তাজ উল-ইসলাম হাশমির Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal, 1920-1947, যেখানে এই বিষয়টিতে আলোকপাত করা হয়েছে। বসু একাধারে যেমন ইতিপূর্বের কাজগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ ছেঁকে আনতে পেরেছেন, তেমনই অনেক নতুন তথ্যেরও সন্নিবেশন ঘটিয়েছেন রাজনৈতিক নথিপত্র ও সাংস্কৃতিক উপাদান থেকে। এর মাধ্যমে তিনি একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন বাঙালি মুসলিম পরিচিতি এবং বাংলায় পাকিস্তান ধারণাটির জনপ্রিয়তার মধ্যে। তার মতে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত পশ্চাদভূমি – যেগুলো একাধারে ছিল অনুন্নত, এবং কলকাতার বাঙালি হিন্দু বাবুদের আধিপত্যে মলীন – সেখানে পাকিস্তান ছিল বাঙালি চাষাভুষাদের জন্য এক তথাকথিত কল্পরাজ্য।
কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে যাবতীয় চাঞ্চল্য ও আনন্দ যতটা দ্রুততার সাথে ঘনীভূত হয়েছিল, ঠিক ততটা অবিলম্বেই যেন এটি এক ফুঁৎকারে উড়েও গিয়েছিল। পাকিস্তান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভঙ্গ ও নৈরাশ্য পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছিল ১৯৪৭ সালের অব্যবহিত পরেই, যেমনটি দৃশ্যায়িত হয়েছে আহমেদ কামাল রচিত State Against the Nation: Decline of the Muslim League in Pre-Independence Bangladesh বইটিতে। কামাল তার বইয়ে দাবি করেন যে, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছিল, সেটিই গড়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের চূড়ান্ত নিয়তি। অর্থাৎ পাকিস্তান ভাগের জন্য ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনকে কৃতিত্ব বা দোষ দেওয়া হলেও, আদতে এর সূচনা হয়েছিল অনেক আগের এক নির্বাচনেই। ১৯৫৪ সালের সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ চরম হারের সম্মুখীন হয়। সমাবেশের মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে তারা এক ডজনেরও কম আসনে জয়লাভ করেছিল। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানের আর সকল দল নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল ২২৩টি আসনে। কিন্তু তারপরও, যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতায় বসার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেটিকে নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মাঝে ফাটল ধরানোরও চেষ্টা করে, যাতে প্রাদেশিক সমাবেশেও ক্রমাগত এর শক্তিক্ষয় হতে থাকে।
একটি ঐতিহাসিক বিবরণ, যেখানে এই সকল জটিল বিষয়গুলোর উপরই আলো ফেলা হবে, সেটি বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণকে সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। কোনো সন্দেহ নেই যে ১৯৭১ সাল সবসময়ই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হয়ে থাকবে। কিন্তু শুধু এই একটি বছর দিয়েই সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে বাঙালি মুসলিমের পরিচিতি ও তার উদ্ভবের বিষয়টি বোঝা সম্ভব হবে না। এই পরিচিতির বিবর্তনই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদেরকে ঠেলে দিয়েছিল একটি নিজস্ব দেশের দাবির দিকে; এবং শেষ পর্যন্ত সেটি তারা লাভও করেছিল, যা ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা — শুরুতে অবিভক্ত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে, এবং ১৯৭১ সাল থেকে, তাদের সম্পূর্ণ নিজেদের একটি দেশ হিসেবে।
অন্য সকল জাতি-রাষ্ট্রের মতো, বাংলাদেশও সংগ্রাম করছে তাদের একটি একক জাতীয় ঐতিহাসিক বিবরণ সৃষ্টি করতে, এবং মানুষকে সেটি বিশ্বাস করাতে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে, যেখানে জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য খুবই কম – যদিও বা থাকে – সেখানেও পরিচিতি গঠনের প্রক্রিয়াটি বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় কেন, একটি রাষ্ট্র যা গঠিত হয়েছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকারের উপর ভিত্তি করে, সেখানেও চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে বাসরত আদিবাসিরা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, কারণ সেখানে দেশের সকল নাগরিককে আখ্যায়িত করা হয়েছে বাঙালি হিসেবে। শিক্ষাবিদ জাহান তার বই , Bangladesh: Promise and Performance এর সম্পাদিত সংস্করণে তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারী মানবেন্দ্রনাথ লারমার কথা, যিনি দাবি করেছিলেন নব্যসৃষ্ট রাষ্ট্রের মানুষকে যেন বাঙালির বদলে বাংলাদেশি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
কিন্তু এই পরামর্শ সমস্যাটির মাত্র অর্ধেক সমাধান দেখাতে পেরেছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার পরিবর্তে, বাংলাদেশি হওয়াটা, অবাঙালি নাগরিকদেরকে জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্ত অনুভব করাতে পেরেছে। কিন্তু একইসাথে এটি বাংলাদেশি বাঙালি – যারা অধিকাংশই মুসলিম – এবং ভারতীয় বাঙালি – যারা অধিকাংশই হিন্দু – এই দুই শ্রেণীর মধ্যে কার্যত একটি ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই পার্থক্য বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, যেটির মূল সংস্করণে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সংবিধানটি বারবার পুনঃলিখিত হয়, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বদলি হিসেবে আনা হয় “মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস”। তারপরও বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতির সন্ধান অব্যাহত রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের সাথে আপোষ না করেই বাঙালি মূলের উপর জোর দেয়া হবে।
এই অনুসন্ধানের পথে একটি আগ্রহোদ্দীপক প্রকাশ হলো বাংলাদেশে উর্দু শব্দের ব্যবহার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন তিনি, যেটি শেষ করেছিলেন দুটি স্লোগান দিয়ে: ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় পাকিস্তান’। অপরদিকে, খান লুৎফর রহমান তার Nation Building Problems in Bangladesh: A Socio-Economic-Political Perspective বইয়ে জানান, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রায় সপরিবারে নিহত হন, তখন সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিষ্ঠিত ‘পাপেট প্রেসিডেন্ট’ খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার বেতার বার্তা শেষ করেছিলেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে।
‘জিন্দাবাদ’ শব্দটির ব্যবহার পরিষ্কারভাবেই ছিল পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে একটি ইতিবাচক সংকেত প্রেরণ, খুব শীঘ্রই যেটির কৃতজ্ঞতা পরিশোধ করেছিল পাকিস্তান দুর্ভিক্ষ-পীড়িত বাংলাদেশে খাদ্যশস্য প্রেরণের মাধ্যমে। এই দুর্ভিক্ষ ছিল একটি মানবিক সঙ্কট, যা শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বগ্রাসী শাসনের ব্যাপারে জনতার অসন্তোষ তৈরিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অবশ্য এর মানে এই নয় যে সেই থেকে উর্দু বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে। তারপরও, ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটির ব্যবহার ইঙ্গিত দিয়েছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে একটি ব্যাপক নীতিগত পট পরিবর্তনের। এছাড়া এর বড় প্রভাব ছিল নিজ দেশের, এবং পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেও — ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ভারতের থেকে দূরে সরে আসা, এবং ধর্ম ও পাকিস্তানের দিকে ঝোঁকা।
সম্পাদকের বক্তব্য: এই লেখাটি একজন ইতিহাসবিদের একটি প্রবন্ধের অনুবাদ, রোর বাংলা কিংবা অনুবাদকের বক্তব্য নয়।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস
২) বাংলাদেশ অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড
৩) মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম