১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয়মাস ব্যাপী সংগঠিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এদেশের দামাল যোদ্ধারা যখন বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরে এলেন, তখন তাদের আমরা বরণ করে নিয়েছিলাম ফুলেল সংবর্ধনা ও ভালবাসায়। তাদের বীর উপাধি দেয়া হয়েছিল, সম্মান দেয়া হয়েছিল, সমাজেও তারা অর্জন করেছিলেন বিশেষ স্থান। কিন্তু ঘরে ফেরা যোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে ঘরে তুলে নেয়া হলেও এই সে যুদ্ধে যে দুই লাখ মা-বোন হারিয়েছিলেন তাদের সম্ভ্রম, হারিয়েছিলেন সর্বস্ব- তাদের এ সমাজ কোনো সম্মানই দেয়নি। বরং তাদের বর্জন করা হয়েছিল সমস্ত সামাজিক আচার অনুষ্ঠান থেকে, আড়ালে রাখা হয়েছিল সমস্ত ভাল কাজ থেকে।
তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে যেটা দেয়া হয়েছিল তার নাম অপবাদ, তার নাম লজ্জা। দেশের জন্য সর্বস্ব হারানো এই নারীদের চারপাশের পরিস্থিতি তখন এতটাই ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছিল যে, তারা যেন হায়নার ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছাড়া পেয়ে আরেক ক্যান্টনমেন্টে এসে পড়েছিল। কেননা, এতদিন শত্রু ও ভয় হিসেবে অচেনা মানুষগুলো থাকলেও এবার যেন চেনা মুখগুলোই অচেনা মানুষগুলোর চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। ১৬ ডিসেম্বর সবার যুদ্ধ যখন শেষ, এই মানুষগুলোর জন্য তখন আরেকটি যুদ্ধ শুরু হলো। সেই যুদ্ধে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো চেনা মানুষগুলো, আত্মীয়স্বজন, এমনকি নিজের পরিবার। সেই যুদ্ধে কেউ ঘর হারালো, কেউ স্বাভাবিক জীবন হারালো, আর কেউ কেউ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে আত্মাহুতি দিল।
আর যারা বেঁচে রইলো তাদের এই অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে শেষদিন পর্যন্ত। তারা ভুলেও কখনো একটিবার গর্ব করে বলতে পারেননি- ঐ পতাকা শুধু বীরের না, তাদের মতো দুই লাখ বীরাঙ্গনারও ত্যাগের ফসল। সর্বহারা এই নারীদের দলে ছিলেন এক স্বাধীনচেতা নারী, যিনি কৈশোরে ব্যক্তি স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটায় ত্যাগ করেছিলেন বাবার ঘর। দীর্ঘ ত্রিশ বছর সম্ভ্রম হারানোর লজ্জায় কুকড়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, নিজেকে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত ভেবে দিন পার করতে করতে একদিন এই নারীর ভেতর আবার জেগে উঠলো পনেরো বছরের সেই স্বাধীনচেতা সত্ত্বাটি। তবে এবার আর ঘর পালাতে নয়, সবাইকে জানিয়ে দিতে যে এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব তারও ত্যাগের ফসল। আর তার এই গল্প শুধু তার নিজের গল্প না, তাদের এই গল্প এই দেশের গল্প, এদেশের দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগের গল্প।
তবে এর ফলাফল যে খুব একটা সহজ হবে না তা তিনি জানতেন। তিনি এটাও জানতেন, এর ফলে হারাতে হতে পারে আবার নতুন করে সবকিছু। এমনকি সেই হারানোর তালিকায় থাকতে পারে নিজের পারিবারও। তবুও পিছপা হলেন না তিনি। কেননা তিনি অনুভব করেছিলেন এদেশের জাতীয় পতাকা যোদ্ধাদের রক্তের পাশাপাশি যে বীরঙ্গনাদেরও সম্ভ্রমের ফসল তা সবার জানা উচিত। সেই লক্ষ্যেই দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে তিনি জাতির সামনে তুলে ধরলেন তার সম্ভ্রম হারানোর গল্প, তার ওপর পাকসেনাদের চালানো অবর্ণনীয় নির্যাতনের কথা। হয়তো ভাবছেন- কে সেই সাহসী নারী? কে সেই বীরঙ্গনা? গলায় বাহারী মালা, কপালে লাল সবুজের পতাকা অংকিত টিপ পরিহিত সেই নারীর নাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় তার নানার বাড়িতে। তার বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক ছিলেন খুলনার দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক এবং মা রওশন হাসিনা ছিলেন একজন প্রগতিশীল নারী। প্রিয়ভাষিণীর বাবা মায়ের জীবন কিছুটা এলোমেলো থাকায় জন্মের পর থেকে তিনি মায়ের সাথে নানার বাড়িতেই থাকতেন। তার নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রগতিশীল ও শিল্পানুরাগী মানুষ।
প্রিয়ভাষিণীর এই শৈল্পিক নামটিও এই ভদ্রলোকই রেখেছিলেন। নানাবাড়িতে এক শৈল্পিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। ফেইরি কুইন নামের সে বাড়ির সবাই কোনো না কোনোভাবে শিল্পের কোনো না কোনো শাখার সাথে জড়িত ছিলেন। প্রিয়ভাষিণীর নানার সংস্কৃতিমনা এই পরিবারটির বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয়, বাড়িটির এক ঘরে ক্যারাম খেলা চলতো তো আরেক ঘরে চলতো লেখালেখি, আবার আরেক ঘরে আবৃত্তি চলতো তো অন্য ঘরে বসতো গানের আসর। এমন একটি সবুজ শ্যামল পরিবারের শৈল্পিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে উঠতে তার ভেতরেও বেড়ে উঠতে থাকে শিল্পসত্ত্বা। পরবর্তী জীবনে ভাষ্কর হয়ে ওঠা হয়তো সেই সত্ত্বারই পরিপক্ক রুপ।
৫ বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণী নানার পরিবারের সাথে খুলনার ফেইরি কুইন নামের বাড়িটি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। সেসময় বালিকা প্রিয়ভাষিণীকে ভর্তি করা হয় টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির স্কুলে। এই নারী শিক্ষা মন্দির থেকেই তার শিক্ষাজীবন শুরু। তবে বেশিদিন তিনি থাকেননি সেখানে। দু’বছর পর ১৯৫৪ সলে প্রিয়ভাষিণীর নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ যুক্তফ্রন্টের শাসনামলে স্পিকার নিযুক্ত হলে নানার পরিবারের সাথে প্রিয়ভাষিণীর ঠাঁই হয় মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। এখানে আসার পর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে ভর্তি করানো হয় সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। নানাবাড়িতে থাকাকালীন সময় তিনি বহু গুণী মানুষের সহচর্য পান। এদের মধ্যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অন্যতম। মিন্টো রোডে তার নানার বাড়ির ঠিক তিন বাড়ি পরেই থাকতেন শেরে বাংলা। সেই সুবাদে খালাদের আঁচল ধরে বালিকা প্রিয়ভাষিণী মাঝে মাঝেই যেতেন শেরে বাংলার বাড়িতে।
কিন্তু প্রিয়ভাষিণীর প্রিয় জায়গা নানাবাড়িতে বেশি দিন আর থাকা হয়নি তার। ৯ বছর বয়সে তাকে তার বাবা খুলনায় নিজের কাছে নিয়ে আসেন। খুলনায় এসে প্রিয়ভাষিণী প্রথমে বীণাপনি পাঠশালায় ভর্তি হলেও পরে সেখান থেকে খুলনা পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এই পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে তিনি এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইসএসসি ও পরে স্নাতক সম্পন্ন করেন। নানার বাড়িতে স্বাধীন ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে মুক্ত হরিণীর মতো ছুটে চলা প্রিয়ভাষিণী বাবার কাছে এসে বিবিধ শাসন ও নিয়ম-কানুনের বেড়াজালের সম্মুখীন হন। ততদিনে কেটে গিয়েছে কয়েকটি বছর। প্রিয়ভাষিণী তখন কিশোরী। তার ভেতরের স্বাধীনচেতা সত্ত্বাটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে। আর যেন বাবার কড়াকড়ি মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি।
কথায় আছে, অতি শাসনে সন্তান নষ্ট হয়, শাসনের বেড়ি ভাঙতে গিয়ে নিয়ে ফেলে ভুল সিদ্ধান্ত। প্রিয়ভাষিণীর ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে। পরিবারের কড়াকড়ি থেকে মুক্তি পেতে মাত্র ১৫ বছর ৬ মাস বয়সে একদিন প্রেমিককে বিয়ে করে বসেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল প্রিয়ভাষিণীর। কেননা তিনি ধরেছিলেন ভুল মানুষের হাত, যে মানুষটি কিশোরী প্রিয়ভাষিণীকে ভালবাসার বদলে দিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। তাছাড়া সংসারের অভাব অনটনও তখন নিত্য সঙ্গী ছিল তার। এসময় তিনি স্কুলের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন পাটকলে। জীবন সংগ্রামের এই বৈতরণী পার হতে গিয়ে একসময় বারবার মনে হয়েছে বড় ভুল করেছেন তিনি। কিন্তু ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না তখন।
কেননা ততদিনে তার ঘরে এসেছে ঐ ভুল মানুষটির ঔরসজাত তিন-তিনটি সন্তান। ভুল মানুষটির প্রতি ভালবাসা না থাকলেও ভালবাসার পুরোটা জুড়ে তখন তার সন্তানেরা। কী করে ভেঙে ফেলবেন তিনি এমন বাসা? তাই মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন ফেরদৌসী। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়ে ওঠে না। অবশেষে ১৯৭১ সালে ভেঙে যায় তার সংসার।
স্বামীর সাথে সংসার ভেঙে যাওয়ার পর প্রিয়ভাষিণী ভাবলেন, এবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন। নিজ হাতে জীবনকে তিনি সাজাবেন, গোছাবেন ও রাঙিয়ে তুলবেন। কিন্তু হায়, ভাগ্য যেন এবারও প্রতিকূলে ছিল তার। একবার জীবন সাজাতে ধরেছিলেন ভুল মানুষের হাত, আর এবার যখন জীবন সাজাবেন বলে স্থির করলেন তখন জাতির জীবন টালমাটাল! বাতাসে লাশ ও বারুদের গন্ধ মাখামাখি, বিপন্ন মানবতা, অধিকার আদায়ের দাবীতে গর্জে উঠেছে বাঙ্গালী।
ফেরদৌসীর পরিবারের সবাই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার ভাইয়েরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন আর তাদের বাড়িতে তার মায়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। যোদ্ধাদের খাদ্য, ওষুধ সবই সরবরাহ করা হতো সেখানে। আর এই যুদ্ধই প্রিয়ভাষিণীর জীবনে নিয়ে আসে এক অবর্ণনীয় বিভীষিকা।
এটি ছিল অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। একদিন রাত তিনটার সময় হঠাৎই তার দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত মেয়েটি এসে তাকে জানায়, পাকবাহিনী তার বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। প্রথমে তিনি আমলে নেননি কথাটি। কেননা তখন ওরকম গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামা এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিনই খান সেনারা কাউকে না কাউকে এভাবে তুলে নিয়ে যেত। কিন্তু মেয়েটি জানালো, ওরা তার বাড়িটিই ঘিরে ধরেছে এবং সম্ভবত তাকেই চিৎকার করে নামতে বলছে।
এবার যেন একটু নড়ে বসলেন তিনি। সাথে সাথে বারান্দায় গিয়ে দেখলেন বাড়ির সামনে ছয়টা গাড়ি, নেমে আসছে খানসেনারা। বুঝলেন, টার্গেট এবার তিনিই। তাকে দেখা মাত্রই ওরা বলে উঠলো, “আমরা ফেরদৌসীকে চাই, ফেরদৌসী উপর থেকে নামো।” সাক্ষাত যম যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন নিস্তার পেতে মানুষ কত বুদ্ধিই না খাটায়। ফেরদৌসীও তেমন পাক হায়েনাদের হাত থেকে নিস্তার পেতে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলে বসলেন, “ফেরদৌসী এখানে নেই, সে খুলনা গিয়েছে।” কিন্তু লাভ হলো না কোনো। কেননা ওদের সাথে থাকা স্থানীয় দুজন পাঞ্জাবী প্রিয়ভাষিণীকে আগে থেকেই চিনতো। সেই রাতে প্রিয়ভাষিণী কাজের মেয়েটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসার কথা বলে একদিন সময় নেন।
পরের দিন ওরা আবার আসে। ধর্মের নামে যুদ্ধে নামা অমানুষগুলোর অধিকাংশই সেদিন ছিল মদ্যপ। প্রিয়ভাষিণী নিজের পোশাক পরিবর্তন করার সময় চাইলে তারা তো দেয়ই না, বরং কু-ইঙ্গিত করে বলে, “আমরা তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দেবো।” পাকবাহিনীর দুই দোসর হত্যার মিথ্যা অভিযোগে ওরা নিয়ে চলে প্রিয়ভাষিণীকে। গাড়িতেই সেদিন পাকবাহিনীর হাতে গণধর্ষণের স্বীকার হলেন তিনি। প্রিয়ভাষিণীর আর্তনাদে সেদিন ওদের মন গলেনি। খানসেনাদের অকথ্য গালাগালি ও পাশবিক নির্যাতন আর প্রিয়ভাষিণীর আর্তচিৎকার একসাথে বয়ে নিয়ে ক্যাম্প অভিমুখে ছুটতে থাকে জলপাই রঙের জীপটি।
ক্যাম্পে নিয়ে তাকে বাঁশের বেড়ার এক খুপরি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। হায়েনার ক্যাম্পে গিয়ে প্রিয়ভাষিণী অবলোকন করেন পাকবাহিনীর অমানুষিক বীভৎসতা। সেখানে অসংখ্য নারীকে তিনি দেখতে পান। তাদের কেউ ছিল অর্ধনগ্ন, কেউ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অসংলগ্ন আচরণও করছিল। প্রিয়ভাষিণী বুঝতে পারেন হায়েনাদের পাশবিক অত্যাচারের ফসল এটা। নির্যাতনের ফলে মেয়েগুলো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ক্যাম্পের এমন ভয়ার্ত পরিবেশ প্রিয়ভাষিণীকে ভয়ে কুকড়ে দেয়। তিনি এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে ছোটবেলায় মায়ের থেকে কারো নিকট মাথা নত করতে না শেখা প্রিয়ভাষিণী যাকে-তাকে পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে যেতে দাও।” তার অবস্থা তখন এতটাই অসহায় ছিল যে পাকবাহিনীর এক আফিসার তাকে দেখে মর্মাহত হয়ে পড়ে। পরে ঐ আর্মি অফিসারের সহায়তায় তিনি সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন।
কিন্তু পালিয়েও কি নিস্তার পেয়েছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী? না, পাননি। পালিয়ে তিনি হায়েনাদের কবল থেকে বাঁচলেও সম্ভ্রম হারানোর যন্ত্রণা নিয়মিত তাড়া করে ফিরছিল ভাষিণীকে। তিনি এতটাই বিষাদগ্রস্থ ছিলেন যে তখন আয়নায় নিজের মুখ দেখতেও ভয় পেতেন।
ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাইরে এসে তিনি যে দৃশ্য অবলোকন করলেন তা ছিল আরো ভয়াবহ। তার মনে হলো সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। সবাই এমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে যে, সেই চাহনিতে পরিষ্কারভাবে উঁকি দিচ্ছে অচ্ছুৎ, কুলটা, বোঝা জাতীয় বিশেষণগুলো। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে চলে গিয়েছিল যে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর কোথাও কোনো জায়গাই যেন তার জন্য না। এমনকি নিজের বাড়িও যেন তখন তার নিকট অপরিচিত স্থান। তার বাড়ির প্রগতিশীল চর্চাকারী সদস্যরাও কেমন যেন নড়ে উঠেছিলেন তাকে দেখে। তাদের মাঝেও কেমন যেন অনীহা কাজ করছিল তার প্রতি। সম্ভ্রম হারানোর গ্লানি তাড়া করে বেড়ানো ফেরদৌসী পরিবারের সদস্যদের এমন আচরণে আরো কুকড়ে যান। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো মানসিক শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেন। তার মনে হতে থাকে এক ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি যেন আরেক ক্যান্টনমেন্টে এসে পড়েছেন।
সবার কাছে এমন পরিত্যক্তা হয়ে যখন মৃতের মতো জীবনযাপন করছিলেন, ঠিক তখন তার কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে, তাকে মানুষের মতো ভালবাসতে পাশে এসে দাঁড়ান এক মহামানব। তিনি প্রিয়ভাষিণীর দ্বিতীয় স্বামী। নাম আহসান উল্লাহ। আর কেউ সেদিন প্রিয়ভাষিণীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দিলেও রণাঙ্গনের এই বীর যোদ্ধা তার সবটুকুই দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে আহসান উল্লাহর সাথে বিয়ে হয় প্রিয়ভাষিণীর। তিনি পাশে এসে দাঁড়ানোয় প্রিয়ভাষিণী অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও চারপাশের পরিস্থিতি আগের মতোই ঘোলাটে থেকে যায়।
এভাবে নিগৃহীত হয়ে তিনি যখন জীবনধারণ করছিলেন, সমাজ সংসারের অবজ্ঞা, দৈনন্দিন জীবনের অভাব অনটন যখন জেঁকে বসেছিল, সেসময় ব্যবহার অনুপযোগী পরিত্যক্ত জিনিসগুলো দেখে সমাজ পরিত্যক্তা প্রিয়ভাষিণীর ওদের নিজের মতোই পরিত্যক্ত মানুষ মনে হয়। তাই মানুষ ছেড়ে এদের সাথেই ভাব জমাতে শুরু করেন তিনি। পরিত্যক্ত ডালপালাসহ ব্যবহারের অযোগ্য, ফেলে দেয়া জিনিসপত্রকে তিনি দিতে থাকেন শৈল্পিক রুপ। সেগুলো দিয়ে বানাতে থাকেন ভাস্কর্য। কথায় আছে, দুঃখ থেকে শিল্পের জন্ম, কষ্ট থেকেই শিল্প উঁকি দেয়। প্রিয়ভাষিণীর বেলায়ও যেন তা-ই হয়। আর এভাবেই বীরাঙ্গনা প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর সত্ত্বার আবির্ভাব ঘটে ১৯৮৪ সালে।
প্রথমদিকে নিজের এই প্রতিভাকে অত গুরুত্ব সহকারে নেননি তিনি। নিতান্তই সময় কাটানো ও ভাল লাগা থেকেই তিনি বানাতেন এগুলো। কিন্তু পরবর্তীতে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের অনুপ্রেরণায় তিনি তার প্রতিভার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। এসএম সুলতানের সাহায্যেই ১৯৯৪ সালে বেঙ্গলে তার ভাস্কর্যের প্রথম প্রদর্শনী হয়। দেশে-বিদেশেও তার শিল্পকর্মগুলো সমাদৃত হওয়া শুরু করে। আর সমাজ সংসারের দেয়া অপবাদ ও বিগ্রহের অভিজ্ঞতাকে পুজি করে প্রিয়াভাষিণী হয়ে ওঠেন ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী। তার শিল্পে উঠে আসে দ্রোহ, যাপিত জীবনের আনন্দ, বেদনা ও ভালবাসা। তিনি দেশে-বিদেশে সমাদৃত হতে থাকেন একজন ভাস্কর হিসেবে। তার শিল্পকর্মের একে একে এগারোটি একক প্রদর্শনীসহ বেশ কিছু যৌথ প্রদর্শনী হয়। তিনি পান সম্মানের জায়গা, পান শ্রদ্ধার জায়গা।
কিন্তু প্রিয়ভাষিণী তবু যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। তার বারবার মনে হত, যুদ্ধে যে নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে সেই লজ্জা তো সেই নারীর নয়, সেই অপরাধ তো সেই নারীর নয়। তবে কেন তাকে অপরাধী হতে হবে? তাকে কেন থাকতে হবে পরিত্যক্তা হয়ে? এসব ভাবতে ভাবতে আর যেন পারছিলেন না। একসময় সিদ্ধান্ত নেন জনসম্মুখে তিনি তার এই সব হারানোর কথা প্রকাশ করবেন, ত্যাগের কথা তুলে ধরবেন। কিন্তু এতে সমূহ বিপদের আশংকা ছিল। ভয় ছিল আবার নতুন করে সর্বহারা হওয়ার। এমনকি নিজের সন্তান-সন্ততিরও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু সর্বহারা প্রিয়ভাষিণী হারাতে হারাতে হারানোর ভয়টাকে আর প্রশয় দেননি। অবশেষে দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর জনসম্মুখে ‘৭১ এর প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে প্রিয়ভাষিণী প্রকাশ করেন তার ওপর পাকবাহিনীর চালানো পাশবিক নির্যাতনের ইতিহাস, ঐ পতাকার জন্য তার সর্বস্ব ত্যাগের গল্প। আর এভাবেই প্রজন্ম পায় এক সাহসী মাকে, যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘পতাকার জন্য দুই লাখ নারীর ত্যাগ ঐ নারীর অপমান নয়’।
আজন্ম দেশপ্রেমিক প্রিয়ভাষিণী যেন এক আজন্ম যোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ নয় মাস হলেও তার যুদ্ধ ছিল যেন আমরণ। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত অবধি তিনি সরব ছিলেন দেশবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষীও দিয়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে এদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তিনি তখন ছিলেন সেই দাবীতে জ্বলে ওঠা শাহবাগ প্রজন্ম চত্তরের একনিষ্ঠ সৈনিক। এ কারণে তাকে বেশ বৈরী আবহাওয়াতেই জীবন কাটাতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো নিয়মিত পেছনে লেগে থেকেছে তার। কখনো রটিয়েছে কুৎসা, আবার কখনো দিয়েছে প্রাণনাশের হুমকি। কিন্তু ভয়ভীতি দেখিয়ে কি আর দুই লাখ বীরাঙ্গনার প্রতিনিধিত্ব করা প্রিয়ভাষিণীকে দমিয়ে রাখা যায়?
নিয়মিত তিনি তার শিল্পকর্ম ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশপ্রেমে নিমজ্জিত থেকেছেন এবং সোচ্চার থেকেছেন দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে। প্রেরণা জুগিয়েছেন নতুন প্রজন্মকে। এভাবেই একজন খাদে পড়া প্রিয়ভাষিণী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আপন আলোয় গড়েছেন নিজ পথ আর সেই পথে পথ খুঁজে পেয়েছে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম।
ব্যক্তিজীবনে এই ভাস্কর তার শিল্পকর্মের কারণে দেশ-বিদেশে যেমন সমাদৃত হয়েছেন, তেমনি পুরষ্কারও পেয়েছেন অসংখ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্বাধীনতা পদক, চাঁদের মাঠ পদক, অনন্যশীর্ষ পদক, মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড, ওয়াইডব্লিউসিএ কর্তৃক সিলভার জুবলি অ্যাওয়ার্ড এবং রিডার্স ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রদত্ত হিরো উপাধি।
তবে উপরোক্ত পুরষ্কারগুলোর কোনোটাই তাকে সার্বভৌমত্বের জন্য সম্ভ্রম ত্যাগের কারণে দেয়া হয়নি। ওগুলো পেয়েছিলেন তিনি তার শিল্পকর্মের জন্য। অবশেষে দীর্ঘ ৪১ বছর পর ২০১৬ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য প্রিয়ভাষিণীকে দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
ব্যক্তিজীবনে প্রিয়ভাষিণী ছিলেন আজন্ম সংগ্রামী এক নারী। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তিজীবনে ৬ সন্তানের জননী এই নারী নিজে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। আজ থেকে এক বছর আগে এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে, যেখান থেকে আর কেউ কখনও ফেরে না। তার চলে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা হারিয়েছি একজন মাকে, একজন দেশপ্রেমিক আজন্ম যোদ্ধাকে।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী রচিত ‘নিন্দিত নন্দন’ বইটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে