শাহজাদপুরের খামারি শহীদুল ইসলাম ও হাওয়া বেগম। মাত্র কয়েকবছর আগেও তাদের খামারের ছিল দীনহীন দশা। যথাযথ জ্ঞানের অভাব, আর সেই সাথে অব্যবস্থাপনা, এই দুইয়ের কারণে খামারের গাভীগুলো পেত না সুষ্ঠু পরিচর্যা। গাভীদের রোগভোগ ছিল বেশি, দুধ দেওয়ার মাত্রা ছিল কম। দুধের উপযুক্ত দামও সবসময় পেতেন না শহীদুল আর হাওয়া।
২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে প্রাণ ডেইরী প্রতিষ্ঠার পর আমূল বদলে যায় তাদের সেই দুধের খামারের চিত্র। প্রাণ ডেইরীর পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সিরাজগঞ্জের খামারিদের। খামার তৈরি, পশুর পরিচর্যা আর অধিক উৎপাদনের জন্য কী কী করণীয় তা হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয় তাদের। খামারিদের নিজস্ব কাজের ধারণা পাল্টে যায় এর ফলে। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে ভালো ফলনও পেতে থাকেন তারা। আর এলাকায় প্রাণ ডেইরীর বিক্রয়কেন্দ্র হওয়ায় দাম যাচাই করেই নিয়মিত বিক্রি করতে পারেন তাদের খামারের দুধ।
এই চিত্র শুধু শাহজাদপুরের নয়। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি, পাবনার চাটমোহর, নাটোরের গুরুদাসপুর, এবং রংপুরে রয়েছে প্রাণের আরও চারটি ডেইরি হাব। সেসব এলাকার খামারিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত খামার গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করছে প্রাণ ডেইরী। এতে আমদানি দুধের উপর নির্ভরতা কমে দুগ্ধ শিল্পে স্বনির্ভর হচ্ছে বাংলাদেশ। আবার অনেক বেকারের কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ায় সাবলম্বী হচ্ছে তরুণ সমাজ।
প্রাণ তাদের ডেইরি হাব এলাকার দুগ্ধ খামারিদের সাথে চুক্তি করে থাকে। নিয়মিত খামার থেকে দুধ সংগ্রহ করার পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে দুধের মান যাচাই করে দুধ সংরক্ষণ করা হয়। তাদের পাঁচটি ডেইরি হাবের আওতায় রয়েছে ১০১টি দুগ্ধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্র। যার আওতাধীন খামারিদের সকল সেবা প্রদান করা হয়। প্রাণ ডেইরির নিজস্ব পশু ডাক্তার নিয়মিত সেবা দিয়ে থাকে চুক্তিবদ্ধ খামারগুলোয়। বর্তমানে পাঁচটি হাব থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় আড়াই লক্ষ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়।
চুক্তিবদ্ধ খামারিদের অনুপ্রাণিত ও উৎসাহ প্রদান করতে গত ৮ জানুয়ারি তারিখে এক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল প্রাণ ডেইরী। এ অনুষ্ঠানে পাঁচটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে সেরা ১৫ খামারিকে পুরষ্কৃত করা হয়।
পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ছিল সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খামার পরিচালনা, দীর্ঘ সময় ধরে প্রাণ ডেইরীকে দুধ প্রদান এবং তাদের সহযোগিতায় ক্ষুদ্র খামার থেকে বৃহৎ খামার গড়ে তোলা। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে প্রাণ ডেইরী কমপ্লেক্সে এই আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু। খামারিদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন তিনি।
দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে পরামর্শ দেন আশারাফ আলী খান খসরু। এধরনের আয়োজনের মাধ্যমে খামারিদের উৎসাহ প্রদান করায় প্রাণ ডেইরীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। খামারিরা যাতে সহজে ঋণ পায় সে ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলেও আশ্বাস দেন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, “স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনে দরকার পুষ্টি। পুষ্টির ভিত্তি হলো দুধ। আর দুধের উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে খামারিরা। এসব খামারিদের সম্মানিত করে আমরা নিজেরাই সম্মানিতবোধ করছি।”
দেশের প্রথম ডেইরি হাব ধারণা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি বলেন সরাসরি খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে তাদের নায্য দাম দেওয়া এবং দুগ্ধশিল্পে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করাই ছিল প্রাণ ডেইরীর মূল উদ্দেশ্য।
এই অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শাহজাদপুর সার্কেল) ফাহমিদা হক শেলী, শাহজাদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ শামসুজ্জোহা, পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের উপপরিচালক ডাঃ আবু সৈয়দ মোঃ নাসির উদ্দিন খান, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান ভূঁইয়া ও প্রাণ ডেইরীর নির্বাহী পরিচালক মোঃ মনিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
প্রাণ ডেইরীর বর্তমানে ১২ হাজার চুক্তিভিত্তিক চাষী রয়েছে যারা গরু পালন করে। আর এই চাষীদের অধীনে রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি গরু। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আরও পাঁচটি ডেইরি হাব স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে প্রাণের।