একাডেমিক ক্ষেত্রে যারা নাট্যকলায় পড়াশোনা করেন, তাদের জ্ঞানার্জনের শুরুটা হয় ইস্কিলুস নাটকগুলো দিয়ে। প্রাচীন গ্রিসের এই নাট্যকার নাট্যকলার ভিত্তি স্থাপন করে দিয়ে গেছেন। শিল্প-সাহিত্যের এই ধারার প্রবাহ স্থায়ী করবার জন্য প্রাথমিক ধাপটি সম্পন্ন করে দিয়ে গেছেন। বিশেষ করে বিয়োগান্ত নাটক রচনাতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাই তাকে আখ্যায়িত করা হয় বিয়োগান্ত নাটকের জনক হিসেবে।
পরবর্তীতে সাহিত্যের এ শাখায় আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তারই যোগ্য উত্তরসূরি সোফোক্লেস এবং ইউরিপিডেস। এই ত্রয়ীর কিছু কাজও আজ অবধি অক্ষত আছে এবং সেগুলো পড়া যায়। আর সব বিখ্যাত গ্রিক ব্যক্তিত্বের মতো ইস্কিলুসের জীবন সম্বন্ধেও খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তাই তাকে নিয়ে যথারীতি সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক আর গল্পগুজব। সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি তো তার মৃত্যু নিয়েই।
‘এসখুলাস’, ‘এইস্কিলাস’, ‘এসকাইলাস’- এরকম আরো অনেকগুলো উচ্চারণ পাওয়া যায় তার নামের। তবে মূল গ্রিক উচ্চারণ ইস্কিলুসই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। খুব সম্ভবত ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের ইলিউসিস নামক এক ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইস্কিলুস। শহরের মস্ত ধনী ইউফোরিয়নের ঘরে জন্ম নেয়ায় তার শৈশবটা আরাম আয়েশেই কেটেছিল বলে ধারণা করা যায়।
কৈশোরে স্থানীয় আঙ্গুর বাগানে কাজ করেছেন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। পড়ালেখা কোথায় করেছেন, কীভাবে করেছেন, সেসব তথ্য আমাদের হাতে নেই। নাটক বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে বিয়োগান্ত নাটক তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন অল্প বয়সেই এটা নিশ্চিত। তবে তার নাটক লেখার সূচনা নিয়ে রয়েছে অলৌকিক তথ্যও যেগুলো বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য।
গ্রিক ভূগোলবিদ পসানিয়াস তার একটি গ্রন্থে ইস্কিলুসের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে পাওয়া যায় ইস্কিলুসের নাটক রচনার অনুপ্রেরণার উৎসের কথা। পসানিয়াসের বর্ণনানুযায়ী, গ্রিকদের মদ এবং আঙ্গুর উৎপাদন বিষয়ক দেবতা (তিনি থিয়েটার এবং ধর্মীয় উৎসব বিষয়ক দেবাতাও) ডায়োনাইসাস ইস্কিলুসের স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাকে চাষাবাদ বাদ দিয়ে বিয়োগান্ত নাটক লিখতে বলেন। এ কাজ করলে তিনি বিখ্যাত হবেন, এ কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি ডায়োনাইসাস। ঘুম থেকে উঠে একদম দেরি করেননি ইস্কিলুস। সেদিন থেকেই শুরু হয় তার নাটক রচনার সাধনা। ২৬ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো তিনি তার নাটক মঞ্চায়ন করতে সক্ষম হন।
শৈশব আর কৈশোরে অন্তত নিজ শহরের বাইরে ভ্রমণ করা হয়নি ইস্কিলুসের, এটা নিশ্চিত। কারণ তিনি যখন ১০ বছরের (মতান্তরে ১৫) বালক, তখন গ্রিসের সিংহাসনে বসে ক্লেইসথেনিস যিনি গ্রিসবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আইন জারি করেন। এই আইনানুযায়ী, কোনো ব্যক্তির পূর্বপুরুষেরা যে শহরে বসবাস করে গেছেন, সেখানেই তাকে বসবাস করতে হবে।
পারসিকদের বিরুদ্ধে সবগুলো যুদ্ধেই দক্ষতার সাথে লড়াই করেছেন ইস্কিলুস। বিশেষ করে পারসিয়ান রাজা প্রথম দারিয়ুসের বিরুদ্ধে ম্যারাথনের যুদ্ধে ইস্কিলুস আর তার ভাই সিনেজাইরাসের অবদান অসীম। গ্রিকরা সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে পারসিক রাজা জেরেক্সেজের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ইস্কিলুস। ‘ব্যাটেল অব সালামি’ নামক এ যুদ্ধ নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত নাটক ‘দ্য পারসিয়ানস’।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৭২ অব্দে ডায়োনাইসিয়া উৎসবে এই নাটকটি মঞ্চায়িত করা হয় যা প্রথম পুরস্কার জিতেছিল সেবার। এখানে ডায়োনাইসিয়া সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রাচীন গ্রিসে জাঁকালো এ উৎসবটি প্রতিবছর নাট্যকলা ও উৎসবের দেবতা ডায়োনাইসাসের সম্মানে পালন করা হতো।
নাটক লিখে যখন সবেমাত্র প্রশংসা কুড়াতে শুরু করেছেন, তখনই জনরোষের মুখে পড়েন ইস্কিলুস। নিজ শহর ইলিউসিসের ‘ইলিউসিনিয়ান মিস্টেরিস’ নামক একটি ধর্মীয় সংঘের সদস্য হন ইস্কিলুস। এ সংঘের কিছু গোপন তথ্য ছিল যেগুলো সংঘের সদস্যরা ছাড়া অন্য কারো সাথে আলোচনা নিষেধ। কিন্তু ইস্কিলুস তার গুটিকয়েক ভক্তের সাথে কিছু গোপন তথ্য নিয়ে মুখ খুলে ফেলেন। এতে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংঘটি। এমনকি একটি নাটক মঞ্চায়নের সময় তার গায়ে পাথরও ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। তিনি সে যাত্রা কোনোক্রমে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন।
এ ঘটনার কিছুদিন পর আদালতে তার বিচার বসে। বিচারে তিনি ভুল স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বিচারকগণ ইস্কিলুসের শহীদ হওয়ার ভাইয়ের কথা বিবেচনা করে তাকে ক্ষমা করেন। কিন্তু জনরোষ কাটতে বেশ কয়েক মাস লেগে যায়। এই মাসগুলোয় তার একটি নাটকও মঞ্চায়নের সুযোগ পায়নি।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ এর দশকে ইস্কিলুস সিসিলি ভ্রমণ করেছিলেন। এ সময় তিনি রচনা করেছিলেন একটি বিখ্যাত নাটক ‘দ্য ওম্যান অব ইটনা’। এ নাটক রচনার পরই সমসাময়িক সকল নাট্যকারকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার এক নম্বর আসনটি পাকাপোক্ত করেন তিনি। তখন থেকে প্রায় প্রতিবছরই ডায়োনাইসিয়া উৎসবে প্রথম স্থান অধিকার করতো তারই নাটকগুলো। বিভিন্ন উৎসের মতে, ডায়োনাইসিয়াতে তিনি ১৩-২০ বার প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
নাটকের জগতে ইস্কিলুসের উত্থানের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন ইতিহাসবিদগণ। অনেকের মতে, তার উত্থানটা অবধারিতই ছিল। ইস্কিলুসের জীবনকাল ও পরবর্তী প্রায় অর্ধশতাধিক বছর গ্রিসে নাট্যকলা সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে। এ সময়ে ডায়োনাইসিয়া উৎসবগুলো হতো অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ এবং সেই উৎসবে প্রথম স্থান অধিকার করা ছিল বিশেষ এক সম্মান। এই সম্মানের জন্য তখন গ্রিকদের মাঝে নাট্যকার হবার ঝোঁক বেড়ে যায়। নাট্যকারদের সামাজিক প্রতিপত্তি এবং আয় দুটোই বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। অন্যদিকে নাট্যকার কেবল সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষেরাই হতে পারতো। সেক্ষেত্রে ইস্কিলুসের নাট্যকার হওয়ার পথে কোনো বাঁধাই ছিল না।
ইস্কিলুস তার জীবনকালে কতগুলো নাটক রচনা করেছিলেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে কোনো সংখ্যাই ১০০ এর নিচে নামেনি। তার এতগুলো লেখার মাঝে বর্তমান সময় পর্যন্ত অক্ষত আছে মাত্র ৭টি। আরো বেশ কিছু নাটকের মূল কাহিনী সংক্ষেপে বলতে পারা যায় কারণ সেগুলো পুরোপুরি অক্ষত না থাকলেও একাধিক খণ্ড থেকে মর্মোদ্ধার সম্ভব হয়েছে। এসবের বাইরে তার আরো ৭১টি নাটকের নাম বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
ইস্কিলুসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চায়িত নাটক হচ্ছে ‘দ্য পার্সিয়ানস’। এ নাটক তিনি দারিয়ুসের বিরুদ্ধে সালামির যুদ্ধ নিয়ে রচনা করেন। ‘সেভেন এগেনেস্ট দ্য থিবিস’ এবং ‘দ্য সাপ্লিয়্যান্ট’ এর মূল কাহিনী ছিল ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ইস্কিলুস ট্রিলজি লিখতে ভালোবাসতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ এর দশক জুড়েই তিনি ট্রিলজি রচনা করেছেন। তবে তার একটি মাত্র ট্রিলজিই বর্তমান অবধি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। ‘দ্য ওরেস্টিয়া’ নামক এ ট্রিলজিটি গ্রিকদের ইতিহাসেই একমাত্র ট্রিলজি যা কালের স্রোতে হারিয়ে যায়নি। এর তিনটি খণ্ড গ্রিক বীর আগামেমনের উত্থান, হত্যা এবং উত্তরসূরীদের নিয়ে সাজানো।
ইস্কিলুসের লেখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিতটি হচ্ছে ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’। এটি মূলত ‘প্রমিথিয়া’ নামক একটি ট্রিলজির প্রথম খণ্ড, যার দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড যথাক্রমে ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ এবং ‘প্রমিথিউস দ্য ফায়ার ব্রিঙ্গার’ অক্ষত অবস্থায় নেই। মর্ত্যের মানুষের জন্য প্রমিথিউসের আগুন নিয়ে আসা এবং জিউসের নিষ্ঠুর অত্যাচারের শিকার হওয়ার গল্পই বর্ণিত হয়েছে এ নাটকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর স্টাইলে। এ নাটকের গল্প বর্ণনা, সংলাপ সবই ইস্কিলুসের চেয়ে কিছু ভিন্ন মনে হয়। এ কারণে ১৯ শতক পর্যন্তও পণ্ডিতগণ এ নাটকটি আদৌ ইস্কিলুসের কি না তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু ইস্কিলুস না হলে এর লেখক কে হতে পারে তারও কোনো নির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় ইস্কিলুসকেই এর লেখক মানতে হচ্ছে।
নাটক ও সাহিত্যে অবদানের বাইরে ইস্কিলুস সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার অদ্ভুত মৃত্যুর গল্পের জন্য। সেই গল্পটি কতটুকু সত্য তা নির্ধারণ করা যায়নি, তথাপি অনেকের মতে, তা সত্য। ৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইস্কিলুস দ্বিতীয়বারের মতো সিসিলি ভ্রমণ করেছিলেন। জীবনের শেষ ভাগটা তিনি এখানেই কাটিয়েছিলেন। তার মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত গল্পটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে অদ্ভুত উপায়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষ! সত্য মিথ্যা যা-ই হোক, ঘটনাটা আসলেই বেশ অদ্ভুত এবং কাকতালীয়।
ল্যামার্জার নামক এক প্রজাতির শকুন আছে যেগুলো কচ্ছপ খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা কচ্ছপ ধরে নিয়ে আকাশে উড়াল দেয় এবং কোনো পাথরের দেখা পেলে সেটির উপর কচ্ছপটি ফেলে দেয় যেন এর উপরের শক্ত খোলস ভেঙে যায়। সিসিলিতে তখন বহু ল্যামার্জারের বসবাস ছিল। পৃথিবীর প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া রচয়িতা হিসেবে পরিচিত প্লিনি দ্য এল্ডার তার এক উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন যে, সিসিলিতে থাকাকালীন ইস্কুলাস ঘরের মধ্যে খুব কম সময় থাকতেন। এমনকি রাতে ঘুমাতেনও ঘরের বাইরে। কারণ কোনো এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তার মৃত্যু হবে মাথার উপর কিছু একটার পতনে!
ইস্কিলুস ভেবেছিলেন ঘরে থাকলে ছাদ না ভেঙে পড়ে আবার। খোলা আকাশের নিচে থাকলে নিশ্চয়ই আকাশ থেকে তারা খসে পড়বে না? কিন্তু ইস্কুলাসের দুর্ভাগ্য যে, আকাশ থেকে তারা খসে না পড়লেও শকুনের ফেলা কচ্ছপই তার মৃত্যুর কারণ হয়! ৪৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোনো এক সকালে তিনি বসে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন, তখন তার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায় উপর থেকে পতিত হওয়া এক আস্ত কচ্ছপের আঘাতে। বেচার শকুনেরই বা দোষ কোথায়? সূর্যালোকে চকচক করা ইস্কিলুসের টাক মাথাটাকেই পাখিটি হয়তো পাথর ভেবেছিল!
প্রায় সকল ইতিহাসবিদই এ গল্পকে নিছক মিথ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
যা-ই হোক, ইস্কিলুসের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে পড়েছিল এথেন্স, বিশেষ করে তার শহর ইলিউসিস। এক সপ্তাহের শোক পালন করা হয় সেখানে, একের পর এক মঞ্চায়িত করা হয় তার নাটকগুলো, তৈরি করা হয় স্মৃতিসৌধ। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করা ইস্কিলুসের অধিকাংশ কাজও মুছে গেছে ইতিহাস থেকে। তথাপি তিনি আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন তার টিকে থাকা কয়েকটি অসাধারণ নাটকের জন্য। সাহিত্যের এ শাখা আজ যে বটবৃক্ষের আকার ধারণ করেছে, তার চারা তো তিনিই রোপণ করেছিলেন। থিয়েটারের বিস্তারে তার অবদান অনস্বীকার্য। আর বিয়োগান্ত নাটক তো তারই সৃষ্টি।