মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে বাপুর মতবাদ বিতর্কিত হতে পারে, তবে ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসে গান্ধীর মতো নেতা আগে কখনো আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে না। সাদা খদ্দর পরা কৃশকায় মানুষটি স্রেফ এক হাতে ছাগলের গলার দড়ি আর আরেক হাতে একটা লাঠি সম্বল করে ভারতকে এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। সরু কাঁধে বয়েছিলেন কোটি মানুষের স্বপ্নগুচ্ছ।
গান্ধীর মতবাদবিরোধী লোকের সংখ্যা বড় কম ছিল না। তার ঘনিষ্ঠতম শিষ্য জওহরলাল নেহেরু আর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পর্যন্ত গান্ধীবাদকে কর্মক্ষেত্রে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। গান্ধীর অহিংস আন্দোলন, দর কষাকষি আর জনপ্রিয়তা ভারতকে ঠেলে স্বাধীনতার দ্বারে পৌঁছে দিল বটে, কিন্তু বুড়ো গুজরাটি পেলেন একটা কাটাছেঁড়া করা ভারত। তিনি পড়ে রইলেন তার উটোপিয়ান ভারতবর্ষের ভাঙ্গাচোরা স্বপ্ন নিয়ে। ওদিকে বাকি ভারত মেনে উঠলো কংগ্রেসীয় সোশ্যালিজম আর কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবধারার টানাটানির মধ্যে।
গান্ধীবাদ ও তার বিরোধীরা
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ওরফে আরএসএস; ১৯২৫ সালে ইউরোপীয় ডানপন্থীদের আদলে তৈরি এই সংগঠনটিকে বর্তমান ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা দলের পিতৃস্থানীয় বলা চলে। বর্তমান বিশ্বের সবথেকে বড় এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং কট্টর ডানপন্থী মতবাদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে এসেছে।
১৯৪৭ সালে এটা মোটামুটি যখন নিশ্চিত যে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ব্রিটিশ ভারতকে টুকরো টুকরো করে কাটবেন, তখন এই হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে গেল গেল রব উঠলো। সাধের মাতৃভূমিকে কে-ইবা খন্ড-বিখন্ড রূপে দেখতে চায় ! কিন্তু সমস্যা হল কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ তখন একমত হয়েছে যে ভারত বিভাগ অনিবার্য। এখানে বলে রাখা ভালো, গান্ধীর কিন্তু ভারত বিভাগে কড়া আপত্তি ছিল। তিনি এমনকি জিন্নাহকে প্রধানমন্ত্রী করে একটা সরকার গঠনের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু নেহেরু, প্যাটেল, জিন্নাহ সবাই তখন ঝানু নেতা। একজন বৃদ্ধ রাজনীতিবিদের কথা তারা শুনবেন কেন! অবিভক্ত ভারতের শাসন পদ্ধতি কেমন হবে কেউ যখন ঠিক করতে পারলো না, তখন সব দলের চাঁইরা বললেন, দেশটাকে কেটেকুটে নিলেই সব সমস্যা দুরস্ত হয়ে যাবে!
আরএসএস এর লোকেরা ব্যাপারটা মোটেই ভালভাবে নিল না। তারা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে একটা জাঁকালো হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার কথা ভাবছেন। সেই স্বপ্ন রসাতলে যাচ্ছে দেখে তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আর এই হাঙ্গামার মধ্যেই ১৪ আগস্ট ভারত ভাগ হয়ে গেল।
আরএসএস বরাবরই দেশের সমস্ত সমস্যা মুসলিমদের ওপরে চাপিয়ে দিতে ভালবাসতো। দেশভাগের পরে তারা মুসলিমদের দুষলো বটে, কিন্তু সাথে সাথে গান্ধীকেও দোষ দিতে ভুললো না। বুড়ো যে বলেছিল দেশ ভাগ হলে সেটা হবে তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে! তেমন কিছু তো হল না। দেশ ভাগ হল আর গান্ধী দেখা গেল দিল্লির বিড়লা ভবনে বসে ছাগলের দুধ খাচ্ছেন। তাঁর দল কংগ্রেস দিব্যি সেই কাজে তাল দিল। কাজেই গান্ধী হয়ে গেলেন দেশের শত্রু। লবণ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন সব ভুলে গেল বিরোধীরা। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে গেল জঙ্গী তরুণেরা।
আরএসএস এর ঘাঁটি ছিল পুনেতে। এই পুনে থেকেই ছত্রপতী শিবাজী মোঘলদেরকে পরাস্ত করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মারাঠা সাম্রাজ্য। একশত বছরের বেশি সময় টিকেছিল সেই সাম্রাজ্য। ব্রিটিশদেরকে দুই দুইটি যুদ্ধে পরাস্ত করেছিল মারাঠা সেনারা। স্বভাবতই পুনে বা আশেপাশের অঞ্চলে গোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদের তখন খুবই রমরমা। গান্ধীকে হত্যাকারীরাও কোনো না কোনোভাবে এই শহরটির সাথে যুক্ত ছিল।
একজন সাভারকর ও পুনের ব্রাক্ষ্মণেরা
দুইবার হিন্দু মহাসভা দলের সভাপতি, লন্ডন থেকে আইনবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত, মহারাষ্ট্রের চার্চিল নামে খ্যাত বিনায়ক দামোদর সাভারকরের শিরায় বইতো খাঁটি চিৎপাবন ব্রাক্ষ্মণের রক্ত। মারাঠা সাম্রাজ্যের অধিপতি পেশোয়ারাও এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সাভারকর ছিলেন ধুরন্ধর বাগ্মী এবং দক্ষ গুপ্তঘাতক। লন্ডনে এক ব্রিটিশ আমলাকে হত্যার চেষ্টা করলে তাকে আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া হয়। পরে সাধারণ ক্ষমা পেয়ে ফিরে আসেন আর আরএসএস দলের মধ্যে ‘হিন্দু রাষ্ট্র দল’ নামের একটি চরমপন্থী দল গড়ে তোলেন। এই দলের সবাই ছিলেন চিৎপাবন ব্রাক্ষ্মণ।
সাভারকরের স্বপ্ন ছিল অখন্ড ভারতকে একটা হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। মুসলমানদেরকে তিনি বিষ নজরে দেখতেন। গান্ধীকে মোটেও সইতে পারতেন না এই মারাঠি বাগ্মী। কাজেই তার সাথে একসময় পরিচয় ঘটলো নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে আর বিষ্ণু কারকারের।
নাথুরাম গডসে ছিল সাদামাটা এক মারাঠি যুবক। তার ধ্যানধারণায় হিন্দু ভারত ছাড়া আর কিছুই স্থান পেত না। পেশায় সে ছিল দর্জি। তার ঘনিষ্ঠ সাগরেদ নারায়ণ আপ্তে ছিল দক্ষ পরিকল্পনাকারী। এই দুজনে ‘অগ্রণী’ আর ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নামের দুটি বিতর্কিত খবরের কাগজ বের করতো। বিষ্ণু কারকারে আহমেদনগরে ‘ডেকান গেস্ট হাউস’ নামে একটা অতিথিশালা খুলে আড়ালে দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্ল্যান আটতো। তার সাথে জুটেছিল মদনলাল পাওহা নামের এক পাঞ্জাবী যুবক। মদনলাল ছিল শরণার্থী। মুসলিমরা তার আত্মীয়স্বজনকে মেরে শেষ করে দিয়েছিল।
এই লোকগুলোর সাথে ব্যবসার ধান্দাতেই এসে জুটলো দিগম্বর গডসে। সাইত্রিশবার হাজতবাসকারী এই ভন্ড সাধুটি বইয়ের দোকানের আড়ালে অস্ত্রের কারবার চালাতো। নাথুরাম গডসের ভাই গোপাল গডসে এবং গোয়ালিয়রের জনৈক উগ্রবাদী হোমিওপ্যাথ ডাক্তারও পরে এই দলের সাথে যুক্ত হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরে, ১৯৪৮ সালে প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধের পরে আরেক ঝামেলা বাধলো। ভারত সরকারের কোষাগারে পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকা ছিল। দেশভাগের পরে এটা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও যুদ্ধের কারণে তা আর হয়নি। এবারে পাকিস্তান সেই টাকা ফেরত চাইলে ভারতীয় নেতারা সরাসরি না বলে দিলেন, কারণ তাদের ভয় পাকিস্তান এই টাকায় অস্ত্র কিনবে। গান্ধী কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ করলেন না। হকের টাকা যেন পাকিস্তানকে ফেরত দেওয়া হয় এই শর্তে তিনি শুরু করলেন অনশন। বলাই বাহুল্য, এই সিদ্ধান্ত প্রচার হওয়ার সাথে সাথে মারাঠা উগ্রপন্থীরা গান্ধীকে হত্যা করবার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ওপরে ছিল সাভারকরের আশীর্বাদ।
গান্ধীজী মৃত!
গান্ধীজী তখন থাকেন দিল্লির বিড়লা ভবনে। নিরিবিলি দালানটি তার যারপরনাই পছন্দ। সেখানেই বাগানে রোজ সন্ধ্যায় বসাচ্ছেন প্রার্থনাসভা। সব ধর্মের মানুষকে একসাথে মিলে মিশে থাকতে অনুরোধ করছেন। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জমায়েত হত গান্ধীজীর কথা শুনতে।
দিল্লি এসে খুনীরা উঠলো মেরিনা হোটেলে। ততদিনে ওরা গান্ধীর প্রার্থনাসভা রেকি করে এসেছে। স্থির হল ২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার গান্ধীকে হত্যা করা হবে। গান্ধীর প্রার্থনা মন্ডপের পেছনে কিছু খুপরি ঘর ছিল। হামলাটা সেখান থেকেই চালাতে মনস্থির করলো সবাই। নাথুরাম আর নারায়ণ বাদে বাকিদের হাতে থাকবে বোমা আর পিস্তল। ওরাই খুন করবে বৃদ্ধকে।
কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে গোলমাল পাকিয়ে গেল। মদনলাল ঠিকমত একটা বোমা ফাটালো বটে, তবে তাতে প্রচুর হৈ চৈ হলেও গান্ধীজীর কিছু হল না। বাকিরা এই ভিড়ে নিজেদের ওপরে অর্পিত দায়িত্বটাও ঠিকমত সমাপ্ত না করে লম্বা দিল। ভেস্তে গেল সব পরিকল্পনা। মদনলাল ধরা পড়লো। বাকিরা চম্পট দিল পুনেতে। এরপরে পুলিশ প্রার্থনাসভায় তল্লাশি চৌকি বসানোর প্রস্তাব দিলেও গান্ধীর আপত্তিতে সেটা আর হয়নি।
৩০ জানুয়ারি বিকালে খাকি পোশাক পরে নাথুরাম গডসে ঢুকে পড়লো প্রার্থনা মঞ্চের কাছে। গান্ধীজীর জেদের কারণে পুলিশ আশেপাশে থাকলেও কাওকে তল্লাশী করা হত না। গোয়ালিয়রের সেই ডাক্তারের কাছ থেকে আনা পিস্তল লুকিয়ে নিয়ে নাথুরাম সোজা হেঁটে গেল গান্ধীজীর কাছে। হাতজোড় করে নিচু হয়ে নমস্কার জানালো। গান্ধীজীর নাতনী মনু ভেবেছিল নাথুরাম পদচুম্বন করবে। হাত বাড়িয়ে সে বাধা দিতে গেলে নাথুরাম তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল। তিনটা গুলি ঢুকে গেল পৃথিবীর দ্বিতীয় জনবহুল দেশের সবথেকে জনপ্রিয় নেতার বুকে। রামনাম করতে করতে নিথর হয়ে গেল ছোট্ট রুগ্ন দেহটা।
ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে সতেরো মিনিট।
খুনীদের পরিণতি
নাথুরাম ঘটনাস্থলেই ধরা পড়ে। পুলিশ সব মিলিয়ে মোট আটজনকে গ্রেফতার করে। সাধু বাড়গে রাজসাক্ষী হয়ে যায়। বিচারে নাথুরাম আর নারায়ণের ফাঁসি হয়। বাকিদের দ্বীপান্তর। সাভারকর তার ধূর্ত বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায়। তাকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করা যায়নি। ১৯৬৬ সালে তার মৃত্যু হয়।
নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে জেল খেটে বের হয়ে এসে আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। গডসে আর সাভারকরের পরিবারের ঘনিষ্ঠতাও বৃদ্ধি পায়। নাথুরামের শেষ ইচ্ছা ছিল অখণ্ড হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগপর্যন্ত যেন তার চিতাভস্ম গঙ্গায় বিসর্জন না দেওয়া হয়। গোপাল ও তার বংশধরদের কাছে এখনো সেই চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে।
গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পেছনে পুলিশের গাফিলতি ছিল। পুলিশ মদনলালের কাছ থেকেই বাকি ষড়যন্ত্রীদের সুলুক সন্ধান পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তদন্তকাজে বিস্ময়কর ধীরগতি দেখা যায়। একথা সত্যি যে অনেক পুলিশ অফিসার মদনলাল ধরা পড়বার পরে খুব চেষ্টা করেছিলেন গোটা ষড়যন্ত্রটা বানচাল করতে। কিন্তু শেষমেষ তারা উপমহাদেশের এই মহাত্মার প্রাণটাকে উগ্রবাদের হাড়িকাঠ থেকে রক্ষা করতে পারেননি।
একটা তথ্য দিয়ে শেষ করা যাক। নাথুরাম গডসের রাজনীতিতে পদার্পণ হয়েছে কিন্তু গান্ধীজীর আন্দোলনে অংশ নিয়েই। তিরিশের দশকের বিখ্যাত সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়ে নাথুরাম হাসিমুখে জেল খেটেছিল। অথচ পরে এই লোকটিই হিংসার পথ বেছে নেয়। হত্যা করে নিজেরই সাবেক গুরুকে।
ফিচার ইমেজ – history.com
তথ্যসূত্র: ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক ল্যাপিয়ের, প্রকাশকাল: ২০০৫, কলকাতা, পৃষ্ঠা: ২৯৬-৩৮৩