‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’- এই কথার যথার্ততা প্রমাণ করতে গিয়েই হয়তো কিংবদন্তী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন-
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
এই চলে যাওয়ার কথা হয়তো অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন তিনি। আর তাই ফেসবুকের শেষ স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “আমাকে যেন ভুলে না যাও… তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।” হয়তো মনে ছিল তার হাজারো ক্ষোভ, অভিমান, না পাওয়ার বেদনা আর ভাই হারানোর ক্রন্দন। তিনি হয়তো তখনো জানতেন না, কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রইবে তার নামটি- ‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল’।
নামটির সাথে মিশে আছে কথা, সুর, দেশ, মুক্তি, ভালোবাসা আর বুক ভরা ক্রন্দন। আমাদের সঙ্গীত জগতে কথা ও সুরের ঐশ্বর্যে প্রতিভাবান এক সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকসহ অনেক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিটি মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। তার এই চলে যাওয়া সঙ্গীতজগতে তাই শুধু ক্ষতের সৃষ্টিই করেনি, তৈরি করেছে এক বিশাল শূন্যস্থান, যা সত্যিই অপূরণীয়।
১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্ম এই প্রবাদ পুরুষের। আজিমপুরের কলোনিতে বাবা ওয়াফিজ আহমেদ ও মা ইফাদ আরা নাজিমুন নেসার সংসারে খুব দুরন্তপনায় কাটছিল বুলবুলের শৈশব। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি খুব আগ্রহ দেখা যায় তার। বাবার সাথে বাড়িতে বসে রেডিও শোনা ছিল নিত্যদিনের দিনলিপি। গান শুনতে শুনতে গান গাওয়ার চেষ্টাও শুরু হলো। গিটার কেনার মাধ্যমে প্রথম বাদ্যযন্ত্র হাতে তুলে নিলেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি খুব ভালোবাসতেন তিনি। প্রকৃতিই যেন তার সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুরু। নিজে নিজেই শিখে ফেলেছিলেন গিটার, পিয়ানো ও হারমোনিয়াম। মাত্র তেরো বছর বয়সেই তৈরি করেছিলেন জীবনের প্রথম গান- “ও মন ময়না, আয় ফিরে আয় না।” নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন মিলে নিজেদের একটি দল গঠন করে পাড়া মাতিয়ে রাখতেন তখন।
কিন্তু হাসিখুশি মাখা শৈশবের দিনগুলো খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি বুলবুলের। এলো ১৯৭১ সাল, দেশজুড়ে শুরু হলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাধ্যমিক পড়ুয়া আহমেদ ইমতিয়াজের বয়স ছিল তখন মাত্র পনের বছর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বড় ভাই টুলটুল যুদ্ধে যোগদান করেন। তখন থেকেই তিনি যেন নিজেকে আর ঘরে বেধে রাখতে পারছিলেন না। দেশ মাকে রক্ষা করার জন্যে মায়ের অনুমতি নিয়ে বন্ধু মানিক ও মাহবুবকে নিয়ে চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি বাঙ্কার খোঁজার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে জুলাই মাসে বন্ধু সরোয়ারকে নিয়ে ঢাকার নিউমার্কেটের প্রবেশমুখে পাকিস্তানী বাহিনীর গাড়িতে গ্রেনেড হামলা করেন। পরের মাসেই তিনি চলে যান ভারতের আগরতলায় প্রশিক্ষণের জন্যে। সেখান থেকে ফিরে এসে ঢাকায় ফিরে ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন’ নামে গেরিলা দল গঠন করে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মেজর আবু মুহম্মদ হায়দারের অধীনে ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
অক্টোবরের দিকে পুনরায় ভারত যাওয়ার আরো তিনজন সহযোদ্ধাসহ কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি চেকপোস্টে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আটক হন। সেখানে আগেই আটককৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদের বন্দী করে রাখা হয়। তার চোখের সামনে আটকে রাখা প্রায় তেতাল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রে গুলি করে মেরে ফেলে রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনী। পরবর্তীতে তাকে মেরে না ফেলে কথা বের করার উদ্দেশ্যে ঢাকার রমনা থানায় স্থানান্তরিত করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে ফিরে আসেন বুলবুল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুনরায় সঙ্গীত নিয়ে মেতে ওঠেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ‘আফটার মেথ’ নামে একটি গানের দল তৈরি করেন। ১৯৭৬ সালে বিটিভির জন্যে গান করার সৌভাগ্য হয় তার। তখন মনে শুধু দেশের কথা, দেশের সুর। তাই প্রতিটি গানই ছুঁয়ে যেত দেশপ্রেমের মায়া। মুক্তিযুদ্ধের সকল অভিজ্ঞতা যেন তার লেখা আর সুরে প্রতিফলিত হয়ে আসতে থাকে। পরবর্তী সাত বছর ধরে শুধু দেশাত্মবোধক গানই তৈরি করে চলেন তিনি। তারপর শুরু হয় তার চলচ্চিত্রে গান করা। নাগরদোলা ছবির জন্যে ‘ও আমার মন কান্দে’ গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে পদার্পণ হয় তার। ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তবে সকলের সুনজরে পড়েন ‘নয়নের আলো’ সিনেমাটিতে সুর করার মধ্য দিয়ে।
তবে এই ছবির কাজ তিনি খুব সহজে পাননি। চলচ্চিত্রাঙ্গনের পরিচালকদের কাছে তখনও খুব পরিচিত মুখ নন তিনি। তাই সকলেই যে তাকে আস্থার সাথেই নিচ্ছিল তেমন ভাবার কোনো কারণ নেই। পরে এক জ্যোতিষীকে দিয়ে তার হাত দেখানো হয়। জ্যোতিষীর ভাষ্য ছিল, এই ব্যক্তির হাতে কোনো প্রকার সুর করার ক্ষমতা বা এই অঙ্গনে সফল হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মনের মধ্যে ছিল যেকোনো প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার দৃঢ় প্রত্যয়। ‘নয়নের আলো’ সিনেমাটির সুর করা প্রায় প্রত্যেকটি গানই সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্কৃতি) পুরস্কার অর্জন করেন। এই চলচ্চিত্রের পর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরবর্তি সময়ে প্রায় কয়েকশ চলচ্চিত্রে সুর ও সঙ্গীতের কাজ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি অনেক শিল্পীর জন্যে ব্যক্তিগত অ্যালবামেও কাজ করেছেন।
তার উল্লেখযোগ্য কিছু গানের মধ্যে রয়েছে ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের পথ ধারে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেম ভিখারি’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়’, ‘কত মানুষ ভবের বাজারে’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘আমার জানের জান আমার আব্বাজান’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’, ‘সাগরের মতোই গভীর’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়’, ‘ফুল নেব না অশ্রু নেব’, ‘বিধি তুমি বলে দাও আমি কার’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন’, ‘নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে’, ‘চতুর্দোলায় ঘুমিয়ে আমি ঘুমন্ত এক শিশু’, ‘তুমি স্বপ্ন তুমি সাধনা’, ‘আকাশটা নীল মেঘগুলো সাদা সাদা’, ‘আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই আর’, ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার’, ‘মাগো আর নয় চুপি চুপি আসা’ সহ আরও অনেক গান। সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনক চাঁপাসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী তার সাথে কাজ করেছেন।
আহমেদ ইমতিয়াজের বর্ণাঢ্য এই সঙ্গীতজীবনের ঠিক ভিন্নরূপ ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন। অনেক না পাওয়ার ক্রন্দন তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। দেশকে ভালোবেসে, দেশমাতৃকার টানে নিজের জীবনের কথা ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পর গান দিয়ে শুরু করেছিলেন তার দ্বিতীয় যুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীন দেশ তখনো ছলে বলে আবার পরাধীনতার মুখোশে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। প্রকৃত বীর কখনো কোনো ভয়ে ভীত হন না। ২০১২ সালে তাই তিনি আবার নেমে পড়লেন নতুন যুদ্ধে। সেই বছর আগস্ট মাসে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে গঠন করা ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে’ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করতে কাঠগড়ায় দাঁড়ান। হাজার ভয়-ভীতি এবং জীবননাশের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে উচ্চারণ করেন তার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু তখনও কি হায় জানতেন এই যুদ্ধেও তাকে হারাতে হবে অনেক কিছু। সাক্ষ্য প্রদানের পরের বছরেই ৯ মার্চ রাতে ঢাকার কুড়িল উড়ালসেতুর পাশে তার ছোট ভাই আহমেদ মিরাজের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এরপর থেকেই জোরালো করা হয় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নিরাপত্তা। স্বাধীন দেশে তখন পরাধীনতার চাঁদর মুড়ি দিয়ে বেদনার পাহাড় গড়ে তোলেন মনের মাঝে। চার দেয়ালে বন্দী থেকে নিজের সৃষ্টি করা ‘সব কটা জানালা, খুলে দাও না’ গানটিই যেন বারবার আর্তনাদ করে গাইতে থাকেন।
দেশের সঙ্গীত জগতে অসামান্য কীর্তির জন্যে ২০১০ সালে তিনি একুশে পদক পান। এছাড়াও ২০০১ সালে ‘প্রেমের তাজমহল’ এবং ২০০৫ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীতায়োজনের জন্যে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পাশাপাশি বেশ কয়েকবার সেরা গীতিকারের জন্য ‘বাচসাস’ পুরস্কার পান তিনি। এছাড়াও রিয়েলিটি শো ‘ক্লোজ আপ ওয়ানের’ তিন মৌসুমের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আমাদের দেশের বিনির্মাণে অসামান্য সাহসী অবদান ও ত্যাগের বিপরীতে তার পাওয়ার হিসেব হয়তো ছিল অত্যন্ত নগণ্য। কিন্তু আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো ব্যক্তিরা কখনো পাওয়ার আশায় কোনোকিছু করেন না। দেশকে ভালোবেসে, দেশের জন্যে পুরো জীবন সেবা করে গেছেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। কিন্তু, এসকল ক্ষণজন্মা মানুষের কখনো মৃত্যু নেই, হতে পারে না। তারা বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে, কোটি মানুষের কন্ঠে। হয়তো এই দিনটির কথা ভাবতে ভাবতেই তিনি লিখেছিলেন-
আমি জায়গা কিনবো কিনবো করে
পেয়ে গেলাম জায়গা শুদ্ধ বাড়ী,
সে বাড়ীতে ঢোকার পরে,
সবার সাথে হয়ে গেলাম আড়ি ।।দরজা নাই জানালা নাই
নাইরে আলো বাতাস
মাটির তলে মাটির বাড়ি
নাম্বার একশত সাতাশ।।