চলে যাওয়া মানে কি প্রস্থান? কিংবদন্তিদের দৈহিক প্রস্থান ঘটে শুধু। তারা থাকেন না থাকা জুড়ে। প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ থাকবেন, তার কবিতার প্রবল শব্দসমাহারে। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হলেও তোপধ্বনি থাকেনি। তিনি পছন্দ করতেন না। আমৃত্যু কবিতায় যে তোপ দাগিয়েছেন, তাতে ম্লানই লাগতো ফাঁকা গুলির আওয়াজ!
স্রোতের ভিতর ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতর স্তব্ধ আয়ু
লেখো আয়ু, লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও
নব্বই বছর বয়সে শব্দহীন হয়ে গেলেন কবি। কোভিডের থাবা আর লিখতে দিল না। সত্তর বছরের সাহিত্যচর্চা চুপ করে গেল। রেখে গেল সত্তার সবটা। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডব বলা হতো যাদের, তাদের একজন শঙ্খ ঘোষ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়; বাকি চারজনের নামও বেজায় ভারী! রবিঠাকুর জীবনকে দেখতেন, জীবনানন্দ লিখতেন। তাদের পরবর্তী সময়ে এসে শঙ্খ ঘোষ দেখতে দেখতে লিখতেন। জীবন সমন্ধে দুর্দান্ত দর্শন পুষতেন নিজের ভেতর।
জীবন মানেই হলো আত্মবোধে নিজেকে সাজানো। নিজের সত্তার কাছে সত্য হতে চাওয়াই জীবন।
সত্তার কাছে সত্য হবার প্রয়াসে কবিতা লিখে গেছেন। প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনে কলম তুলেছেন গণমানুষের পক্ষে। ১৯৫২ সালে ভারতের কোচবিহারে খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। মৃত্যু হয় এক কিশোরীর। ভাতের অধিকার চেয়ে আন্দোলনে গিয়ে ভাতের বদলে গুলি খাওয়া মেনে নিতে পারেননি কবি। কলম থেকে বেরিয়ে আসে প্রতিবাদ,
নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।
১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া কবির আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। বাবা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মা অমলা ঘোষ। ২১ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করা কবির পৈত্রিক বাড়ি বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন বাংলাদেশের আরেক জেলা পাবনায়। পিতার কর্মস্থল হওয়াতে বেশ কয়েক বছর পাবনায় থাকেন এবং সেখানে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। পেশা হিসেবে অধ্যাপনাকে বেছে নেন। জ্ঞানের আলো ছড়ান কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সমৃদ্ধ বিদ্যাপীঠে। কাজ করেছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ায় রাইটার্স ওয়ার্কশপে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সহকর্মীরা যেমন মোহিত হতো, তেমনি বর্তমান সময়ের অনেক কবিই ছিলেন তার স্নেহপ্রতিম।
জয় গোস্বামী অন্যতম। এতটাই কাছের ছিলেন, শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুতে যারপরনাই ভেঙে পড়েন জয়। শুধু কি জয় গোস্বামী? একটু গভীরে দৃষ্টি ফেললে সহজে বোঝা যায়, বাংলা সাহিত্যাঙ্গন কত বিশাল নক্ষত্রের খসে পড়া দেখল! তিনি অবশ্য ফের উদিত হবেন। রোজ আনকোড়া কারও তার কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে। মানুষের বড়োত্বের প্রমাণ মেলে বিনয়ে। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন বিনয়ের বরপুত্র। যত ব্যস্ত থাকুন, তার কাছে কবিতা নিয়ে এসে খালি হাতে কেউ ফিরেনি কখনও। আনকোড়া তরুণ হোক অথবা নামজাদা কবি, সকলকে শ্রদ্ধা করতেন। কবিতায় বিপ্লবী হলেও বাস্তব জীবনে স্বল্পভাষী ছিলেন। যার কলম কথা বলে, তার আসলে মুখে বলার প্রয়োজন হয় না।
বাংলা সাহিত্যজগতে শঙ্খ ঘোষের অবদান বলে শেষ করা দুরূহ। কবিতা দিয়ে বাজিমাত করলেও থেমে থাকেননি। প্রবন্ধ, নাটক, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ গবেষণা বারেবারে মনে করায় তিনি কতটা উঁচুমানের। বাবরের প্রার্থনা, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, দিনগুলি রাতগুলি, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, এ আমির আবরণ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। রবিঠাকুরকে নিয়ে তার রচিত ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ সর্বজনবিদিত একটি গ্রন্থ। এছাড়া ১৯৯৯ সালে অনুবাদ করেছেন ‘রক্তকল্যাণ’ নামক কন্নড় নাটক, যা তাকে এনে দেয় ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মাননা।’ সময়ের ব্যবধানে অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। তন্মধ্যে রবীন্দ্র পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, সরস্বতী পুরস্কারের পাশাপাশি জ্বলজ্বল করবে পদ্মভূষণ!
শঙ্খ ঘোষের মতে, একদিন কবিতার কাছে দাবী করা হয়েছে যে, সে বদলে দেবে সভ্যতার মুখশ্রী। যুগে যুগে শঙ্খ ঘোষের মতোন কবিরা কবিতার হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে নিপীড়িতদের। শোষণের বিরুদ্ধে, কাপুরুষের কপটতার বিরুদ্ধে, নপুংসকের নোংরামির বিরুদ্ধে বজ্রকন্ঠে অকুতোভয় হুংকার দিতে শিখিয়েছে ভীত-সন্ত্রস্ত সভ্যতাকে। তিনি লিখেছিলেন, “ক্ষীণায়ু এই জীবন আমার ছিল শুধুই আগলে রাখা, তোমার কোনো কাজেই আসলো না!” অথচ তিনি ঠিকই জানতেন, তার এই জীবন কতখানি কাজে এসেছে। জাগরণের স্বপ্ন আঁকা প্রতিটি শিল্পীর ক্যানভাসে তিনি তুলির আঁচড় হয়ে থাকবেন। গায়কের গানের প্রতি চরণে বাজবে শঙ্খ ধ্বনি। কবি শঙ্খ ঘোষ, আপনার গোপন রক্তে যে নেশা ছিল, তাতে শস্য দানা ফলবে ততদিন, যতদিন দুই বাংলায় সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকবে।