[দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন]
১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ১০ম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কংগ্রেসে লেনিনের প্রস্তাবে ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ সংক্ষেপে নেপ (NEP) গৃহীত হয়। নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তবাজার ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ট্রটস্কিসহ আরো কয়েকজন নেতা নেপের ব্যাপক বিরোধিতা করলেও স্ট্যালিন দৃঢ়ভাবে এর সমর্থন করেন। ট্রটস্কি নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে পুঁজিবাদী ও পশ্চাদপদ বলে কটূক্তি করেন।
এ সময় ট্রটস্কি ও স্ট্যালিনের মধ্যে দ্বৈরথ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বলশেভিক পার্টিতে লেনিনের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠতে থাকেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিনের প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী বছর, ১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত বলশেভিক পার্টির একাদশ কংগ্রেসে। সেই কংগ্রেসে স্ট্যালিনকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। স্ট্যালিনের সাধারণ সম্পাদক হওয়া যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা পরবর্তী কয়েক বছরের পরিস্থিতি ও কর্মকাণ্ড থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যদিও পার্টির অনেকে স্ট্যালিনকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি, তথাপি স্ট্যালিন সেই পদে অধিষ্ঠিত হন। স্ট্যালিনের নিষ্ঠুরতার জন্য অনেক সিনিয়র বলশেভিক নেতা উক্ত পদের জন্য স্ট্যালিনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, এমনকি স্বয়ং লেনিন স্ট্যালিনের নেতৃত্বের যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তবে স্ট্যালিনের উপর লেনিনের ছিল অগাধ ভরসা।
১৯২২ সালের মে মাসে লেনিন আকস্মিক স্ট্রোক করেন। এই পক্ষাঘাতের পর লেনিন প্রায় অক্ষম হয়ে পড়েন। এমনিতেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক কাজে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে গিয়ে শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি দেননি লেনিন। এ সময় লেনিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সাময়িক বিরতি নেন এবং ক্রেমলিন থেকে দূরে গোর্কিতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে থাকেন। লেনিনের এই অক্ষমতার ফলে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্ট্যালিনের উপর দায়িত্ব বেড়ে যায় এবং পার্টিতে লেনিনের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন স্ট্যালিন।
লেনিনের অসুস্থতা পার্টিতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধিতে স্ট্যালিনকে এক বিরাট সুযোগ এনে দেয়। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পার্টির সকল পর্যায়ে স্ট্যালিনের ছিল ব্যাপক ক্ষমতা। সাধারণ সম্পাদকের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, পার্টির অভ্যন্তরে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন স্ট্যালিন।
১৯২২ সালের ডিসেম্বরে, ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকস (USSR) বা সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পেছনে স্ট্যালিনের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এ সময় লেনিন কিছুটা সুস্থ হয়ে আবারো কাজে ফিরে আসেন। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, তখন লেনিন ও স্ট্যালিনের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
স্ট্যালিনের রূঢ় স্বভাবের ফলে অনেক বলশেভিক নেতা তাকে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের জন্য লেনিনকে প্রভাবিত করেন। একসময় লেনিন স্ট্যালিনকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তিনি তা করেননি, ফলে স্ট্যালিন তার পদে টিকে থাকেন। কিছুদিন পর লেনিন তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করেন এবং অনেকদিন অসুস্থ থাকার পর ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেনিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দায়িত্ব নিলেন স্ট্যালিন। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লেনিনের সমাধিস্তম্ভের ব্যবস্থা করেন স্ট্যালিন। নিজেকে লেনিনের অনুগত হিসেবে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। পেট্রোগ্রাদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লেনিনগ্রাদ। একজন অনুগত লেনিনবাদী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিন প্রকৃতপক্ষেই লেনিনের সবচেয়ে অনুগত শিষ্য ছিলেন।
ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ প্রমুখ অসংখ্যবার লেনিনের বিরোধিতা করেছেন। সেই তুলনায় স্ট্যালিন ছিলেন লেনিনের অত্যন্ত অনুগত। লেনিনকে আদর্শ মেনেই স্ট্যালিন রাজনীতিতে নেমেছিলেন। ১৯০৩ সালে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি যখন দুই ভাগে (বলশেভিক ও ম্যানশেভিক) বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তখনও লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টিতেই যোগ দেন স্ট্যালিন।
রাজনীতির শুরু থেকেই লেনিনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন স্ট্যালিন। তিনি সর্বদাই নিজেকে লেনিনের শিষ্য হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। ১৯৩১ সালে জার্মান লেখক এমিল লুডউইগের সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি লেনিনের ব্যাপক প্রশংসা করেন এবং বলেন, “আমার কথা বলতে গেলে, আমি লেনিনের একজন সামান্য শিষ্য এবং আমার জীবনের লক্ষ্য হলো তার উপযুক্ত শিষ্য হয়ে ওঠা।”
মৃত্যুর পূর্বে লেনিন পার্টির নেতৃত্বের বিষয়ে একটি তথাকথিত উইল করে যান। সেই উইলে তিনি স্ট্যালিনকে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে একজন সহনশীল ও ভদ্র কাউকে এই পদ বসানোর নির্দেশ দেন। তবে, এই উইল সম্পর্কে শুধু পার্টির শীর্ষ কয়েকজন নেতাই জানত, পার্টির সাধারণ সদস্যরা এই বিষয়ে কিছুই জানত না।
অনেকে লেনিনের এই উইলকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, লেনিন এই উইল করে যাননি। লেনিন জীবিতাবস্থায় প্রকাশ্যে যে বিষয়ে কোনো কথা বলে যাননি, মৃত্যুকালে গোপনে কেন উইল করে পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করবেন, এই বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। এজন্য অনেকে এই উইলের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা লেনিনের উইলটি পার্টির আসন্ন ত্রয়োদশ কংগ্রেসে পেশ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং স্ট্যালিন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বহাল থাকেন।
লেনিনের মৃত্যুর পর, তার উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌঁড়ে কয়েকজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দিতে স্ট্যালিনের পাশাপাশি আরো আগ্রহী ছিলেন লিয়ন ট্রটস্কি, গ্রিগরি জিনোভিয়েভ, লেভ কামেনেভ, নিকোলাই বুখারিন, অ্যালেক্সি রাইকভ এবং মিখাইল টমস্কি। এদের প্রত্যেকের মধ্যেই লেনিনের উত্তরসূরি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল। ফলে, কমিউনিস্ট পার্টি কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়।
পার্টিতে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে স্ট্যালিন ট্রটস্কিকে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচনা করেন। স্ট্যালিন আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, লেনিনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ট্রটস্কিই তার বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হবেন। ফলে লেনিন অসুস্থ থাকাকালেই,ট্রটস্কির বিরোধিতা মোকাবিলা করতে স্ট্যালিন জিনোভিয়েভ ও কামেনেভের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। জিনোভিয়েভ ও কামেনেভের ট্রটস্কিকে নিয়ে ভয় ছিল। এই দুজন ভেবেছিলেন ট্রটস্কি একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারেন। একইসঙ্গে এই দুজন স্ট্যালিনের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ব নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন।
স্ট্যালিন কামেনেভ ও জিনোভিয়েভকে বোঝান, লেনিনের মৃত্যুর পর পার্টি একক নেতৃত্বের পরিবর্তে যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া উচিত। ফলে, এই দুজন নেতৃত্বের বিষয়ে ট্রটস্কির তুলনায় স্ট্যালিনকে নিরাপদ বিবেচনা করেন। কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ স্ট্যালিনকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেনে নেন। স্ট্যালিনও দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কৌশলে নিজের ভিত্তি মজবুত করতে থাকেন।
কামেনেভ ও জিনোভিয়েভের প্রস্তাবেই পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে লেনিনের উইল পেশ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সময় স্ট্যালিন, কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ মিলিত হয়ে ট্রটস্কিবিরোধী জোট গঠন করেন। বুখারিনও তখন স্ট্যালিনকে সমর্থন করেন। স্ট্যালিন কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার সমর্থকদের স্থান দিয়ে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন, অন্যদিকে ট্রটস্কিপন্থীদের ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব থেকে সরিয়ে দিতে থাকেন।
ট্রটস্কি ও তার সমর্থকরা স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে, এমনকি লেনিনবাদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকে। ট্রটস্কির এমন কর্মকাণ্ডের জবাবে স্ট্যালিনও ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। স্ট্যালিন বিভিন্ন রচনা ও বক্তৃতায় ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এ সময় এক ভাষণে স্ট্যালিন ট্রটস্কিবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, পার্টিকে অধিকতর মজবুত ও শক্তিশালী করতে হবে এবং পার্টিতে কোনো ভাঙন ধরতে দেওয়া হবে না।
জনগণের সামনে লেনিনবাদকে স্পষ্ট করার জন্য ‘লেনিনবাদের সমস্যা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন স্ট্যালিন। সেখানে তিনি লেনিনবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ এবং সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্ক্সবাদ। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, লেনিনবাদ হচ্ছে সাধারণভাবে সর্বহারা বিপ্লবের কৌশলনীতি, বিশেষ করে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের তত্ত্ব ও কৌশল।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্যালিন অধিকতর স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে থাকেন। পরবর্তীতে একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করে নিজের পথ কণ্টকমুক্ত করতে থাকেন। দলে জিনোভিয়েভ ও কামেনেভের প্রভাব কমাতে প্রথমে তাদের সমর্থকদের বহিষ্কার করেন স্ট্যালিন। তার এহেন কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ তার বিরোধিতা শুরু করেন। কিছুদিন পর কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ প্রকাশ্যে স্ট্যালিনের বিরোধিতা করে ট্রটস্কির পক্ষে যোগ দেন। পরবর্তীতে ট্রটস্কি, কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ মিলে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী জোট গঠন করেন। সম্মিলিত বিরোধী জোট স্ট্যালিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে উঠেপড়ে লাগে।
রাজনৈতিক চালে স্ট্যালিন ছিলেন অন্যদের চেয়ে পাকা। সময়োপযোগী চাল দিয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেন। প্রয়োজনে কাছে টেনে এবং বিরোধিতা করলে বহিষ্কারের মাধ্যমে স্ট্যালিন ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। তবে, স্ট্যালিনের কয়েকটি গুণ তার রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি আবদান রাখে। কে কী চায় তিনি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারতেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, যা তার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
ক্রমেই ট্রটস্কিপন্থী ও স্ট্যালিনপন্থী উপদলের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়তে থাকে। কামেনেভ, জিনোভিয়েভ ও ট্রটস্কিসহ তাদের জোটকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে দলবাজি ও পার্টিতে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন স্ট্যালিন। তিনি তাদের বহিষ্কারের হুমকি দিলে তারা দলাদলি বন্ধে রাজি হয়। কিছুদিন পর আবারো প্রকাশ্যে স্ট্যালিনের বিরোধিতা করতে থাকেন সম্মিলিত বিরোধী জোটের নেতারা। তাদের বিরোধিতার মাত্রা একসময় চরমে পৌঁছায়।
শেষপর্যন্ত স্ট্যালিন সম্মিলিত বিরোধী জোটকে ভেঙে দেন। স্ট্যালিন ধীরে ধীরে ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে পার্টি ও সরকারের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে দিতে থাকেন। পার্টির অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং দলাদলির অভিযোগে ১৯২৬ সালে ট্রটস্কি ও কামেনেভকে পলিটব্যুরো থেকে সরিয়ে দেন স্ট্যালিন। এ সময় জিনোভিয়েভকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
১৯২৭ সালে স্ট্যালিন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে প্রভাবশালী দুই নেতা ট্রটস্কি ও জিনোভিয়েভকে তাদের কিছু সমর্থকসহ বহিষ্কার করেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে বহিষ্কার করে স্ট্যালিন মোটামুটি তার রাস্তা মসৃণ করে দেন। রুশ বিপ্লব ও রাশিয়ান গৃহযুদ্ধে লেনিনের পর সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল লিয়ন ট্রটস্কির। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে ট্রটস্কির বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। এত প্রভাবশালী নেতা সত্ত্বেও রাজনৈতিক চালের মাধ্যমে ট্রটস্কিকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হন স্ট্যালিন।
কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে কমিউনিস্ট পার্টিতে একক আধিপত্য বিস্তার করেন স্ট্যালিন, হয়ে ওঠেন সুপ্রিম লিডার। ১৯২৭ সালের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন।
পার্টিতে বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের বহিষ্কার করলেও তাদেরকে ভুল স্বীকার করে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুযোগে অনেকেই ভুল স্বীকার করে ফিরে আসেন এবং তাদেরকে পুনরায় দলে জায়গা দেওয়া হয়। কিছুদিন পর কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ তাদের ভুল স্বীকার করে পার্টিতে ফিরে আসেন। যদিও কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ পরবর্তীতে আর কখনো কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি, তবে পার্টিতে তাদেরকে জায়গা দেওয়া হয়। পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
১৯২৮ সালের মধ্যে স্ট্যালিন তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেন। এবার তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তৎকালীন ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে বেশ পিছিয়ে ছিল। শিল্পোন্নত পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় রুশ দেশ তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রধানত কৃষিনির্ভর। এছাড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধের কারণে রাশিয়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে যায়। এমতাবস্থায় অত্যন্ত দ্রুত এই অর্থনৈতিক দূরবস্থা কাটিয়ে ওঠার দরকার ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য স্ট্যালিন বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্ট্যালিন বুঝতে পারেন, টিকে থাকতে হলে তার দেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর দাঁড়াতে হবে এবং শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরির জন্য শিল্পোন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। তিনি আরো বুঝতে পারেন, কৃষি দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে শিল্পের সংযোগ ঘটাতে হবে এবং কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হবে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্ট্যালিন অনেকগুলো পরিকল্পনা হাতে নেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।