Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিস্টোফার ম্যাক কেন্ডলেস, ইন্টু দ্য ওয়াইল্ড এবং একটি সংক্ষিপ্ত যাযাবর সফরনামা

সম্ভাব্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। S.O.S! আমাকে বাঁচান। আমাকে সাহায্য করুন। আমি গুরুতর আহত এবং মরতে বসেছি। আমি এতটাই দুর্বল যে এখান থেকে হেঁটে নিরাপদ স্থানে যেতে পারছি না। এখানে আমার সাথে কেউ নেই। আমি একদম একা। আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি মজা করছি না। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলছি, আমাকে বাঁচানোর জন্য কেউ এগিয়ে আসুন। আমি খুব কাছেই জাম সংগ্রহ করতে বেরিয়েছি। সন্ধ্যার দিকে ফিরবো। কেউ থাকলে এগিয়ে আসুন। ধন্যবাদ।

ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস।

?’ আগস্ট”

ডেনালি জাতীয় পার্কের জঙ্গলের কিছুটা গভীরে বেশ জীর্ণ এবং মরচে পড়া ধাতব দেহের একটি বাসের দরজায় সেঁটে দেয়া এই কাগজটি একদল শিকারীর নজরে আসলো। শিকারীদের নিকট এই বাসটি একদম নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরে বাসটি এই জঙ্গলের এখানে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে শিকারীরা দূরে শিকার করতে গেলে বাসটিকে বিশ্রাম করার অস্থায়ী কুটির হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্তু বাসের দরজায় কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা এই আকুতি তাদের কাছে পুরনো ছিল না। বেচারা মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে দিন, তারিখের হিসেব ভুলে বসেছিল। তাই তারিখের স্থলে ‘?’ চিহ্ন দিয়ে স্বাক্ষর করা সেই চিরকুটে।

শিকারীরা যেদিন এই চিরকুট আবিষ্কার করলেন, সেদিনের তারিখ ছিল সেপ্টেম্বর ৬। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। জীবনের অনেকটা সময় দূরন্ত পথিকের ন্যায় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়ানো ম্যাক কেন্ডলেসকে সেই বাসও আর কয়েকদিনের জন্য আটকে রাখতে পারেনি। ঠিকই সে এর ১৯ দিন আগে এক দূর অজানায় পালিয়ে গেছে। যে অজানা থেকে কেউ কখনো ফিরে আসে না।

ডেনালি পার্কের বাসের গায়ে ম্যাক কেন্ডলেসের চিরকুট; Image Source: Into The Wild Book

ক্রিসের সাজানো জগত

২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘ইন্টু দ্য ওয়াইল্ড’ যারা দেখেছেন, তাদের কাছে ক্রিস্টোফার ম্যাক কেন্ডলেস অপরিচিত কেউ নন। সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার এবং একটি সুন্দর জীবনের মায়া ত্যাগ করে অসীমের হাতছানিতে সবকিছু পেছনে ফেলে যাযাবর বনে যাওয়া এই মানুষটির জীবন রঙিন পর্দার দর্শকদের চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করেছিলো। পড়াশোনা, চাকরির চাপ এবং হাজারো দায়িত্বের চাপে পড়ে মাঝে মাঝে আমাদের সবারই ইচ্ছে জাগে, দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়ার। সবার ইচ্ছে হয়, একদিন সবকিছু পেছনে ফেলে প্রকৃতির নিবিড় মায়ায় ঘুরে ফিরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ঠিক ক’জনের সাহস হয়, এই ইচ্ছেকে সত্যতে রূপান্তর করার? আর যদি আপনার সামনে অপেক্ষা করে একটি সম্ভাবনময় ভবিষ্যৎ, তাহলে তো ভুলেও কেউ ওদিকে পা মাড়াবেন না।

বাবা-মায়ের সাথে ক্রিস; Image Source: The Wild Truth

কিন্তু একজন পেরেছিলেন। সেই যাযাবর বনে যাওয়া ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেসের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্মরত প্রকৌশলী পিতা এবং সফল উদ্যোক্তা মায়ের প্রথম সন্তান ক্রিসের উপর পরিবারের স্বপ্ন ছিল বেশি। ক্রিস ছোট থাকা অবস্থায় তার বাবা-মা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ত্যাগ করে ভার্জিনিয়ার আনান্দেল অঞ্চলে বসবাস করা শুরু করেন। এখানে ক্রিসের বোন ক্যারিনের জন্ম হয়। একদম ছোট থেকেই কিছুটা জেদি এবং রগচটা ছিলেন ক্রিস। কিন্তু পড়াশোনায় ছিলেন সবার সেরা। কৃতিত্বের সাথে তিনি স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। কলেজ জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু একদিন ক্রিস এক অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হন। তিনি জানতে পারেন, তার বাবার ক্যালিফোর্নিয়াতে আরেকজন স্ত্রী রয়েছেন। সেই স্ত্রীর ঘরে দুই সন্তানও রয়েছে।

এই কথা জানার পর যেন নিজের বাবাকে অচেনা লাগে ক্রিসের। এর মানে কি আজীবন যে মানুষকে তিনি বাবা হিসেবে জেনে এসেছেন, তিনি সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ? দ্রুত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ক্রিস। এখান থেকেই যেন ক্রিসের নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগতে শুরু করে। তিনি নিজের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। যাযাবর হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি একবারও তাদের সাথে কথা বলেননি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন

কলেজ পাস করে ক্রিস আটলান্টার এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে তিনি ইতিহাস এবং নৃতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। এই সময়ে তিনি আধুনিক সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও তিনি কিছু পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি ঈর্ষণীয় ফলাফল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেন। তার সিজিপিএ ছিল ৪ এ ৩.৭২। এই উচ্চ সিজিপিএ নিয়ে যেখানে নব্য গ্রাজুয়েটরা স্বপ্নে বিভোর থাকে, সেখানে ক্রিস ছিলেন পুরোদস্তুর হতাশ। তার কাছে এসব কিছুর কোনো মানে ছিল না। তিনি মনে করতেন, উচ্চশিক্ষা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মেকি। তাই তিনি চাকরিজীবনে প্রবেশ করতে অনুৎসাহী ছিলেন।

একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে পালিয়ে যান ক্রিস; Image Source: Boredom Therapy

ক্রিস পারিবারিক সূত্রে বেশ ভালো অংকের টাকার মালিক হতেন। কিন্তু হুট করে তিনি সবকিছু পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষাবৃত্তি থেকে প্রায় ২০ হাজার ডলারের মতো অর্থ তিনি পেতেন। পুরো অর্থ তিনি ক্ষুধা নিবারণ সংস্থা OXFAM-এ দান করে দেন। এরপর একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে পালিয়ে যান এই বিষাক্ত সভ্যতা ছেড়ে, গহীন অরণ্যের দিকে, যেখানে প্রকৃতি তাকে হাতছানি দিচ্ছে।

ক্রিস থেকে অ্যালেক্স

সংসার জীবন ত্যাগ করে ক্রিসের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের ১ জুলাই। নিজের পুরাতন গাড়িতে চড়ে ক্রিস সোজা পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে অ্যারিজোনা গিয়ে পৌঁছালেন। এখানে বন্যার পানিতে ভিজে তার গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তাই গাড়ির গায়ে একটি ছোট চিরকুট ঝুলিয়ে দিলেন। সেখানে লিখলেন, কেউ যদি গাড়িটি চালাতে পারে, সে বিনা অনুমতিতে গাড়িটি নিয়ে যেতে পারবে। এরপর গাড়ির পেছনের আসনে নিজের অধিকাংশ সামগ্রী ফেলে পায়ে হাঁটা শুরু করেন তিনি। পদব্রাজক ক্রিস এরপর থেকে যার সাথেই পরিচিত হন, নিজেকে‘অ্যালেক্স সুপারট্রাম্প’ নামে পরিচয় দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ক্রিসের এখানেই যবনিকাপাত হয়। জন্ম হয় যাযাবর অ্যালেক্সের।

গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেলে তা পরিত্যাগ করেন ক্রিস; Image Source: Pixabay/CC0 1.0

পৃথিবীর পথে পথে

যাযাবর অ্যালেক্সের দীর্ঘ যাত্রায় প্রথম বন্ধু হয় জেন বারস নামক এক নারী। তিনি নিজেও অ্যালেক্সের ন্যায় পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু তিনি অ্যালেক্সের ন্যায় পায়ে হাঁটতেন না। তার একটি গাড়ি ছিল। অ্যালেক্স ১৯৯০ সালের ১৫ আগস্ট দেখা পান জেনের। নিজের মায়ের বয়সী জেনের মাঝে যেন হারানো মাতৃস্নেহ খুঁজে পান অ্যালেক্স। তাই খুব কম সময়ের মাথায় তিনি জেনের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। তবে অ্যালেক্সকে কোনো এক জায়গায় বেশিদিন ধরে রাখা দুষ্কর। তাই কিছুদিন পরেই তিনি জেনকে ফেলে নতুন গন্তব্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরতেন তিনি। আর রাতটা কাটিয়ে দিতেন স্থানীয় ট্রেনের বগিতে। মাঝে মাঝে খোলা আকাশের নিচেও রাত কাটিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে অ্যালেক্সের কোনো মাথাব্যথা নেই। এভাবে তিনি পৌঁছে যান দক্ষিণ ডাকোটায়।

ওয়েস্টবার্গ দম্পতির সাথে ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস (মাঝে); Image Source: Alex Supertramp Journal

ডাকোটায় তিনি এক নতুন বন্ধুর খোঁজ পান। ওয়েন ওয়েস্টবার্গ নামক এই নতুন বন্ধু শস্য খামারে কাজ করতো। অ্যালেক্স ওয়েনের সাথেও দ্রুত বন্ধুত্ব গড়ে ফেলেন। ওয়েন অ্যালেক্সের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল বলে ধারণা করা হয়। অ্যালেক্স ক’দিন পর ওয়েনের খামারে কাজ করাও শুরু করেন। এর প্রধান কারণ ছিল, অ্যালেক্স তখন পথের ফকির। পকেটে এক সেন্টও ছিল না। হয়তো তিনি এখানে আরো কয়েকদিন থাকতেন। কিন্তু ঝামেলা করলো পুলিশ। বন্ধু ওয়েন বেআইনি কাজে ফেঁসে গেলে অ্যালেক্স দক্ষিণ ডাকোটা থেকে মেক্সিকো পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে থাকলেও এবার শুরু হলো বিদেশ যাত্রা। আর এই বিদেশ যাত্রায় তার বাহন কোনো বিমান ছিল না, ছিল একটি কায়াক (নৌকার মতো একপ্রকার বাহন)।

কায়াকে চড়ে মেক্সিকো রওয়ানা দিলেন ক্রিস; Image Source: Chris Wechter

কায়াকে চড়ে মেক্সিকো উপসাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে যান অ্যালেক্স। এখান থেকে কিছু স্থানীয় মেক্সিকান অ্যালেক্সকে ট্রাকে করে কিছু দূর এগিয়ে দেন। মেক্সিকোর শুষ্ক আবহাওয়ায় কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো কায়াকে চড়ে অ্যালেক্স বিচরণ করেন তার নিজস্ব জগতে, যেখানে জীবন মানেই মুক্তি। মাঝে মাঝে বন্ধু জেনকে পোস্টকার্ড পাঠাতেন তিনি। নিজের ভ্রমণ কাহিনীকে একটি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন তিনি। তবে মেক্সিকোর কায়াকে চড়া জীবনও দীর্ঘস্থায়ী হলো না অ্যালেক্সের। ১৯৯১ সালে নতুন বছরের শুরুতে তিনি পুনরায় নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিন।

মেক্সিকো থেকে ফেরত ক্রিস

মেক্সিকো প্রবেশের সময় সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও ফিরতি পথে ধরা পড়লেন অ্যালেক্স। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপরাধে তাকে পুলিশ হাজতে পাঠিয়ে দিলো। অ্যালেক্স কাউকে বোঝাতে পারলেন না, তিনি একজন যাযাবর। অবশ্য বোঝাতে পারলেও কোনো লাভ হতো নাকি! আইনের চোখে যাযাবরদের জন্য কোনো ছাড় নেই। কিন্তু ভাগ্যক্রমে দায়িত্বরত পুলিশ অ্যালেক্সের কথা মন দিয়ে শুনলেন। তিনি অ্যালেক্সকে এক শর্তে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশের অনুমতি দিলেন। সেটি হলো, অ্যালেক্সের সাথে রাখা অস্ত্রটি থানায় জমা থাকবে। অ্যালেক্স এক গাল হেসে রাজি হয়ে গেলেন। মাত্র তিন মাসের মেক্সিকো ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরলেন অ্যালেক্স সুপারট্রাম্প।

যাযাবর জীবন উপভোগ করছেন অ্যালেক্স; Image Source: Alex Supertramp Journal

দেশে এসে তিনি পুনরায় নিজের নাম ‘ক্রিস’ ব্যবহার শুরু করলেন। কারণ, তিনি বুলহেড সিটির ম্যাক ডোনাল্ড’সে চাকরি নিয়েছিলেন। এখানে তিনি ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেন। বেশ কয়েক মাস এখানেই কাটালেন তিনি। এরপর যথেষ্ট ডলার সঞ্চয় হওয়ামাত্র ফের পথের অ্যালেক্সে ফিরলেন ক্রিস। পুনর্জন্ম নেওয়ার পর তিনি তার বন্ধু জেন বারসের সাথে দেখা করতে যান। জেন তখন তার প্রেমিক ববের সাথে একটি বইয়ের দোকান চালাতেন। এখানেই বছরের শেষ সময়টুকু অতিবাহিত করেন অ্যালেক্স।

সেই বিখ্যাত জার্নালের একটি পৃষ্ঠা; Image Source: J C Neville

আলাস্কার জিম গেলিয়েন

ছটফটে অ্যালেক্স পুনরায় জেন বারস থেকে বিদায় নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ ডাকোটা ভ্রমণ করে এপ্রিলের ২৮ তারিখ পাড়ি জমান আলাস্কায়। এখানে তিনি জিম গেলিয়েন নামক এক বিদ্যুৎ মিস্ত্রীর সাথে বন্ধুত্ব করেন। জিম বেশ মিশুক স্বভাবের মানুষ। অ্যালেক্স প্রথম আলাপেই জিমকে বেশ পছন্দ করে ফেলেন। তিনি জিমকে নিজের যাযাবর জীবনের গল্প শোনান। অ্যালেক্সের গল্প শুনে জিম বুঝতে পারলেন, যত ভালো বন্ধুত্বই হোক না কেন, অ্যালেক্স আর কিছুদিন পরেই আবার নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবেন। এবং হলোও তা-ই। ক’দিন পরেই অ্যালেক্স ডেনালি জাতীয় পার্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন।

আলাস্কায় পৌঁছালেন অ্যালেক্স; Image Source: Letty

বন্ধু জিম অ্যালেক্সকে নিজের গাড়িতে করে স্টামপিডি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। গাড়ি থেকে নামার সময় অ্যালেক্সের সাথে ছিল মাত্র ১০ পাউন্ড চাল, জঙ্গলে টিকে থাকার উপর লেখা কয়েকটি বই ও একটি .২২ রাইফেল। অ্যালেক্সের সাথে কোনো ভালো মানচিত্রও ছিল না। সামান্য এই সরঞ্জাম নিয়ে ডেনালি পার্কের মতো দুর্গম জঙ্গলে টিকে থাকা অভিজ্ঞ শিকারীদের জন্যও দুরূহ হবে। সেখানে অ্যালেক্স নির্ঘাত মারা পড়বে, এমনটাই আশঙ্কা করেছিলেন জিম। একাকী হেঁটে চলা অ্যালেক্সের কি সেই ভয় আছে? সে দিব্যি হেঁটে চললো গহীন অরণ্যের দিকে।

মাত্র ১০ পাউন্ড চাল নিয়ে রওয়ানা দিলেন অ্যালেক্স; Image Source: Outside Magazine

জাদুর বাসে ১১৩ দিন

ডেনালি পার্কের টেকলানিকা নদীর তীর থেকে কিছুটা ভেতরে গেলেই সবার চোখে পড়বে নীল-সাদা রঙ করা একটি পুরাতন বাস। জায়গায় জায়গায় রঙ উঠে যাওয়া এই বাসটি যতই পুরাতন হোক, অ্যালেক্সের কাছে এটিই ছিল নিরাপদ আশ্রয়। মাথার উপর ছাদ থাকা মানে রাতের তুষার থেকে মুক্তি। এছাড়া খোলা জঙ্গলে বন্য প্রাণীর আক্রমণের হাত থেকে মুক্তি দিবে এই বাস। তাই সবকিছু ভেবে একেই বাসস্থান হিসেবে বেছে নিলেন তিনি।

ডেনালির সেই জাদুর বাস; Image Source: Glogster

ডেনালির গহীন জঙ্গল থেকে অ্যালেক্স বিভিন্ন ফল এবং বুনো সবজি সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে লাগলেন। অ্যালেক্স তার সাথে থাকা বই ঘেঁটে ঘেঁটে খাওয়ার উপযোগী গাছের নাম শিখতে থাকেন। গাছ, লতা-পাতা ছাড়াও জংলি কাঠবেড়ালি, হাঁস প্রভৃতি প্রাণীর শিকার করে সেদিনের আহারের সংস্থান করতেন তিনি। কিন্তু দিন এনে দিন খেয়ে জঙ্গলে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। তাই একদিন অ্যালেক্স একটি হরিণ শিকার করলেন। কিন্তু অ্যালেক্সের ভাগ্য খারাপ হওয়ায় হরিণ ভক্ষণের আগেই এর অধিকাংশ মাংস নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনাকে অ্যালেক্স তার ডায়েরিতে তার যাযাবর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ট্র্যাজেডি এখানেই শেষ হয়নি। শেষদিকে তার ডায়েরির দিনলিপি পড়ে বোঝা যাচ্ছিলো, জঙ্গল জীবন অ্যালেক্সকে কাবু করে ফেলেছে।

বাসের ভেতর ক্রিসের নিবাস; Image Source: The Flying Tortoise

অ্যালেক্স অনেকদিন চেষ্টা করলেন ডেনালিতে টিকে থাকার, কিন্তু শেষমেশ হার মানলেন। অনেক হয়েছে, এবার বাড়ি ফেরা যাক। তিন মাস পর অ্যালেক্স সুপারট্রাম্প পুনরায় ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস বনে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কথায় আছে না- অভাগা যেথায় যায়, সাগর শুকিয়ে যায়! অ্যালেক্স শহরের দিকে ফিরতে শুরু করলেন। কিন্তু যে পথ ধরে তিনি ফিরছিলেন, তা তখন তুষার গলা জলে প্লাবিত। তাই অ্যালেক্স শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে পথ পাড়ি দিতে পারলেন না। নিরুপায়, অসহায়, পরাজিত অ্যালেক্স পিছু হটলেন। ততক্ষণে দিনের সূর্য টুপ করে ডুব দিয়েছে পশ্চিম দিগন্তে।

নীল জামের মুগ্ধতা!

অ্যালেক্স জঙ্গলে থাকা অবস্থায় যেসব সবজি খেয়ে জীবনধারণ করতেন, এর মধ্যে জংলি আলুও ছিল। প্রথমদিকে সেগুলো খেতে খারাপ না লাগলেও, একসময় তা বেশ তিক্ত হয়ে ওঠে। অ্যালেক্স তাই আলু ছেড়ে এর বীজ খাওয়া শুরু করে। ততদিনে অ্যালেক্স খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার উপরে বীজগুলোও নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাই খুব সহজে তা অ্যালেক্সের দেহে বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হলো। সেদিনের হাসিখুশি যাযাবর তখন ডেনালির গহীন অরণ্যে একাকী বিষক্রিয়ায় ছটফট করে মরতে বসলেন। তিনি সাহায্য চেয়ে অজানা শিকারীর প্রতি চিরকুট লিখে বাসের দরজায় সেঁটে দিলেন। এরপর শুরু হলো অপেক্ষা। কিন্তু কেউ তার অপেক্ষার প্রহর ভাঙতে এগিয়ে এলো না। এদিকে তার স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির পথে ধাবিত হলো।

জংলি সবজি খেয়ে দিন গুজরান করছিলেন ক্রিস; Image Source: NPR

অ্যালেক্স বেশ অসুস্থ শরীর নিয়ে ডায়েরির পাতা খুললেন। এরপর বেশ অস্পষ্ট হাতের লেখায় তিনি লিখলেন,“নীল জাম খুব সুন্দর!” সেদিন ছিল তার বনবাসের ১০৬তম দিন। এরপর তিনি আর কখনো কলম হাতে নিতে পারেননি। নীল জামের একরাশ মুগ্ধতার স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে আর ৭ দিন পরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ক্রিস্টোফার ম্যাক কেন্ডলেস ওরফে অ্যালেক্স সুপারট্রাম্প।

পত্রিকার পাতায় ক্রিসের মৃত্যুসংবাদ; Image Source: People

মৃত্যুর ১৯ দিন পর (বনবাসের ১৩২তম দিন) একদল শিকারী সেই জাদুর বাসের সন্ধান পেলেন। সেই সাথে অবসান ঘটলো ক্রিসের অপেক্ষার। এর সাথে অপেক্ষার অবসান ঘটলো তার বাবা-মায়ের, যারা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন তার সন্তানকে। অনেকের কাছে ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস একজন নায়ক, যিনি আধুনিক যুগের নোংরা বাস্তবতাকে পরিত্যাগ করে একজন মুক্ত যাযাবর হিসেবে পৃথিবীর পথে পথে জীবনকে উপভোগ করে গেছেন। অনেকের কাছে ক্রিস একজন জেদি, একগুঁয়ে ও বোকা, যিনি স্বার্থপরের ন্যায় নিজের কথা ভেবে তার পরিবারকে এক অবর্ণনীয় দুঃখের মাঝে ফেলে পাকিয়ে গেছেন। কোন পক্ষের কথা সঠিক, সে যুক্তি-তর্কের ধারে যাচ্ছি না। শুধু বলবো, ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেসের জীবন আমাদের নিকট এমন এক নিদর্শন, যা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু উপলব্ধি করার আছে।

অনেকের কাছে ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস একজন নায়ক; Image Source: Jon Krakauer
সিনেমার পর্দায় ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেসের চরিত্রে অভিনয় করেন এমিল হার্স; Image Source: IMDB 

ম্যাক কেন্ডলেসের ডায়েরির পাতা থেকে তার জীবনের যে গল্প উঠে এসেছে, তাকে পুঁজি করে মার্কিন লেখক এবং অভিযাত্রিক জন ক্রাকাউর ১৯৯৬ সালে প্রকাশ করেন জীবনী গ্রন্থ ‘ইন্টু দ্য ওয়াইল্ড’। বিখ্যাত পরিচালক শন পেন ২০০৭ সালে এটিকে সিনেমায় রূপান্তরিত করেন। ম্যাক কেন্ডলেসের সেই বাসটি এখনো ডেনালির অরণ্যে পড়ে আছে। শুধু নেই এর সামনে বসে একসময় হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে ক্যামেরাবন্দী হওয়া ক্রিস ম্যাক কেন্ডলেস।

This is a Bangla article about Chris McCandless, who left all his fortune behind to be a nomad. He had quite a journey around the states and also outside the border. But this journey came to an end with a tragedy. His life story was converted into a book named 'Into the wild' and also into a movie of the same name.

Reference: All the other references of this articles are hyperlinked.

Featured image: USA Today

Related Articles