“চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর।”
৯০ এর দশকে, যখনও কোনো ভিডিও গেম ছিল না, কিংবা মোবাইল-ট্যাবলেট আর কম্পিউটার গেমস সুলভ হয়ে ওঠেনি, সেসময়ের যেকোনো ছেলে-মেয়ের কাছে এই লাইনটি ছিল অত্যন্ত পরিচিত। সে সময়ে দুপুরের রোদ্দুরে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে কমিক্স পড়া কিংবা স্কুল ফাইনালে ভাল নাম্বার পেলে উপহার হিসেবে দু-চারটা রংচঙে গল্পের বই উপহার পাওয়া- এসবই ছিল শৈশবের আনন্দ। এই আনন্দের ভাগটুকুর অধিকাংশ জায়গাই বোধহয় দখল হয়ে আছে ‘চাচা চৌধুরী’, ‘সাবু’, ‘বিল্লু’, ‘পিংকী’ আর ‘রমন’দের দিয়ে।
বাজি ধরে বলা যায়, এই নামগুলো শুনে অনেকের মুখেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। যারা জানেন না, তাদের জন্য বলি, এরা সব জনপ্রিয় কিছু কমিক্সের চরিত্র, যাদের আঁকড়ে ধরে অনেকের রঙিন শৈশব কেটে গেছে।
আমরা সবাই টিনটিনের অনেক ভক্ত, কিন্তু ক’জন জানেন এই বিখ্যাত কমিক সিরিজের স্রষ্টার নাম হার্জ? স্ট্যান লি’র নাম শুনলে ক’জন বলে দিতে পারবেন যে স্পাইডারম্যান, থর এক্স-ম্যান আর হাল্কের সৃষ্টির কারিগর তিনি? সম্ভবত সৃষ্টিশীল মানুষের কৃতিত্বটা ঠিক এই জায়গাটাতেই যে লোকে তাদের চাইতেও তাদের সৃষ্টিকে আজীবন মনে রাখে। সেজন্যেই বোধহয় চাচা চৌধুরী, ভিনগ্রহের পালোয়ান সাবু আর তাদের নীল রঙের কুকুর রকেটের কীর্তিকলাপ সবাই জানলেও তাদের কারিগরের নামটি অনেকেরই অজানা।
চাচা চৌধুরী বা পিংকী-বিল্লুর কমিক্সের ওপরের দিকে বাম কোণায় একটা চারকোণা বক্সের ভেতর লেখা থাকে ‘ডায়মন্ড কমিক্স’, আর কমিক্সের শিরোনামের ওপর বা নিচে ছোট করে লিখা থাকে ‘প্রাণ’ কথাটি। ছোটবেলায় অনেকেই ভাবে, কমিক্সের নামটিই বুঝি ‘চাচা চৌধুরী প্রাণ’। কিন্তু খুব কম লোকই জানেন, যে ব্যক্তি শিশু-কিশোরদের জন্যে এমন একটা রঙিন জগত সৃষ্টি করেছেন, সেই জনপ্রিয় কার্টুনিস্টের নামটিই আসলে ‘প্রাণ‘।
প্রাণ কুমার শর্মা
কত ছেলেমেয়ে বইয়ের পাতার ফাঁকে বিল্লু পিংকী সাবু বা চাচা চৌধুরীর কমিক্স রেখে ধরা পড়ে বাবা-মায়ের কানমলা খেয়েছে, তার আসলে কোনো ইয়ত্তা নেই। একটা কমিক্স পেলে সেটাকে খুব যত্ন করে আস্তে আস্তে পড়তে হত, কারণ শেষ হয়ে গেলে আবার কবে নতুন হাতে আসবে তার তো ঠিক নেই। বন্ধুদের সাথে বা পাড়ার সমবয়সীদের সাথে কয়েকটা কমিক্স ভাগাভাগি করে পড়ার যে রোমাঞ্চ, তার সাথে এখনকার ভিডিও গেমের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু যে লোকটি আমাদের চমৎকার ছোটবেলা উপহার দিয়েছেন, সেই প্রাণ কুমার শর্মার জীবন কেমন ছিল?
প্রাণ কুমার শর্মা ১৯৩৮ সালের ১৫ই আগস্ট বর্তমান পাকিস্তানস্থিত কাসুর নামের ছোট্ট একটি গ্রামে জন্ম নেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর প্রাণের পরিবার ভারতের গোয়ালিয়রে চলে আসে, সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে। তিনি পলিটিক্যাল সায়েন্সে দিল্লি থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর হুট করে মাথায় তার আঁকাঝোকার ভূত চেপে গেল, ভর্তি হয়ে গেলেন মুম্বাইতে স্যার জে জে স্কুল অফ আর্টসের ফাইন আর্ট বিভাগে। সেখান থেকে ফাইন আর্টের ওপর ডিপ্লোমা করেন তিনি। পড়াশোনার পাট এভাবেই চুকলো তার।
কিন্তু তাতে কী হবে, যার মাথাভরা এমন দুর্দান্ত সব কার্টুনের আইডিয়া আর গল্পের ফুলঝুরি- তার দ্বারা কি আর আর্ট পলিটিক্স ওসব সম্ভব? কাজেই প্রাণ ঝুঁকে গেলেন নিজের প্রচণ্ড আগ্রহের একটি জগতে, আর তা হলো কার্টুন। কার্টুনিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ারটি শুরু হয় ১৯৬০ সালে, যখন ‘দৈনিক মিলাপ’ এ প্রথমবারের মতো তার ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়। সে সময়ে তার তৈরি ‘ডাবু’ চরিত্রটি ভারতজুড়ে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
সে সময়ে গোটা ভারতে বিদেশী কমিক্স স্ট্রিপের একাধিপত্য ছিল। ভারতীয় কার্টুনিস্ট তখনও সেভাবে তৈরি হয়ে ওঠেননি। প্রাণ ভাবলেন, এই ব্যাপারটার একটা পরিবর্তন আনা যাক। তখন তিনি স্থানীয় সমস্যাবলীকে মুখ্য রেখে ভারতীয় নর-নারীদের নিয়ে আকর্ষণীয় সব কমিক্স বানাতে শুরু করেন।.১৯৬৯ সালে প্রাণ চাচা চৌধুরীর স্কেচ করতে শুরু করেন। ‘লোটপোট’ নামের একটি হিন্দি ম্যাগাজিনে চাচা চৌধুরীর কমিক্স স্ট্রিপ প্রথমবারের মতো ছাপা হয়। এরপর এটি সিরিজ আকারে ছাপা হতেই থাকে, যা তার জন্য খ্যাতির দুয়ার খুলে দেয়।
সম্মাননা ও পুরস্কার
চাচা চৌধুরীর পর একে একে বিল্লু, পিংকী, রমন, শ্রীমতিজী আর চান্নি চাচী চরিত্রের মজাদার সব কমিক্স বের করেন প্রাণ। তার কমিক্সের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, চরিত্রগুলো আশেপাশের লোকেদের মধ্য থেকেই নেওয়া। কেবল সাবু বাদে বোধহয় আর কোনো চরিত্রই অবাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায় না। আর ছোটখাট মজার মজার দু’একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে যে দুর্দান্ত কাহিনী বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি, তার কোনো জুড়ি নেই।
গত ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট কার্টুনিস্ট এই কিংবদন্তী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি পেয়েছেন গোটা ভারত আর বাংলাদেশের অজস্র ভালবাসা। আমাদের সকলের শৈশবের কারিগর তো এই প্রাণই, তিনি যেন সত্যিকার অর্থে গোটা কার্টুন জগতের প্রাণ। তার মতো করে আর কে কবে আমাদের ছোটবেলাকে এত বৈচিত্র দিতে পেরেছে? প্রাণকে সকলে ভালবেসে ‘ভারতের ওয়াল্ট ডিজনি’ বলে থাকে। তবে সম্ভবত তিনি নিজের কাজের মাত্রায় ডিজনির চাইতেও অনন্য অসাধারণ একজন শিল্পী ছিলেন।
১৯৮২ সালে তিনি সর্বপ্রথম তার কাজের জন্য ‘ঠিঠোলী’ পুরস্কারে সম্মানিত হন। দেশি কমিক্সকে ভারতে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ১৯৯৫ সালে লিমকা বুক অফ রেকর্ডেও তার নাম উঠেছিল। এরপর ২০০১ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কার্টুনিস্টের পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সম্মাননাটি তিনি পান মৃত্যুর পর, আর তা হলো মরণোত্তর পদ্মশ্রী পুরস্কার।
প্রাণের তৈরি কয়েকটি চরিত্র
প্রাণের তৈরি এই চরিত্রগুলো সবার কাছে এত আপন হয়ে যাবার রহস্য বোধহয় এই যে, আমাদের মনে একটা ভারহীন হাসির উদ্রেক করে এই চরিত্রগুলো। এদের নিয়ে আরও পড়ার ইচ্ছা আমাদের মাঝে জেগে ওঠে। এমনকি এখন যে হালের বেসিক আলী, বাবু বা অন্য যত বিখ্যাত সব কার্টুন, তাদের আর্টিস্টরাও কিন্তু এই প্রাণের কমিক্স পড়েই বড় হয়েছেন। প্রাণের উদ্দেশ্যই ছিল ভারতকে বিদেশি কমিক্সের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে দেশি কমিক্সের প্রচলন করা, যা তিনি সফলভাবেই করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন, “বর্তমান যুগে দৈনন্দিন জীবনযাপনে অত্যধিক ট্যাক্স এবং মূল্যবৃদ্ধির চাপের জন্য জর্জরিত ভারতবাসীদের মুখে যদি একটুও হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি, তাহলে আমি মনে করবো যে আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।”
প্রাণের এই অবদান বৃথা যায়নি, আজও তিনি বেঁচে আছেন তার তৈরি করা সব চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এখনও এ যুগের বাচ্চারা তার লেখা ও আঁকা কমিক্স পড়ে খুশি হয়। তো দেখে নেয়া যাক প্রাণের কয়েকটি জনপ্রিয় চরিত্রকে।
চাচা চৌধুরী ও সাবু
কম্পিউটারের চেয়ে প্রখর মগজের চাচা চৌধুরীকে নব্বইয়ের দশকের ছেলেমেয়েরা সুপারহিরোর চাইতে কোনো অংশে কম ভাবে না। লাল পাগড়ি আর সাদা গোঁফের আড়ালের বুদ্ধিদীপ্ত হাসির এই লোকটি অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী। যেকোনো রহস্য বা যে কারও ঝামেলার সমাধান তার কাছে আছে। নিজের জিপ ডগডগ আর কুকুর রকেট তার সর্বক্ষণের সঙ্গী।
তবে চাচা চৌধুরীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পালোয়ান সাবু। জুপিটার গ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসা এই বিশালদেহী পালোয়ানের মনটা অবশ্য শিশুদের মতোই। খেতে খুব ভালবাসে, আর তাই রোজ কাকীমা তাকে ৫০-৬০টা গরম লুচি আর লস্যি বানিয়ে দেন। তবে রেগে গেলে কিন্তু সাবুর মাথা একেবারেই ঠিক থাকে না। আর সেজন্যেই কমিক্সেও বলা আছে, “সাবু যখন রেগে ওঠে তখন দূরে কোথায় আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ে”। চাচা চৌধুরী আর সাবুর চিরশত্রু হলো রাকা, যে এক আশ্চর্য ওষুধ খেয়ে অমর হয়ে আছে। এছাড়া এতে রয়েছে ধমাকা সিং, গোবর সিং আর টিঙ্গু মাস্টারের মতো মজার মজার কয়েকটি চরিত্র।
পিংকী
সেই যুগের সুপারহিট মেয়ে চরিত্র হলো পিংকী। প্রাণ তাকে তৈরি করার সময় খুব সম্ভবত চাঞ্চল্য একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছিলেন! আর তাই কমিক্সের মধ্যে পিংকী বড়দের কাছে সমস্যার এক অন্যতম কারণ। কখনও সে দাদুকে জ্বালাচ্ছে, কখনও বা প্রতিবেশী ঝপট কাকুর বাড়ি গিয়ে তাকে উপদ্রব করছে। পিংকী আর তার পোষা কাঠবেড়ালি কুটকুট সবার খুব পরিচিত। বিশেষ করে তার সুন্দর সুন্দর ফ্রক আর বব করে কাটা চুলের ব্যান্ডের জন্য মেয়ে বাচ্চারা তাকে খুব পছন্দ করে। কার্টুনিস্ট প্রাণের এক ছটফটে চরিত্র এই পিংকী।
বিল্লু
প্রাণের আরেকটি কমবয়সী জনপ্রিয় চরিত্র হলো কিশোর বিল্লু। চোখের উপরে পড়ে থাকা চুলের বিল্লু পরিবারের একমাত্র আদরের ছেলে। কখনও সে গানের কনসার্টে যায়, কখনও পিকনিক করতে আর কখনও বা নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চার করতে। বিল্লুর সাথে একটিমাত্র লোকের সবসময়েই গোলমাল বেঁধে যায়, আর সে হলো বজরঙ্গী পালোয়ান। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার সাথে এটা সেটা নিয়ে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। বিল্লুর প্রিয় বান্ধবীর নাম জোজী, জোজীর বাবা কর্নেল থ্রি নট থ্রি-কে বিল্লু খুব ভয় পায়। বদমেজাজী এই লোকটি কথায় কথায় বিল্লুর দিকে বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসেন। সব মিলিয়ে বিল্লু্কে কম-বেশি সবাই-ই খুব পছন্দ করে।
রমণ
ছাপোষা নিরীহ এক ভদ্রলোকের গল্প নিয়ে তৈরি এই কমিক্সটিও বেশ জনপ্রিয় আর সুখপাঠ্য। প্রতিদিনকার জীবনের নানা বাস্তব সমস্যাকে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রাণ নিপুণ হাতে, কিন্তু হাস্যরসের মধ্য দিয়ে। রমণের গল্প এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে।
শ্রীমতিজী
প্রাণ কুমার শর্মা সম্ভবত চেয়েছিলেন সব শ্রেণীর মানুষকে তার কার্টুনের মাধ্যমে স্পর্শ করতে। আর সেজন্যই বোধহয় তার একটি অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র হলো শ্রীমতিজী, যে ভারতের আর দশজন সাধারণ গৃহিণীদের একজন। শ্রীমতিজী কমিক্সের মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন ঘরকান্নার বিভিন্ন সমস্যা, ভারতের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন এসব কিছুই খুব হালকা চালে তিনি দেখিয়েছেন। সেজন্য এই কমিক্সটি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। একটি ভারতীয় পত্রিকায় সিরিজ আকারে শ্রীমতিজীর কমিক্স স্ট্রিপ নিয়মিত প্রকাশিত হত।
ওপরে বর্ণিত কমিক্সগুলো ছাড়াও আরও অনেক চরিত্র আছে, যারা প্রাণের হাতে তৈরি। এসব চরিত্র আমাদের হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে আর আমাদের শৈশবকে করে তুলেছে আরও রঙিন। প্রাণ কুমার শর্মার কাছে নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরা তাই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।