যুগ যুগ ধরে মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে আকাশের ওপারে কী আছে জানার। চেষ্টা চলেছে পৃথিবীর বাইরে আর কোথাও, অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না তা জানার। মহাকাশের রহস্য ভেদ করতে অনেক ব্যর্থ-সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদও বাদ যায়নি এসব অভিযান থেকে। পঞ্চাশ বছর আগে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছিল, যেদিন চাঁদে প্রথম কোনো মানুষের পা পড়েছিল আর সেই মানুষটি ছিলেন নীল আর্মস্ট্রং।
১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো-১১ মিশনটির মাধ্যমে চাঁদে প্রথমবারের মতো কোনো মানুষ পদার্পণ করেছিল। সেই বছরের ২০ জুলাই ১০.৫৬ পি এম EDT (স্থানাংকিত আন্তর্জাতিক সময় বা UTC সময় অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ০২.৫৬) মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং প্রথম কোনো মানুষ হিসেবে চাঁদের গায়ে নিজের পদচিহ্ন এঁকে দেন।
নীল আর্মস্ট্রংয়ের পুরো নাম নীল এল্ডেন আর্মস্ট্রং। ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেটের ওয়াপাকনেটা নামক স্থানে। তিনি ছিলেন স্টিফেন কনিগ আর্মস্ট্রং এবং ভায়োলা লুইসা এঞ্জেল দম্পতির প্রথম সন্তান। বংশানুক্রমিকভাবে তিনি একজন স্কটিশ ও জার্মান।
তিনি একাধারে একজন মহাকাশচারী, অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, নেভাল অ্যাভিয়েটর, টেস্ট পাইলট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৩৬ সালের ২০ জুলাই মাত্র ছয় বছর বয়সে যখন তিনি প্রথমবারের মতো বিমান যাত্রা করেন তখন থেকেই তার বিমান এবং এভিয়েশন বিষয়ে অদম্য আগ্রহ জন্ম নেয়। ১৯৪৭ সালে তিনি তার ষোলতম জন্মদিনে একজন লাইসেন্সড পাইলট এবং নেভাল এয়ার ক্যাডেটের স্বীকৃতি পান। তিনি বয়েজ স্কাউটের সদস্য ছিলেন এবং এর সর্বোচ্চ সম্মাননা ঈগল স্কাউট অর্জন করেন।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে তিনি নেভির মিডশিপম্যান হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। ২ মার্চ ১৯৫০ সালে তিনি প্রথমবারের জন্য কোনো বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে তার বিমান অবতরণ করান।
নীল আর্মস্ট্রং ইন্ডিয়ানার পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে তাকে কোরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হওয়ায় তার পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয়। পরে কিছুটা দেরিতে ১৯৫৫ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন। কোরীয় যুদ্ধের সময় একবার তার প্লেন গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছিল। ওই যুদ্ধে তার সাহসীকতার জন্য তিনি তিনটি এয়ার মেডেলে ভূষিত হন। এর বহু বছর পরে ১৯৭০ সালে যখন তিনি বিশ্ববিখ্যাত, তখন তিনি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মাস্টার অব সায়েন্স ডিগ্রী অর্জন করেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফর্নিয়া থেকে।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই তিনি সিভিলিয়ান রিসার্চ পাইলট হিসেবে ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনটিক্স (NACA) এ যোগদান করেন। ১লা মার্চ ১৯৫৫ সালে জীবনে প্রথমবারের মতো টেস্ট পাইলট হিসাবে তিনি বিমান চালনা করেন। NACA-কে পরবর্তীতে ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NASA) নামে নামকরণ করা হয়।
তিনি টেস্ট পাইলট হিসাবে ১১০০ ঘন্টার বেশি বিভিন্ন সুপারসনিক বিমানের সফল উড্ডয়ন করেছেন, যার মধ্যে এক্স-১৫ রকেট প্লেনও ছিল।
জুন ১৯৫৮ সালে আর্মস্ট্রং মার্কিন এয়ার ফোর্সের ‘মেন ইন স্পেস সুনেস্ট’ (Man in Space Soonest – MISS) নামক প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পর্যাপ্ত ফান্ডের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। নাসার একটি সিভিলিয়ান প্রজেক্ট ‘প্রজেক্ট মার্কারি’ শুরু হলেও তিনি সিভিলিয়ান হওয়ায় নভোচারী হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। কারণ তখন শুধু মার্কিন বিমান বাহিনীর পাইলটরাই মহাকাশচারী হতে পারতেন।
১৯৬২ সালে নাসা জেমিনি-৮ মিশনের জন্য নভোচারী নেয়ার ঘোষণা দিলে আর্মস্ট্রং তাতে আবেদন করেন এবং নাসার দ্বিতীয় গ্রুপের মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি দুই আসনের জেমিনি-৮ মিশনের দায়িত্বে ছিলেন। জেমিনি-৮ মিশনেই তিনি প্রথমবারের মতো একটি স্পেস ফ্লাইটের কমান্ডিং পাইলটের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই ছিলেন নাসার প্রথম সিভিলিয়ান নভোচারী যিনি মহাকাশে পাড়ি জমান।
১৬ মার্চ ১৯৬৬ সালে জেমিনি-৮ এর কমান্ড পাইলট হিসাবে আর্মস্ট্রং এবং ডেভিড আর. স্কট প্রথমবারের মতো একটি মনুষ্যবিহীন অ্যাজেনা রকেটের স্পেস ডকিং (মহাশূন্যে দুটি মহাকাশযান সংযুক্তি) করতে সফল হন। এসময় একটি স্পেস থ্রাস্টারে কোনো কারণে গোলযোগ দেখা দিলে মহাকশযানটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘুরতে থাকে। এতে আর্মস্ট্রং সাথে সাথে রকেটটিকে অ্যাজেনা থেকে বিচ্ছিন্ন করেন এবং পুনঃনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মাহাকাশযানটিকে প্রশান্ত মহাসাগরে জরুরি অবতরণ করাতে বাধ্য হন।
মে ১৯৬৮ সালে আর্মস্ট্রং মারাত্মক একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। লুনার ল্যান্ডিং রিসার্চ ভেহিকেল (যে মেশিন চাঁদের নামার মেশিনের মতো উড়তে পারে) সাহায্যে পরীক্ষামূলকভাবে চাঁদের মাটিতে নামার বিষয়টি অনুশীলন করার সময় মেশিনটির জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে তা বিস্ফোরিত হয়। ভাগ্য সহায় থাকায় সে যাত্রায় আর্মস্ট্রং বেঁচে যান, কারণ যানটি বিস্ফোরিত হওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগেই আর্মস্ট্রং বেরিয়ে এসেছিলেন।
অক্টোবর ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো মনুষ্যবিহীন মহাকাশযানের পৃথিবী থেকে পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত উড্ডয়ন-অবতরণ পরীক্ষা চালানোর পর অ্যাপোলো-৭ প্রথমবার মনুষ্যবাহী মহাকাশযান হিসাবে পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত যায়। এরপর অ্যাপোলো-৮, ৯, ১০ বারবার পৃথিবী থেকে মহাকাশ পর্যন্ত যাতায়াত করে। এরপর আসে চাঁদের উদ্দেশ্যে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া প্রথম সফল মিশন অ্যাপোলো-১১।
জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে নাসা অ্যাপোলো-১১ মিশনের যাত্রীদের নাম ঘোষণা করে। নীল আর্মস্ট্রং (জেমিনি-৮), এডউইন ‘বাজ’ অলড্রিন (জেমিনি-১২), মাইকেল কলিনস (জেমিনি-১০)-কে এই তিন সদস্যবিশিষ্ট মিশনের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
১৬ জুলাই ১৯৬৯ সালে ফ্লোরিডার কেপ কেনাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে আর্মস্ট্রং, অলড্রিন, এবং কলিনস অ্যাপোলো-১১ মিশনের যাত্রী হয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। চারদিন পর ‘ঈগল’ (মূল মহাকাশযানের ক্ষুদ্র অংশ যা চাঁদের মাটিতে নামতে ব্যবহৃত হয়েছিল) চাঁদের মাটি স্পর্শ করে। প্রথম মানুষ হিসেবে আর্মস্ট্রং তার বাম পা চাঁদের মাটিতে রাখেন এবং বলে ওঠেন, “একজন মানুষের জন্য এটা একটা ক্ষুদ্র ধাপ হলেও মানব জাতির জন্য এটি একটি বিরাট পদক্ষেপ।” (“That’s one small step for a man, one giant leap for mankind”)।
বলা হয়ে থাকে, আর্মস্ট্রং চাঁদে নামার উত্তেজনায় “That’s one small step for man, one giant leap for mankind” বলে ফেলেছিলেন। উত্তেজনায় ইংরেজী ব্যকরণের নিয়মে ‘Man’ এর আগে ‘A’ লাগাতে ভুলে যান। পরে অবশ্য সাউন্ড ওয়েভ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তিনি ঠিকই বলেছিলেন কিন্তু রেডিও স্ট্যাটিকে গোলযোগের কারণে তা হারিয়ে গিয়েছিল।
চাঁদের মাটিতে মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেয়া ওই অভিযান শেষে মিশনে অংশ নেয়া তিন নভোচারী পৃথিবীব্যাপী ভ্রমন করেন।
চাঁদে সফল অভিযানের পর আর্মস্ট্রং উপ-সহযোগী প্রশাসক হিসেবে নাসা প্রধান কার্য্যালয়ে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সেই পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপরে তিনি ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত একটানা ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাটিতে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি কম্পিউটিং টেকনোলজিস ফর এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
আর্মস্ট্রং নাসা ছাড়ার পর থেকেই খুব নির্জনে তার জীবন কাটান। যদিও চাঁদে ওই অভিযানের বর্ষপূর্তিতে তিনি মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
৭ আগস্ট ২০১২ সালে ৮২ বছরে পা দেয়া আর্মস্ট্রংকে করোনারী বাইপাস সার্জারি করাতে হয়। সেই অপারেশনে সৃষ্ট জটিলতায় তিনি একই বছরের ২৫ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এভাবেই ঘটনাবহুল আর সাহসী এক জীবনের ইতি ঘটে। চাঁদের মাটিতে প্রথম পদক্ষেপ ফেলে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, আর সেই সাথে নিজেকে করেছিলেন ইতিহাসের পাতায় অমর।