আব্দুল কালাম, রামেশ্বরমের সেই ছোটখাটো ছেলেটির আজ জগতজোড়া খ্যাতি। শুধুমাত্র ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি কিংবা ভারতীয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি খাতের একজন কিংবদন্তীই নন, আব্দুল কালাম ভারতীয় জনতার কাছে একজন সন্তের নাম, যিনি পুরো জীবনটাই ব্যয় করেছেন দেশের উন্নতির জন্য। ভারতীয়দের শিখিয়েছেন স্বপ্ন দেখতে, বিশ্বাস করতে। তার অসামান্য আধ্যাত্মিক চেতনার মাধ্যমে এক সুতোয় গেঁথেছেন নানা ধর্ম, মতে বিভক্ত ভারতীয়দের।
আব্দুল কালাম জন্মেছিলেন মাদ্রাজ রাজ্যের অন্তর্গত রামেশ্বরমের এক তামিল পরিবারে। তার পিতা জয়নুল আবেদিন প্রথাগত শিক্ষা বা ধন সম্পত্তির দিক থেকে সমৃদ্ধ না থাকলেও সমৃদ্ধ ছিলেন সহজাত প্রজ্ঞা ও হৃদয়ের মহানুভবতার দিক থেকে। আর মা আশিয়াম্মাও ছিলেন তার যোগ্য সহকারী।
আব্দুল কালামের আধ্যাত্মিক চেতনার হাতেখড়ি তার বাবার কাছ থেকেই। তিনি সারা জীবন স্মরণ রেখেছেন তার বাবার সেই অমূল্য বানী-
প্রত্যেকটা মানুষ তার সময়ে, তার অবস্থানে, যে অবস্থায় আছে তাতে সে সমগ্র ঐশ্বরিক সত্তার এক বিশেষ অংশ। তাহলে দুঃখ কষ্ট আসলে মানুষ ভয় পাবে কেন? দুঃখ কষ্ট আসলে এর প্রয়োজনীয়তা বোঝার চেষ্টা কর। আর দুঃসময় এলেই নিজেকে যাচাই করার সুযোগ আসে।
এ পি জে আব্দুল কালাম এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসেও পরবর্তী জীবনে তার অর্জন নিয়ে কখনোই অহংকারী হননি। তিনি বলতেন, “এ সব তো ঈশ্বরেরই করুণা, তিনি কালাম নামে এক ক্ষুদ্র ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন করেছেন”। তিনি তার জীবনের সকল অর্জন উদাহরণ হিসেবে রেখে সাধারণ মানুষকে বলে গেছেন,
নিজেদেরকে কখনো তুচ্ছ মনে করো না। ঈশ্বর আমাদের সবার মধ্যে এক আগুনপাখি লুকিয়ে রেখেছেন। আমাদের জীবন যেন সে আগুনপাখিকে ডানা দেয়ার প্রচেষ্টায় নিবেদিত হয়। যাতে তার মঙ্গল আভায় পূর্ণ হয়ে যায় গোটা পৃথিবী।
চলুন দেখে আসি এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনের কিছু খন্ডচিত্র। কিভাবে তিনি প্রতিকুল সময়গুলো মোকাবেলা করেছেন, আকার দিয়েছেন তার স্বপ্নকে।
স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন করে পথচলা
১৯৫৮ সালের দিকের কথা। আব্দুল কালাম মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এম.আই.টি) থেকে সদ্য এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। তার বুক জুড়ে তখন আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন। শৈশবে রামেশ্বরমের ধূসর বিকেলে সামুদ্রিক চিল, সারস পাখিদের উড়তে দেখে রোমাঞ্চিত হতেন। অদ্ভুত রকমের লোভ হত আকাশে ওড়ার। আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই তো ফিজিক্সে বিএসসি শেষ করার পরও ভর্তি হয়েছিলেন এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে।
গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হওয়ার পর তার সামনে দুটি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ এলো। একটি বিমান বাহিনীতে, অন্যটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে Directorate of Technical Development and Production – DTD & P(Air)-এ। আব্দুল কালাম দুটিতেই আবেদন করলেন। দুটিই তার বিমান ওড়ানোর স্বপ্নের সাথে সম্পর্কিত। তবে বিমান বাহিনীর চাকরিটি ছিল সরাসরি বিমানের পাইলট হিসেবে, আর অন্যটি বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত কাজ। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিমান বাহিনীর চাকরিটির জন্য অধিক আগ্রহী ছিলেন।
ইন্টার্ভিউ এর জন্য ডাক আসে দুই জায়গা থেকেই। দিল্লীতে DTD & P এর ইন্টার্ভিউ সম্পন্ন করে কালাম বিমান বাহিনীর ইন্টার্ভিউ এর জন্য দেরাদুন পৌঁছান। বিমান বাহিনীর ইন্টার্ভিউতে মেধার চাইতে “ব্যক্তিত্বের” উপর বেশী জোর দেয়া হয়। তারা শারীরিক সক্ষমতা সম্পন্ন ও চনমনে স্বভাবের কাউকে চাইছিলেন। আটজন অফিসার নিয়োগের জন্য সেখানের পঁচিশজন আবেদনকারীর মধ্যে আব্দুল কালাম নবম হলেন। প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরল তাকে, ভেবেছিলেন এ ব্যর্থতার সাথেই হয়তো ভেঙ্গে গেল আশৈশব লালিত স্বপ্ন।
ভাঙ্গা মন নিয়ে তিনি হৃষীকেশ পৌঁছান। সাক্ষাত করেন স্বামী শিবানন্দের সাথে। স্বামীজীর গৌতম বুদ্ধের মতো অবয়ব, শিশুর সারল্যমাখা হাসি অনেকটাই শান্ত করে আব্দুল কালামের মনকে। তিনি তার সমস্ত মনঃকষ্টের কারণ, তার স্বপ্ন ভঙ্গের কাহিনী খুলে বললেন স্বামী শিবানন্দকে।
স্মিত হেসে স্বামীজী বললেন
আকাঙ্ক্ষা যখন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আসে আর যখন এ আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয় তখন এটি শক্তিশালী এক বৈদ্যুত-চুম্বকীয় শক্তি ধারণ করে। মনের ঘুমন্ত অবস্থায় এ শক্তি ইথারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আর মহাজাগতিক শক্তির স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়ে বিবর্ধিত অবস্থায় আবার ফিরে আসে সচেতন মনে। সত্যিকারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই। এটি চিরদিন হয়ে এসেছে আজও হবে। যেমন চিরকাল নিয়ম মেনে সূর্য উঠে, বসন্ত আসে; ঠিক তেমনি। তুমি ভরসা হারিও না।
স্বামীজীর ক্ষীণ কিন্তু গভীর কণ্ঠস্বর হতে উৎসারিত বাক্যগুলো আব্দুল কালামের হৃদয়কে আশ্চর্যরকম ভাবে পরিপূর্ণ করে দেয়। তিনি আবার ভরসা ফিরে পান। খুঁজতে থাকেন নিজের মধ্যকার আগুনপাখিকে। যেমনটি স্বামীজি বলছিলেন
আজকের ব্যর্থতা ভুলে যাও তার বদলে তোমার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যের অনুসন্ধান কর। এয়ার ফোর্সের পাইলট হওয়া তোমার নিয়তি নয়। নিজের সঙ্গে একাত্ম হও,আত্মসমর্পণ কর ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে।
দিল্লী ফিরে আসে আব্দুল কালাম DTD & P এ তার ইন্টার্ভিউ এর ফলাফল জানতে যান। জবাবে হাতে পান এপয়েন্টমেন্ট লেটার। বিমানবাহিনীতে প্রবেশ করতে না পারার সমস্ত ক্ষোভ দূর করে তিনি এখানে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন।
হোভারক্রাফট নন্দীর নির্মাণ ও INCOSPAR এ যোগদান
DRTD & P তে প্রায় বছর তিনেক তিনি বিভিন্ন দলে সহকারী হিসেবেই কাজ করেছেন। এরপর এরোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট (এ.ডি.ই) প্রতিষ্ঠিত হলে আব্দুল কালামকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়। এ.ডি.ই থেকে পরিকল্পনা করা হয় ভারতের প্রথম স্বদেশী হোভারক্রাফট নির্মাণের। হোভারক্রাফট হলো এমন একটি বাহন যা মাটি, পানি বা বরফের আস্তরণ সব কিছুর উপর দিয়ে চলতে সক্ষম। হাওয়ার কুশনের উপর ভর করে এটি প্রায় ভেসেই চলে আর এ কারণে এর গতিও অনেক বেশী। এ হোভারক্রাফটের নকশা ও বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা দলটির দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল কালামকে।
তবে এ দায়িত্বটি তাদের সাধ্যের তুলনায় অনেক বেশীই ছিল। তাদের কারোরই ইতোপূর্বে সম্পূর্ণ কোনো মেশিন তৈরি করার অভিজ্ঞতা ছিলো না; বাহন তো দূরের কথা। তাছাড়া ছিলো না হোভারক্রাফট নির্মাণের জন্য উন্নত যন্ত্রপাতিও। হোভারক্রাফট সম্পর্কিত যা কিছু পাওয়া গেল, তারা পড়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু যথেষ্ট তথ্য পেলেন না। পাননি এ বিষয়ে সাহায্য করার মতো অভিজ্ঞ কাউকেও।
কিন্তু আব্দুল কালাম দমলেন না , তিনি এ স্বল্প জ্ঞান আর নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এটি তৈরি করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন তার মতো ছোট কোনো শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা কাউকে এসকল জায়গায় কোনোমতে নিজের টিকে থাকার সংগ্রাম করেই যেতে হবে যদি কোনো সুযোগ এসে পরিস্থিতির মোড় না ঘুরিয়ে দেয়। আর তিনি এও জানতেন তার নিজের জন্য এ সুযোগ নিজেকেই তৈরী করে নিতে হবে। আর তাই এ হোভারক্রাফট প্রজেক্টকেই তিনি বেছে নিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
কাজে নেমে পড়লেন আব্দুল কালাম ও তার দল। এ.ডি.ইর অনেক সিনিয়র বিজ্ঞানীও তাদের টিটকিরি করছিল উন্নত সরঞ্জাম ও কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া এ অসম্ভবের পেছনে ছুটতে দেখে। এটি করার জন্য তাদেরকে তিন বছর সময় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা দুই বছর ছয় মাসের মাথায়ই তৈরী করে ফেললেন ভারতের প্রথম স্বদেশে নির্মিত হোভারক্রাফট। ৪০ মিলিমিটারের হাওয়ার গদির উপরে প্রায় ৫৫০ কিলোগ্রাম ওজন সহ চলার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি হোভারক্রাফট। শিবের বাহনের অনুসারে এর নামকরণ করা হলো ‘নন্দী’।
সামরিক খাতে ব্যাবহারের জন্য নিজ দেশে হোভারক্রাফট নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন। কিন্তু পরে তিনি মন্ত্রিত্ব হারানোর পর এ স্বদেশে হোভারক্রাফট নির্মাণের প্রকল্প নানা বিতর্কের ফাঁদে পড়ে থেমে যায়। আব্দুল কালাম এই প্রথম আবিষ্কার করলেন তাদের এ বিশাল সীমাবদ্ধতাকে।
সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা নন্দীর নির্মাণ করেছিলেন। কখনো মাথায়ও আসেনি যে এটি ব্যবহার করা হবে না। আশাহত হলেন তিনি। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ এ গোলমালে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। তবে আব্দুল কালামের বিশ্বাস ছিল তার এত পরিশ্রম এভাবে বৃথা যাবে না।
এর কিছুদিন পর একদিন তাদের জানানো হয় একজন উঁচু পর্যায়ের অতিথি তাদের ল্যাবরেটরি পরিদর্শনে আসবেন, আব্দুল কালাম যেন নন্দীর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের ব্যবস্থা করেন। নতুন আশা দোলা দিয়ে উঠল তাদের মনে। পরদিন আব্দুল কালাম ওনাকে নিয়ে তার হোভারক্রাফটে ঘুরলেন এবং এ সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের জবাব দিলেন। পরে জানতে পারলেন এ অতিথি ছিলেন এম.জি.কে মেনন, টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ- TIFR এর ডিরেক্টর।
এর এক সপ্তাহ পরেই আব্দুল কালামের ডাক আসে মহাকাশ গবেষণার জন্য TIFR এর বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান INCOSPAR এর কাছ থেকে। রকেট ইঞ্জিনিয়ার পদে ইন্টার্ভিউ এর জন্য। ইন্টার্ভিউতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে এটি গতানুগতিক ইন্তাটার্ভিউ নয়, এখানে তাকে যাচাই করা হচ্ছে বৃহত্তর কোনো চিন্তা মাথায় রেখে। দেখা হচ্ছে কি কি সম্ভাবনা নিহিত আছে তার মধ্যে। পরদিনই আব্দুল কালাম জানতে পারলেন যে INCOSPAR এ তার চাকরী হয়ে গেছে। তার মতো তরুণের কাছে তখন এ পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতই।
INCOSPAR এ আব্দুল কালাম সাহচর্য পেয়েছেন ডক্টর বিক্রম সারাভাই এর। নিজের জীবনে যার প্রভাব তিনি পরবর্তীতে সবসময় স্বীকার করেছেন। এখানেই মূলত তার ‘আব্দুল কালাম’ থেকে কিংবদন্তী হয়ে উঠার পালা শুরু হয়। সে সময়গুলোতে ভারতের কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ও মিসাইল নির্মাণ সহ বিভিন্ন মিশনে তার সাফল্য-ব্যর্থতার গল্প ও সেসকল মুহূর্তে তার চিন্তাধারা আরো অনুপ্রেরণার, আরো অনুকরণীয়।