(পর্ব ১২ এর পর থেকে)
“আমি পরিষ্কার বিবেকে বলতে পারি যে, আমার কর্তব্য পালনের জন্য আমার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব ছিল, আমি সবই করেছি।” (গিওর্গি ঝুকভ, ১৯৭৪)
১৯৭৪ সালের ১৮ জুন মার্শাল গিওর্গি ঝুকভের ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু ঝুকভের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বদের কাহিনি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় না। কার্যত জীবিত থাকাকালেই ঝুকভকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং আলেক্সান্দর সুভোরভ ও মিখাইল কুতুজভের মতো জগদ্বিখ্যাত রুশ সমরনায়কদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। কিন্তু মৃত্যুর পর তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৭ সালে ঝুকভকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করার পর ক্রুশ্চেভ ও তার সমর্থকরা অভিযোগ করেছিলেন যে, ঝুকভ নিজেকে ঘিরে একটি ‘কাল্ট’ নির্মাণ করছেন। কার্যত ঝুকভ এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। কিন্তু ঝুকভের মৃত্যুর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার ব্যক্তিত্বকে ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং পরবর্তীতে রাশিয়ায় একটি ‘কাল্টে’র সৃষ্টি হয়।
ঝুকভের অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান ছিল স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। ২০ জুন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’য় ঝুকভের মৃত্যুর সংবাদ ছাপা হয় এবং তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। পার্টির মহাসচিব লিওনিদ ব্রেঝনেভসহ শীর্ষ সোভিয়েত সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা এই ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। ২১ জুন প্রাভদায় ঝুকভের সম্পর্কে আরেকটি লেখা ছাপা হয় এবং এটি লিখেছিলেন ঝুকভের প্রাক্তন সহকর্মী ও প্রাক্তন সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেক্সান্দর ভাসিলেভস্কি। এই লেখায় তিনি ঝুকভের সামরিক নৈপুণ্যের এবং বিশেষ করে তার অপারেশনাল আর্টের ব্যাপক প্রশংসা করেন।
ঝুকভের মৃতদেহ মস্কোয় সোভিয়েত সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাখা হয়েছিল এবং সেখানে হাজার হাজার সোভিয়েত নাগরিক ঝুকভের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। ২১ জুন যখন ঝুকভের মৃতদেহের ছাই ক্রেমলিন ওয়াল নেক্রোপলিসে সমাহিত করা হয়, তখন ঝুকভের কফিন বহনকারীদের মধ্যে ছিলেন ব্রেঝনেভ স্বয়ং। এরপর যে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়, সেটিতে প্রধান বক্তা ছিলেন তদানীন্তন সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রেচকো।
ঝুকভের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক ইতিহাসে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্রে ঝুকভের অবদানকে বিস্তৃত আকারে উল্লেখ করা হয়। ঝুকভের অর্জন নিয়ে শিশু–কিশোর ও তরুণদের জন্য একটি বিশেষ বইও রচিত হয়। ঝুকভের জন্মস্থান স্ত্রেলকোভকা গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ঝুকভ রাখা হয় এবং ১৯৮০ সালে সদ্য আবিষ্কৃত একটি নক্ষত্রের নামকরণও ঝুকভের নামানুসারে করা হয়।
১৯৮০–এর দশকের শেষ দিকে ঝুকভ সম্পর্কিত স্মৃতিকথা নিয়ে দুটি সংকলন প্রকাশিত হয় এবং ঝুকভের মেয়ে এরা ও এল্লা উভয়ের লেখাই এগুলোতে প্রকাশিত হয়। উভয়েই তাদের লেখায় ঝুকভকে একজন আদর্শ ও স্নেহবৎসল পিতা হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন। তারা দুজন ঝুকভ কর্তৃক তাদের কাছে ও তাদের মায়ের কাছে লিখিত চিঠিগুলোও প্রকাশ করেন, এবং এই চিঠিগুলো থেকে সেনানায়ক ঝুকভের পরিবর্তে ব্যক্তি ঝুকভ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ঝুকভের আরেক মেয়ে মারিয়া ঝুকভের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তার ব্যক্তিগত কাগজপত্র লাভ করেন এবং এগুলোর ভিত্তিতে ১৯৯০ সালে মারিয়ার সহায়তায় ঝুকভের আত্মজীবনীর ১০ম সংস্করণ ও ১৯৯২ সালে ১১তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ব্রেঝনেভের সময়ে প্রকাশিত ঝুকভের আত্মজীবনীতে যে অংশগুলো সেন্সররা বাদ দিয়েছিল, সেসব এই সংস্করণগুলোতে প্রকাশ করা হয়।
১৯৮৭ সালে ঝুকভকে নিয়ে বিখ্যাত সোভিয়েত লেখক কনস্তান্তিন সিমোনভ কর্তৃক লিখিত ‘Notes Towards a Biography of G. K. Zhukov’ প্রকাশিত হয় এবং এতে ঝুকভের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করা হয়। ১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিকোলাই পাভলেঙ্কো (‘ভোয়েন্নো–ইস্তোরিচেস্কি ঝুর্নালে’র প্রাক্তন সম্পাদক) ঝুকভের সম্পর্কে বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখেন এবং এগুলো ‘এক অধিনায়কের ভাগ্যের স্মৃতি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এগুলোতে স্তালিন, ক্রুশ্চেভ ও ব্রেঝনেভর আমলে ঝুকভের প্রতি যেসব অবিচার করা হয়েছে, সেগুলোকে তুলে ধরা হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থার পতন ঘটে এবং নতুন রাষ্ট্র রাশিয়ার সৃষ্টি হয়। নতুন রুশ সরকার ঝুকভের গুণকীর্তন অব্যাহত রাখে। ঝুকভ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট এবং স্তালিন ও সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি তার আনুগত্য ছিল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। কিন্তু একই সঙ্গে তার দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ে তার অবদান নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। ফলে কমিউনিস্ট স্তালিনের জেনারেল থেকে ঝুকভ সহজেই জাতীয়তাবাদী রাশিয়ার জাতীয় বীরে রূপান্তরিত হন।
নতুন রাশিয়ায় একটি স্মৃতিচারণমূলক রুবলে ঝুকভের ছবি খোদাই করা হয়। ১৯৯৪ সালের রুশ রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েলৎসিন ঝুকভের সম্পর্কে দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এদের মধ্যে একটিতে ১৯৯৫ সালের মে মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঝুকভের উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয় এবং অপরটিতে ঝুকভের নামে দুটি সামরিক পদক (‘অর্ডার অফ ঝুকভ’ এবং ‘ঝুকভ মেডাল’) প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯৬ সালে ঝুকভের ১০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার জন্মস্থান ঝুকভ গ্রামের সীমানা বর্ধিত করে একে একটি শহরের মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং সেখানে ঝুকভের সম্মানে একটি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৯ সালে রুশ রাষ্ট্রপতির একটি কমিশনের প্রদত্ত প্রতিবেদনে ১৯৫৭ সালে ক্রুশ্চেভ ঝুকভের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছিলেন, সেগুলো থেকে তাকে দায়মুক্তি প্রদান করা হয়।
অবশ্য রুশ সরকারের উদ্যোগের বাইরেও ঝুকভকে নিয়ে রাশিয়ায় বিভিন্ন আয়োজন হয়ে থাকে। তার স্মরণে সেখানে নিয়মিত বিশেষ প্রদর্শনী ও সম্মেলন আয়োজিত হয়, স্মৃতি ফলক স্থাপিত হয়, সম্পাদকীয় ও টিভি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশিত হয় এবং গান ও কবিতা রচিত হয়। বস্তুত ১৯৯০–এর দশক থেকে প্রতি বছরই রাশিয়ায় ঝুকভ ও তার অবদান নিয়ে একাধিক বই প্রকাশিত হয়ে আসছে। অবশ্য উল্লেখ্য যে, রাশিয়ায় পশ্চিমাপন্থীদের কেউ কেউ ঝুকভের কঠোর সমালোচক এবং তাদের কাছে তিনি একজন খলনায়ক, কারণ তিনি ছিলেন স্তালিন ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের একান্ত অনুগত সেনানায়ক।
ঝুকভের জীবনকাহিনী ছিল বড়ই বিচিত্র। একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে তিনি লাল ফৌজের সর্বাধিনায়কে পরিণত হন, কিন্তু এই অবস্থান থেকে তার পতন ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে তিনি আবার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আবারো তার পতন ঘটে। পরবর্তীতে তিনি তার মর্যাদা ফিরে পান, কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষস্তরে পৌঁছানো তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
অবশ্য ঝুকভ প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতালোভী ছিলেন না এবং তার মধ্যে কখনো ‘বোনাপার্টবাদী’ আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। সামরিক শক্তি ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের আকাঙ্ক্ষা তার কখনোই ছিল না। আজীবন তিনি ছিলেন একজন বিশ্বস্ত ও একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট। বস্তুত কমিউনিজম ও স্তালিনের প্রতি তার আস্থা এতটাই সুদৃঢ় ছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্তালিন তাকে পদোবনতি দিয়ে কার্যত নির্বাসিত করলেও তিনি স্তালিনের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্তালিনের নিষ্পেষণের আংশিক সমালোচনা করেছেন, কিন্তু স্তালিনের ঐতিহ্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করেননি। কার্যত তার আত্মজীবনীতে তিনি স্তালিনকে বেশ ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং একজন সুদক্ষ সমরবিশারদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কমিউনিস্ট পার্টি, স্তালিন ও সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি গভীর আস্থার পাশাপাশি ঝুকভের চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তার প্রগাঢ় দেশপ্রেম, তার স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং তার প্রখর বাস্তববাদিতা। দেশপ্রেমের টানেই ঝুকভ সামরিক জীবন বেছে নিয়েছিলেন এবং সোভিয়েত প্রচারণায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণের তীব্র সমালোচনা করা হলেও ঝুকভ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকে নিজের জন্য গৌরবের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতেন। তদুপরি, ঝুকভ ছিলেন জাতিগতভাবে রুশ এবং কমিউনিস্ট আদর্শের পাশাপাশি নিজের রুশ পরিচিতি নিয়েও ঝুকভ সচেতন ছিলেন। ঝুকভের প্রখর দেশপ্রেমের কারণে তাকে সহজেই সোভিয়েত–উত্তর রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বীর থেকে রুশ জাতীয়তাবাদী বীরে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়েছে।
অবশ্য ঝুকভের স্বাধীনচেতা মনোভাব বরাবরই তার জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তার স্বাধীনচেতা মনোভাবকে সোভিয়েত নেতারা নিজেদের ক্ষমতার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং এজন্য তাকে পর পর দুবার ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অপসারণ করা হয়। পরিহাসের বিষয় এই যে, ঝুকভের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন এবং তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল থেকে অপসারণের ফলে ঝুকভের জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা কার্যত আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
একইসঙ্গে ঝুকভ ছিলেন প্রখর বাস্তববাদী এবং তিনি প্রয়োজনে নিজস্ব মতামত পরিবর্তন বা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। উদাহরণস্বরূপ, অপারেশন বার্বারোসার প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুকভ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিআক্রমণ পরিচালনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন, কিন্তু তার এই নীতি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে পরবর্তীতে তিনি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া প্রতিআক্রমণ চালানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই নিয়ে স্তালিনের সঙ্গে তার মতবিরোধেরও সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে, ১৯৫৭ সালে ক্রুশেভ ও মলোতভ গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে ঝুকভ ক্রুশেভের পক্ষকে সমর্থন করেন, কারণ তার কাছে ক্রুশেভের নীতিগুলোকে বেশি বাস্তববাদী মনে হয়েছিল এবং মলোতভ গ্রুপের সদস্যদের ধ্যানধারণাকে গোঁড়া ও সেকেলে মনে হয়েছিল। কার্যত তার প্রখর বাস্তববাদিতার কারণেই দুবার পতনের পরও শান্ত থাকা এবং ঝোঁকের বশে কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। এবং এই বাস্তববাদিতার কারণেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়কে পরিণত হতে পেরেছিলেন।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন ঝুকভকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হবে? কেন তার মেধাবী সহকর্মী কনস্তান্তিন রোকোসোভস্কি, ইভান কোনেভ বা আলেক্সান্দর ভাসিলেভস্কি এই মর্যাদা পাবেন না? কেন ডুইট আইজেনহাওয়ার, জর্জ প্যাটন, ডগলাস ম্যাকআর্থার বা বার্নার্ড মন্টগোমারি এই সম্মানের অধিকারী হবেন না? কেনই বা ঝুকভের শত্রু হেইঞ্জ গুডেরিয়ান, এরিক ভন ম্যানস্টেইন কিংবা এরউইন রোমেলকে এই গৌরব দেয়া হবে না?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রথমত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি জানতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহুসংখ্যক রণাঙ্গন ছিল, যেগুলোর মধ্যে প্রণিধান ছিল পূর্ব রণাঙ্গন, পশ্চিম রণাঙ্গন, বলকান, উত্তর আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া। ঝুকভ লড়াই করেছিলেন পূর্ব রণাঙ্গনে এবং পূর্ব রণাঙ্গনই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান ও ভাগ্যনির্ধারণী রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গনে জার্মানি তাদের সামরিক শক্তির ৬৫% থেকে ৭০% মোতায়েন করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার ৮০% হয়েছিল পূর্ব রণাঙ্গনে। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। সোভিয়েত সৈন্যরাই বার্লিন দখল করেছিল এবং তাদের কাছেই অক্ষশক্তির সিংহভাগ সদস্য (জার্মানি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া) আত্মসমর্পণ করেছিল। এজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক কেবল তিনিই হতে পারেন, যিনি পূর্ব রণাঙ্গনের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন।
মার্কিন সমরনায়ক আইসেনহাওয়ার, প্যাটন ও ম্যাকআর্থার এবং ব্রিটিশ সমরনায়ক মন্টগোমারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, এবং তাদের সামরিক নৈপুণ্য নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তাদের কেউই পূর্ব রণাঙ্গনে লড়াই করেননি। অনুরূপভাবে, জার্মান সমরনায়ক রোমেলও পূর্ব রণাঙ্গনের লড়াইয়ে কখনো অংশগ্রহণ করেননি। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্যনির্ধারণী রণাঙ্গনে তাদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না এবং এজন্য তাদের ব্যাপক সামরিক কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়কের মর্যাদা প্রদান করা যায় না।
পূর্ব রণাঙ্গনের লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী জার্মান সমরনায়করা (যেমন: গুডেরিয়ান ও ম্যানস্টেইন) যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন এবং সোভিয়েতদের ওপর বিরাট বিরাট পরাজয় চাপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কাউকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হিসেবে অভিষিক্ত করা যায় না, কারণ এই যুদ্ধে জার্মানি যে কেবল পরাজিত হয়েছিল তা-ই নয়, তাদের রাষ্ট্রই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং, অবশিষ্ট রইলেন সোভিয়েত সমরনায়কগণ, যাদের মধ্যে ছিলেন ঝুকভ, ভাসিলেভস্কি, কোনেভ ও রোকোসোভস্কি।
এই সমরনায়কদের মধ্যে প্রত্যেকেই সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়েরই স্বাদ পেয়েছেন। ঝুকভ যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফের প্রধান ছিলেন এবং এজন্য যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েতরা যে অভাবনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, তার আংশিক দায় ঝুকভের কাঁধেও বর্তায়। রঝেভ–ভিয়াজমা অপারেশন, অপারেশন মার্স, অপারেশন পোলার স্টার এবং আরো কতিপয় অভিযানে ঝুকভ শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিলেন। সুতরাং, ঝুকভকে সুভোরভের সঙ্গে তুলনা করা হলেও ঝুকভ কার্যত সুভোরভের মতো যুদ্ধে অপরাজেয় ছিলেন না এবং তার সমালোচনা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
কিন্তু একইসঙ্গে ঝুকভ যেসব বিরাট সাফল্য অর্জন করেছেন, সেগুলো তার ব্যর্থতাগুলোকে ম্লান করে দেয়। ঝুকভের নেতৃত্বেই সোভিয়েতরা খালখিন গোলের যুদ্ধে জাপানিদের পরাজিত করে এবং মঙ্গোলিয়ায় জাপানি আগ্রাসন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণ রোধ করে। ১৯৪১ সালের আগস্ট–সেপ্টেম্বরে ঝুকভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সৈন্যরা ইয়েলনিয়ায় জার্মানদের পরাজিত করে এবং বিরাট এক মনস্তাত্ত্বিক বিজয় অর্জন করে। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে ঝুকভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সৈন্যরা লেনিনগ্রাদকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করা। ১৯৪১ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে ঝুকভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মানদের মস্কো দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় এবং অপারেশন বার্বারোসাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
১৯৪২ সালে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে সোভিয়েতদের বিরাট বিজয়ে ঝুকভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে লেনিনগ্রাদের অবরোধে ভাঙন ধরানোর ক্ষেত্রে তিনি কার্যকরী ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৩ সালে কুরস্কের যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ ও যুদ্ধ পরিচালনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে ঝুকভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সৈন্যরা কিয়েভ পুনর্দখল করে এবং ১৯৪৩–৪৪ সালে জার্মানদের হাত থেকে ইউক্রেন ও বেলোরুশিয়া মুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সর্বোপরি, ১৯৪৫ সালে ওয়ারশ অধিকারের মধ্য দিয়ে ঝুকভ ১৯২০ সালে লাল ফৌজের অসমাপ্ত রয়ে যাওয়া কাজ সমাপ্ত করেন এবং বার্লিন অধিকারের মধ্য দিয়ে নাৎসি জার্মানির চূড়ান্ত পতন ঘটান।
অন্য কোনো সোভিয়েত সমরনায়ক ঝুকভের মতো পূর্ব রণাঙ্গনের প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি। ঝুকভ যেভাবে একাধারে জেনারেল স্টাফের প্রধান, ফ্রন্টের অধিনায়ক, স্তাভকার সমন্বয়ক ও উপ–সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্য কোনো সোভিয়েত সমরনায়ক এত বিস্তৃত দায়িত্ব পালন করেননি। কোনেভ ও রোকোসোভস্কি ছিলেন ফ্রন্ট অধিনায়ক এবং তারা কখনো ঝুকভের মতো যুদ্ধের সময় স্তাভকার সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেননি কিংবা একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ পরিচালনা করেননি। ভাসিলেভস্কি জেনারেল স্টাফের প্রধান ও স্তাভকার সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন, কিন্তু ফ্রন্ট অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা ছিল সীমিত।
সুতরাং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিজয়ী মার্শাল’দের মধ্যে ঝুকভের নাম যে সর্বাগ্রে থাকবে, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এজন্য ঝুকভকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করা মোটেই অযৌক্তিক নয়। বস্তুত জেনারেল আইসেনহাওয়ার ঝুকভের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, বড় মাপের যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সমসাময়িক অন্য যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে ঝুকভের সামরিক অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি।
অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ে ঝুকভ বা অন্য কোনো ব্যক্তির একক অবদান ছিল না। এই বিজয়ে অন্যান্য সোভিয়েত সমরনায়করা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা তাদের সফল কার্যক্রমের মাধ্যমে বিজয় অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সোভিয়েত অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যুদ্ধ চলাকালে অর্থনীতি সচল রেখে এবং সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের ক্ষেত্রে জার্মানিকে ছাড়িয়ে গিয়ে সোভিয়েতদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা সরবরাহ করেছিলেন। সোভিয়েত রাজনৈতিক নেতৃত্ব কঠোর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রচণ্ড জার্মান আক্রমণের মুখে সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন এবং যুদ্ধ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্তালিন নিজে যুদ্ধের কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং শ্রেষ্ঠ সমরনায়কদের কাছ থেকে তাদের সেরাটা আদায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিজয়ে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিলেন। সর্বোপরি, লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত সৈনিক, পার্টিজান, শ্রমিক, কৃষক ও জনসাধারণের অন্যান্য অংশ অশেষ ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধে বিজয় অর্জনে সহায়তা করেছিল।
অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের কৃতিত্ব এককভাবে ঝুকভকে দেয়া চলে না, কারণ কারো পক্ষে একাকী যুদ্ধজয় সম্ভব নয়। কিন্তু একই সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় রেখে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি বিজয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে ঝুকভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হিসেবে রুশ জনমনে স্থান করে নিয়েছেন। সুতরাং, রুশ ইতিহাসে ঝুকভ যে একজন অনন্যসাধারণ সমরনায়ক হিসেবে সগৌরবে বিরাজ করবেন, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।