১৯৩৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। তুরস্কে সহকর্মীদের সাথে শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত শটগানের একটি গুলি লাগে ২৭ বছর বয়সী এক আমেরিকান তরুণীর বাম পায়ে। তিনি তুরস্কের ইজমির শহরে আমেরিকান দূতাবাসের নিযুক্ত ক্লার্ক ছিলেন। সহকর্মীরা তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা আজকের মতো উন্নত ছিল না। ফলে তরুণীর বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ পুরোটাই কেটে ফেলে দিতে হয়। পায়ে কাঠের একটি নকল পা লাগানো হয়। তিনি এই নকল পায়ের নাম দেন ‘কাথবার্ট’। সাধারণ কোনো মানুষ হলে বাকি জীবন হয় পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতেন অথবা, নিরাপদ কোনো চাকরি নিয়ে কাটিয়ে দিতেন।
কিন্তু সেই তরুণী ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সেই নকল পা দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর সময়টায় ফ্রান্সে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন মিত্রশক্তির পক্ষে। নাৎসিদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ লিস্টে নাম হয় তাঁর। গেস্টাপো বাহিনী তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য দেয়ালে তাঁর ছবি ছাপায়। তাঁকে মিত্রশক্তির সবচেয়ে বিপদজনক স্পাই হিসেবে দেখে জার্মানরা। শত্রুপক্ষের কাছে তিনি ‘দ্য লিম্পিং লেডি’ নামে পরিচিতি পান। কিন্তু শত চেষ্টার পরও নাৎসি বাহিনী তাঁকে ধরতে পারেনি। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও থেমে থাকেননি। অবসর নেয়া সময় পর্যন্ত কাজ করেছেন সিআইএতে। তিনি ছিলেন বাল্টিমোরে জন্ম নেয়া ভার্জিনিয়া হল, যার ছিল একাধিক ছদ্মনাম। এক পা ছাড়াই কীভাবে নাৎসিদের যম হয়ে ওঠেছিলেন সেটা নিয়েই আজকের লেখা।
ভার্জিনিয়া হল ১৯০৬ সালের ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় গ্রীষ্মের সময় কাটাতেন ভাইয়ের সাথে তাদের মেরিল্যান্ডের ১১০ একরের ফার্মে। ছুটিতে পরিবারের সাথে ইউরোপে ঘুরতে যেতেন। পড়াশোনা করেছেন বাল্টিমোরের রোল্যান্ড পার্ক কাউন্টি ডে স্কুলে। এরপর র্যাডক্লিফ ও বার্নার্ড কলেজে পড়েন। স্নাতক সম্পন্ন করেন ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে। ছোটবেলা থেকেই ফরাসি ভাষায় ভালো দক্ষতা অর্জন করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষালাভ করতে গিয়ে ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষাতেও দক্ষ হয়ে ওঠেন।
তিনি ছিলেন খুবই উচ্চাভিলাষী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন। এজন্য ১৯২৯ ও ১৯৩০ সালে দুবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা দেন। কিন্তু দুবারই তিনি অকৃতকার্য হন। তখন ১,৫০০ জন পররাষ্ট্র কর্মকর্তার মাঝে মাত্র ৬ জন ছিলেন নারী। তাই তিনি ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য পোল্যান্ডের ওয়ারশতে আমেরিকান দূতাবাসে ক্লার্কের কাজ করা শুরু করেন। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর তুরস্কে বদলি হন। আর তুরস্কতেই পা হারান তিনি। এরপর পররাষ্ট্র কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁর। কারণ ১৯৩৭ সালে আবারো পরীক্ষা দিতে চাইলে পা না থাকায় তাঁকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু দমে যাননি তিনি। ক্লার্কের চাকরি ছেড়ে ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান। এ সময়ই তাঁর এমন সুযোগ আসে, যাতে তাঁর পা না থাকা কিংবা নারী হওয়া কোনোটাই বাধা ছিল না। ইউরোপ জুড়ে তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ৩ সেপ্টেম্বর ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন থেকে ফ্রান্সের পরাজয়ের সময় পর্যন্ত ভার্জিনিয়া সেখানে অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাজ করেন। এ সময় যুদ্ধের ময়দান থেকে আহত সৈনিকদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসতেন নিরাপদ জায়গায়। ফ্রান্সের পরাজয়ের পর তিনি ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। এ সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ‘স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ’ বা এসওই গঠন করেন। ভার্জিনিয়ার সাথে এ সময় এসওই’র এক সদস্যের পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে ভার্জিনিয়া এসওই’র সাথে যোগাযোগ করেন।
কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় এসওই তাঁকে ফ্রান্সে পাঠায় গুপ্তচরবৃত্তির জন্য। পররাষ্ট্র বিভাগে যে কারণে তিনি সু্যোগ পাননি, সেটিই এখন তাঁর পক্ষে দারুণভাবে কাজ করল। তিনি ছিলেন নারী, একইসাথে একটি পা নেই। ব্রিটিশদের কাছে এটাই মোক্ষম অস্ত্র মনে হলো। কারণ, এতে তিনি নাৎসিদের সন্দেহের চোখ ফাঁকি দিতে পারবেন। সেখানে তাঁর কাজ ছিল জার্মানদের আক্রমণ সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করা। একইসাথে ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা ও তাদের অস্ত্রের যোগান দেয়া।
এসময় তিনি গুপ্তচরের কৌশল, মোর্স কোড, হাতাহাতি লড়াই, মানচিত্র পড়া, ক্যানু চালানো, আক্রমণ পরিকল্পনা করা ইত্যাদি কাজ শেখেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল জারমেইন। তিনি ফ্রান্সে প্রবেশ করেন ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ এর ফরাসি-আমেরিকান রিপোর্টার হিসেবে। এসওই সাধারণত তাদের এজেন্টদের ছয় মাসের বেশি সময় এক জায়গায় রাখতো না। কিন্তু ভার্জিনিয়া হল ১৫ মাস ফ্রান্সের লিওনে কাজ করেন। এ সময় ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীকে গোপনে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। মিত্রবাহিনীর বিমানচালকদের প্যারাস্যুট দিয়ে নামার নিরাপদ জায়গা জানিয়ে দিতেন। এছাড়া ফ্রান্সের অন্যান্য এলাকার এসওই সদস্যদের লিয়াজোঁ হিসেবেও কাজ করেন। শুধু তা-ই নয়, ফরাসি ও জার্মান কারাগার ও ক্যাম্প থেকে যুদ্ধবন্দীদের পালিয়ে যেতেও সাহায্য করেন।
ভার্জিনিয়া হল তাঁর প্রতিটি কাজই এত দক্ষভাবে করেছিলেন যে, নাৎসিদের ক্ষতিগুলো তাদের চোখে পড়া শুরু করল। কিন্তু ভার্জিনিয়া ছদ্মবেশে এত নিখুঁত ছিলেন যে, কখনো ধরা পড়েননি। কিন্তু তারা ঠিকই খবর পেয়ে গেল, একজন খোঁড়া মহিলা গুপ্তচর এসবের মূল হোতা। সেসময় ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণে আসে গেস্টাপোর কুখ্যাত ক্লস বার্বি। তাকে ডাকা হতো ‘লিওনের কসাই’ নামে। সে ভার্জিনিয়ার ছবি পুরো ফ্রান্স জুড়ে ছাপায় এবং তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার কথা জানায়। ভার্জিনিয়া তখন ফ্রান্স ছেড়ে স্পেনে পালান।
স্পেনে তাঁর পালানোর পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। তখন ছিল শীতের সময়। একদিকে তুষারপাত, অন্যদিকে তাঁর কাঠের পা। এত প্রতিকূলতা নিয়ে তাঁকে পাইরিনিজ পর্বত পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু স্পেনে গিয়েও তিনি নিরাপদ থাকতে পারেননি। তাঁকে অবৈধ অভিবাসনের অপরাধে স্পেনের একটি রেল স্টেশন থেকে আটক করা হয় এবং মিরান্ডা ডেল এব্রো কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি বিশ দিন আটক ছিলেন। তারপর আমেরিকান দূতাবাসের মাধ্যমে ছাড়া পান। এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান। তিনি আবারো ফ্রান্সে যেতে চাচ্ছিলেন কাজ করার জন্য। কিন্তু তখন তিনি গেস্টাপোর মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে থাকায় এসওই তাঁকে আর সেখানে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে চায়নি। বরং তাঁকে স্পেনে পাঠানো হয় শিকাগো টাইমস পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন ফ্রান্সের মতো বড় কোনো কাজে যুক্ত হতে।
অবশেষে তাঁর হাতে সুযোগ আসে। ১৯৪৪ সালের ১০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিস অভ স্ট্রাটেজিক সার্ভিস’ বা ওএসএস-এ যোগ দেন। এটি ছিল যুদ্ধকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থা, যা থেকে পরে সিআইএর জন্ম হয়। ওএসএসের মাধ্যমে ভার্জিনিয়া পুনরায় ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তবে এবার এক খোঁড়া বৃদ্ধার ছদ্মবেশে যান। হাঁটার ভঙ্গি করেন বৃদ্ধাদের মতো, দাঁতগুলোও ফরাসিদের মতো করে পরিবর্তিত করেন। তিনি মধ্য ফ্রান্সের ক্রোজান্ট নামের একটি ছোট গ্রামের একটি ফার্মে যান। সেখানে তিনি গরু পরিচর্যা করতেন, পনির বানাতেন এবং ফার্মের মালিককে কাজে সাহায্য করতেন।
তাঁর মূল কাজ ছিল রেডিও অপারেটর হিসেবে তথ্য পাচার করা এবং জার্মানদের আক্রমণ করার জন্য একটি বাহিনী গড়ে তোলা। তিনি জার্মান সেনাদের চলাচল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেন। সকল তথ্য তিনি রেডিওর মাধ্যমে লন্ডনে প্রেরণ করতেন। ছদ্মবেশে থাকলেও তাঁকে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের মধ্যে থাকতেন। এ সময় ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীকে মিত্রপক্ষের কাছ থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে পাওয়া অস্ত্রের যোগান দেন। তিনি ফরাসি বাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়নকে প্রশিক্ষণ দেন এবং একই সাথে জার্মানদের মধ্যে ভুল তথ্য পাচার করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন।
তিনি তখন তাঁর বাহিনী নিয়ে চারটি সেতু ধ্বংস করেন, মালবাহী রেলগাড়িকে লাইনচ্যুত করেন, বিভিন্ন স্থানের রেললাইন মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেন এবং টেলিফোন লাইনও বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাঁর বাহিনী ১৫০ জন জার্মানকে হত্যা করে এবং ৫০০ জনেরও বেশি জার্মানকে আটক করে।
যুদ্ধ শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমেন ওএসএস ভেঙে দেন। তখন তিনি নতুন গঠিত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএতে যোগ দেন। দুই বছর ইউরোপে কাটিয়ে ১৯৫০ সালে বিয়ে করেন ওএসএস ও সিআইএর আরেক এজেন্ট পল গয়লটকে। এরপর তিনি সিআইএর বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে বাধ্যতামূলক অবসরের পূর্ব পর্যন্ত সিআইএতেই কাজ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি মারা যান।
তিনি সবসময়ই ছিলেন প্রচারবিমুখী মানুষ। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমেন তাঁকে সাহসিকতার জন্য জনসম্মুখে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক ডিএসসি প্রদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভার্জিনিয়া হল ওএসএসের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল উইলিয়াম জে ডনোভানকে অনুরোধ করেন, পদকটি যেন তাঁর কার্যালয়ে শুধুমাত্র ভার্জিনিয়ার মায়ের উপস্থিতিতে দেয়া হয়। কারণ তিনি চাইতেন, তাঁর পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়ে তাঁর কাজে যেন বিঘ্ন না ঘটায়। এমনকি পরিবারের সাথেও তাঁর কাজ নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না।
তিনি মারা যাওয়ার পরও খুব কমই আলোচনা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। তবে সম্প্রতি কিছুটা হলেও আলোচনায় আসছেন তিনি। ২০০৫ সালে লেখক জুডিথ এল পিয়ারসন ভার্জিনিয়া হলের জীবনী নিয়ে লেখেন ‘ওলভস এট দ্য ডোর’ বইটি। এ বছর তাঁকে নিয়ে আরেকটি বই আসছে। লেখক সোনিয়া পারনেলের লেখা বইটির নাম ‘এ ওমেন অভ নো ইম্পরট্যান্স’। প্যারামাউন্ট পিকচার্স ২০১৭ সালে এই বইটির সত্ব কিনে নেয়। বইটি থেকে বানানো মুভিতে ভার্জিনিয়া হলের চরিত্রে অভিনয় করবেন স্টার ওয়ার্স খ্যাত অভিনেত্রী ডেইজি রিডলি।