জীবদ্দশায় তিনি বাবা-মা’র রাখা নামের বদলে ‘দ্য অ্যাভিয়েটর’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি এতটাই খ্যাতিমান আর আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে তার জীবন কাহিনী নিয়ে ২০০৪ সালে ‘দ্য অ্যাভিয়েটর’ নামের একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় হলিউডে, চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছে মার্টিন স্করসিস। বেশ কয়েকটি বিভাগে অস্কার পাওয়া এই সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। বিলিয়নিয়ার এবং অ্যাভিয়েশন টাইকুন হাওয়ার্ড হিউজের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। সিনেমা নয়, বাস্তব জীবনের সুপারহিরো এই পাইলটকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
কংগ্রেসনাল স্বর্ণপদক, অকটেভ শ্যান্যু পদকের মতো নামিদামী পদকজয়ী শিল্পপতি হাওয়ার্ড হিউজ ১৯০৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর হিউস্টন অঙ্গরাজ্যের টেক্সাসে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাওয়ার্ড হিউজ সিনিয়র ছিলেন খনিজ তেল শিল্পের কূপখনন প্রকৌশলী। বিপুল অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি তা খুইয়ে ফেলারও অভ্যাস ছিল তার। মা অ্যালেন গানো ছিলেন বিত্তবান কনফেডারেট জেনারেলের দৌহিত্রি। অ্যালেন ১৯০৫ সালে হাওয়ার্ডকে জন্ম দেয়ার সময় মৃত্যুশঙ্কায় ছিলেন। হাওয়ার্ডের জন্মের পর থেকে সাংসারিক দিকে মনোযোগী হন হাওয়ার্ড সিনিয়র। কাজেই বিত্তশালী পিতার একমাত্র সন্তান হিউজ, বলতে গেলে সোনার চামচ মুখে নিয়েই বড় হন।
মা আ্যলেন গানো নিজে ওসিডি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার) এবং শুচিবায়ুতায় আক্রান্ত ছিলেন। ছেলে হাওয়ার্ডও আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন ওসিডির সাথে। ছেলেকে একেবারেই কাছছাড়া করতে চাইতেন না অ্যালেন। পরিস্থিতি বেগতিক চিন্তা করে হাওয়ার্ড সিনিয়র ছেলের জন্য বোর্ডিং স্কুলের ব্যবস্থা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুলের দুষ্প্রাপ্য আসনগুলোর জন্য হাওয়ার্ড যোগ্য ছিলেন না, যে সমস্যা হাওয়ার্ড সিনিয়র তার চেক বইয়ের বলে কাটিয়ে উঠতেন। বোর্ডিং স্কুলের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি হাওয়ার্ড, তিনি আংশিক শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছিলেন। তবে স্কুল থেকেই তার জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আগ্রহ তৈরী হয়। তার জীবনে ঘোরতর দুর্যোগ নেমে আসে যখন বাবা-মা দুজনই ২ বছরের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৩ সালে সে সময়কার হাওয়ার্ডকে বলা যায় ১৮ বছর বয়সী এক যুবক, যার শিকড় পরিচিতি ছিল না। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিয়ে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া কিছু জটিলতাও ছিল। তবে প্রাচুর্যের সমাহারে হাওয়ার্ড হিউজ নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন যে তার বিপুল পরিমাণ অর্থভান্ডার তার বাবার তৈরী ড্রিলবিটের মতোই যেকোনো বাধা ভেদ করতে পারবে। চলচ্চিত্র আর ঊড়োজাহাজ নিয়ে কৌতুহল থেকেই সে সময় জীবনের দিকনির্দেশনা পান হাওয়ার্ড। বাবার মৃত্যু হলে অগাধ সম্পদের মালিক হন তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই সম্পদ কাজে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেন সিনেমা আর বিনিয়োগ করেন এরোপ্লেন তৈরি করার শিল্পে। তিনি একাধারে মার্কিন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, পাইলট, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সমাজসেবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার সময়কার অন্যতম সফল এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিও ছিলেন তিনি।
একসঙ্গে অনেকগুলো এরোপ্লেনের এক্রোবেটিক ফ্লাইংয়ে অংশগ্রহণের কাহিনী নিয়ে হিউজ নির্মাণ করেছিলেন ‘হেল’স অ্যাঞ্জেল’ নামক চিত্তাকর্ষক একটি সিনেমা। এরপর তিনি তৈরি করেন রেসিং এরোপ্লেন। নিজের ডিজাইনে তৈরি করা এরোপ্লেন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সৃষ্টি করেছিলেন অনেকগুলো রেকর্ড। সে সময়ের সর্ববৃহৎ ডানা সম্বলিত ‘হারকিউলিস’ বিমানের নির্মাতা হাওয়ার্ড হিউজ। ১৯৬৬ সালেই তার কোম্পানির ডিজাইন করা ‘সারভেয়র-১’ এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মার্কিন মহাকাশযান হিসেবে বহুল পরিচিত এটি।
১৯৩৫ সালে হাওয়ার্ড হিউজের নিজস্ব ডিজাইন এবং পরিকল্পনায় তৈরি করা এইচওয়ান নামক উড়োজাহাজটি ঘণ্টায় ৩৫২ মাইল গতিবেগে চালিয়ে তখনকার সময়ের জন্য তৈরি করেছিল বিশ্বরেকর্ড। ১৯৩৭ সালে লস অ্যাঞ্জেলস থেকে নিউ জার্সির নেওয়ার্ক বিমানবন্দরের দীর্ঘ পথ স্বল্পতম সময়ে পাড়ি দেয়ার রেকর্ডও গড়েছিলেন তিনি। ১৯৩৮ সালে ৩ দিন ১৯ ঘণ্টায় নিজের ডিজাইন অনুযায়ী, সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে তৈরি করা লকহিড-১৪ এরোপ্লেনে বিশ্ব পরিভ্রমণ করে নিজের বিশ্বরেকর্ডের ঝুলিতে আরও একটি নতুন রেকর্ড সংযোজন করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকারের অনুরোধে, সরকারি অনুদানে ‘এক্স-এফ-ইলেভেন’ এবং ‘স্প্রুস গুজ’ নামক বিশাল আকারের দুটি উড়োজাহাজ নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমটি ছিল গোয়েন্দা কাজের জন্য দ্রুতগামী বিমান, দ্বিতীয়টি ছিল বড় পরিসরের পরিবহন বিমান। তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে বিমান দুটি সফল উড্ডয়নে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় মার্কিন সরকারও বিমানগুলো তৈরির ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং অতিরিক্ত অনুদান দেয়ার ঘোষণা বাতিল করে দেয়। কিন্তু তাতে করে হাওয়ার্ড হিউজ দমে যাননি একটুও। নিজের অর্থেই ঐ বিমান তৈরির কাজ চালিয়ে যান তিনি। ১৯৪৬ সালে হাওয়ার্ড হিউজ এক্স-এফ-ইলেভেন নামক গোয়েন্দা বিমানটির পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন।
ওদিকে ‘স্প্রুস গুজ’ নামক পরিবহন বিমানটি তৈরি করতে গিয়ে তিনি প্রায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ৪৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করার পরও ঐ পরিবহন বিমানের কার্যকারিতা প্রমাণিত না হওয়ায় সরকার প্লেন তৈরির প্রয়োজনীয় ধাতব সামগ্রী দিতে অস্বীকৃতি জানান। এই অবস্থায় এত বড় বিমান ধাতুর পরিবর্তে কাঠের ফ্রেম দিয়ে নির্মাণ করার বুদ্ধি বের করেন হিউজ। ১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর ‘স্প্রুস গুজ’ মাত্র ১ মিনিটের জন্য আকাশে উড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এই বিমান ছিল উভচর বা অ্যাম্ফিভিয়ান এবং তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান।
তারপর থেকে এই অসম সাহসী ও জেদি পাইলটের জীবনে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়। দুটো বিমান তৈরির কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। টিডব্লিউএ (ট্রান্স ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ) এয়ারলাইনে তার মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ ছিল। প্যানঅ্যাম এয়ারলাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিডব্লিউএ দারুণভাবে মার খায়। ফলে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হন হাওয়ার্ড হিউজ নিজে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দাম্পত্য জীবনে চরম বিশৃঙ্খলার শিকার হন তিনি। তাছাড়া ক্রমাগত পেইন কিলার খাওয়ার প্রভাব তো ছিলই। সব মিলিয়ে ক্রমশ তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে থাকেন। এরপর যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন হলিউড আর লাস ভেগাসের হোটেল কক্ষে নিভৃত জীবনযাপন করেন হিউজ।
জীবনের শেষ পর্যায়ে রূপালী পর্দার সামনে একা বসে থাকা সেই ১৮ বছরের তরুণরূপে আবির্ভাব ঘটে তার। যখন মানসিক অসামঞ্জস্য, শ্রবণের অসুবিধা বাড়তে থাকে, চিকিৎসা নির্ভরশীলতা তখন হিউজকে চার দেয়ালে বন্দী করে চলচ্চিত্রের সামনে আটকে ফেলে। মার্টিন স্করসিস তার সিনেমায় সে অবস্থাটিও দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন, যখন দিনের পর দিন দরজা-জানালা আটকে হাওয়ার্ড ঘুরে বেড়াতেন নিজের ঘরে, হাত পায়ের নখ কাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার জন্য সেই ঘর থেকে বের হয়ে শৌচাগারে পর্যন্ত যেতেন না হাওয়ার্ড, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সকালে নাস্তার সাথে আসা দুধের বোতলেই কাজ সারতেন এবং বোতলগুলোর গায়ে তারিখ লিখে সেগুলো সাজিয়ে রাখতেন। তিনি অবশ্য জীবনভর তার ওসিডি রোগের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেছেন, এই রোগের জন্যই তো সব কাজ এত নিখুঁতভাবে করতে পেরেছেন হাওয়ার্ড।
১৯৭৩ সালে ‘অ্যাভিয়েশন হল অফ ফেইম’ মিউজিয়ামে তার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়। বলা হয়, মারভেল কমিকসের স্ট্যান লি তার টনি স্টার্ক/আয়রনম্যান চরিত্রটি সৃষ্টির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন হাওয়ার্ড হিউজের জীবন থেকেই। ইতিহাসবিস্মৃত এই পাইলট সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ডেভিড থমসন বলেন,
“হাওয়ার্ডের চরিত্রটি পুরুষ দর্শকদের মুগ্ধ করতে পারে কারণ সত্যিকার অর্থে পুরুষ চিন্তাধারার সবচেয়ে অপরিপক্ব বাসনাগুলো তিনি নিজ জীবনে প্রত্যক্ষ করে ছিলেন। একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়ে ওঠা, আর সেই সাথে জিন হারলো, ক্যাথরিন হেপবার্নের মত সুন্দরীদের সাথে অন্তরঙ্গ মেলামেশা ছিল যেকোন একাকী চলচ্চিত্রভক্তের দিবাস্বপ্ন। আর এই দিবাস্বপ্নটি বাস্তবে উপভোগ করেছিলেন হাওয়ার্ড।”
সারাটা জীবন মেধা, বিত্ত, বিতর্ক সব মিলিয়ে সবদিক থেকেই চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়া একজন মানুষের জীবন কী রকম হতে পারে, তার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন হাওয়ার্ড হিউজ। আকাশে ওড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেকর্ড সৃষ্টিকারী এই বিশ্বখ্যাত পাইলটের মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালের ৫ এপ্রিল।
তথ্যসূত্র: সাত্তার, আলমগীর, বেলুন থেকে বিমান, সাহিত্য প্রকাশ (১৯৯৪), পৃষ্ঠা ন: ২১৮-২২০
ফিচার ইমেজ- cloudfront.net