জেমস হাটন যখন তার সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখনকার পশ্চিমা সমাজ বাইবেলের বিখ্যাত মহাপ্লাবন তত্ত্ব অনুযায়ী বিশ্বাস করতো যে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল মাত্র ছয় হাজার বছর পূর্বে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখন পৃথিবীর ধ্বংস হবার দিনক্ষণও মোটামুটি প্রচলিত ছিল। বিজ্ঞান সমাজও বিশ্বাস করতো, পৃথিবী আর এক হাজার বছর বা সামান্য বেশি টিকে থাকবে! এই ধারণার অবসান ঘটানোর শুরুটা করেন জেমস হাটন। এজন্য তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজও করেন। তিনি স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূল, দ্বীপ ও পাহাড়-পর্বত থেকে পাথর সংগ্রহ করেন এবং সেগুলোর গঠন পরীক্ষা করেন। এতোটুকুতেই সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি সমগ্র ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ঘুরে বেড়ান এবং বিভিন্ন অঞ্চলের পাথরের গঠন পরীক্ষা করে দেখতে পান যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানের পাথরের গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৭৮৫ সালে হাটন যখন তার পাথর সম্বন্ধীয় গবেষণা প্রকাশ করেন, তখন সেগুলো বিজ্ঞান মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করে। তার গবেষণাপত্রের নামকরণ করা হয়, ‘থিওরি অব আর্থ’ যা পরবর্তীতে দুই খণ্ডের বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণায় হাটন পরিষ্কার ভাষায় বলেন যে, পৃথিবীর সৃষ্টি আদতে কত আগে হয়েছিল তা সম্পর্কে মানুষের সামান্যতম ধারণা নেই, নেই ধ্বংস সম্পর্কেও অনুমানের কোনো অবকাশ।
হাটনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয় তার ‘রক সাইকেল’ বা পাথরের ভাঙা-গড়ার চক্র। তিনি দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ করে এই চক্রের কথা উল্লেখ করেন। এই চক্র অনুযায়ী, প্রথমে নানান প্রাকৃতিক কারণে পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। সেগুলো আবার বাতাসের সাথে কিংবা বৃষ্টির পানিতে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয় এবং সমুদ্রের তলদেশে জমা হয়। এভাবে চূর্ণ পাথরের স্তর বাড়তে থাকে এবং নিচের দিকের স্তর পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপে পুনরায় কঠিন পাথরে পরিণত হয়। সেগুলো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসলে চক্রটি আবার শুরু হয় এবং এভাবেই চলতে থাকে। হাটনের রক সাইকেলের প্রধান দিকগুলো একনজরে দেখে নেয়া যাক:
- পৃথিবীর অভ্যন্তরে অত্যাধিক উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজমান।
- এই আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাই নতুন করে পাথর সৃষ্টি করে।
- বায়ু এবং পানির দ্বারা ভূমিক্ষয় পলি, বালু এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথুরে কণার সৃষ্টি করে যা দীর্ঘ সময়ের আবর্তে অত্যন্ত ধীরে ধীরে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়।
- সমুদ্রের তলদেশে নতুন একটি স্তর সৃষ্টির সাথে সাথে পুরাতন স্তরটি অধিক গভীরে প্রোথিত হয় এবং তা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপের কারণে আবার কঠিন পাথরে পরিণত হয়।
- সেই পাথরগুলো পুনরায় উত্থিত হয়ে নতুন ভূমির সৃষ্টি করে।
- সেই নতুন ভূমি পুনরায় ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে এবং নতুন একটি চক্রের শুরু হয়। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক ধীরগতির এবং অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ের আবহে ঘটে।
জেমস হাটন ১৭২৬ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিন দুটি! পুরাতন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, তার জন্মদিন ৩ জুন হলেও আধুনিক বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ১৪ জুন। শহরের শ্রেষ্ঠ সওদাগর উইলিয়াম হাটন এবং তার স্ত্রী সারা বেলফোরের ঘরে জন্ম নেয়া জেমসের শৈশব কাটে বিলাসিতা আর শৌখিনতায়। দশ বছর বয়সে তিনি এডিনবার্গ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৭৪০ সালে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক, ল্যাটিন, দর্শন এবং গণিত পড়ার জন্য ভর্তি হন। তার আকর্ষণের বিষয় পরিবর্তন হয় এক রসায়ন ক্লাসে। সেদিন জনৈক অধ্যাপক ক্লাসে অ্যাকোয়া রেজিন দ্বারা স্বর্ণের দ্রবীভূত হবার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন। এ বিষয়টি জেমসকে এতোটাই অভিভূত করে যে তিনি নিয়মিত রসায়ন পড়তে শুরু করলেন। শুধু পড়াই নয়, তিনি তার বন্ধু ডেভির সাথে মিলে বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষাও শুরু করেন। বিশেষ করে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড নিষ্কাশন বিষয়ক পরীক্ষায় তারা বেশ সাফল্যও লাভ করেন।
স্নাতক শেষ করে একজন বিখ্যাত আইনজীবীর সাথে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করলেও হাটন তার বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন রসায়ন গবেষণায়ই। কিন্ত তার ঝোঁক আবারো ভিন্নদিকে প্রবাহিত হয়। এবার তিনি আইন ছেড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া শুরু করেন। দুই-তিন বছর একজন নামকরা চিকিৎসকের সাথে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৭৪৯ সালে জেমস হাটন নেদারল্যান্ডের লিডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ লাভ করেন। সে বছরই তিনি স্বদেশের রাজধানী লন্ডনে চলে আসেন এবং একটি চেম্বার খুলে বসেন। কিন্তু বিধি বাম! তার ডাক্তারি করবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। লন্ডনের সব প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত ডাক্তারদের ভিড়ে তিনি নিজের অস্তিত্বই জানান দিতে ব্যর্থ হন!
ডাক্তারি পেশায় ব্যর্থ হয়ে হাটন তার বন্ধু ডেভির সাথে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডের ব্যবসা শুরু করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাপক লাভবান হন। তিনি দ্রুত সময়ে এডিনবার্গে একাধিক বাড়ি ক্রয় করেন। ব্যবসায় ক্রমাগত সাফল্যে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বাবার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কৃষি জমিতে কৃষি কাজ শুরু করেন। আর এই কৃষিকাজই তাকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গবেষণার দিকে যাবার পথ তৈরি করে দেয়। তিনি তার জমির মাটির গুণগত মান রক্ষার জন্য স্কটল্যান্ডের বাইরে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন এবং ভিন্ন ভিন্ন রকমের মাটি পরীক্ষা করে দেখেন। এ সময়ই পাথরের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তিনি পাথর নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি দেখতে পান, অনেক পাথরই সৃষ্টি হয়েছিল মূলত পলি ও বালু জমাট বেধে। আর এরপর থেকেই শুরু হয় তার পাথর নিয়ে গবেষণা। তিনি স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ভ্রমণ শুরু করেন বিভিন্ন রকমের পাথরের খোঁজে।
পরবর্তী সময়ে জেমস হাটন কীভাবে তার রক সাইকেল তত্ত্ব প্রদান করেছেন, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। তবে এ সময় ঘটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো জানা হয়নি। এ সময় হাটন একটি অঘোষিত এবং অলিখিত ক্লাবের সদস্য হন, যার নাম হয় ‘ওয়েস্টার ক্লাব’। এক-দুই প্লেট ওয়েস্টারের সাথে এক বোতল ভদকা বা হুইস্কি নিয়েই এই ক্লাবে চলতো জ্ঞানগর্ভ আড্ডা, যার জন্য এর নাম হয় ওয়েস্টার ক্লাব। তবে পাঠক বিস্মিত হবেন এই ক্লাবের সদস্যদের কথা জানলে। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর সবচেয়ে মেধাবীদের আড্ডা ছিল এই ওয়েস্টার ক্লাব। ক্লাবের প্রাথমিক তিনজন সদস্য ছিলেন জেমস হাটন, অ্যাডাম স্মিথ যিনি কিনা আধুনিক অর্থনীতির জনক এবং রসায়নবিদ জোসেফ ব্ল্যাক যিনি কার্বন ডাইঅক্সাইড ও ম্যাগনেসিয়াম আবিষ্কার করেন। জ্ঞানগর্ভ আড্ডার জন্য আর কারো প্রয়োজন আছে কি? তবে ওয়েস্টার ক্লাবের প্রয়োজন ছিল এবং সেই প্রয়োজনের ধারাবাহিকতায় সেখানে যুক্ত হন আরো দুজন মহামানব জেমস ওয়াট ও ডেভিড হিউম! এই জেমস ওয়াট সেই জেমস ওয়াট, যার বাষ্প ইঞ্জিন বদলে দিয়েছিল পুরো পৃথিবীর চেহারা। আর ডেভিড হিউমকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ ইংরেজ দার্শনিক।
পাথর চক্র আবিষ্কার করে জেমস হাটন পরোক্ষভাবে ইউনিফর্মিটারিয়ানিজম তত্ত্বই আবিষ্কার করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে তার এই তত্ত্ব চার্চ ও বাইবেলের বিরোধিতা করায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আরো অনেক গবেষক হাটনের কাজ নিয়ে গবেষণা করেন। ব্রিটিশ ভূগোলবিদ উইলিয়াম হেওয়েল এর নামকরণ করেন ইউনিফর্মিটারিয়ানিজম। এর মূলকথাই হচ্ছে পৃথিবীর ভূত্বকে যেকোনো পরিবর্তন একটি অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং প্রক্রিয়াটি সর্বত্রই একরকম হয়। তবে হাটনের কাজগুলো জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল তার বন্ধু গণিতবিদ প্লেফেয়ারের। প্লেফেয়ার ১৮০২ সালে ‘ইলাস্ট্রেশনস টু দ্য হাটনিয়ান থিওরি অব দ্য আর্থ’ নামক একটি বই প্রকাশ করলে বিজ্ঞান বিশ্ব নতুন করে হাটনের কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করে। ১৮৩৩ সালে চার্লস লেইলি তার বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপ্যাল অব জিওলজি’ প্রকাশ করেন যেখানে তিনি হাটনের ইউনিটারিয়ান ধারণার বিশদ বিবরণ দেন। পরবর্তীতে আরো অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণার সাথে ক্রমাগত জেমস হাটনের কাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকে। বর্তমানে আমরা জানি, ভূতত্ত্বের একটি সার্বজনীন মৌলিক বিষয় হচ্ছে এই ইউনিফর্মিটারিয়ানিজম।
হাটন চিরকুমার ছিলেন। ১৭৪৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি স্মিটন নামে একটি পুত্রসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। তবে ছেলের সাথে তার সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। ১৭৯৭ সালের ২৬ মার্চ ৭০ বছর বয়সী হাটন এডিনবার্গে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে এডিনবার্গের গ্রেফিয়ার চার্চে সমাহিত করা হয়।