জিবরান কাহলিল জিবরান, সংক্ষেপে কাহলিল জিবরান নামে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত তিনি। ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি লেবাননের দক্ষিণে অবস্থিত পবিত্র উপত্যকা নামে পরিচিত ওয়াদি কাদিশার ছোট্ট এক গ্রাম বিশারিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নামও ছিল কাহলিল জিবরান। দ্বন্দ্ব এড়াতে আমরা তাকে জিবরান সিনিয়র হিসেবে সম্বোধন করবো। জিবরান সিনিয়র ছিলেন সুঠাম, স্বাস্থ্যবান, লম্বা দৈহিক গড়নের শক্তসমর্থ পুরুষ। শিক্ষিত, মার্জিত এই ব্যক্তি সম্ভবত পুরো গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ ছিলেন। তাই পুরো গ্রামই তাকে ভয় পেত। দুর্ভাগ্যক্রমে, তার অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রিত এবং রুক্ষ আচরণের জন্য তার পরিবারের সদস্যরাও তাকে ভয় পেত! বিশেষ করে জিবরানের সাথে সম্পর্কটা ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। জিবরান তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, “বাবাকে মনে পড়ে কেবল তার সততা, সাহস আর বিশুদ্ধতার জন্য।” তার এই উক্তিতেই বোঝা যায় বাবার সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল।
অন্যদিকে জিবরানের মা কামিলেহ রাহমি ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। জিবরান সিনিয়র যখন বিধবা কামিলেহকে বিয়ে করেছিলেন, তখন তার ২ বছর বয়সের একটি শিশু ছিল, যার নাম পিটার। কাহলিলের প্রাথমিক জীবনে সহিত্যের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টির পেছনে একক অবদান ছিল এই নারীর। শিল্প রুচিসম্পন্ন কামিলেহ ভালো গানও গাইতে পারতেন। বিয়ের পর ধর্মীয় কারণে গানের চর্চা যদিও খুব একটা করতেন না, তথাপি কাহলিলের জন্মের পর তিনি মাঝে মাঝেই সুর করে গান গাইতেন আর অবসর সময়ে সাহিত্যচর্চা করতেন। আর মায়ের এই গুণটিই আকৃষ্ট করে জিবরানকে, যদিও তার বাবা সংগীত, সাহিত্য কোনোটাই খুব একটা পছন্দ করতেন না। মায়ের প্রতি জিবরানের ছিল অসীম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর আবেগ। মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, “মানুষের ঠোটে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে ‘মা’!”
সৎভাই পিটার ছাড়াও মারিয়ানা এবং সুলতানা নামে জিবরানের দুই ছোট বোন ছিল। শৈশবে জিবরান তাদের সাথে খেলাধুলায় খুব একটা যোগ দিতেন না। কারণ তিনি ভালোবাসতেন চিত্রাঙ্কন। হাতের কাছে কাগজ কলম না পেলে বাড়ির বাইরে গিয়ে মাটিতে কিংবা শীতকালে তুষারের উপরেই ছবি এঁকে যেতেন তিনি। আর তার এই ছবি আঁকাকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন দিতেন তার মা। জিবরানের যখন ৫ বছর, তখন তার সাথে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্মের পরিচয় করিয়ে দেন তার মা। তিনি নতুনভাবে চিত্রকর্মের প্রেমে পড়েন। কিন্তু সেবছরই তার জীবন আকস্মিকভাবে বদলে যায়। তার বাবা কোনো দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়েন (যদিও তা ছিল রাজনৈতিক ফাঁদ) এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হন। তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সংসারের খরচ যোগানোর দায়িত্ব বর্তায় কামিলেহর হাতে, অথচ বিশারি গ্রামে নারীদের জন্য বলার মতো কোনো কাজই ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে কামিলেহ তার সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। শুরু হয় জিবরানের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।
স্বামীকে পেছনে ফেলে অধিকতর কঠিন নতুন জীবনে প্রবেশ করেন কামিলেহ। পরিবার নিয়ে বোস্টন শহরে স্থায়ী হন। কিন্তু মার্কিন মুলুকে পা দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন যে, জীবন সেখানে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে। মারিয়ানা ও সুলতানাকে স্কুলে ভর্তি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কারণ নারী শিক্ষা তখনো অতটা বিস্তার লাভ করেনি। বড় ছেলে পিটারকে ভর্তি করাতে পারেননি শরণার্থী বলে। তবে জিবরানের ক্ষেত্রে শরণার্থী পরিচয়টি বাঁধা হয়ে ওঠেনি তার মেধার জন্য। তবে কামিলেহকে এর জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। প্রথমে কয়েকমাস ফুটপাতে খাদ্যসামগ্রী ফেরি করে কিছু টাকা জমিয়ে একটি ছোট দোকান খুলে বসেন। সেখানে পিটার আর ছোট দুই মেয়ে কাজ করা শুরু করলে অর্থাভাব ঘুচতে শুরু করে।
অন্যদিকে জিবরান তার মেধা আর আঁকাআঁকির প্রতি গভীর আসক্তির বলে দ্রুতই শিক্ষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। বালক জিবরানের চিত্রকর্মে মুগ্ধ হয়ে এক শিক্ষক তাকে সেসময়কার নামকরা চিত্রশিল্পী ফ্রেড হল্যান্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ফ্রেড হল্যান্ড জিবরানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথকে আরেক ধাপ প্রশস্ত করে দেন। তিনি জিবরানকে বোস্টনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। থিয়েটার, অপেরা আর আর্ট গ্যালারির মাঝে নিজের প্রকৃত সত্তাকে খুঁজে পেতে শুরু করেন জিবরান। হল্যান্ডের হাত ধরে ক্লাসিক্যাল গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য আর পাশ্চাত্যের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন জিবরান। পাশাপাশি ফটোগ্রাফিও শুরু করেন একটু একটু করে। আর বছর ঘুরতেই বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য স্কেচ আঁকার চাকরিও পেয়ে যান। কিন্তু তখনই আবার একটু পিছুটান।
“বন্ধুত্ব সর্বদাই একপ্রকার মধুর দায়িত্ব, কখনোই সুযোগ নয়।”- কাহলিল জিবরান
আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ না থাকলেও জিবরান তার মেধার জোরে হয়তো কিছু একটা করতে পারতেন। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় উচ্চশিক্ষার জন্য, বিশেষ করে আরবি শিক্ষার জন্য, তাকে লেবানন ফেরত পাঠানোর। অগত্যা লেবানন যেতেই হলো জিবরানের। বৈরুতের ‘কলেজ লা সেগেসি’তে ভর্তি হয়ে ইতিহাস ও দর্শন পড়তে শুরু করেন। তবে গৎবাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা তাকে খুব বেশি আটকে রাখতে পারেনি। তিনি অধিকাংশ ক্লাসেই অনুপস্থিত থাকতেন আর এক মনে স্কেচ এঁকে যেতেন। শিক্ষকরাও তাকে খুব একটা জেরা করতে পারতেন না তার অনুপস্থিতির জন্য। তার ফিটফাট পরিধেয়, ভাবগম্ভীর ব্যক্তিত্ব আর মানব হৃদয় পড়ে ফেলার মতো চোখের কাছে হার মানতো সকলে। জিবরানের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি দেখলেই যেন তার সামনের ব্যক্তিটি সব অভিযোগ ভুলে যেতেন। সব মিলিয়ে দিনকাল মন্দ কাটছিল না জিবরানের। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন বোস্টন থেকে চিঠি এলো। ছোট বোন সুলতানার প্রচণ্ড অসুখ।
বোনের অসুখের খবর পেয়ে বোস্টন ছুটে যান জিবরান। কিন্তু সুলতানা আর সুস্থ হয়ে ওঠেনি। সুলতানার চলে যাওয়াটা ছিল কেবল শুরু। জিবরান পরিবারের সাথে হঠাৎ যেন সখ্যতা গড়ার আকর্ষণ বোধ করেছিল যমদূত। তাই তো মাস ঘুরতেই মারা গেলেন জিবরানের মা। তার বড় ভাই পিটার ভাগ্যের সন্ধানে গিয়েছিলেন কিউবা। তিনিও ফিরে আসেন প্রাণঘাতী রোগ নিয়ে এবং সুলতানার মৃত্যুর চতুর্থ মাসে মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৪ মাসে পরিবারের ৩ জনকে হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যান জিবরান। মারিয়ানার সাথে অন্যমনস্ক হয়ে দোকান চালানোর কাজ শুরু করেন নিজেই। আর বৈরুতে ফেলে আসা পড়ালেখা কিংবা বোস্টনের থিয়েটার, অপেরার কথা যেন বেমালুম ভুলে যান। এতসব পারিবারিক সমস্যা জিবরানের মতো একজন মেধাবী ক্রমে হারিয়ে ফেলছেন নিজেকে, এ ব্যাপারটি ভীষণ পীড়া দিত ফ্রেড হল্যান্ডকে। তিনি কথা বলেন বোস্টনের স্থানীয় এক কবি জোসেফিনা পিবডির সাথে। পিবডি ব্যাপারটা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন এবং জিবরানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, শোক থেকে বেরিয়ে আসাটা সহজ করে দেন।
“গতকাল হলো আজকের স্মৃতি আর আজকের স্বপ্ন হলো আগামী”- কাহলিল জিবরান
হল্যান্ড আর জোসেফিনার কল্যাণে জিবরানের প্রাণশক্তি একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগলো। তিনি দোকানটি বিক্রয় করে দিয়ে নিজের লেখনির উপর জোর দেন আর বন্ধুদের সহায়তায় নিজের চারকোলে আঁকা ছবিগুলো নিয়ে একটি ব্যক্তিগত চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন। প্রদর্শনীটি অর্থনৈতিকভাবে সফল হবার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়াতে সক্ষম হয়। তবে এসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে এই প্রদর্শনীতে, আর তা হলো ম্যারি হাসকেলের সাথে সাক্ষাৎ। দিনটি ছিল ১৯০৪ সালের ৩রা মে, যা জিবরানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। ৩০ বছর বয়সী রমণী হাসকেলের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা পরবর্তীতে কতবার যে স্মরণ করেছেন জিবরান তার ঠিক নেই। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, “বোস্টনে অসংখ্য মানুষের সাথে আমার পরিচয় আছে। তাদের মাঝে অনেককেই অনেক কারণে ভালো লাগে। কিন্তু ম্যারিকে প্রথমবার দেখার পরই আমার ভালো লাগতে শুরু করেছিল আর আমি এর কোনো কারণও খুঁজে পাচ্ছিলাম না!”
২০ বছরের যুবকের সাথে ৩০ বছর বয়সী নারীর প্রেম খুব একটা সচরাচর ঘটে না। ঘটলেও সে প্রেম সফলতার মুখ দেখে খুব কম সময়ই। কিন্তু, জিবরান আর হাসকেলের প্রথম সাক্ষাতেই যেন তারা ঠিক করে ফেলেছিলেন নিজেদের ভবিষ্যৎ। সেটা অসফল হলেও আদতে সফল। কারণ এই প্রেমই তো লেবাননের জিবরানকে পৃথিবীর জিবরান করেছে। উল্কার মতো হঠাৎ জিবরানের জীবনে প্রবেশ করেছিলেন হাসকেল, কিন্তু ধ্রুবতারার মতো ধ্রুব হয়ে ছিলেন পরবর্তী জীবনে। তাদের নিখাদ ভালোবাসার গল্প আমরা জানতে পাই হাসকেলের লিখে যাওয়া দিনলিপির কল্যাণে। হাসকেলের সাথে প্রেম যত প্রগাঢ় হচ্ছিল, জিবরানের ভেতরকার মেধা তত বিস্ফোরিত হচ্ছিল। হাসকেলের অনুপ্রেরণায় জিবরান আরবি থেকে অনুবাদ না করে সরাসরি ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন। বছরের শেষ দিকে ‘আল মুহাজির’ নামক একটি অভিবাসী পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি। এ পত্রিকাতেই ছাপা হয় তার প্রথম কবিতা।
“কষ্ট তোমার জীবনের সে আবরণটা ভেঙে দেবে, যা তোমার উপলব্ধিকে সীমাবদ্ধ করে রাখে।”- কাহলিল জিবরান
১৯০৫ সাল থেকে মুহাজিরে ‘টিয়ারস অ্যান্ড লাফটারস’ নামে একটি কলাম লিখতে শুরু করেন কাহলিল জিবরান, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে, তার আরবি লেখাগুলো ইংরেজি লেখাগুলোর মতো ততটা প্রশংসা কুড়াতে পারছিল না। ফলে তিনিও ধীরে ধীরে তার মনোযোগ ইংরেজির দিকেই নিয়ে যেতে থাকেন। এর পেছনে অবশ্য ধর্মীয় কারণও ছিল। সাহিত্য আর শিল্পের মাঝে বড় হওয়া জিবরানের মাঝে কোনোরূপ গোঁড়ামি ছিল না। এ ব্যাপারটা প্রকাশ পেত তার লেখাতেও। তিনি নারীদেরকে অধিকতর স্বাধীনতা দেবার পক্ষপাতি ছিলেন, যে কারণে ধর্মীয় নেতাগণ তার লেখার কঠোর সমালোচনা করতেন।
মাঝখানে বছর দুই আমেরিকার বাইরে ছিলেন জিবরান। বন্ধু জোসেফের সাথে প্যারিস আর লন্ডনের বিভিন্ন আর্ট গ্যালারিতে ঘুরে বেড়ান। এ সময়টা তার ছোটবোন মারিয়ানার দেখাশোনা করতেন হাসকেল। ১৯১০ সাল থেকে হাসকেল একটি সাময়িকী প্রকাশ করতে শুরু করেন যেখানে তিনি জিবরানের সাথে তার স্মৃতিগুলো প্রকাশ করেন। এই সাময়িকীতে তিনি প্রায় ১৭ বছর যাবত লিখেছেন। সে বছরই হাসকেলকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেম নিবেদন করে বিয়ের প্রস্তাব দেন জিবরান। উল্লেখ্য, তাদের মাঝে সম্পর্কটা প্রেমের হলেও বয়সের পার্থক্য আর সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তখনো পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি। একই কারণে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে না দিলেও সরাসরি গ্রহণও করতে পারেননি হাসকেল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ইতালি যখন তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, জিবরানের মনে তখন মুক্ত সিরিয়ার স্বপ্ন দানা বেঁধে ওঠে। তার এই স্বপ্ন আরো প্রবল হয়, যখন ইতালিয়ান সেনাপতি গিসেপ গ্যারিবাল্ডির সাথে তার দেখা। গ্যারিবাল্ডি তাকে স্বাধীন সিরিয়া গঠনের আশ্বাসও দেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার প্রাক্কালে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সমগ্র আরব বিশ্বকে এক হয়ে লড়বার জন্য আহ্বান জানান জিবরান। এ সময় সাহিত্যিকের বাইরে একজন সমাজকর্মী হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠেন জিবরান। তার প্রথম আরবি বই ‘ব্রোকেন উইংস’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১২ সালে, যা খুব একটা সমাদৃত হয়নি। তবে পরের বছরই তার প্রথম ইংরেজি ভাষার বই ‘দ্য ম্যাডম্যান’ পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়।
১৯১৪ সালেই জিবরান তার ভুবনখ্যাত ‘দ্য প্রফেট’ লেখা শুরু করেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি তখন ইংরেজি ভাষাভাষীদের মতো সাবলীল। তবে, সমস্যা হতো যতিচিহ্নে। এক্ষেত্রে হাসকেল ছিলেন তার একমাত্র ভরসা। প্রফেট লেখার মাঝেই তিনি ‘দ্য ফোররানার’ লিখে শেষ করেন, যার সম্পাদনা করেন হাসকেল। ১৯২৩ সালে প্রফেট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত জিবরানকে সর্বোতভাবে সহায়তা করেন হাসকেল, বিশেষ করে তার লেখায় যতিচিহ্নের ব্যবহার উন্নয়নে। ১৯২০ সালে নিউইয়র্কে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বাড়ি ফিরে সেদিন হাসকেলকে তিনি বলেছিলেন, “জানো, ঠাকুর বলেছেন আমেরিকা হচ্ছে একটি কল্পনাশক্তিহীন অর্থলোভী ভূখণ্ড যেখানে আমি এক টুকরো কল্পনা!”
প্রফেট প্রকাশের পর থেকেই জিবরান আর হাসকেলের সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। আরব লেখক মে জিয়াদের সাথে জিবরানের মেলামেশা পছন্দ হচ্ছিলো না হাসকেলের। অন্যদিকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় জিবরানও হতাশ ছিলেন। ১৯২৬ সালে তো হাসকেল এক ব্যক্তিকে বিয়েও করেন। বিস্ময়করভাবে হাসকেলকে এ বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিলেন জিবরান নিজেই। এতে করে তাদের সম্পর্কটা আরো এক প্রস্থ খারাপ হয়েছিল বৈকি। তারপরও সাহিত্যিক কাজকর্ম তাদের সম্পর্কটা একরকম ধরে রেখেছিল। জিবরানের সবচেয়ে দীর্ঘ ইংরেজি বই ‘জেসাস’ এর সম্পাদনাও হাসকেলই করেন। এ বই প্রকাশের পর থেকেই তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে থাকে। তিনি শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে অ্যালকোহলের শরণাপন্ন হন। তখন আবার আমেরিকায় অ্যালকোহল নিষেধাজ্ঞার যুগ চলছিল। তাই একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অ্যালকোহল পান নিয়ে কিছুদিন চললো বেশ হৈচৈ। স্পষ্টতই জীবনের শেষ দিনগুলোতে এসে হাসকেলের বিরহে কাতর হয়ে ওঠেন তিনি। তার আকাশে হাসকেল যে ধ্রুবতারা হয়ে ছিলেন।
১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল, নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন কাহলিল জিবরান। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র ৪৮। তাকে লেবাননে নিজ গ্রামে সমাহিত করা হয়। তার কবরের পাশে তার শেষ ইচ্ছামতো লেখা আছে, “আমি তোমাদের মতো বেঁচে আছি এবং তোমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। চোখ বন্ধ করে চারদিকে অনুভব করার চেষ্টা করো, আমাকে খুঁজে পাবে।” জিবরান তার যাবতীয় অর্থ তার বোন মারিয়ানা আর হাসকেলের নামে উইল করে দিয়ে যান। তার চিত্রকর্মগুলো আর স্টুডিওটি তিনি হাসকেলকেই দেন, যেখানে তিনি হাসকেলের সাথে প্রেমের ২৩ বছরের সব চিঠিগুলোই জমা রেখেছিলেন। হাসকেল প্রথমে ভেবেছিলেন সেগুলো পুড়িয়ে ফেলবেন এই ভেবে যে, সেখানে তাদের যৌন মিলনের প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে। পরে অবশ্য তিনি তা করেননি।
“সাধ্যের চেয়ে বেশি দেয়ার নাম বদান্যতা। আর প্রয়োজনের চেয়ে কম নেয়ার নাম অহং”- কাহলিল জিবরান
দ্য প্রফেট ছিল কাহলিল জিবরানের জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। ৪০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে ২৬টি কাব্যিক প্রবন্ধের এই গ্রন্থ। বিখ্যাত মার্কিন গায়ক এলভিস প্রিসলি তার জীবনে প্রফেটের প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। তার কবিতার লাইনগুলো এত চমৎকার এবং অর্থপূর্ণ ছিল যে বিখ্যাত সব গায়ক তাদের গানে সেগুলো ব্যবহার করতেন প্রায়ই। ‘ফোম অ্যান্ড স্যান্ড’ নামক জিবরানের একটি কবিতার দুটি পঙক্তি বেশ বিখ্যাত হয়েছি যেগুলো ‘দ্য বিটলস’ ব্যান্ডের জন লেনন তার লেখা গান ‘জুলিয়া’তে ব্যবহার করেছিলেন। ‘আই অব দ্য প্রফেট’ গেয়েছিলেন জনি ক্যাশ। আমেরিকাতে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তার অতীত ইতিহাস না জানলে বোঝার উপায় নেই যে প্রাথমিকভাবে তিনি ছিলেন আমেরিকায় একজন ‘লেবানিজ শরণার্থী’! আর লেবাননে তার গ্রামের মানুষ তো তাকে তাদের ‘প্রফেট’ বলেই অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, এই প্রফেটের সাথে ধর্মের যোগ নেই। জিবরানের লেখা গ্রন্থের মূল চরিত্র স্বয়ং জিবরানকেই মনে করতে চেয়েছিলেন তার গ্রামবাসীরা।
১৯৭১ সালে জিবরানের সম্মানে লেবানন সরকার একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। তার নামে একটি জাদুঘর রয়েছে তার গ্রাম বিশারিতে। বৈরুতে রয়েছে জিবরান বাগান। তার চিত্রকর্মের আর্ট গ্যালারি আছে বোস্টন এবং মেক্সিকোতে। কানাডার মন্ট্রিলে একটি দীর্ঘ রাস্তার নাম রাখা হয়েছে জিবরান স্ট্রিট। তাছাড়াও মরক্কো, আর্মেনিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা সহ বিশ্বের অনেক দেশেই তার স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে আবক্ষ মূর্তি, ভাস্কর্য, বাগান ইত্যাদি। এত সম্মান আর এত জনপ্রিয়তা একজন ব্যক্তি কেন পেয়েছেন তা অনুধাবনযোগ্য। মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে দারিদ্র্য আর শোকের সাথে লড়াই করেও আরবি, ইংরেজিসহ (আরবি ৮টি) ৫০টির অধিক বই, প্রবন্ধ লিখে গেছেন, এঁকেছেন অসংখ্য ছবি। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আরব সাহিত্যে পুনর্জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন, অল্প কিছু বই লিখেই যিনি মার্কিন সমাজে প্রেমের অর্থ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে গিয়েছিলেন। আজও আমরা তার কবিতা পড়ি আর মুগ্ধ হই। তার দ্য প্রফেটের জনপ্রিয়তা আজও একটু কমেনি। আর কাহলিল জিবরান নামটি আজও সাহিত্যপ্রেমীদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়।
ফিচার ছবি: kompasiana.com