Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম নারী মহাকাশচারী: কল্পনা চাওলা

ছোট্ট একটি মেয়ে, তার স্বপ্ন একদিন আকাশ ছোঁবে। ছোটবেলা থেকে সে স্বপ্ন বুনে চলে, একদিন সে বৈমানিক হয়ে আকাশে ডানা মেলবে। সে বয়সেই খেলার ছলে সে বিমানের ছবি আঁকত আর বাবার কাছে বায়না ধরত বিমান দেখাতে নিয়ে যাবার। মেয়েটির নাম কল্পনা চাওলা। ভারতে জন্ম নেয়া তিনি প্রথম নারী, যিনি মহাকাশে পাড়ি জমান।

 কল্পনা চাওলা © Tony Ranze

১৯৬২ সালের ১৭ মার্চ কল্পনা চাওলা ভারতের হারিয়ানা রাজ্যের কার্নাল গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কল্পনার জন্মদিন কাগজে-কলমে পরিবর্তন করে ১ জুলাই, ১৯৬১ করা হয় যাতে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।

ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বিমান দেখতে স্থানীয় ফ্লাইং ক্লাবে যেতেন কল্পনা। বাবা মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার মা ছিলেন উদার, পরিশ্রমী আর স্বাধীনচেতা নারী, আর সেজন্যই কল্পনা তার স্বপ্নের উড়ান বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। সেসময়ে ভারতে মেয়েদের লেখাপড়া করা অপ্রয়োজনীয়, বিলাসী চিন্তা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু সে বাস্তবতার মধ্যেও মায়ের প্রেরণায় তিনি এবং তার বোনেরা এগিয়ে গেছেন, করেছেন লেখাপড়া।

কল্পনার ডাকনাম ছিল ‘মন্টো’। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী, আর তাই তিনি তার নাম নিজেই নির্বাচন করেছিলেন। অনুষ্ঠান করে কল্পনার কোনো নামকরণ করা হয়নি। পার্শ্ববর্তী ট্যাগোর বাল্য বিদ্যালয়ে যখন তিনি তার মাসির সাথে গেলেন ভর্তি হতে, তখন শিক্ষক তার নাম জানতে চাইলেন। তার মাসি জবাব দিলেন যে, তারা তার নাম এখনও চুড়ান্ত করেননি তবে তাদের চিন্তায় তিনটি নামের তালিকা আছে।

কল্পনা, সুনয়না আর জ্যোৎস্না- এই তিন নাম ছিল পরিবারের বিবেচনায়। এমতাবস্থায় যখন শিক্ষক কল্পনাকে জিজ্ঞ্যেস করলেন, তার কোন নামটি পছন্দ- কল্পনা নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন, ‘কল্পনা’। এভাবেই দাপ্তরিকভাবে তার নাম হল কল্পনা চাওলা। কল্পনার নামের সাথে জড়িয়ে ছিল ‘স্বপ্ন’।

গ্রীষ্মকালে যখন তারা রাতে ঘরের ছাদে শুয়ে থাকত, তখন কল্পনা রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কারনেল ফ্লায়িং ক্লাব থেকে উড়ে যাওয়া বিমানের দিকে তাকিয়ে তিনি হাত নাড়াতেন। এক সাক্ষাৎকারে কল্পনা তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে করতে বলেন,

আমরা বাবাকে বলতাম আমাদের বিমানে চড়াতে তখন বাবা আমাদের পুষ্পক আর খেলনা বিমানে চড়াতে নিয়ে যেতেন। আমার মনে হয়, সেটিই আমাকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে জুড়ে দেয়।

বিদ্যালয়ে যখন তার সহপাঠীরা পাহাড়-পর্বত, আকাশ, মাটি, মানুষ আঁকত- তখন কল্পনা বিমানের ছবি আঁকতেন। চারুকলার ক্লাসে তিনি বিভিন্ন ধরনের বিমানের মডেল তৈরি করতেন। কল্পনা ছেলেদের মতো চুলের কাট দিতেন। সাথের অন্য মেয়েরা নাচ, গান পছন্দ করলেও তিনি সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টন, দৌড় ভালোবাসতেন।

STS-107 এর সদস্যদের সাথে কল্পনা © NASA

ইংরেজি, ভূগোল আর হিন্দিতে ভালো ফলাফল করলেও কল্পনার পছন্দের বিষয় ছিল বিজ্ঞান। একবার গণিতের ক্লাসে শিক্ষক যখন তাকে বললেন নাল সেটের উদাহরণ দিতে, তিনি তখন বললেন- ভারতীয় নারীরা নাল সেটের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, কারণ তখন পর্যন্ত কোন ভারতীয় নারীই মহাকাশ বিজ্ঞানী হোননি।

১৯৭৮ সালে দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর তিনি চিন্তা করলেন, এবার তাকে তার স্বপ্নের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করতে হবে। তার বাবার ধারণা ছিল, মেয়েদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, সুতরাং তিনি কল্পনার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি পরামর্শ দিলেন, শিক্ষকতা বা ডাক্তারি পড়ার। কিন্তু কল্পনা দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন, তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ভবিষ্যতে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হবেন।

অবশেষে মায়ের চাপ আর কল্পনার তীব্র ইচ্ছার কাছে পরাজয় স্বীকার করে তার বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার অনুমতি দেন। এরপর কল্পনা চণ্ডিগড়ের পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন। এবং সব বাধা পেরিয়ে তিনি সেখানে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে একমাত্র মেয়ে হিসেবে ভর্তি হয়ে যান।

১৯৮২ সালে কল্পনা চাওলা পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। তিনি তার ব্যাচে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন এবং তার কলেজ থেকে তিনিই প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হোন।

অত্যন্ত ভালো ফলাফল আর কলেজের অ্যারো এবং অ্যাস্ট্রো সোসাইটির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকায় খুব সহজেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স করার সুযোগ পান। পরিবারকে মানিয়ে সেখানে যেতে তার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এজন্য তিনি নির্দিষ্ট সময়ের কয়েকমাস পরে কোর্সে যোগ দেন।

১৯৮৪ সালে তিনি টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ১৯৮৬ সালে ইউনিভার্সিটি অভ কলোরাডো বোল্ডার থেকে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর তার দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। ১৯৮৮ সালে শেষ করেন তার ডক্টরাল স্টাডিজ, যার মাধ্যমে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী পান।

স্বামীর সাথে কল্পনা চাওলা © Roberto Schmidt

১৯৮৮ সালেই কল্পনা নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারে পাওয়ার লিফট কম্পিউট্যাশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক্সের ওপর গবেষণা কাজের মাধ্যমে শুরু করেন কর্মজীবন।

১৯৯৩ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ওভারসেট মেথডস ইনকরপোরেশন নামে কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে কল্পনা নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োজিত হোন। ১৯৯৫ সালে মহাকাশচারী হিসেবে জনসন স্পেস সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হোন।

১৯৯৬ সালে কল্পনা কলম্বিয়া মিশনে মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে রোবটিক আর্ম অপারেটরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এই মিশন ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে ১৫ দিন মহাকাশে অবস্থান করে। সেটাই ছিল তার প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাড়ি দেয়া। সেই স্পেস শাটল ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পৃথিবীতে ফিরে আসে।

২০০০ সালে এসটিএস-১০৭ মিশনে আবার তাকে মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয়। স্পেস শাটল কলম্বিয়ার চূড়ান্ত অভিযান। প্রাথমিকভাবে সেই মিশন জানুয়ারি ২০০১ সালে যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হয়ে ২০০৩ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে লঞ্চ করা হয়।

স্পেস সুটে কল্পনা © NASA

স্পেস সাটলটি ১৫ দিন ২২ ঘণ্টা মহাকাশে অবস্থান করে। শাটলটি উড্ডয়নের ৮১.৭ সেকেন্ড পরেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক টুকরো ফোম শাটলটির বাম পাশের অরবিটারের ক্ষতিসাধন করে। তা সত্ত্বেও মিশনটি সফলভাবে চলতে থাকে।

২০০৩ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি স্পেস শাটলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে। কিন্তু এই অভিযানের অভিযাত্রীরা কেউ আর জীবিত পৃথিবীর মাটিতে অবতরণ করতে পারেননি। কেনেডি স্পেস সেন্টারে অবতরণের ১৬ মিনিট আগেই স্পেস ক্রাফটটি টেক্সাসের আকাশে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিস্ফোরিত হয়। এতে মিশনের সাত অভিযাত্রী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। কল্পনাও সেই অভিযানে মৃত্যুবরণ করেন। সেটিই তার জীবনের শেষ মহাকাশ যাত্রায় পরিনত হয়।

কল্পনাকে তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী উথার ন্যাশনাল পার্কে সমাহিত করা হয়। তার আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভারত তাদের প্রথম মেটোরোলজিকাল স্যাটেলাইট এর নাম ‘কল্পনা-১’ রাখে।

কল্পনা ব্যক্তিগত জীবনে ফরাসী নাগরিক জিন পিয়েরে হ্যারিসন এর সাথে ১৯৮৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। ১৯৯১ সালে কল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন।

১৯৯৫ সালে নাসা এমসে কল্পনা © NASA

কল্পনা তার অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল স্পেস মেডেলের সম্মানে ভূষিত হন। তাছাড়াও নাসা স্পেস মেডেল, নাসা ডিস্টিঙ্গুইশড সার্ভিস মেডেলের সম্মানেও ভূষিত হন। তার মৃত্যুর পর কল্পনার স্মৃতিতে মঙ্গল গ্রহের কলম্বিয়া হিল চেইনের একটি চূড়াকে কল্পনা হিল নাম দেওয়া হয়।

কল্পনা চাওলা ছিলেন এক আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তার স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করে গেছেন আমৃত্যু। তাই তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের অভিযান। তার অবদানের মাধ্যমে তিনি মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

কল্পনা চাওলা সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ

১) Kalpana Chawla: A Life

Related Articles