কয়েক বছর আগের কথা, আমার অফিসে এক সদ্য তরুণ ছাত্রের আগমন। সে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হতে চায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী এই মেধাবী ছাত্র বুয়েটে পড়ার সুযোগ ফেলে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায় শুধুমাত্র একজন মানুষের জন্য। তিনি প্রফেসর মাহবুব মজুমদার, সকলের প্রিয় মাহবুব স্যার।
এমন অনেক শিক্ষার্থী, শুধুমাত্র প্রফেসর মাহবুবের সাথে কাজ করবার লোভে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেড়ে পড়তে এসেছে ব্র্যাকে। এমনকি স্যারের ক্লাস করতে কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভিড় জমাতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের অনেক শিক্ষার্থী। বিকাল পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে সেই ক্লাস শেষ হয়ে, ক্লাস-পরবর্তি আলোচনা গড়াতো রাত নয়টা বা তারও বেশি সময়। সময়ের আপেক্ষিকতা নিয়ে স্যারের লেকচার শুনতে শুনতে আমাদের খেয়ালই থাকতো না কতটা সময় চলে গেছে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের কাছে এক বিষ্ময়ের নাম মাহবুব মজুমদার। তবে সাধারণ মানুষের কাছে যেন আড়ালেই রয়ে গেছে আত্মপ্রচারের ঘোরবিরোধী, নিরহঙ্কার এই গণিতবিদ ও পদার্থবিদের অসংখ্য কৃতিত্বের কথা।
১৯৭১ এ জন্ম নেয়া মাহবুবুল আলম মজুমদার বেড়ে উঠেছেন আমেরিকায়। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের একাডেমিক প্রতিযোগিতা ও মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। হাইস্কুল পর্যায়ে সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে দুইবার অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পর্যায়ে ও ওয়াশিংটন স্টেট পর্যায়ে ম্যাথমেটিক্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন কয়েকবার।
শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপই মাহবুব মজুমদার সম্পন্ন করেছেন বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে স্নাতক ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। উল্লেখ্য, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় এমআইটি ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থান যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয়। এমআইটিতে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন কিংবদন্তি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যালান গুথকে। বিগ ব্যাং থিওরির সবচেয়ে জনপ্রিয় Cosmological Inflation মডেলটির অন্যতম উদ্ভাবক প্রফেসর অ্যালান গুথ। গুথের মতো কিংবদন্তি বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্য ও অনুপ্রেরণায় তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও প্রায়োগিক গণিতের জগতে যাত্রা শুরু করেন তরুণ মাহবুব মজুমদার। এই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি তার ডক্টরাল ডিগ্রি শুরু করেন বিশ্বসেরা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স ও থিওরেটিকাল ফিজিক্স (DAMPTP)-এ। ক্যামব্রিজে মাহবুব মজুমদারের অফিসকক্ষ থেকে কয়েক কদম এগোলেই ছিল বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের অফিসকক্ষ। স্টিফেন হকিং তার বইতে লিখেছিলেন তার কিছু প্রিয় শিক্ষার্থী, সহকর্মীদের কথা। সেই মেধাবী নামগুলোর অন্যতম ছিল, মাহবুব মজুমদার।
সাধারণত ডক্টরাল থিসিস হয়ে থাকে একজন বিজ্ঞানীর গবেষণার প্রথম ধাপ। সেই প্রথম ধাপেই স্ট্রিং-কসমোলজির জগতে যুগান্তকারী তত্ত্বের অবতারণা করেন মাহবুব মজুমদার। তার সেই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এখনও এগিয়ে চলছে স্ট্রিং-কসমোলজির অসংখ্য গবেষণা।
ক্যামব্রিজে কৃতিত্বের সঙ্গে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক হিসেবে মাহবুব মজুমদার যোগদান করেন ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্জিত এমন অভিজ্ঞতা ও কৃতিত্বের পর যখন হয়তো বিদেশে একই মানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তার যোগ দেয়ার কথা, তখন তিনি এসমস্ত ছেড়ে ফিরে এলেন মাতৃভূমি, বাংলাদেশে।
২০০৫ এ দেশে ফেরার পর থেকেই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের জাতীয় কোচ হিসেবে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রফেসর মজুমদার। তার নিরলস পরিশ্রম ও অভিনব প্রশিক্ষণের ফলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ঝুলিতে এসেছে ২৮টি ব্রোঞ্জ পদক, ৭টি রৌপ্য পদক ও একটি স্বর্ণপদক। তার প্রচেষ্টায় এবছরই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতন অংশগ্রহণ করে ইউরোপিয়ান গার্লজ ম্যাথমেটিকাল অলিম্পিয়াড-২০২১ এ। মেয়েদের জন্য আয়োজিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই অলিম্পিয়াডে প্রথমবার অংশ নিয়ে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ জিতে নেয় বাংলাদেশের মেয়েরা। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের সাফল্যের মূল কারিগর মাহবুব মজুমদার। শুধু তাই নয়, প্রফেসর মজুমদারের প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের মেধাবী ও পদকজয়ী শিক্ষার্থীরা বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়েছে এমআইটি, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন-এর মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কোনোরকম ব্যাক্তিস্বার্থ বা সুবিধাগ্রহণ ছাড়াই বিনাবেতনে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের উন্নতির জন্য।
শুধুমাত্র গণিতদলের শিক্ষার্থীরাই নয়, প্রফেসর মাহবুবের অনুপ্রেরণা ও সহায়তায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটার সায়েন্সের মতো বিষয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণায় যুক্ত হয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না হয়েও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ড. নাফিজ ইশতিয়াক, যিনি এখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজে গবেষণা করছেন স্ট্রিং থিওরির মহারথী এডওয়ার্ড উইটেনের সরাসরি সহকর্মী হিসেবে। মাহবুব মজুমদারের ছাত্রছাত্রীদের কৃতিত্বের গল্প নিয়ে লিখে ফেলা যাবে আস্ত একটি বই। সেই চেষ্টা আরেকদিন করা যাবে। শুধু পড়াশোনাতেই নয়, ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো পারিবারিক, আর্থিক বা অন্য সমস্যাতেও সবসময় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এই মানুষটি।
বর্তমানে প্রফেসর মাহবুব মজুমদার নিয়োজিত আছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ডেটা আন্ড সায়েন্সেস-এর ডিন ও অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ডের অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। শুরু থেকেই শিক্ষা কারিকুলাম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় উন্নতি ও আধুনিকায়নে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ক্যাটাগরি থিওরি, টপলোজির মতো অ্যাডভান্সড ক্লাসগুলো করতে পারছে বিষয়গুলোতে অভিজ্ঞ অধ্যাপক ও গবেষকদের কাছে। মহামারির এই চরম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা যাতে ব্যাহত না হয় তাই তিনি তার সহকর্মীদের সহায়তায় তৈরি করেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম buX, যা কিনা দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম। এমন বেশ কিছু প্রচেষ্টার ফলেই সীমিত ও ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ নিয়েও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে তাদের কোর্সগুলো করতে পারছে।
একজন ডিন ও প্রফেসর হিসেবে শিক্ষার্থীদের জন্য সবসময় খোলা থেকেছে তার দরজা। কোর্স নিয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যা বা নতুন কোর্স চালু করার দাবি, নতুন গবেষণা বা ক্যারিয়ারের দিকনির্দেশনা- যেকোনো বিষয়ে শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক যে কেউই তার সাথে আলাপ করতে পারে বন্ধুর মতো। সবসময় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন গ্রেড নয়, বরং জ্ঞানার্জনের দিকে মনোযোগ দিতে। ডিস্ক্রিট ম্যাথ পরীক্ষায় স্যার খুব মজার ও অভিনব প্রশ্ন করতেন, সময় থাকতো অফুরন্ত! প্রশ্নের শেষে লেখা থাকতো এমন একটি বাক্য- “এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো, যা তুমি ভালোভাবে শিখতে পারোনি তা শিখতে তোমাদেরকে সহায়তা করা। না পারলে হতাশ হয়ো না।”
নিজের ব্যাক্তিগত অর্জন বা কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলা একেবারেই পছন্দ করেন না প্রফেসর মাহবুব। তবে তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তোলার সাধনায় শুরু থেকেই সম্মুখীন হয়েছেন নানান প্রতিকূলতার। সেসব বাধা ও বাধাপ্রদানকারীদের নিয়েও কথা বলতে পছন্দ করেন না তিনি। অনেকেই প্রশ্ন করেন, প্রফেসর মাহবুব মজুমদারের মতো একজন মানুষ এত সুযোগ ছেড়ে বাংলাদেশে কেন ফিরে এলেন? কয়েকবছর আগে একটি ইন্টারভিউতে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
ক্যারিয়ারটা আসলে কী? আমি যদি এমআইটির একজন প্রফেসর হই বা নোবেল প্রাইজও পাই, সেটা তবুও শুধুই একটা নিজস্ব অর্জন। আমার দেশের তরুণ প্রজন্মকে যদি তৈরি করতে পারি, সেটাই হবে আমার সত্যিকারের সাফল্য।
হাজারও প্রতিকূলতার সাথে নীরবে লড়াই করে, নীরবেই তিনি পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন তরুণ প্রজন্মকে, আলোকিত করছেন আমাদের বাংলাদেশকে। আজীবন আলো ছড়িয়ে যাওয়া নক্ষত্রের ধর্ম, তাকে কখনো থামানো যায় না।