এপ্রিলের ৩০ তারিখ। ১৯৪৫ সালের এই দিনে রহস্যজনকভাবে আত্মহত্যা করেন জার্মান ফুয়েরার এডলফ হিটলার। এরই মাধ্যমে ইউরোপের বুকে চলতে থাকা বছরব্যাপী ধ্বংসলীলার আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপে শেষমেশ ফিরে আসে একচিলতে খুশির ফরমান। রাস্তায় বেরিয়ে আসে মুক্তিকামী জনতা। দেশে দেশে নেমে আসে আনন্দের ঢল। বিশ্বযুদ্ধের রণক্ষেত্র ইউরোপে যখন শান্তির আমেজ, তখন নিশ্চয়ই যুদ্ধসেনাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা। কিন্তু সেটা হতে দিচ্ছে না নাছোড়বান্দা জাপান। যুদ্ধবাজ জাপানিরা নিশ্চিত হার জেনেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলো। তাদের জন্য যুদ্ধে নতি স্বীকার করা চূড়ান্ত অপমানস্বরূপ। প্রয়োজনে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে, তবুও যুদ্ধ থামতে দেওয়া যাবে না।
মিত্রপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিলো। কী মুশকিল! নানা উপায়ে যুদ্ধ থামানোর পায়তারা করা হলো, কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাই তারা জাপানিদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এমন শিক্ষা দেওয়া হবে, যেন তারা ফের যুদ্ধের নাম নিতে গেলে একশবার ভাবে। এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলো এক নতুন বোমা। আগস্টের ৬ তারিখ জাপানের হিরোশিমার বুকে নিক্ষেপ করা হলো সেটি। সেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটা মাত্র শুধু জাপান নয়, পুরো পৃথিবী আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
হিরোশিমা যেন এক অতিপ্রাকৃত আক্রোশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। ক’দিন বাদে ফের নাগাসাকিতে আরেকটি বোমা ফেলা হলো। এবার জাপানিদের টনক নড়লো। স্বয়ং সম্রাট হিরোহিতো করজোড় করে যুদ্ধ থামানোর মিনতি করলেন। আত্মসমর্পণ করলো অহংকারী জাপানিরা। যুদ্ধ থেমে গেলো। কিন্তু থামলো না আলোচনা। এই ভয়ংকর বোমা নিয়ে শুরু হলো গুঞ্জন। “কে এই বোমা তৈরি করলো?” লোকমুখে শুধু এই প্রশ্ন। লোকমুখেই ঘুরতে লাগলো একজনের নাম, “এটি নিশ্চয়ই আলবার্ট আইনস্টাইনের কাজ।” সবাই বিশ্বাস করেও ফেললো, এটি আইনস্টাইন ছাড়া কারো কাজ হতেই পারে না। এমনকি বোমা পতনের ৭৮ বছর পরেও বহু মানুষের কাছে আইনস্টাইন হলেন পারমাণবিক বোমার জনক। এই ঐতিহাসিক ভুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় এই বোমার মূল জনকের নাম। আসলে নিউ ইয়র্কের মাটিতে বেড়ে উঠা রবার্ট ওপেনহাইমার নামক এক পদার্থবিদ ছিলেন সেই প্রলয়ংকারী পারমাণবিক বোমার পিতা। যখন জাপানিদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিলো আকাশ-বাতাস, তখন এই বিজ্ঞানী বিড়বিড় করে বলছিলেন,
“এখন আমি হলাম মৃত্যু, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত ধ্বংসকারী”।
জন্ম এবং শিক্ষাজীবন
নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনের গল্প। জুলিয়াস ওপেনহাইমার এবং ইলা ফ্রিডম্যান দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নিলো এক শিশু। ১৯০৪ সালের ২২ এপ্রিল জন্ম নেওয়া সেই শিশুর নাম রাখা হলো বাবার সাথে মিলিয়ে জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। তার পিতা ছিলেন এক জার্মান বংশোদ্ভূত অভিবাসী। শহরে কাপড় আমদানিকারক হিসেবে তার সুনাম ছিলো। তার স্ত্রী ইলা ছিলেন একজন পেশাদার আঁকিয়ে। দুজনেই চিত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। বাবা-মায়ের বদৌলতে শিশু রবার্ট বেড়ে উঠতে থাকেন ভ্যান গগ, সেজানি, গগিন প্রমুখ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর রঙিন কল্পনায় লালিত হয়ে। সবাই ভেবেছিলো এই ছেলে বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হবে। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিলো রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করার। রসায়নের প্রতি এই স্বপ্ন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর কীভাবে যেন পদার্থবিদ্যার প্রতি অসীম ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়।
রবার্ট ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ১৯২১ সালে কৃতিত্বের সাথে স্কুলের পাট চুকিয়ে তিনি ঐতিহ্যবাহী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। এখানে তিনি পদার্থবিদ্যা, গণিত, দর্শন, প্রাচ্য ধর্ম, ফরাসি এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার সুযোগ পান। তখন হার্ভার্ডে তাপ গতিবিদ্যা বিষয়ের উপর লেকচার দিতেন বিখ্যাত পদার্থবিদ পার্সি ব্রিজমান। ওপেনহাইমার তার সান্নিধ্যে পরিচিত হন গবেষণামূলক পদার্থবিদ্যার সাথে। অত্যন্ত জটিল এই বিষয়ে অধ্যয়ন করতে যেখানে অনেক মেধাবী ছাত্র হিমশিম খেতো, সেখানে ওপেনহাইমার দক্ষতার সাথে সব পরীক্ষায় পাশ করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে তিনি হার্ভার্ড থেকে সকল বিষয়ে সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হন। সমাবর্তন দিবসে সনদপত্র হাতে নিয়ে রবার্ট স্বপ্ন দেখতে থাকেন ইউরোপ ভ্রমণ করার। কারণ, তখন ইউরোপ ছিল বিজ্ঞানের চারণভূমি।
নতুন দিগন্ত
রবার্ট ওপেনহাইমারের মতো প্রতিভাবান ছাত্রের স্থান হলো ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। এখানকার বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিস গবেষণাগারে বিজ্ঞানী জে জে থমসনের অধীনে গবেষণা শুরু করেন তিনি। বিজ্ঞানী থমসন ছিলেন ইলেক্ট্রনের প্রথম আবিষ্কারক। তিনি তার অবদানের জন্য সম্মানজনক নোবেল পুরষ্কার পর্যন্ত পেয়েছিলেন। যোগ্য গুরুর অধীনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ লাভ করতে থাকেন রবার্ট।
তবে তিনি ক্যাভেন্ডিসের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কয়েক মাস পর তার গবেষণাগারের রুটিন মাফিক জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নিলে তিনি জার্মানি ভ্রমণ করেন। সেখানে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২৭ সালে তিনি এই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। রবার্টের প্রতিভার কথা তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি তৎকালীন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং ম্যাক্স বর্নের সাথে পরমাণুর গঠন নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান। পিএইচডি গ্রহণের কিছুদিন পর তিনি বিজ্ঞানী বর্নের সাথে সম্মিলিতভাবে বর্ন-ওপেনহাইমার তত্ত্ব প্রদান করেন। তার যশে আকৃষ্ট হয়ে বড় বড় গবেষণাগার থেকে কাজ করার আমন্ত্রণ আসতে থাকে।
শিক্ষকতা এবং রাজনীতি
১৯২৯ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার আমন্ত্রণ লাভ করেন। ইউরোপের কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা অবকাশ নিয়ে তিনি ফিরে যান নিজের দেশে। সময় ভাগ করে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা চালিয়ে যান। তিনি তার ছাত্রজীবনের প্রতিভাকে শিক্ষকতার মাধ্যমে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। তার সহকর্মী পদার্থবিদ হ্যান্স বিথ তার শিক্ষকতা নিয়ে মন্তব্য করেন,
তার লেকচার ছিল চমৎকার অনুভূতি। গবেষণাধর্মী পদার্থবিদ্যা ছাড়াও তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বিষয়গুলো বেশ সহজে প্রকাশ করতে পারতেন। বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার ছাড়াও তার ব্যতিক্রমী ভঙ্গি ছিল, যার মাধ্যমে তিনি পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষায় এক অনন্য মুগ্ধতা হাজির করাতে পারতেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শিক্ষক এরকম অনুভূতি দিতে পেরেছে কি না সেটা আমার জানা নেই। তার চাহনি দেখেই বোঝা যেত, পদার্থের সকল গূঢ় রহস্য তার জানা। তিনি কখনোই তার ছাত্রদের সরাসরি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতেন না। বরং ছাত্রকে সেই প্রশ্নের উত্তর বের করার পাথেয় বাতলে দিতেন।
এরই মধ্যে ইউরোপের পরাশক্তি জার্মানিতে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে যায়। জার্মানির ক্ষমতায় আসেন এডলফ হিটলার। হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ওপেনহাইমার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৬ সালে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় তিনি কম্যুনিস্ট ধারার রাজনীতিবিদদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। কিন্তু পরবর্তীতে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রপ্রধান জোসেফ স্ট্যালিন কর্তৃক সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের প্রতি অবমাননামূলক ব্যবহারের কারণে তিনি এই রাজনৈতিক ধারা থেকে সরে আসেন। এরই মাঝে তার জীবনে বেশ বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। ১৯৩৭ সালে বাবা জুলিয়াস মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাবার মৃত্যুর পর রবার্ট কিছুদিনের জন্য নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন। পারিবারিক সম্পত্তির ভার বুঝে নিয়ে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করেন। কয়েক বছর পর ক্যাথেরিন পুনিং হ্যারিসন নামক এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির সংসারে পিটার এবং ক্যাথেরিন নামে দুটো সন্তানের জন্ম হয়।
বিশ্বযুদ্ধ এবং ম্যানহ্যাটন প্রকল্প
১৯৩৯ সালে এডলফ হিটলার যখন তার নাৎসি বাহিনী নিয়ে পোল্যান্ড দখল করে ফেলেন, তখন শুরু হয়ে যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিশাপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার যুদ্ধ শুরুর পর পর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, লিও সাইলার্ড এবং ইউজিন ওইনার যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সতর্কতা জ্ঞাপন করে একটি জরুরি পত্র প্রেরণ করেন। সেখানে তারা হিটলার কর্তৃক পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। আইনস্টাইনদের সেই পত্রের পর মার্কিন বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক বোমার উপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। এদের মধ্যে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার গবেষক রবার্ট ওপেনহাইমারও ছিলেন। প্রতিভাবান রবার্ট তার গবেষণাগারে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম থেকে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম-২৩৫ আলাদা করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে হলে ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর সংকট ভর নির্ণয় করা আবশ্যক ছিল।
রবার্টের গবেষণা চলাকালীন সময়ে সরকার কর্তৃক পারমাণবিক বোমা তৈরির একটি বড় বাজেটের প্রকল্প শুরু করার আলোচনা চলতে থাকে। বহু আলোচনার পর ১৯৪২ সালে সরকার কর্তৃক মার্কিন সেনাবাহিনীকে ব্রিটিশ, মার্কিন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের একত্র করে প্রকল্প উদ্বোধনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পারমাণবিক বোমা তৈরির এই প্রকল্পের দাপ্তরিক নামকরণ করা হয় ‘ম্যানহ্যাটন প্রকল্প’। প্রকল্পে শত শত বিজ্ঞানীর সমাগম ঘটে। কিন্তু সকল বিজ্ঞানীর শিরোমণি ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে পুরো গবেষণার সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে বোমা প্রকল্পের কাজ। পাছে হিটলার বোমা তৈরি করে ফেলে, এই ভয় ছিল। প্রাথমিকভাবে বোমা তৈরি শেষে রবার্ট পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন লস আলামোস মালভূমিকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই লস আলামোসের একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। এই স্থান বেছে নেওয়ার পেছনে কী শৈশবের কোনো ঘটনা জড়িত ছিল, সেটা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ১৯৪৩ সালে এই স্থানে সফল পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের মাধ্যমে তিনি জন্ম দেন এক বিধ্বংসী অস্ত্রের। ভয়ংকর জন্মের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য আঁতকে ওঠেন জন্মদাতা রবার্ট। এর দু’বছর পর হিরোশিমা-নাগাসাকি বিস্ফোরণের মাধ্যমে অভিষিক্ত হয় পারমাণবিক বোমা। বোমা পতনের পর সেই বছর অক্টোবরে সগৌরবে প্রকল্প থেকে ইস্তফা দেন তিনি।
হাইড্রোজেন বোমা বনাম রবার্ট
এক পারমাণবিক বোমা দিয়ে রবার্ট ওপেনহাইমার যেখানে সফলতার শীর্ষে আরোহণ করলেন, তখন কে জানতো আরেক প্রলয়ংকারী বোমাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। পারমাণবিক বোমার কারণে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বিশ্বযুদ্ধের ইতি টানলে বহু মার্কিনির নিকট ওপেনহাইমার এক নায়কের নাম হয়ে দাঁড়ায়। তার বোমার কারণে দ্রুত যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই তার আপনজনকে কাছে ফিরে পেয়েছিলো। দেখতে দেখতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। সবাই যার যার জীবনে ফিরে যায়। রবার্ট ওপেনহাইমারকে সরকার পারমাণবিক শক্তি কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়। তিনি সর্বদা ভয় পেতেন, অন্য কোনো রাষ্ট্র এই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে অন্ধ স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। এই দুশ্চিন্তা তাকে ভেতর থেকে যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। ১৯৪৯ সালে স্ট্যালিন কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়নের সফল পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের ঘোষণা আসলে ফের মার্কিন মুলুকে আতঙ্কের ছায়া দেখা দেয়।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান সোভিয়েত তৎপরতায় কমিশনের বিজ্ঞানীদের সাথে গোপন বৈঠকে বসলেন। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কি সোভিয়েতের সাথে সমঝোতায় বসবে, নাকি হাজার পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণের কাজ শুরু করবে? কমিশনের বিজ্ঞানীরা সবাই বোমা নির্মাণের বিপক্ষে রায় দেন।
বিজ্ঞানীদের এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির মনঃপুত হলো না। তিনি এর পেছনে সভাপতি রবার্টকে দায়ী করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সরকারের কর্মকাণ্ডে হতবাক হয়ে যান তিনি। চার বছর তদন্ত চলার পর প্রতিবেদনে জানানো হয়, পূর্বে রবার্ট ওপেনহাইমারের সাথে কম্যুনিস্টদের আঁতাত ছিল। তাই তার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রবিরোধী ছিল। তৎক্ষণাৎ পারমাণবিক গবেষণাগারে প্রবেশের সকল অনুমতি থেকে তাকে বঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। দেশের নায়ক থেকে এক ধাক্কায় খলনায়ক বনে যান এই বিজ্ঞানী। পরবর্তী এক দশক বঞ্চনার শিকার হন তিনি। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রবার্টের সাথে করা পূর্ব সরকারের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেন এবং তাকে সম্মানজনক এনরিকো ফার্মি পুরষ্কারে ভূষিত করেন। এর মাধ্যমে তিনি হয়তো খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।
শেষ জীবনে তিনি টুকটাক রাজনীতি করেছিলেন। প্রিন্সটনে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক এক প্রতিষ্ঠানে তিনি পরিচালক হিসেবে বেশ কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জীবনে তিনি সর্বদা পারমাণবিক বোমা বিরোধী বক্তব্য দিয়ে গেছেন। নিজের সন্তানে বিতৃষ্ণ এই জনক ১৯৬৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরই মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির এক শক্তিশালী হাতিয়ার উদ্ভাবকের জীবনের যবনিকাপাত হয়।