Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেহেদি হাসান: গাড়ির মেকানিক থেকে একচ্ছত্র গজল সম্রাট

মেহেদি হাসান, শ্রোতাদের হৃদয়ে তিনি ‘গজল সম্রাট’, অসাধারণ গায়কীতে তিনি মুগ্ধ করেছেন এই উপমহাদেশের অসংখ্য সঙ্গীতবোদ্ধাকে। অনবদ্য গায়নশৈলী, গানের প্রতি আবেগ আর সুমিষ্ট কণ্ঠের কারণে গজলের জগতে এক নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে নিতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। তিনিই প্রথম গজলকে আপামর মানুষের কাছে নিয়ে আসেন।

হাজার হাজার দর্শকের সামনে গজল পরিবেশন করা প্রথম শিল্পী তিনি। লতা মঙ্গেশকর তার সঙ্গীত শুনে বলেছিলেন, “স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার কণ্ঠে অবস্থান করেন।” আরেক কিংবদন্তী জগজিৎ সিং বলেছিলেন “তার মাপের গজল শিল্পী আরেকজন তৈরি হওয়া অসম্ভব”। কাওয়ালি শিল্পী আবিদা পারভীনের মতে, “সঙ্গীতের ভুবনে তিনি এক জীবন্ত টাইটানিকস্বরূপ”। আরেক মহান গায়ক মো. রফি বলেছিলেন, “জনগণের জন্য আমরা গান করি, আর আমাদের জন্য গান করেন মেহেদী হাসান”।

মেহেদি হাসান; Source: badarartist.com

জন্ম ও শৈশব

মেহেদি হাসানের জন্ম অবিভক্ত ভারতে, ১৯২৭ সালের ১৮ জুলাই রাজস্থান প্রদেশের ঝুনঝুনু জেলার লুনা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পী পরিবারে। সঙ্গীতের প্রাচীন ধ্রুপদী ধারাকে নিয়ত লালন করে, এমন পরিবারে মেহেদী হাসান ছিলেন সঙ্গীত সাধনার ১৬তম প্রজন্ম। শিশুকালেই তালিম নেন তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে। তার পিতা ওস্তাদ আজিম খান ও চাচা ইসমাইল খান ছিলেন তার প্রথম শিক্ষাগুরু

ধ্রুপদী সঙ্গীতের একচ্ছত্র সম্রাট মেহেদি হাসান; Source: mousici.com

তার সঙ্গীতে দক্ষতা কিশোর বয়স থেকেই বিকশিত হতে শুরু করে। উদীয়মান প্রতিভা হিসেবে খুব দ্রুতই পরিচিতি লাভ করেন তিনি। শোনা যায়, একবার বারোদার মহারাজার দরবারে প্রায় চল্লিশ মিনিট রাগ ‘বসন্ত’ পরিবশেন করে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি, তখন তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর।

দেশভাগের পর পাকিস্তানে

১৯৪৭ এর দেশভাগের পর মেহেদি হাসানের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। এ সময় তার পরিবার ভারত ছেড়ে পাকিস্তানের সঞ্চিয়াল জেলার ছিচা ওয়াতনি এলাকায় বসতি গড়েন। দেশভাগের আঁচ লাগে পরিবারের মধ্যে।

১৯৪৭ এর দেশভাগের নির্মম পরিণতি থেকে রক্ষা পায়নি মেহেদি হাসানের পরিবারও; Source:Herald Magazine – Dawn

নিত্য লেগে থাকা অভাব-অনটনের পরিবারে বড় ছেলে তিনি, ২০ বছরের তরুণ মেহেদির জন্য তাই তখন জীবনটা ছিল বেশ অস্বস্তিকর। পরিবারের অভাব-অনটন কিছুটা লাঘবের জন্য মেহেদি চাকরি নেন সাইকেল মেরামতের দোকানে। শিখলেন ট্রাক্টর আর গাড়ির মেকানিকের নানা কাজ। তেল-কালি-ঝুলির মধ্যে জীবিকা নির্বাহ করলেও, সঙ্গীত চর্চা থেকে অবশ্য তিনি দূরে সরে থাকেননি। বরং গান হয়ে ওঠে তার একলা মনের খোরাক। সময়-সুযোগ পেলেই সঙ্গীতের কঠোর সাধনা তিনি করে গেছেন নিয়মিতই। অচেনা, অজানা বন্ধু-বান্ধবহীন পরিবেশে সঙ্গীত হয়ে ওঠে তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

রেডিওতে প্রথম গান পরিবেশন

১৯৫৭ সালে রেডিও পাকিস্তানে অডিশনের সুযোগ পান মেহেদি হাসান। অডিশনে একের পর এক গাইলেন ঠুমরি, রাগ- খাম্বাজ, পিলু, দেশ ইত্যাদি বিভিন্ন ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। তার অসাধারণ সুরের জাদুতে মুগ্ধ হন বিচারকগণ। তাকে ৩৫ রুপী সম্মানীতে ‘এ’ গ্রেডের ঠুমরী শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। রেডিওতে গান গাওয়ার সুবাদে তার পরিবারের যেমন আর্থিক সঙ্কট লাঘব হয়, তেমনি সঙ্গীত জগতে ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ শুরু করেন মেহেদি হাসান।

লাইভ প্রোগ্রাম অনুষ্ঠানে মেহেদি হাসান; Source: Hindustan Times

গজল ও প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ

ঠুমরী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও নিজেকে তিনি মনে করতেন একজন পরিপূর্ণ গজল শিল্পী। গজলের প্রতি তার ভালোবাসা তখন একটুও কমেনি। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন উর্দু কবিতার প্রতি। কিছু কবিতাও লেখেন তিনি উর্দুতে এবং তাতে সুর করেন। একবার রেডিওর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধে পরীক্ষামূলকভাবে দুটো গজল পরিবেশন করেন, আর তাতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে দাঁড়ায়। তিনি রেডিওতে আরো বেশ কয়েকটি গজল পরিবেশনের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন কাড়েন। গজল শিল্পী হিসেবে হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেতে থাকেন তখন থেকেই। ‘ম্যায় হোস ম্যায় থা তো ফির’, ‘রাফতা রাফতা ও মেরি হাস্‌তি কা সামান হো গ্যায়ি’, ‘খুবাকু ফেইল গেয়ি’, ‘মহব্বত করনে ওয়ালে’, ‘দুনিয়া কিসিকে পেয়ার’, ‘জিন্দেগি মে তো সাবহি পেয়ার কিয়া কারতি হে’, ‘বাত কারনি মুঝে মুশকিল’, ‘খুলি জো আঙ্গা ওহ থা’,  ‘আব কি বিচরে’ সহ বহু গজল তাকে এনে দেয় গজলের মুকুটহীন সম্রাটের সম্মান। সঙ্গীত ও গজল হয়ে ওঠে তার আমৃত্যু সঙ্গী।

সঙ্গীতের দুই কিংবদন্তী লতা মঙ্গেশকর ও মেহেদি হাসান ; Source: youtube.com

১৯৬২ সালে পাকিস্তানের উর্দু চলচ্চিত্রে প্রথম প্লে ব্যাক করার সুযোগ পান মেহেদি হাসান। তার গাওয়া ‘জিস নে মেরে দিল কো দর্দ দিয়া’ গানটি শ্রোতাদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ‘ফারাঙ্গি’ ছবিতে কবি ফৈয়জ আহমদ ফৈয়জের সৃষ্টি ‘গুল সে রাংগ ভারে’ গজল গানটির প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর আর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। একের পর এক জনপ্রিয় গানের প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে তিনি স্থায়ী আসন করে নেন। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে শতাধিক গান গেয়েছেন এই শিল্পী।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আগমন ও বাংলা গান

স্বাধীন বাংলাদেশে মেহেদি হাসান প্রথম আসেন ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে। সেসময় তিনি বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ প্রযোজনায় পরিচালিত ‘জান্নাত দোযখ’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলা গান রেকর্ড করেন। উর্দু গজল ছাড়াও বাংলা গানেও তিনি তার মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রাখেন। মাসুদ করিমের কথায়, এ. হামিদের সুরে ও সুবল দাশের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘তুমি যে আমার ভালোবাসা’ এবং ‘সুখেরই স্বপ্ন কে ভেঙে দিল’ এই দুটি দ্বৈতসঙ্গীত করেন মেহেদী হাসান। গান দুটিতে তার সাথে কণ্ঠ দেন বাংলাদেশের দুই জনপ্রিয় শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন ও রুনা লায়লা। এর আগেও মোহনলাল দাশের কথা ও সুরে ‘হারানো দিনের কথা’, আশরাফ-উজ জামান খানের কথা ও সুরে ‘এত ভাল লাগে কেন’ এবং মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও আলী হোসেনের সুরে ‘ঢাকো যত না নয়ন কথা’- এই বাংলা গানগুলো করেন মেহেদি হাসান। তার গায়নশৈলীতে মন্ত্রমুগ্ধকর হয়ে ওঠা সেই গানগুলো বাংলার সঙ্গীতপ্রেমীদের আজও মুগ্ধ করে।

বাংলাদেশে আয়োজিত সার্ক সম্মেলনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মেহেদি হাসানের সঙ্গীত পরিবেশনা; Source: blogs.thenews.com.pk

উল্লেখযোগ্য গানের অ্যালবাম

মেহেদি হাসানের উল্লেখযোগ্য অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে- ক্যাহনা উসে, ইন কনসার্ট, মাহফিল, খুলি জো আঙ্গ, নজরানা, লাইভ অ্যাট রয়েল অ্যালবার্ট হল, আন্দাজ-ই-মাস্তানা, শাম-ই-গজল,  ক্লাসিক্যাল গজল- ১, ২, ৩, দিল জো রোতা হেয়ি, গালিব গজলস, গজলস ফরেভার-১, রিমেমবারিং মেহেদি হাসান, ট্রেজারস, গোল্ডেন কালেকশন অব মেহেদি হাসান-১, ২, গোল্ডেন গ্রেট, লাইফ স্টোরি, লাইভ আর্ট খাম্বাজ, দরবার গজল ও লাইভ কনসার্ট ইন ইন্ডিয়া। ২০১০ সালের অক্টোবরে এইচএমভি হতে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘সারহাঁদে’।

বিভিন্ন কনসার্টে পরিবেশিত মেহেদি হাসানের গানগুলো নিয়ে প্রকাশিত অ্যালবাম; Source: hindustantimes.com

সম্মান ও স্বীকৃতি

পেশাদার গায়কের সাথে সাথে তিনি ছিলেন এক অনন্য সঙ্গীত পরিচালক। তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘সারহাঁদে’-তে ফারহাদ শাহজাদের কথা ও মেহেদি হাসানের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সাথে গাওয়া ‘তেরা মিলনা’ গানটি শ্রোতাদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। মেহেদি হাসান উর্দু, বাংলা, পাঞ্জাবি ও আফগান ভাষায় ২০ হাজারের অধিক গান গেয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী ভক্তদের মনের খোরাক মিটিয়েছেন। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা।

মেহেদি হাসানের জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে প্রকাশিত অ্যালবাম ‘শাহেনশাহ-ই-গজল’; Source: youtube.com

পকিস্তানের চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি পেয়েছেন ‘নিগার এওয়ার্ড’, অনবদ্য গজলের জন্য ভক্তদের কাছ থেকে লাভ করেন ‘শাহেনশাহ-এ-গজল’ ও ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ উপাধি। সঙ্গীতে সারাজীবন কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’, ‘হিলাল-এ-ইমতিয়াজ’ এবং ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’, ভারত সরকার ‘সায়গল অ্যাওয়ার্ড ইন জলান্ধর’, নেপাল সরকার ‘গোর্খা দক্ষিণা বাহু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের সর্বাধিক পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত গজল শিল্পী |

দীর্ঘ অসুস্থতায় শেষ বয়সে গান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন মেহেদি হাসান; Source: thedailynewnation.com

প্রয়াণ

দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে আশির দশকের পর থেকে অনুষ্ঠানে গান করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সঙ্গীত থেকে একপ্রকার নির্বাসনই নিয়েছিলেন মেহেদি হাসান। অবশেষে ২০১২ সালের ১৩ জুন করাচির এক হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে এই সঙ্গীত তপস্বীর চিরবিদায় ঘটে। তিনি রেখে গেছেন ১৪ জন সন্তানের এক বৃহৎ পরিবার। তার সন্তানদের মধ্যে ওস্তাদ পীর বক্স এবং ওস্তাদ মহম্মদ হুসেইন বর্তমানে সঙ্গীতচর্চার সাথে যুক্ত রয়েছেন। এমন মহান শিল্পীকে কখনোই দেশ-কালের সীমানায় বেঁধে রাখা যায় না। মহান এই সুর সম্রাটের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

ফিচার ইমেজ- nytimes.com

Related Articles