জার্মানির যেমন আছে ব্রান্ডেনবার্গ গেট, ভারতের যেমন আছে ইন্ডিয়া গেট, তেমনি আমাদের রয়েছে ঢাকা গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত দোয়েল চত্বর থেকে বাংলা একাডেমি যাওয়ার পথেই এই ঢাকা গেটের অবস্থান। এই পথ দিয়ে সচরাচর চলাফেরা করা প্রায় সবাই এই গেটটি একবার হলেও দেখেছেন। তবে যারা কালেভদ্রে এই রাস্তার যাত্রী, গেটটি তাদের নজরে পড়েনি বললেও অবাক হবার কিছু নেই। কারণ, ঢাকা গেট ব্রান্ডেনবার্গ এবং ইন্ডিয়া গেটের মতো অতিকায় নয়। তার উপর গেট বলতে আমরা যা বুঝি, তার কিছুই এখন বাকি নেই।
স্রেফ তিনটি স্তম্ভ দেখে বোঝা যায়, এককালে এখানে ঢাকা গেট বলতে কিছু একটা ছিল। এই ‘এককাল’ বলতে বোঝায় সপ্তদশ শতাব্দীর ঢাকাকে। সেই সময় থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত এই ধ্বংসপ্রায় ফটকটি ছিল ঢাকা মহানগরীর উত্তর প্রবেশদ্বার। মোঘল আমলে বাগ-ই-বাদশাহী নামক সুসজ্জিত বাগানের পাশে নির্মিত এই দীর্ঘ ঢাকা গেট নির্মাণ করেছিলেন এক মহান সুবেদার, যাঁর নাম ছিল মীর জুমলা।
এককালে বাংলার সুবেদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই মহান ব্যক্তিত্ব ঢাকা, তথা সমগ্র বাংলার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ঢাকাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মীর জুমলার স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এমনকি, সম্রাট শাহজাহানকে কোহিনুর হীরক উপহার দেওয়া ব্যক্তি হিসেবেও অনেকে মীর জুমলাকে চিহ্নিত করেছেন। আমাদের আজকের প্রবন্ধে বাংলার সুবেদার মীর জুমলার বর্ণাঢ্য জীবনী সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।
যেখান থেকে শুরু
পৃথিবীর বুকে মীর জুমলার যাত্রা শুরু হয় সুদূর পারস্যের ইস্পাহানের আর্দিস্তান নামক অঞ্চল থেকে। আনুমানিক ১৫৯১ সালে এক দরিদ্র তেল ব্যবসায়ীর পরিবারে জন্ম নেন এক পুত্র সন্তান। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় মুহম্মদ সাঈদ। এই মুহম্মদ সাঈদ পরবর্তীতে মুয়াজ্জম খান, খান-ই-খানান, সিপাহ সালার এবং ইয়ার-ই-ওয়াফাদারসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত হন। তবে ইতিহাসবিদরা তাকে ‘মীর জুমলা’ নামেই চিনেন। বাল্যকালে মীর জুমলা নিজ আগ্রহে লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি গণিতের বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে পারদর্শী ছিলেন। তার এই দক্ষতা পরবর্তীতে তাকে পারস্যের এক হীরক বণিকের অধীনে কেরানির চাকরি পেতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু এই চাকরিতে বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি তিনি।
দরিদ্রতার কারণে তাকে অল্প কিছুদিন পরেই ভাগ্য সন্ধানের জন্য অন্য পথ খুঁজে নিতে হয়। এবার তিনি এক ঘোড়ার বেপারীর অধীনে চাকরি করা শুরু করেন। এই বেপারী আবার ভারতবর্ষের গোলকুণ্ডা অঞ্চলে ঘোড়া রপ্তানি করতেন। বাণিজ্যিক সূত্রে আনুমানিক ১৬১৫-২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই বেপারীর সাথে সর্বপ্রথম ভারতের বুকে আগমন ঘটে মীর জুমলার। ভারতের গোলকুণ্ডা অঞ্চলে এসে তিনি এক স্থানীয় হীরক বণিকের অধীনে ফের কেরানি হিসেবে কাজ করতে থাকেন।
গোলকুণ্ডায় ভাগ্য পরিবর্তন
কেরানি হিসেবে কর্মরত থাকলেও মীর জুমলা তার মনিবের ব্যবসাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন। তৎকালীন ভারতবর্ষে গোলকুণ্ডা ছিল হীরক ব্যবসার রাজধানীস্বরূপ। আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলেও মীর জুমলা ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি সবসময় নিজে থেকে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। তাই কেরানি অবস্থায় হীরক ব্যবসার খুঁটিনাটি শেখার পর নিজেই হীরক বণিক হিসেবে আবির্ভূত হন। রাতারাতি চৌকশ মীর জুমলা হীরক ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। আর্থিক অবস্থা উন্নতির সাথে তার সামাজিক পদমর্যাদাও বৃদ্ধি পায়।
মীর জুমলা তখন হীরক ব্যবসার সূত্র ধরে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সাথে পরিচিত হন। এবার তার মাথায় নতুন স্বপ্নের ভূত চাপলো। তিনি প্রশাসনের উঁচু পদে চাকরি লাভ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন। উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে তিনি ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর মাছলিপাটনামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি লাভ করেন। তিনি দক্ষতার সাথে বন্দরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। ততদিনে তিনি রাজদরবারের অনেক সভাসদের সাথে ওঠা-বসা শুরু করেন। তখন ভারতের গোলকুণ্ডার শাসক ছিলেন সুলতান আব্দুল্লাহ কুতুব শাহ। তিনি মীর জুমলার ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে তাকে গোলকুণ্ডা ফিরিয়ে আনেন এবং তার সার-ই-খাইল বা উজির হিসেবে নিযুক্ত করেন।১
এভাবে কেরানি থেকে কালক্রমে বিচক্ষণতার জোরে উজির হয়ে ওঠেন ইস্পাহানের মীর জুমলা। কিন্তু উজিরের দায়িত্ব ছিল অন্যান্য কাজের চেয়ে ভিন্ন। মীর জুমলাকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ সভাসদ এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের খুশি রাখার জন্য উপঢৌকন এবং প্রশাসনিক সুবিধা প্রদান করতে হতো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি সুলতানের জননীকে উপহার হিসেবে ‘হায়াত মহল’ নামে একটি ভবন নির্মাণ করে দেন। অন্দরমহলে জননীর বিশ্রামের জন্য ১২ মণ সোনা দিয়ে বিছানা নির্মাণ করে দেন। তার এসব কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে সুলতান এবং সভাসদদের সন্তুষ্ট করেছিল। তাই সুলতান মীর জুমলার পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতেন না। তৎকালীন (১৬৩৯ সাল) ব্রিটিশ বণিকদের হিসাব নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, মীর জুমলাকে সুলতানের প্রধান সহচর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার সম্মতি ব্যতীত সুলতান কোনো হীরক খরিদ করতেন না বলে জানা গেছে।
উজির থাকা অবস্থায়ও মীর জুমলা তার হীরক ব্যবসা চালিয়ে যান। ততদিনে তিনি ‘ধনকুবের’ হিসেবে আবির্ভূত হন। পদমর্যাদাবলে তিনি হীরক ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, মীর জুমলার কোষাগারে সঞ্চিত হীরার ওজন ছিল প্রায় ২০ মণ! মীর জুমলার অধীনে ১০টি জাহাজ ছিল। ইংরেজ এবং ডাচ নাবিক দ্বারা পরিচালিত এই জাহাজ দিয়ে বার্মা, আচেহ, মালদ্বীপ, পারস্য এবং আরব সাম্রাজ্যে বাণিজ্য করতেন তিনি। ভারতের বিখ্যাত কেলিকো সুতা এসব দেশে প্রায় ৫০% মুনাফায় রপ্তানি করে মূল্যবান চুনি, মুক্তা, মশলা এবং চাল সংগ্রহ করতেন মীর জুমলা।২
দক্ষিণ ভারত আক্রমণ
সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। সুলতানের সেনাবাহিনীর তুলনায় এসব রাজ্য শক্তিশালী ছিল না। উপরন্তু, তাদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে মীর জুমলা ১৬৪৬ সালে দক্ষিণ ভারত আক্রমণ করেন। মীর জুমলার নেতৃত্বে সুলতানী বাহিনী অনায়াসে এসব রাজ্য দখল করতে সক্ষম হয়। এরপর তিনি নেলোর, তিরুপতি দখল করে ফোর্ট সেন্ট জর্জ পর্যন্ত সুলতানী সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। মীর জুমলার এই বিজয় অভিযানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল দুর্ভেদ্য গান্দিকোটা দুর্গ দখল করা।
পেনা নদীর তীরের গান্দিকোটা দুর্গ তখন সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। দুর্গের ফটক পর্যন্ত যেতে হলে পাড়ি দিতে হত মাত্র ৭ ফুট চওড়া সরু পথ। মীর জুমলা এই সরু পথ দিয়ে ভারী কামান এবং অন্যান্য গোলাবারুদ বহন করে দুর্গের ফটক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। প্রথমেই ভারী গোলাবর্ষণের মাধ্যমে দুর্গের ফটক উড়িয়ে দেন তিনি। তার মুহুর্মূহু গোলা বর্ষণের মুখে অসহায় আত্মসমর্পণ করে গান্দিকোটা বাহিনী। এভাবে দক্ষিণ ভারতের বুকে মীর জুমলার কর্তৃত্ব শুরু হয়।
সুলতান বনাম মীর জুমলা
সুলতানের এককালের বিশ্বস্ত উজির মীর জুমলা এখন দিগ্বিজয়ী সেনাপতি। দক্ষিণ ভারত দখলের পর মীর জুমলার প্রতিপত্তি এবং সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অঢেল বিত্তের অধিকারী হয়ে উঠেন। আর তাতেই সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন স্বয়ং সুলতান। একসময় গুজব উঠলো, সুলতান নন, বরং মীর জুমলাই এই সাম্রাজ্যের প্রধান কাণ্ডারী। সুলতান মীর জুমলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে তার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওদিকে সুলতানের এমন আচরণে মীর জুমলা মনঃক্ষুণ্ণ হন। একসময় মীর জুমলা ব্যবসা গুটিয়ে মাতৃভূমি ফেরত যাওয়ার কথাও ভাবছিলেন। কিন্তু তখন দৃশ্যপটে হাজির তখন তৎকালীন দাক্ষিণাত্যের সুবেদার মোঘল শাহজাদা আওরঙ্গজেব। মীর জুমলার গান্দিকোটা দখলের গল্প শুনে তিনিও তার গুণমুগ্ধ ছিলেন। সুলতানের সাথে রেষারেষির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে মোঘল সাম্রাজ্যের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দেন।৩
মীর জুমলা হয়তো এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু তখন সুলতান আব্দুল্লাহ কুতুব শাহ তার স্ত্রী এবং সন্তানদের গোলকুণ্ডা দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন। সুলতানের এমন আচরণের পর তিনি আর পেছনে তাকাননি। মীর জুমলা পক্ষ বদলে আওরঙ্গজেবের দলে যোগ দেন। আওরঙ্গজেব বিশেষ ক্ষমতাবলে তার পরিবারের মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। মূলত, এখান থেকে শুরু হয় মীর জুমলার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
দিল্লিতে মীর জুমলা এবং কোহিনুর বিতর্ক
মীর জুমলার এই ঘটনা দিল্লির মসনদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সম্রাট শাহজাহান মীর জুমলার প্রতি আগ্রহী হয়ে তাকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান। ১৬৫৬ সালে দিল্লিতে রাজকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে মীর জুমলার। রাজকীয় বললেও হয়তো কম হয়ে যাবে। কারণ বিখ্যাত পরিব্রাজক নিকোলো মানুচ্চির দিনলিপি থেকে জানা যায়, মীর জুমলাকে গ্রহণ করতে দিল্লির গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ঢল নেমেছিল। অন্যান্য সুবেদারগণ তাকে অভিবাদন জানিয়ে সম্রাটের মঞ্জিল পর্যন্ত এগিয়ে দেন। সেই সময়ে সম্রাটের সাক্ষাতের পূর্বে নিয়ম অনুযায়ী দামি উপঢৌকন প্রদান করতে হতো।
প্রথানুযায়ী মীর জুমলা সম্রাট শাহজাহানকে গোলকুণ্ডা থেকে সংগৃহীত কয়েক ধরনের হীরকখণ্ড উপহার দেন। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, এই উপঢৌকনের অংশ হিসেবে কোহিনুর হীরাও অন্তর্ভূক্ত ছিল। তবে এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি। বিশেষ করে, আওরঙ্গজেবের হীরক ভাণ্ডার প্রদর্শনের সুযোগ লাভ করা ফরাসি পরিব্রাজক জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ট তাভেঁনিয়েঁর মতে, মীর জুমলা কর্তৃক শাহজাহানকে উপহার দেওয়া হীরকখণ্ডটি কোহিনুর নয়, বরং ‘ওরলভ’ নামক অন্য একটি হীরা। এই হীরা পরবর্তীতে রাশিয়ান জারিনা ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটের অন্তর্গত হয়েছিল। হীরাটি বর্তমানে ক্রেমলিনে সংরক্ষিত রয়েছে।
সম্রাট শাহজাহান মীর জুমলাকে মুয়াজ্জম খান উপাধি দেন এবং মোঘল সাম্রাজ্যের উজির হিসেবে নিযুক্ত করেন। উজির থাকাকালীন সময়ে তিনি আওরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। এর ফলে অন্যান্য শাহজাদাদের সাথে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। দারাশিকো, শাহ সুজাসহ বাকিরা তাকে অপছন্দ করতেন। মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের প্রতি অনুগত ছিলেন। পরবর্তীতে শাহজাহানের অসুস্থতার সময়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলাকালে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে তার ভাই শাহ সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রেরণ করেন। ১৬৫৯ সালে খাজোয়ার যুদ্ধে মীর জুমলার হাতে পরাজিত হন শাহ সুজা। তিনি শাহ সুজাকে ঢাকা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। ঢাকায় মীর জুমলা বাহিনী থেকে বিতাড়িত হয়ে শাহ সুজা আরাকান রাজ্যে আশ্রয় নেয়। মীর জুমলার সফল অভিযানের পর নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেন।৪
মীর জুমলার সুবেদারগিরি
১৬৬০ সালে ৬৯ বছর বয়সে বাংলার সুবেদার হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন মীর জুমলা। মোঘল সাম্রাজ্য তখন ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। বিশেষ করে বাংলার অবস্থা ছিল করুণ। মীর জুমলা প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। তিনি রাজমহলের পরিবর্তে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ঢাকাসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্গ, সেতু এবং রাস্তা নির্মাণ করা শুরু করেন। মীর জুমলার একটি দুর্গ ছিল বর্তমান ময়মনসিংহ রোডের পাশে টঙ্গী জামালপুরে। এই দুর্গের সাহায্যে তিনি উত্তরাঞ্চলের সাথে ঢাকার যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধান করতেন। নারায়ণগঞ্জ জেলায় তার অন্য দুটি দূর্গ রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের পাগলায় তিনি একটি সেতু (পাগলা পুল) নির্মাণ করেন যার ধ্বংসাবশেষ হিসেবে একটি মিনার এখনও বিদ্যমান রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর কেল্লা এবং নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় অবস্থিত সোনাকান্দা কেল্লা মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। নদীপথে মগ জলদস্যুসহ অন্যান্য শত্রুর আক্রমণ থেকে বাংলাকে নিরাপদ রাখতে এসব দুর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
১৬৬৩ সালে মীর জুমলা নির্মাণ করেন ঢাকা গেট। ঢাকার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এই ফটক ঢাকাবাসীকে মগ দস্যুর হাত থেকে রক্ষা করতো। অনেকের মতে, হাতির আক্রমণ থেকে শহরকে রক্ষা করতে এই ফটক নির্মিত হয়েছিল। বিভিন্ন যুদ্ধে মীর জুমলা কামান ব্যবহার করতেন। তার ব্যবহৃত কামানের মধ্যে বিবি মরিয়ম এবং কালে খাঁ জমজম ছিল সুবিখ্যাত। কালে খাঁ জমজম অযত্নে বুড়িগঙ্গা নদীর তলায় হারিয়ে গেলেও বিবি মরিয়ম কামানটি এখনও অক্ষত রয়েছে। মীর জুমলা কামান নামে সমধিক পরিচিত এই কামানটি এখন গুলিস্তানের ওসমানী উদ্যানে সংরক্ষিত রয়েছে। মীর জুমলার হাত ধরে বাংলার রাজধানী ঢাকা তার হৃত গৌরব ফিরে পেতে শুরু করে।
আসাম, কামরূপ এবং কোচবিহার অভিযান
মীর জুমলার অধীনে মোঘল সাম্রাজ্য আরও প্রসারিত হতে থাকে। তিনি বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এই প্রসারণ নিশ্চিত করেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আসাম (আহোম), কামরূপ এবং কোচবিহার অভিযান। তখন কামরূপের ক্ষমতায় ছিলেন আসামের রাজা জয়ধ্বজ সিংহ। অপরদিকে কোচবিহারের ক্ষমতায় ছিলেন রাজা প্রাণনারায়ণ। মীর জুমলার সেনা ও নৌবাহিনীর একাংশ কামরূপে প্রেরণ করে নিজে কোচবিহার আক্রমণ করেন। দেড় মাস যুদ্ধ করার পর রাজা প্রাণনারায়ণ পাহাড়ে পালিয়ে গেলে মীর জুমলা বিজয়ী হন। এরপর তিনি কামরূপ আক্রমণ করেন। রাজা জয়ধ্বজ মীর জুমলার উচ্চাভিলাষী চরিত্রের ব্যাপারে অবগত ছিলেন। তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে কামরূপ ত্যাগ করে আসাম (আহোম) ফিরে যান এবং প্রতিরক্ষা জোরদার করেন।
মীর জুমলা আসামের দিকে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। আসামের বৈরী আবহাওয়া এবং ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি গড়গাঁও পর্যন্ত দখল করতে সক্ষম হন। এরপর নেমে আসে বর্ষার ঢল। অতিবৃষ্টির কারণে আসামের রাস্তাঘাট ডুবে বন্যা সৃষ্টি হয়। মীর জুমলা বাহিনী একটি উঁচু ভূমিতে আটকা পড়ে যায়। তখন রাজা জয়ধ্বজের সৈন্যরা রাতের আঁধারে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মোঘলদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। এমনকি মোঘলদের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মাঝে সৈন্যরা নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে থাকে। খাদ্যাভাব এবং রোগের প্রকোপে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সৈনিক মারা গেলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পিছপা হন মীর জুমলা। বর্ষা শেষে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আসাম ত্যাগ করেন মীর জুমলা।৫
জীবনাবসান
ব্যর্থ আসাম অভিযান শেষে মীর জুমলা বাংলায় ফিরে আসার যাত্রা শুরু করেন। তবে আসামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার কারণে দুর্বল মীর জুমলার পক্ষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। নৌকাযোগে ফেরার পথে খিজিরপুর নামক অঞ্চলে ১৬৬৩ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন এই মহান সুবেদার। তাকে বর্তমান আসাম-মেঘালয় সীমান্তবর্তী ঠাকুরবাড়ি জেলার একটি টিলায় সমাধিস্থ করা হয়। এখনও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে মীর জুমলার কবর সংরক্ষিত রয়েছে।
মীর জুমলার জীবনীগ্রন্থের লেখক ইতিহাসবিদ জগদীশ সরকারের মতে, তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি অসি এবং মসি, দুটোই সমান যোগ্যতায় চালাতে পারতেন। তিনি ইরানে জন্ম নিলেও ভারতবর্ষকে নিজের আপন ভূমি হিসেবে গণ্য করতেন। বর্তমান বাংলা এবং দক্ষিণ ভারতের বহু স্থাপনার মাঝে তার গল্প ছড়িয়ে আছে। নারায়ণগঞ্জের দিগুবাবুর বাজার সংলগ্ন একটি সড়কের নাম রাখা হয়েছে মীর জুমলার নামে। মীর জুমলার প্রয়াণের শত বছর পেরিয়ে গেলেও, এসবের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন এককালের শক্তিমান সেনাপতি, চৌকস বণিক এবং বিচক্ষণ প্রশাসক মুহম্মদ সাঈদ ওরফে মীর জুমলা।