মির্চা এলিয়াদ, নাম শুনলেই বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের চোখে ‘লা ন্যুই বেঙ্গলি’ বইয়ের ফ্ল্যাপটা ভেসে উঠে। মনে পড়ে যায় মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতের কথা। কেউ অবশ্য আরেকটু এগিয়ে মির্চা আর মৈত্রেয়ীর সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে দু’চার খণ্ড চিন্তা উপস্থাপন করে। অথচ এতোসবের কোনটাই মির্চাকে সংজ্ঞায়িত করে না। বরং কখনো কখনো অবমূল্যায়ন করে। সত্যিকার পরিচয় অন্য কোথাও। ধর্মের ইতিহাস এবং দর্শনকে পাঠ করার নতুন তরিকা উন্মোচন করেছিলেন মির্চা এলিয়াদ। মানুষের ভেতরে ধর্মবোধের উৎস আবিষ্কারের নেশা সম্মোহনের মতো তাকে ঘিরে রেখেছে।
ম্যাকমিলান থেকে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অব রিলিজিয়ন’ সিরিজের প্রধান সম্পাদক মির্চা এলিয়াদ। শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ‘ধর্মের ইতিহাস’ বিভাগটা মূলত তারই সৃষ্টি। মির্চার সম্মানে এখনো রাখা হয়েছে চেয়ার। তার লেখা ও চিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু পণ্ডিত আধুনিক যামানায় ধর্ম নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছেন। সমালোচনা যে নেই তা না, তবে মির্চার জ্ঞান অন্বেষণ ছাপিয়ে গেছে অন্য সকল পরিচয়কে।
মির্চা এলিয়াদ
১৯০৭ সালে রোমানিয়ার বুখারেস্টে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন মির্চা। শৈশবে সাক্ষী হন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। জার্মান বাহিনী যখন বুখারেস্টে বোমা ফেলছে, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে তিনি এঁকেছেন নিজের ভবিষ্যত। পরবর্তী জীবনে বারবার সেই স্মৃতি জাবর কেটেছেন। মানুষের হিংস্রতায় বিরক্ত হয়ে আশ্রয় খুঁজেছেন প্রকৃতির কাছে। সেই আশ্রয়ের সূচনা গ্রামীণ মানুষের মাঝে চর্চিত লোককাহিনী এবং বিশ্বাস নিয়ে ঘাটাঘাটির মধ্য দিয়ে। আস্তে আস্তে সকল ধর্মবিশ্বাস নিয়ে অনুসন্ধানের তৃষ্ণা জন্ম নেয়। অবচেতনেই ঘুরে যেতে থাকে জীবনের বাঁক। বাবা ভয় পেতেন, এলিয়াদ হয়তো তার চোখটাই খুইয়ে ফেলবে। কিন্তু নাছোড়বান্দা পুত্র পড়াশোনায় কমতি রাখতে নারাজ। বালজাক থেকে ফ্রেজার অব্দি বাঘা বাঘা পণ্ডিতের লেখা গিলতে থাকলেন গোগ্রাসে। শিখলেন ফারসি এবং হিব্রুর মতো ভাষাগুলো। আয়ত্ব করলেন শেখ সাদি থেকে প্রাচীন মেসোপটেমিয় গিলগামেশ। দর্শনটা তাহলে বাদ থাকবে কেনো? মনোনিবেশ করলেন সেখানেও। ১৯২১ সালে অর্থাৎ মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রকাশ করলেন প্রথম লেখা ‘দ্য সিল্কওয়ার্ম’স এনিমি’।
ইউনিভার্সিটি অব বুখারেস্ট থেকে দর্শনের পাঠ চুকিয়ে প্রবেশ করেন পণ্ডিত নায়ে ইয়োনেস্কোর জগতে। বিশেষ করে তার ধর্মচিন্তা এলিয়াদকে প্রভাবিত করেছে পরবর্তী জীবনে। কয়েক বছরের শিষ্যত্ব সমাপ্ত হলো একটা ঘটনায়। এখন যেমন ভারতের ছাত্ররা ইউরোপে পাড়ি জমায় পড়াশোনার জন্য। সেই যুগে কাশিমবাজারের মহারাজা ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ভারতে আহ্বান ও বৃত্তি ঘোষণা করতেন। ১৯২৮ সালে সেই বৃত্তিতে হাত দিয়েই কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এলিয়াদ।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অধীনে সংস্কৃত এবং ভারতীয় দর্শনের পাঠ নেবার জন্য আসেন। অবশ্য এর আগেই মিসর ভ্রমণ করে সেখানকার ধর্ম ও ভাষা সম্পর্কে ধারণা নিয়েছিলেন। এই সুরেন্দ্রনাথই মৈত্রেয়ী দেবীর পিতা। ভারতীয় দর্শনের উপর তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা নেহায়েত কম না। তার লেখা পাঁচ খণ্ডের ‘আ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ফিলোসোফি’ এখনো ভারতীয় দর্শনচর্চার উল্লেখযোগ্য কীর্তি বলে পরিগণিত। এলিয়াদ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং আশ্রমগুলোতে ঘুরাঘুরি করেন। দর্শনের মৌলিক বিষয়াদির সাথে রপ্ত করেন পালি, বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষা।
১৯৩০ সালের দিকে দাশগুপ্তের সাথে অবস্থান করার সময়েই প্রেমে পড়েন মৈত্রেয়ী দেবীর। ঘটনা উভয়েই নিজ নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি সমেত। পাঠকদের কাছে যা খুব পরিচিত। এই সময়েই ভারতীয় দার্শনিক আনন্দ কুমারস্বামীর সাথে যোগাযোগ ঘটে। বিনিময় হয় নানা চিন্তার। নিজ ভূমে যখন ফিরে গেলেন, তখন ইউরোপ নতুন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবরুদ্ধ সময়ে বিভিন্ন ঘরানার লেখকদের সাথে উঠাবসা হয়। এলিয়াদ নিজেও উঁচু মানের সাহিত্যিক। অবশ্য যুদ্ধ পরবর্তী কমিউনিস্ট শাসনে ডানপন্থী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতার দায়ে নির্বাসনে দেয়া হয় তাকে।
এলিয়াদ তখন রেনে গ্যেনন, হেনরি করবিন এবং কার্ল গুস্তাভ ইয়াঙের মতো বিখ্যাত পণ্ডিতদের চিন্তার স্পর্শে। ১৯৫৬ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থিতু হলেন। জোয়াকিম ওয়াচের আমন্ত্রণে বক্তব্য দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতোমধ্যে ধর্মের ইতিহাস ও দর্শনে তার জ্ঞান চাউর হয়ে গেছে। ওয়াচের আকস্মিক মৃত্যুতে সেই দায়িত্বে নিয়োগ পান মির্চা। পান দীর্ঘদিন ধরে জমিয়ে রাখা গবেষণা প্রকাশ করার সুযোগ। ভ্রমণ করেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ১৯৮৬ সালের মৃত্যু অব্দি তা জারি ছিল। তার মৃত্যুকে শিষ্যরা গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের সাথে তুলনা করে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২০০ মানুষের উপস্থিতিতে হয় শেষকৃত্য। বক্তৃতা দেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সল বেলো।
প্যাটার্ন
‘দ্য স্যাক্রেড এন্ড দ্য প্রোফেন’ মির্চা এলিয়াদের প্রধান সৃষ্টিকর্মের একটি। রুডলফ অটোর লেখা ‘দ্য আইডিয়া অব হোলি’ প্রকাশের পরে এই ঘরানায় সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী। মির্চার মতে, স্যাক্রেড বা পবিত্রতা হলো বস্তুজগতকে ছাপিয়ে উঠা উপলব্ধি, যা পরম সত্য, সৃষ্টিকর্তা কিংবা নির্বাণ হিসাবে হাজির হয়। ইহুদি বিশ্বাসে খোদা প্রতিশোধপরায়ণ, খ্রিষ্টিয় অতীন্দ্রিয়বাদীদের কাছে খোদা একই সাথে প্রেমময় এবং রাগী। অন্যদিকে ভারত এবং চীনে ব্যক্তিসত্তাকে নির্দিষ্ট মাত্রায় উত্তোলন নির্বাণ নামে পরিচিত। সবই মূলত স্যাক্রেডকেই নির্দেশ করে। এই বিমূর্ত স্যাক্রেড যেখানে মূর্ত হয়ে উঠে, তাকেই বলা হয় হায়ারোফ্যানি।
এখানে বোধ হয় থিয়োফ্যানি এবং হায়ারোফ্যানি শব্দদ্বয়ের পার্থক্য বলে নেয়া জরুরি। থিয়োফ্যানি হলো কোনো দেবতা কিংবা উপাস্যের প্রকাশ। ওল্ড টেস্টামেন্টে খোদা মেঘ, মানুষ, আগুন কিংবা প্রশান্ত বাতাসের রূপে হাজির হয়েছেন। অন্যান্য ধর্ম এবং উপকথাতেও স্রষ্টা কিংবা দেবতাদের প্রকাশ সংক্রান্ত বয়ান হাজির আছে, যা আসলে থিয়োফ্যানি। বিপরীতভাবে হায়ারোফ্যানি যেকোনো ধরনের স্যাক্রেড বা পবিত্রতাকে প্রকাশ করে বলে তার পরিসর আরো বিস্তৃত।
সেক্যুলার চোখে পৃথিবীর সমগ্র স্থান কিংবা ইতিহাসের সমগ্র সময়কে একরকম মনে হতে পারে। কিন্তু মানুষ স্বভাবগত ভাবেই ধর্মবোধকে লালন করে। সেই অর্থে হোমো স্যাপিয়েন্সকে হোমো রিলিজিয়োসাস বলা যায় অনায়াসে। সেই ধার্মিক চোখে বিশেষ কোনো স্থান কিংবা বিশেষ কোনো সময় স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাপিয়ে পবিত্র রূপে হাজির হয়। জন্ম নেয় পৃথিবীর কেন্দ্রধারণা এবং উপাসনাগার। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে উদযাপিত হয় বিশেষ কোনো দিন। মানুষ কোরবানি করার মধ্য দিয়ে বস্তুত নিজেকে রূপকভাবে ইবরাহিমের ত্যাগের মুহূর্তকেই হাজির করতে চায়।
ধর্মের দর্শন
মির্চা এলিয়াদ বিভিন্ন ধর্ম এবং মিথের মধ্যে আশ্চর্যজনক সূত্র লক্ষ করেছেন। প্রতিটা সমাজে গড়ে উঠা সৃষ্টিতত্ত্ব, সূর্যদেবতার উপাসনা, চন্দ্রদেবীর ঐতিহ্য এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ব্যাখ্যায় অদ্ভুত মিল। মেসোপটেমিয় সভ্যতার নিদর্শন গিলগামেশে বর্ণিত মহাপ্লাবনের ধারণার সাথে ইসলাম বর্ণিত নুহের মহাপ্লাবন এবং হিন্দুধর্মে বিবৃত মনুর সময়কালে সংঘটিত মহাপ্লাবনে খুব একটা ফারাক নেই। সূর্য সকল শক্তির উৎস, প্রতিটি জীবনই সূর্যের উপর নির্ভরশীল। অপরদিকে চাঁদের জন্ম-মৃত্যুর অনন্ত চক্র যেন মানবজীবনেরই অনন্ত উত্থান-পতনের খেলাকে প্রতিকায়িত করে।
মহাপ্লাবনের ঘটনাটা মূলত ধার্মিক চোখে সম্পূর্ণ নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা। বিশৃঙ্খলাকে ধুয়ে সরিয়ে দিয়ে শুদ্ধতার নয়া আবাদ। একই কারণে পানি গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধর্মে পানি দিয়ে শরীর বা কোন বিশেষ অঙ্গ ধুয়ে ফেলার রীতি পালিত হয়। জন্মের পর হোক কিংবা মৃত্যুর পর। বিজ্ঞানের বয়ানে গোসলের মাধ্যমে মানুষ আগের চেয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠে। কিন্তু ধর্মের চোখে এই পরিচ্ছন্নতার বড় অংশ আত্মিক। গোসলের মানুষকে দ্বিতীয়বার জন্ম দেয়। অতীতের পাপ ধুয়ে নিয়ে দেয় নতুন জীবনের সুযোগ। ‘পানির অপর নাম জীবন’ -কথাটা কেবল জৈবিক ভাবে না, আধ্যাত্মিক ভাবেও সত্য। ঠিক একইভাবে নববর্ষ উদযাপন নিছক একটা দিনকে উদযাপন না। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে ফিরে যাবার তাড়না।
জীবনের জন্ম পৃথিবীতে। ফলে ধার্মিকের চোখে পৃথিবী জীবনদাত্রী মাতা। অনেক সংস্কৃতিতে পৃথিবীকে দেবী হিসাবে উপসনা করার সিলসিলা উদ্ভূত হবার মূলসুর এখানে। আবার কোনো একটা পাথর, কোনো একটা গাছ কিংবা প্রাকৃতিক কিছু মানুষের কাছে পবিত্রতা ও অপার্থিবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। চৌম্বক বলরেখার মতো সেই পবিত্র স্থানকে ঘিরে গঠিত হয়েছে সমাজ। মানুষ যখন উপসনাগারে যায়, তখন সে মূলত স্বর্গের সিঁড়িতে পা রাখে। দুনিয়াতে অবস্থিত হয়েও প্রতিটি উপাসনাগার তাই আসলে অপার্থিব জগতের দুয়ার।
বৈপরীত্য
ধর্মের একটা বৈশিষ্ট্য খেয়াল করেছেন মির্চা এলিয়াদ। ধার্মিকের মনস্তত্ত্ব গঠিত জন্ম-মৃত্যু, ঠাণ্ডা-গরম, রাত্রি-দিন প্রভৃতি দ্বৈততা নিয়ে। অবশ্য আপাত চোখে দ্বৈততা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য বিদ্যমান। যেমন, ইহুদি বিশ্বাসের খোদা একইসাথে প্রচণ্ড রাগী এবং দয়ালু। ভারতীয় এবং চীনা বিশ্বাসে এই প্রবণতা প্রবল। মির্চা এই বিশেষত্বকে আখ্যা দিয়েছেন ‘কোয়েনসিডেনশিয়া অপজিটরাম’। যেখানে একটা আরেকটাকে সংজ্ঞায়িত করে। এজন্যই ধার্মিকের চিন্তা চক্রাকার। সেক্যুলার চোখে জীবনকে সরলরৈখিক মনে হতে পারে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেখানে সমাপ্তি টানা হয় সকল কিছুর। কিন্তু ধার্মিকের কাছে মৃত্যুর মানে নতুন জীবনের সূচনা, যেভাবে পার্থিব জীবনের সূচনা কোন এক স্বর্গীয় জীবনের সমাপ্তি টেনে।
সেক্যুলার ইতিহাসও সরলরৈখিক। সময়ের অন্তহীন ধাবমানতায় মানুষ কেবল অসহায় পুতুল মাত্র। যেন কিছু করার নেই, নেই তার থেকে মুক্তি। অথচ ধার্মিক সময়ের সাথে দুইটা মাত্রা যোগ করেছে। প্রথমত, সময়কে চক্রাকার হিসাবে উপস্থাপন করেছে, ফলে পৃথিবীর ইতিহাসের ভালো মন্দের ক্রমবিবর্তনে নিজেদের সক্রিয় করে তুলতে পারে। দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসবের তকমায় সময়ের মধ্যে পোর্টাল তৈরি করে ফিরে যেতে পারে সৃষ্টির আদি অবস্থায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ধার্মিক ব্যক্তি সেক্যুলার ব্যক্তির থেকে অনেক বেশি মুক্ত, আশাবাদী এবং সম্ভাবনাময়।
ঐতিহ্য
ধর্মের দর্শন অন্বেষণে মির্চার রচনাবলি নেহায়েত কম না। ‘স্যাক্রেড এন্ড প্রোফেন’ এবং ‘কসমস এন্ড হিস্ট্রি’ পরবর্তী পণ্ডিতদের জন্য নির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। তবে তার সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ কাজ বোধ হয় ‘শামানিজম: আর্কাইক টেকনিকস অব এক্সটেসি’ গ্রন্থে। এখানে তিনি শামানিজম সম্পর্কে মৌলিক কিছু তত্ত্বের প্রবর্তন করেছেন। এছাড়া যোগ, আলকেমি, প্রাচীন আধ্যাত্মিকতা নিয়ে প্রকাশ করেছেন গ্রন্থ এবং জার্নাল। শেষ জীবনে ‘আ হিস্ট্রি অব রিলিজিয়াস আইডিয়াজ’ নামে কয়েক খণ্ডে ধর্মের ইতিহাস লেখায় হাত দেন। বর্তমানে তিন খণ্ড অব্দি পাওয়া যায়। তার মিথ এন্ড রিয়েলিটি, ইমেজ এন্ড সিম্বল, দ্য কোয়েস্ট এবং প্যাটার্নস ইন কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন- প্রতিটি বইই দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে বোদ্ধামহলে। সাহিত্যেও মুন্সিয়ানা ছিলো যথেষ্ট। ‘দ্য ফরবিডেন ফরেস্ট’ উপন্যাসকে গণ্য করা হয় তার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসাবে।
বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা মির্চা এলিয়াদের গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন ‘ইয়ুথ উইদাউট ইয়ুথ’। লা নুই বেঙ্গলির গল্প অবলম্বন করে ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় দ্য বেঙ্গলি নাইট। রোমানিয়ার বিভিন্ন থিয়েটারেও তার গল্পকে নাট্যরূপ দান করে মঞ্চস্থ করা হয়েছে প্রায়শ। সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে সুরিয়ালিজম এবং ম্যাজিক রিয়েলিজমের ছাপ পাওয়া যায়।
সবিশেষ
২০০০ সালে সল বেলো তার শেষ উপন্যাস রাভেলস্টাইন প্রকাশ করেন। কেন্দ্রিয় চরিত্র এলান ব্লুম একজন ফিলোসোফার। সেখানে রাডু গ্রিলেসকো চরিত্রকে চিত্রিত করা হয়েছে লেখকের ঘনিষ্ট বন্ধু এবং সহকর্মী হিসেবে। সমালোচকদের ভাষ্য অনুসারে এই রাডু গ্রিলেসকো চরিত্রই মির্চা এলিয়াদ।
এন্টি-সেমিটিজমের অভিযোগ এনে মির্চা এলিয়াদকে সমালোচনা করা হয়। কিন্তু তার পাণ্ডিত্য তাতে ফিকে হয় না। বরং ধার্মিক বনাম সেক্যুলার দ্বন্দ্বের বাইরে দাঁড়িয়ে ধর্মকে পাঠ করার তরিকা পরবর্তী প্রজন্মকে ধর্ম বুঝতে আগ্রহী করে তুলেছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে আবিষ্কার করার মতো এক স্বতন্ত্র জগৎ। ভবিষ্যতে যে কেউ ধর্মের ইতিহাস এবং দর্শন নিয়ে পাঠ করতে চাইলে মুখোমুখি হবে মির্চা এলিয়াদের। এক ধর্মকে হারিয়ে আরেক ধর্মকে জিতিয়ে নেয়ার পাঠ না। খুব কাছে থেকে উপলব্ধির পাঠ। যে উপলব্ধি নিয়ে বেঁচে থাকে ওই ধর্মকে আঁকড়ে থাকা প্রবল বিশ্বাসী মানুষটা।