জীবনানন্দ হয়ে সংসারে আজো আমি
সব কিছু ভুলে যেন করি লেনদেন
তুমিও তো বেশ আছো, ভালোই আছো
কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেনটানা টানা চোখে কালি পড়েনি কোনো
হাসলেও গালে টোল পড়ে এখনো
কি জাদু জানো তা বিধাতা জানেন
কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেনপরিপাটি বেশবাস তেমনি আছে
ঘটনার কোনো রেশ নেই তো কাছে
এভাবে সবাই কি থাকতে পারেন
কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেন
কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় শুদ্ধতম কবি। তাঁর বনলতা সেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যেরই এক অনন্য সম্পদ। সেই বনলতা সেনকে নিয়ে এমন কাব্যিক গীতিকবিতার সাথে ধ্রুপদী সুর মিলে ওপরের গানটি তৈরি হয়েছে। বাংলা গানের রুচিশীল শ্রোতামাত্রই গানটির সাথে পরিচিত। কিন্তু অনেকে শ্রোতাই জানেন না গানটি কার গাওয়া। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বলতে যে দেশে একজন কিংবদন্তি শিল্পী আছেন সেটা পর্যন্ত জানেন না অনেকেই!
সংগীতের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর মধ্যে গাওয়া কিংবা শোনার জন্য অন্যতম জটিল, বিশুদ্ধ ও শ্রতিমধুর একটি শাখা হলো উচ্চাঙ্গ সংগীত। এদেশে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শ্রোতা যেমন সীমিত, তেমনি শিল্পীর সংখ্যাও হাতেগোনা। যারা নিরন্তর সাধনার মধ্য দিয়ে বাংলা ধ্রুপদী সংগীতকে নিয়ে গেছেন উচ্চতার শিখরে, তাদের মধ্যে অন্যতম এক সুরের জাদুকর নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী। ধ্রুপদী ও বিশুদ্ধ সংগীতের গুরু হওয়ায় তাকে সবাই ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী হিসেবেই সম্বোধন করে থাকে।
প্রারম্ভিক জীবনে শুরুটা করেছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ আয়াত উল্লাহ খানের কাছে। নিরন্তর সাধনা করে যখন মোটামুটি গানটাকে আয়ত্বে নিয়ে আসেন, তখন মরহুম আয়াত উল্লাহ খান তার প্রিয় শিষ্যকে তুলে দেন পাক-ভারত উপমহাদেশের পাটিয়ালা ঘরানার দুই দিকপাল ওস্তাদ আমানত আলী খান ও ওস্তাদ ফতেহ আলী খান ভ্রাতৃদ্বয়ের হাতে। তাদের কাছে থেকে ধ্রুপদী ও উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতিটি শাখায় নিজের দক্ষতাকে বৃদ্ধি করে অনেকদূর নিয়ে যান তিনি; হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের অন্যতম সংগীত-সাধক।
৮০ ও ৯০ দশক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ ছিলো। তখন অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ছিলো রমরমা। কত শত শিল্পী তখন রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন, নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু সেই সময়টাতেও স্রোতে গা না ভাসিয়ে যেসব শিল্পী দিনের পর দিন সাধনা করে গেছেন, শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করে গেছেন, সৃষ্টি করে গেছেন কালজয়ী সব গান, তাদেরই একজন ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী।
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৫২ সালের ২৫শে অক্টোবর। যদিও সার্টিফিকেটে ১৩ই জানুয়ারি হওয়ায় সবাই সেই তারিখটাকেই ফলো করে থাকেন, মিডিয়াগুলো সেই তারিখ অনুযায়ীই তাঁকে নিয়ে কাজ করে। তাঁর গ্রামের বাড়ি ও জন্মস্থান নরসিংদীর শিবপুর থানার খৈনকুট গ্রামে। পরিবারের সবার সাথে শৈশবের কিছুটা সময় সেখানে কাটলেও মূলত ঢাকাতেই তিনি বড় হয়েছেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকার বকশি বাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষে পুরোপুরি গানের প্রতি ঝুঁকে পড়লেও মাঝখানে কিছুদিন লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন) শিক্ষকতাও করেন।
পারিবারিক জীবনে ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী দুই সন্তানের জনক। ছেলে ফাইয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী ও মেয়ে মেহনাজ চৌধুরী বারখা। পেশাদার শিল্পী না হলেও ছেলে-মেয়ে দুজনেই দারুণ গান করেন, বাবার মতোই শুদ্ধ সংগীতকে লালন করেন। ছেলে ফাইয়াজ বাবার সাথে কয়েকটি টিভি অনুষ্ঠানে মিউজিশিয়ান হিসেবে বাজিয়েছেন বিভিন্ন সময়। মেয়ে অবশ্য দেশের বাইরে থাকেন। তাঁর স্ত্রী সাবরা নিয়াজও সংগীত পরিবারের সন্তান। শ্বশুর সৈয়দ জাকির হোসেনও ছিলেন উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান সুরস্রষ্টা ও উচ্চাঙ্গ সংগীতের গুরু।
নিভৃতচারী সুরসাধক নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী প্রথম টেলিভিশনে আসেন ১৯৮৫ সালে, বিটিভিতে ‘আমার যত গান’ নামক অনুষ্ঠানে। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন এর উপস্থাপক। যদিও এর আগেই তিনি বিদেশে গাইতে শুরু করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রথমবার মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে গাইতে যান। এরপর একে একে বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজের কণ্ঠ আর সুরের মূর্ছনায় শ্রোতাদের সামনে দেশের, বাংলা গানের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন। ক্রমশ দেশ-বিদেশের শ্রোতাদের মুগ্ধ করে উপমহাদেশের অন্যতম ধ্রুপদী শিল্পীতে পরিণত হন তিনি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় ও রাগ সংগীতের ওপর দুর্দান্ত দখল থাকা এই সাধক শিল্পী ঠুমরি, খেয়াল, গজলসহ সকল ঘরানাতেই নিজেকে মেলে ধরেছেন দারুণভাবে।
শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী গেয়েছেন আধুনিক বাংলা গানও। ভিন্ন স্বাদের দারুণ সব কথা ও সুরে বের হওয়া ‘জীবনানন্দ’, ‘আধুনিক বাংলা গান-১’, ‘স্বপনে’ ও ‘ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী’ অ্যালবামগুলো সেটারই সাক্ষী দেয়। এসব অ্যালবামের বেশ কিছু গান হয় শ্রোতাপ্রিয়ও।
ভালো গানের শ্রোতা হয়তো কম, কিন্তু যারা ভালো গান শোনেন তাদের প্লে-লিস্টে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী অবশ্যই থাকেন। মানসম্মত শ্রোতাদের মাঝে খুব কমই আছেন যারা বৃষ্টি-বাদলের দিনে তাঁর গাওয়া এই গানটি শোনেন না-
আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়লো তোমার
অশ্রুভরা দুটি চোখ
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ।বেদনাকে সাথী করে
পাখা মেলে দিয়েছ তুমি
কত দূরে যাবে বল
তোমার পথের সাথী হব আমি।একাকিনী আছ বসে
পথ ভুলে গিয়েছ তুমি
কোন দূরে যাবে বল
তোমার চলার সাথী হব আমি।
বৃষ্টির গান আছে অসংখ্য। কিন্তু এই গানের মতো মনের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্যোতনা সৃষ্টি করার মতো গান আছে ক’টা? অথবা হাজার হাজার প্রেমের গানের ভিড়ে নিচের গানটির মতো ক’টা গানই বা প্রেমকে ব্যাখ্যা করতে পারে?
প্রেম যেন এক প্রজাপতি চোখে এসে বসে
স্মৃতি হয়ে থাকে তোলা মনেরই আরশেকেউ তারে পেয়ে যায় কেউ চেয়ে পায় না
না পাওয়ার যন্ত্রনা কোনোদিন যায় না
তবু প্রেম প্রেমিকের নয় আর কারো সে।কেউ বলে প্রেম সেতো হৃদয়ের আয়না
একবার ভেঙে গেলে সেই দাগ যায় না
চিরদিন থেকে যায় বিরহের পরশে।
অ্যালবাম, আধুনিক গানের পাশাপাশি প্লেব্যাকও করেছেন কয়েকটি ছবিতে। এর মধ্যে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন এহতেশাম পরিচালিত ‘গীত কাহি সংগীত কাহি’ ছবিতে। এরপর ‘নতুন বউ’, ‘দিওয়ানা’, ‘দেনা পাওনা’, ‘চকোরী’ ও ‘মিস সুন্দরী বাংলাদেশ’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। এসব ছবির পরও আরও অনেক ছবিতে প্লেব্যাকের অফার এসেছিলো তার কাছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আর প্লেব্যাক করতে চাননি তিনি!
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী সবসময় আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন, নীরবে-নিভৃতে সুর-সাধনায় মগ্ন থাকেন। খ্যাতির লোভ কিংবা প্রচারের আলো তাকে কখনোই টানেনি। একজন জীবন্ত কিংবদন্তি হওয়া সত্ত্বেও এখনও টিভি চ্যানেলগুলোতে তাকে কালেভদ্রেই পাওয়া যায়। অথচ চাইলেই পারতেন নিজেকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যেতে। কিন্তু যারা সাধক, তারা খ্যাতির কাঙাল নন কখনোই। তিনি নিজেই বলেছেন ‘আমি কখনোই প্রচারণায় যাইনি। কারণ আমার মনে হয়েছে আমার নিজের আসল জায়গা হচ্ছে সাধনা। এখানে ঠিক থাকলেই হয়তো সবই ঠিক থাকবে।’
বাংলাদেশ, বাংলা গানের সৌভাগ্য যে আমাদেরও একজন নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী আছেন। এত বড়মাপের সুরের জাদুকর হয়েও যার মধ্যে নেই সামান্যতম অহংকার। আরও অনেক বছর বেঁচে থেকে এই মহান সুরসাধক আমাদের সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন করে রাখবেন এটাই সবসময় কামনা করি।