Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রবীর সেন: কুমিল্লার যে ছেলেটি ভারতীয় দলে খেলা প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার

তার নাম অন্তত দুই দফা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। বাবা মায়ের রাখা নাম তো ছিল প্রবীর সেন, কিন্তু শারীরিক অবয়ব ছোটখাট হওয়ায় (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা) সবাই তাকে খোকন বলে ডাকতো। বাংলা ভাষাভাষীরা তো জানেনই, বাচ্চাদের জন্য একটি আদুরে ডাক খোকন। কিন্তু বিদেশীরা তো আর তা জানে না। তাই ক্রিকেট বিষয়ক বিভিন্ন ইংরেজি ডকুমেন্টে তারা খোকনটাকে ঈষৎ পাল্টে ‘খোখান’ করে নিয়েছে।

কিন্তু নামে কী-ই বা আসে যায়। মানুষের কাজটাই তো আসল। এবং সেক্ষেত্রে প্রবীর কিংবা খোকন দারুণ সফল। ব্যাট-বলের খেলায় হামেশা উইকেটের পিছনে দাঁড়াতেন। ভারতীয় জাতীয় দলে খেলতে গিয়েও এই ভূমিকাই পেয়েছিলেন। তার অভিষেকের আগে ভারত যে ১২টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলো, সেখানে উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়েছিলেন ছয়জন। অথচ এরপর তিনি একাই দলের এক নম্বর উইকেটকিপার হিসেবে খেলেছিলেন ১৪টি টেস্ট। এ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়, উইকেটকিপার হিসেবে তিনি ঠিক কতটা ধারাবাহিক ছিলেন। তাই তো তাকে বলা হয়ে থাকে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘প্রথম গ্রেট উইকেটকিপার’।

তবে প্রবীর সেনের পরিচিতি কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখাটা ঠিক হবে না। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার আছে। প্রথমত, তার জন্ম কিন্তু বাংলাদেশের কুমিল্লায়, এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে। তার বাবার নাম অমিয় সেন, আর মা বাসন্তী সেন। ভারতীয় জাতীয় দলে খেলা প্রথম বাঙালি ক্রিকেটারও তিনিই। আর সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে স্টাম্পিং করারও গৌরব রয়েছে এই বঙ্গসন্তানের! 

প্রবীর সেন; Image Source: Wikipedia

প্রবীর যখন ভারতের জাতীয় দলে ঢোকেন, উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তখন কঠিন প্রতিযোগিতা চলছে মাধব মন্ত্রী ও নানা যোশির মধ্যে। এছাড়া ইব্রাহিম মাকা ও বিজয় রাজিন্দরনাথও মাঝেসাঝে এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। কিন্তু চারিদিকে এত এত বিকল্প থাকতেও আপাতদৃষ্টিতে অপরিণত মনে হওয়া প্রবীরই বনে যান উইকেটকিপার হিসেবে দলের প্রথম পছন্দ।

১৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২০টি ক্যাচ ধরার পাশাপাশি, ১১টি স্টাম্পিংও করেছিলেন প্রবীর। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০৮টি ক্যাচের বিপরীতে তার দখলে ছিল ৩৬টি স্টাম্পিংয়ের রেকর্ড। ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতেও তিনি মোটামুটি ভালোই করতেন। তিনটি সেঞ্চুরিসহ ২৩.২৪ গড়ে ২,৫৮০ রান করেছিলেন তিনি। কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে একদমই সুবিধা করতে পারেননি, এখানে তার অর্জন মাত্র ১১.৭৮ গড়ে ১৬৫ রান।

শুরুর দিনগুলো

১৯২৬ সালের ৩১ মে বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন প্রবীর। মোট চার ভাইবোন ছিলেন তারা। বোনের নাম মনি, আর দুই ভাই সমীর ও রণবীর। রণবীর ছিলেন প্রবীরের চেয়ে পাক্কা ১৯ বছরের ছোট। পরবর্তী সময়ে তিনিও বাংলার হয়ে রনজি ট্রফিতে খেলেছিলেন।

পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন প্রবীর। কলকাতার লা মার্টিনেয়ার কলেজে পড়েছিলেন তিনি। এরপর গ্র্যাজুয়েশন করেন সিনিয়র ক্যামব্রিজ থেকে। তবে এসবের পাশাপাশিই ক্রিকেট খেলায় নিজের পারদর্শীতা দেখাতে শুরু করেছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্কুলের বৈতরণী পেরোনোর কিছুদিন পরই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় তার। রনজি ট্রফির একটি ম্যাচ ছিল সেটি। খেলেছিলেন বাংলার হয়ে, বিহারের বিপক্ষে। ইডেন গার্ডেনসে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে দুই ইনিংসে ১৩ ও ২ রান করেছিলেন। এছাড়া উইকেটকিপার হিসেবে ছিল তিনটি ডিসমিসাল।

তার পরের ম্যাচটিও ছিল ঘরের মাঠে। এবারের প্রতিপক্ষ ছিল হোলকার। ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে ওয়ান-ডাউনে ব্যাট করতে নামেন। এবং এবারই করে ফেলেন বাজিমাৎ। সিকে নায়ুডু, বিবি নিমবালকার, হীরালাল, মুশতাক আলিদের মতো বোলারদের বিপক্ষে ২২৫ মিনিট ক্রিজে টিকে থেকে ১৪২ রানের ঝলমলে এক ইনিংস খেলেন। পরবর্তীতে কমল ভট্টাচার্যের বোলিং তোপে দুই ইনিংসেই অল্প সংগ্রহে গুটিয়ে যায় হোলকারের ইনিংস। প্রবীরের দল ম্যাচটি জিতে নেয় ১০ উইকেটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারত যখন আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছে, ততদিনে প্রবীর ঘরোয়া ক্রিকেটে তিন বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। তারপরও ১৯৪৬ সালে ভারত যখন ইংল্যান্ড সফরে গেল, সেই দলে ছিলেন না তিনি। অবশ্য ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে তিনি ঠিকই ডাক পেয়ে যান।

টেস্ট অভিষেক

দলের সাথে প্রবীর অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার জাতীয় দলের টেস্ট ম্যাচ খেলার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। দলে রয়েছেন জেনি ইরানির মতো উইকেটকিপার। তাই প্রবীর ধরেই নিয়েছিলেন, ইরানিকে বিশ্রাম দিতে কয়েকটা ট্যুর ম্যাচে হয়তো তাকে মাঠে নামাবে টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু গ্যাবায় প্রথম ম্যাচে ভারতের শোচনীয় পরাজয়, এবং সিডনিতে দ্বিতীয় ম্যাচ ড্র করার পর, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তৃতীয় টেস্টে ইরানির বদলে স্কোয়াডে নিয়ে আসা হলো প্রবীরকেই।

তবে জাতীয় দলে অভিষেকের আগেই হইচই ফেলে দিয়েছিলেন প্রবীর। অ্যাডিলেড ওভালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ট্যুর ম্যাচে তিনি ভিনু মানকাড়ের বোলিংয়ে স্টাম্পিং করেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। আর তাতেই তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যমে। 

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়েছিলেন প্রবীরের হাতে; Image Source: Getty Images

পরবর্তীতে প্রবীর নিজেও দাবি করেছিলেন, এটিই ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন। “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উত্তেজনার মুহূর্তটি এসেছিল যখন আমি অ্যাডিলেডে ব্র্যাডম্যানকে স্টাম্পড করেছিলাম। কারণ তিনি যে আমার দেখা সর্বকালের সেরা।”

তবে মূল টেস্ট ম্যাচে প্রবীরের ঝুলিতে ছিল না তেমন কোনো অর্জন। প্রথম ইনিংসে ব্র্যাডম্যানের ১৩২ রানের সুবাদে ৩৯৪ রানের বড় সংগ্রহ পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ওই ইনিংসে রন হ্যামেন্সকে স্টাম্পড করেছিলেন প্রবীর। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি তালুবন্দি করেন সিড বারনেসের ক্যাচ। দুইবারই বোলার ছিলেন লালা অমরনাথ। তবে এই দুই ডিসমিসাল দলের জন্য তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেনি। দ্বিতীয় ইনিংসেও শতক হাঁকান ব্র্যাডম্যান, আর অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি জিতে নেয় ২৩৩ রানে।

পরের ম্যাচে, অ্যাডিলেড ওভালে ভারতের এক ব্যাটসম্যানও জোড়া শতক হাঁকিয়েছিলেন। তিনি বিজয় হাজারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইনিংস ব্যবধারে হার এড়াতে পারেনি ভারত। আর সেক্ষেত্রে কিছুটা দায় অবশ্যই প্রবীরেরও ছিল। তার উপর ভরসা করে তাকে তিন নম্বরে পাঠিয়েছিলো টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু বিনিময়ে তিনি গোল্ডেন ডাক মারেন।

সিরিজের শেষ ম্যাচটি ছিল আবার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। এখানেও ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচ হারে ভারত। এ ম্যাচে মানকাড়ের ব্যাট থেকে এসেছিল একটি সংগ্রামী শতক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত ম্যাচটি গো-হারা হারলে, পাঁচ ম্যাচ সিরিজের ফলাফল দাঁড়ায় ০-৪। তবে এই শেষ ম্যাচে প্রবীরের জন্য ব্যক্তিগত একটি গৌরবের জায়গা ঠিকই ছিল। অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ১২৮ ওভার (প্রতি ওভার ৮ বলে) ব্যাট করে ৮ উইকেটে ৫৭৫ রান করলেও, উইকেটের পেছনে প্রবীর ছেড়েছিলেন মাত্র ৪টি বাই রান।

ব্যাট হাতে পুরো সফরটাই যেন প্রবীরের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছিল। ছয় ইনিংসে ৫.৬০ গড়ে ৩৩ রান করেছিলেন তিনি। আর ট্যুর ম্যাচগুলো মিলিয়ে ৯ গড়ে ৮১ রান। অবশ্য উইকেটকিপার হিসেবে অস্ট্রেলীয় সমালোচকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন ঠিকই। ওই সফরে গিয়ে তিনি উইকেটকিপিংয়ের পরামর্শ নিয়েছিলেন ডন ট্যালনের কাছ থেকে। প্রবীরের ভাষ্যমতে, ডন ট্যালনের পরামর্শে নিজের স্ট্যান্স বদলেছিলেন তিনি, যা তার ৩০০ শতাংশ উন্নতি ঘটিয়েছিল। অন্যদিকে প্রবীরের উইকেটকিপিংয়ে বার্ট ওল্ডফিল্ড এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাকে নিজের একজোড়া গ্লাভস পর্যন্ত উপহার দিয়েছিলেন তিনি।

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও জেসি ব্র্যাডম্যানের সাথে প্রবীর; Image Source: Wikimedia Commons

রেকর্ডবুক ওলটপালট

যেমনটি আগেই বলেছি, ভারতীয় জাতীয় দলে প্রবীরের প্রতিযোগী ছিলেন বেশ ক’জন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো যার সাথে, তিনি মাধব মন্ত্রী – বোম্বের অধিনায়ক, উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ও উইকেটকিপার। ব্যাটিংয়ে মাধব প্রবীরের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও, প্রবীর জাতীয় দলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে রাখছিলেন উইকেটের পেছনে নিজের অদ্বিতীয় দক্ষতার জোরে। তবে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি গড়পড়তা সিরিজ কাটানোর পর, দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।

দলের বাইরে গিয়ে ব্যাট হাতেও যেন তেড়েফুঁড়ে ওঠেন প্রবীর। ১৯৫০-৫১ মৌসুমে বিহারের বিপক্ষে তিনি খেলেন ক্যারিয়ারসেরা ১৬৮ রানের ইনিংস। নবম উইকেটে জ্যোতিশ মিত্তারের সাথে গড়েন ২৩১ রানের জুটি, যা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১১তম সেরা নবম উইকেট জুটি, এবং বেঙ্গলের জন্য এখনো সেরা নবম উইকেট জুটি (প্রকৃতপক্ষে সপ্তম উইকেট থেকে যেকোনো উইকেটে সেরা)।

এরপর থেকে জাতীয় দলে আসা-যাওয়ার মাঝে থাকেন প্রবীর। ইডেন গার্ডেনসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ডাকা হয় তাকে, কিন্তু কানপুরের গ্রিন পার্কে পরের ম্যাচেই আবার বাদ পড়েন তিনি। চিপকে শেষ টেস্টে তিনি ফের দলে ডাক পান।

এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি স্টাম্পিং; Image Source: ESPN Cricinfo

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিজের সেরা ঝলক এই চিপক টেস্টেই দেখান প্রবীর। প্রথম ইনিংসে তিনি একে একে স্টাম্পড করেন টম গ্র্যাভেনে, ডোলান্ড কার, ম্যালকম হিল্টন ও ব্র্যায়ান স্ট্যাথামকে – এবং প্রতিটিই মানকড়ের বলে। এভাবে তিনি বনে যান এক ইনিংসে চারটি স্টাম্পিং করা ইতিহাসের দ্বিতীয় উইকেটকিপারে। অপর উইকেটকিপার ছিলেন ওল্ডফিল্ড। আর এক ইনিংসে পাঁচ স্টাম্পিং করা একমাত্র উইকেটকিপার কিরণ মোরে (১৯৯৮ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে)।

দ্বিতীয় ইনিংসেও মানকাড়ের বলে হিল্টনকে স্টাম্পড করেন প্রবীর, যার মাধ্যমে তিনি পরিণত এক টেস্টে পাঁচটি স্টাম্পিং করা প্রথম উইকেটকিপারে। পরবর্তীতে কিরণ মোরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক ম্যাচে ছয়টি স্টাম্পিং করেছিলেন। প্রবীর তার এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের সুবাদে ১৯৫২ সালে ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার জিতেছিলেন।

এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি স্টাম্পিং; Image Source: howSTAT!

সর্বনাশা ইংল্যান্ড সফর

১৯৫২ সালের ইংল্যান্ড সফরের জন্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রবীর। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টেও খেলেছিলেন তিনি, যে ম্যাচে ভারত একই দিনে ৫৮ ও ৮২ রানে অল-আউট হয়েছিল। হেডিংলি ও লর্ডসে প্রথম দুই টেস্টে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রবীর দ্য ওভালেও খেলেছিলেন। এই সফরজুড়েও গ্লাভস হাতে বিস্ময় ছড়িয়েছিলেন প্রবীর, কিন্তু ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছিলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। তবে একটি ব্যতিক্রম ছিল গ্ল্যামোরগানের বিপক্ষে ট্যুর ম্যাচটি, যেখানে ৭৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।

পাকিস্তান সিরিজ ও বিদায়

যোশির আগমনের পর থেকে ভারতীয় দলে উইকেটকিপারের জায়গাটি আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবুও নির্বাচকরা পাকিস্তানের বিপক্ষে কোটলায় প্রথম ম্যাচের জন্য আস্থা রাখেন প্রবীরের উপরেই। যথারীতি সেই ম্যাচেও উইকেটকিপার হিসেবে দারুণ করেছিলেন তিনি। তবে এই ম্যাচটি তার জন্য স্মরণীয় অন্য একটি কারণে। এই ম্যাচে তিনি তার টেস্ট ক্যারিয়ারসেরা ২৫ রান করেছিলেন। নবম উইকেটে হেমু অধিকারীর সাথে ৩৪ রানও যোগ করেন। কিন্তু এরপরও দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। নির্বাচকরা পরের তিন ম্যাচে যোশি, রাজিন্দারনাথ ও মাকাকে খেলালেও, ইডেন গার্ডেনসে শেষ ম্যাচের জন্য প্রবীরকেই ফিরিয়ে আনেন।

ওয়াকার হাসান ও ফজল মাহমুদের ম্যাচ বাঁচানো জুটিতে ড্র হয়ে টেস্টটি। এ ম্যাচে ব্যাট হাতে ১৩ রান করেন প্রবীর, আর গুলাব্রাই রামচাঁদের বলে একটি ক্যাচ ধরেন ও একটি স্টাম্পিং করেন। তখনো তিনি জানতেন না, এমন সাদামাটাভাবেই খেলে ফেলবেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টটি

পঙ্কজ রায় ও প্রবীর সেন; Image Source: Yahoo Cricket

বল হাতে হ্যাটট্রিক

হ্যাঁ পাঠক, ভুল পড়েননি আপনি। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান প্রবীরের ক্যারিয়ারের নামের পাশে একটি হ্যাটট্রিকসহ ৭টি প্রথম শ্রেণীর উইকেটও আছে। ১৯৫৩ সালে উড়িষ্যার বিপক্ষে ১২৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। কিন্তু দুই মৌসুম পর একই মাঠে, একই প্রতিপক্ষের বিপরীতে বল হাতে অসাধারণ একটি অর্জনের মালিক হয়েছিলেন তিনি।

সাদাচোখে মনে হবে কেবলই একতরফা একটি ম্যাচ ছিল এটি, যেখানে বাংলার ৪ উইকেটে ৩২৯ রানের জবাবে উড়িষ্যা অল-আউট হয়েছিল ৫৮ ও ১২৬ রানে। কিন্তু এই ম্যাচটির শেষ হয়েছিল আজবভাবে। প্রবীরের বলে প্রথমে রাম শাস্ত্রী স্টাম্পড হন। এরপর তিনি পরপর দুই বলে বোল্ড করেন তামায়া শাস্ত্রী ও নিমাল পাধিকেও। ম্যাচটি তিনি শেষ করেন ৩.৪-১-৪-৩ বোলিং ফিগার নিয়ে। এভাবে তিনি টিসি লংফিল্ডের পর বাংলার দ্বিতীয় বোলার হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করেন।

তবে প্রবীরের এই অর্জন নিয়েও খানিকটা বিতর্ক রয়েছে। অনেকে দাবি করে থাকেন, ওই ম্যাচেও শুরুতে উইকেটকিপিং করেছিলেন তিনি। এরপর গ্লাভস খুলে বল হাতে তুলে নেন। সেক্ষেত্রে একই ম্যাচে তিনি উইকেটকিপিংও করেছেন, আবার বল হাতে হ্যাটট্রিকও করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই মতামত হলো, ওই ম্যাচে অভিষিক্ত হওয়া গোপাল চক্রবর্তীই শুরু থেকে উইকেটকিপিং করে এসেছেন। গোটা ম্যাচে একবারও উইকেটের পেছনে দাঁড়াননি প্রবীর। সেক্ষেত্রে কোনো প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে উইকেটকিপিং করা এবং বল হাতে হ্যাটট্রিকও করার গৌরব কেবল একজন ক্রিকেটারেরই। তিনি অ্যালান স্মিথ। ১৯৬৫ সালে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে এসেক্সের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিলেন তিনি।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর

১৯৫৭-৫৮ মৌসুম পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যান প্রবীর। নিজের শেষ মৌসুমে প্রেজেন্ট ইলেভেনের বিপক্ষে পাস্ট ইলেভেনের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। সেই ম্যাচে ১৮ ও ৩৯ রান এসেছিল তার ব্যাট থেকে। তারচেয়েও জরুরি বিষয়টি হলো, দুইটি ক্যাচ আর ছয়টি স্টাম্পিংও করেছিলেন উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে। এর দুই সপ্তাহ পরে সার্ভিসেসের বিপক্ষে তিনি তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলেন। সে ম্যাচে ব্যাট হাতে ৫৭ রান করেছিলেন বটে, কিন্তু ডিসমিসাল ছিল শূন্য। বোধকরি এভাবেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তার সময় ফুরিয়েছে।

প্রবীর সেন, পঙ্কজ রায় ও বিজয় হাজারে; Image Source: Getty Images

শেষ কথা

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও, গোটা ৬০’র দশক জুড়ে কলকাতার ক্লাব ক্রিকেট মাতিয়ে গেছেন প্রবীর। কিন্তু ১৯৭০ সালের ২৭ জানুয়ারি, হঠাৎ করেই একটি ম্যাচ শেষে স্ট্রোক করেন তিনি। এবং ৪৪তম জন্মদিন পালনের আগেই পাড়ি জমান অন্য জগতে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে আজও কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় পি সেন মেমোরিয়াল ট্রফি, যেটি কলকাতার ক্লাব ক্রিকেটের সবচেয়ে সম্মানজনক টুর্নামেন্টগুলোর একটি। এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার (ইস্ট বেঙ্গল, ১৯৯৪) ও চামিন্দা ভাসের (মোহনবাগান, ২০০৯) মতো কিংবদন্তী ক্রিকেটাররাও। মোট কথা, ক্রিকেট দুনিয়ায় প্রবীর সেন আজও পরম সম্মানের পাত্র হয়েই আছেন। বর্তমান প্রজন্ম যে তাকে মনে রাখেনি, এটি তাদেরই ব্যর্থতা।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about cricketer Probir Sen, the very first Bengal cricketer to play for Indian national cricket team. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Getty Images

Related Articles