“এই কাজ মেয়েদের জন্য নয়”– কর্মক্ষেত্রে এমন কথা অনেক নারীই শুনে থাকেন। কথার মাত্রা যে শুধু এতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা কিন্তু নয়। এর সাথে যুক্ত হয় আরো নানা কটু মন্তব্য। কেউ হয়ত নারীকে হেয় করার জন্য বলে থাকেন, আবার হয়ত বা কেউ নারীর কর্মদক্ষতার সাথে পেরে না উঠার ভয়ে এমন কথা বলে তাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বলে থাকেন। কারণ যা-ই হোক না কেন, কাজের ক্ষেত্রে এমন কোনো বাধা-ধরা শ্রেণীবিভাগ ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে নারী এবং পুরুষের কর্মক্ষেত্র পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করা রয়েছে।
গোয়েন্দাগিরি- এই পেশার নামের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। পর্দায় ফেলু মিত্তির, ব্যোমকেশ বক্সী, জেমস বন্ডের উপর চিত্রায়িত সিনেমাগুলো ছোটবেলা থেকেই সকলের প্রিয় সিনেমার তালিকায় শীর্ষে থাকে সবসময়। রহস্যকে ঘিরে মানুষের আকর্ষণ স্বভাবসুলভ, আর রহস্যের সমাধান সে তো চরম উত্তেজনাকর। তাই গোয়েন্দা এবং গোয়েন্দাগিরিকে ঘিরে সকলের আগ্রহ চিরকালের। আমরা সবসময়ই গোয়েন্দার বেশে একজন পুরুষকেই দেখে এসেছি, তাই গোয়েন্দাগিরিকে একচ্ছত্র পুরুষের পেশা বলেই আমাদের ধারণা এতকাল ধরে চলে এসেছে।
রজনী পণ্ডিত গোয়েন্দাগিরি পেশায় নাম লেখানো প্রথম ভারতীয় নারী। যে পেশায় পুরুষের একক আধিপত্য, সেখানে তার শুরু এবং পথ পরিক্রমা মোটেও সহজ ছিল না। লোকের হাজারো তীর্যক কথা এবং বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তিনি আজ একজন সফল গোয়েন্দা। ১৯৯১ সালে তার প্রতিষ্ঠিত রজনী পণ্ডিত ডিটেকটিভ সার্ভিস আজ ২৫ বছর যাবত দাপটের সাথে কাজ করে চলেছে। ৫০ বছর বয়স্কা এই নারী এ পর্যন্ত ৭,৫০০টি কেস সুরাহা করেছেন এবং বর্তমানে তার অধীনে প্রায় ২০ জন কাজ করছেন। শুধু সমগ্র ভারতেই নয়, বিশ্বের আরো কিছু দেশেও তিনি কাজ করে থাকেন। আসুন তার গোয়েন্দা হয়ে ওঠা এবং তার কিছু গোয়েন্দাগিরির কথা জেনে নেয়া যাক।
এই গোয়েন্দা নারীর জন্ম ভারতের মহারাষ্ট্রের থানিতে। একটি মধ্যবর্তী পরিবারে তার বেড়ে উঠা। বাবা ছিলেন ভারতের একজন সিআইডি অফিসার এবং মহাত্মা গান্ধী হত্যার তদন্তে দায়িত্বরতদের একজন। রজনী পণ্ডিত মারাঠী সাহিত্য নিয়ে রূপারেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা শেষে এবং ডিটেকটিভ এজেন্সি শুরুর মধ্যবর্তী ৩ মাস তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। শুরুতে এই কাজে তার বাবার মোটেও সম্মতি ছিল না, কিন্তু মা প্রথম থেকেই পাশে ছিলেন এবং তাকে মানসিকভাবে শক্তি যুগিয়ে গেছেন। রজনী পণ্ডিত ছোটবেলা থেকেই বড্ড জেদি ছিলেন, আর তাই তার মা যখন জানতে পারেন যে, তিনি গোয়েন্দাগিরিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তিনি আর দ্বিমত পোষণ করেননি।
গৎবাঁধা চাকরি ছেড়ে তিনি কেন এই ভিন্ন পেশাকে বেছে নিলেন জানতে চাওয়া হলে উত্তরে বলেন,
“আপনি যদি কোনোকিছু করবেন বলে মনস্থির করে থাকেন, তবে অবশ্যই তা আপনার করা উচিত। যদি আপনি আত্মবিশ্বাসী, সাহসী এবং কাজ সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়চেতা হয়ে থাকেন তবে যেকোনো ধরনের কাজ করাতে কোনো লজ্জা নেই। এই তিনটি বিষয় ঠিক থাকলে নারীরা তাদের মনস্থির করা যেকোনো কাজই করতে পারে যা তাদেরকে অনেক দূর অবধি এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
তিনি আরো বলেন,
“আমি কখনো কোনোকিছু নিয়ে ভয় পাই না। যদি বলি মৃত্যুভয়ের কথা, তাহলে বলতে হয় মৃত্যু তো যেকোনো সময় যেকোনোভাবেই আসতে পারে। আপনি হয়তো আপনার শোবার ঘরে খুব আয়েশ করে বসে আছেন, এমতবস্থায় ছাদ মাথার উপর ভেঙেও তো মৃত্যু হতে পারে যে কারো। তাহলে আর ভয় রইল কীসের!”
গোয়েন্দা এজেন্সি খোলার পূর্বে কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার আশেপাশে ঘটে যাওয়া নানা রকম ঘটনা তাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি তার আশেপাশে এমন অনেককে দেখতে পান যারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগছেন, যা তারা নিজেরা সমাধান করতে পারছে না, কিন্তু বাইরের কারো সহায়তায় সেসব সমস্যা হয়তো খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সেই মানুষগুলো জানে না যে ঠিক কার কাছে গেলে তারা তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে। একজন গোয়েন্দার ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা এখানেই।
রজনী পণ্ডিত তার জীবনের প্রথম কেসটি সুরাহা করেছিলেন কলেজে পড়ার সময়, তখনও তার গোয়েন্দা সংস্থার পথচলা শুরু হয়নি। তার এক কলেজ সহপাঠীর আচরণে হঠাৎ বেশকিছু পরিবর্তন তিনি লক্ষ্য করেন, যা তার কাছে মোটেও ভালো ঠেকেনি। তিনি খোঁজখবর নিতে শুরু করেন এবং একপর্যায়ে গিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, মেয়েটি কিছু খারাপ ছেলে বন্ধুর পাল্লায় পড়েছে এবং ধূমপান, মদ্যপানসহ আরো বেশ কিছু অসৎ কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিলম্ব না করে ব্যাপারটি মেয়েটির বাবাকে জানান। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে চাননি। পরে রজনী পণ্ডিত অসৎ কাজে লিপ্ত থাকাকালীন তোলা বেশ কিছু ছবি তাকে দেখালে তিনি বিশ্বাস করেন। অতঃপর মেয়েটির পরিবার ধীরে ধীরে তাকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনেন। মেয়েটির বাবা রজনী পণ্ডিতের এমন কাজে বেশ অভিভূত হয়ে তাকে প্রথম বলেছিলেন, “তুমি কি গোয়েন্দা হতে চাও বা গোয়েন্দাগিরি নিয়ে কিছু ভাবছ কি?”
গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে রহস্য উদঘাটনে তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে। গৃহ পরিচারিকা, অন্ধ মহিলা, গর্ভবতী, ফুটপাতের ফেরিওয়ালা- এমন অনেক বেশ ধারণ করেছেন তিনি।
তার সমাধানকৃত ৭,৫০০ হাজার কেসের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস বা বনিবনা না হওয়া, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়া, বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রীর সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ- এ ধরনের ঘটনাগুলোর আধিক্য ছিল। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি সবসময় মানুষের বিপদের সময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করে থাকি, তাদের সাহস যোগাই এবং উৎসাহিত করে থাকি নিরুৎসাহিত না হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এতে হয়ত মানুষ হিসেবে আমার সামাজিক দায়িত্বও কিছুটা পালিত হয়।
একবার এক সহকর্মী তার কাছে এক সমস্যার কথা জানান। মহিলার তিন সন্তান ছিল এবং তাদের মধ্যে একজনের সদ্য বিয়ে হয়েছে। সমস্যা হলো কিছুদিন যাবত মহিলার গয়না কে যেন চুরি করতে শুরু করেছে এবং তার ধারণা তার ছেলের বউ কাজটি করছে। কিন্তু সঠিক কোনো প্রমাণ হাতে না থাকায় তিনি বাড়িতে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না।
বিনা পারিশ্রমিকে তিনি কেসটির সমাধান করে দেন। নিয়মিত তার বাড়ির উপর লক্ষ্য রাখা শুরু করেন এবং দেখেন যে প্রতিদিন সবাই যখন বাড়ির বাইরে চলে যায় তখন তারই এক ছেলে গয়না চুরি করে এক বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যায়।
গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে তাকে পোহাতে হয়েছে নানারকম ঝামেলাও। বিভিন্ন সময়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং পুলিশের হেনস্থা ও হুমকির সম্মুখীনও হয়েছেন বারবার। তার পথচলাটা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু অদম্য সাহস আর ইচ্ছেশক্তি নিয়ে হাসিমুখে তিনি তার দলসহ এগিয়ে গেছেন সবসময়।
তিনি বলেন,
“আমাদের সময়ে তো এখনকার মতো সাউন্ড রেকর্ডার, স্পাই ক্যামেরার মতো অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি ছিল না, তাই সেই সময় আমাদের কাজও কিছুটা কঠিন ছিল। যোগাযোগের জন্য সবার হাতে হাতে মুঠোফোনের প্রচলনটাও বেশ জোরেশোরে শুরু হয়নি তখনও।”
তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কেস ছিল এক খুনের আসামীকে খুঁজে বের করা এবং এই কেসটি সমাধান করার জন্য তিনি এক অপরিচিতের বাসায় ৬ মাস গৃহ পরিচারিকার ছদ্মবেশে ছিলেন। তাকে কেউ জানিয়েছিল যে, জনৈক মহিলা তার স্বামীকে খুন করার জন্য এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন। পুলিশও এই ঘটনার তদন্ত করছিল এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তারা গ্রেফতার করতে পারছিলেন না। এখানে বলে রাখা ভালো, মহিলা পরে নিজে তার ছেলেকে হত্যা করেন, কারণ ছেলে তার মায়ের সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তিনি অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু সেই মহিলার জনৈক প্রেমিক শুধুমাত্র রাতেই বাড়িতে আসতেন, যার কারণে বাড়ির বাইরে থেকে রজনী পণ্ডিতের জন্য অনুসন্ধান করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।
তখন তিনি সেখানে এক গৃহ পরিচারিকার বেশে যান এবং নিজেকে নিতান্ত হতদরিদ্র ও কাজের সন্ধানে আসা একজন অসহায় নারী হিসেবে তুলে ধরেন। অতঃপর গৃহকর্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি সেই বাড়িতে কাজের জন্য নিযুক্ত হন। তিনি ক্রমশ প্রমাণ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। একদিন সেই মহিলা এবং তার প্রেমিকের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয় এবং মহিলা তাকে আর কখনো এখানে আসতে নিষেধ করেন, কারণ তার মনে হয়েছিল আশেপাশের মানুষ তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে।
রজনী পণ্ডিত বুঝে যান আজকেই মোক্ষম সুযোগ, আজকের পরে তিনি হয়ত আর কখনো এই খুনীদের ধরতে পারবেন না। প্রয়োজন ছিল সেই মুহূর্তে পুলিশকে খবর দেয়া, কিন্তু তখনকার দিনে মোবাইল ফোন সহজলভ্য ছিল না। ফোন করার জন্য তাকে বাড়ির বাইরে ফোন বুথে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই সময় এমন কোনো কারণ ছিল না যে তিনি সেই মহিলাকে বলে বাইরে যেতে পারেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি নিজের পায়ে ছুঁড়ি ফেলে দেন। সাথে সাথেই রক্ত বের হতে থাকে ক্ষতস্থান থেকে। তা দেখে গৃহকর্ত্রী তাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে বলেন। এই সুযোগে দ্রুত বাড়ির বাইরে দিয়ে পুলিশকে খবর দেন রজনী। অতঃপর আসল খুনী ধরা পড়ে এবং রজনী পণ্ডিতের ঝুলিতে আরো একটি সাফল্যগাঁথা প্রবেশ করে।
কাজের পুরষ্কারস্বরূপ ২০১০ সালে দূরদর্শন থেকে তিনি হিরকানি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ২০১৪ সালে ইনভেস্টিগেশন প্রফেশনাল অফ দ্য ইয়ারের সম্মানও অর্জন করেছেন রজনী। নারী হিসেবে তিনি যেমন এক নতুন পথের দিশারী, ঠিক তেমনই একজন দৃঢ়চেতা মানুষের উদাহরণও বটে। ভারতে পুরুষের একক আধিপত্যে থাকা কর্মক্ষেত্রে তার পদার্পণ ও সাফল্য অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা।
ফিচার ইমেজ: SBS