‘নাম্বার এইট প্লিজ’- টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মীকে কেউ হয়তো কথাটা বললেন। কয়েকশ মাইল দূরে কোনো বন্ধুকে খুব দরকারি কোনো খবর হয়তো পাঠাতে চান তিনি। ‘ডট-ড্যাশ-ডট’ এর সেই বিখ্যাত মোর্স কোডের কাজ তখনই শুরু হয়ে গেল এবং লোকটি কাউন্টার ছাড়ার আগেই হয়তো বন্ধুর কাছে সেই খবর পৌঁছে গেল। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির ফলে যন্ত্রটার কথা এখন আর সেভাবে কেউ না চিনলেও একসময় দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম ছিল এই টেলিগ্রাফ।
দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে প্রায় চিন্তার গতিতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা যার জন্যে সম্ভব হয়েছিল তিনি কিন্তু প্রথম জীবনে ছিলেন নামকরা শিল্পী। হ্যাঁ, স্যামুয়েল মোর্সের কথাই বলছি। যৌবনে তিনি একটার পর একটা সুরম্য ছবি এঁকেছেন আর স্বপ্ন দেখেছেন, পঞ্চদশ শতাব্দীর শিল্প ঐশ্বর্যকে যারা পুনরাবিষ্কৃত করবেন, তিনি হবেন তাদেরই একজন। ভেবেছিলেন রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো এবং তিশিয়ানের প্রতিভার সঙ্গে একদিন তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। পঁচিশ বছর বয়সেই লন্ডনের রয়্যাল একাডেমিতে তার ছবি স্থান পেলেও, শেষপর্যন্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে মোর্স আজ টেলিগ্রাফের আবিষ্কারক হিসেবেই পরিচিত।
১৭৯১ সালের ২৭ এপ্রিল বোস্টনে স্যামুয়েল মোর্সের জন্ম। পিতা ধর্মযাজক জেডিয়া মোর্স আর মা এলিজাবেথ ফিনলে মোর্স। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক বিষয়ে উৎসাহ দেখা যায়। ভাই সিডনীর সাথে নানা পরীক্ষায় মেতে থাকতেন মোর্স। পড়াশোনার জন্য প্রথমে তাকে পাঠানো হয় ফিলিপস একাডেমিতে। কিন্তু সেখানে ভালো ফলাফল না করায় এবং মোর্সের চিত্রকলায় ব্যাপক উৎসাহ দেখে তার পিতা তাকে পাঠালেন ইয়েল কলেজে। সেখান থেকে তার স্নাতক সম্পন্ন হবার আগেই বিদ্যুৎ সম্বন্ধে বহু বক্তৃতা তিনি উৎসাহ নিয়ে শুনতেন। আর অবসর সময় কাটাতেন ছবি এঁকে।
কিন্তু ক্রমশ চিত্রশিল্পের প্রতি বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়তে থাকেন তিনি। শেষপর্যন্ত বাবার কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে ১৯১১ সালে চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনার জন্যে ইউরোপে পাড়ি জমান। ইউরোপ থেকে বাড়িতে প্রথম চিঠি লেখেন, “ইচ্ছে করে আমার চিঠিখানা যেন তোমরা এখনই পেয়ে যাও। কিন্তু তিন হাজার মাইল তো আর এক মুহূর্তে পার হওয়া যায় না।” লন্ডনে যে চার বছর ছিলেন সেই সময় তিনি বিখ্যাত আমেরিকান চিত্রশিল্পী বেনজামিন ওয়েস্টের কাছে কলাবিদ্যা শেখেন এবং কয়েকটি সুন্দর ছবিও আঁকেন।
বোস্টনে ফিরে এসে মোর্স একটি স্টুডিও খোলেন। স্টুডিওতে লাভ হতো খুবই কম। তার দেশের লোকেরা তখনো পোর্ট্রেট ছাড়া অন্য কোনো ছবির বিচার করতে শেখেনি। বাধ্য হয়ে তখন ইজেল কাঁধে করে তাকে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। ১৮১৬ সাল থেকে ১৮১৮ সাল পর্যন্ত তিনি নিউ ইংল্যান্ড থেকে ভারমুস্টের বিভিন্ন শহর ঘুরে ঘুরে এঁকেছেন একেকটি পোর্ট্রেট।
সেসময় লুক্রেসিয়া ভেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। লুক্রেসিয়া তাকে অনেক কাজে সাহায্য করেন। তাদের বিবাহিত জীবনকে সুখে-শান্তিতে ভরিয়ে রাখেন। মোর্স যখন ওয়াশিংটনে হ্যামিলটনের পোর্ট্রেট আঁকায় ব্যস্ত, তখন স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পান। নিউ হ্যাভেন থেকে ওয়াশিংটনে এই খবর পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ছ’দিন। অথচ দূরত্ব মাত্র চারশো মাইলেরও কিছু কম। স্ত্রীর মৃত্যুতে মোর্স খুব ভেঙে পড়েন। লুক্রেসিয়া তিনটি সন্তান রেখেই চিরবিদায় নেন পৃথিবী ছেড়ে। মোর্স তাদেরকে আত্মীয়দের বাড়িতে রেখে ১৮২০ সালে বেরিয়ে পরেন ইউরোপ ভ্রমণে।
তিন বছর পর দেশে ফেরার পথে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ডক্টর চার্লস জ্যাকসন নামে বোস্টনের জনৈক ভদ্রলোক জাহাজের লোকদের আনন্দদানের জন্য নানারকম বৈদ্যুতিক পরীক্ষা দেখাচ্ছিলেন। তা দেখে মোর্সের মনে হলো, বিদ্যুৎকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে মানুষের ভাষাকেও মুহূর্তের মধ্যে দূরে পাঠানো হয়তো অসম্ভব নয়। মাইলের পর মাইল তারের ভেতর দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে। মোর্স ভাবলেন, তারের যেকোনো অংশে বিদ্যুতের উপস্থিতিকে যদি দেখানো সম্ভব হয়, তবে মানুষের ভাষাকেও বিদ্যুতের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক অংশ থেকে অন্য অংশে পাঠিয়ে দেওয়া অসম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা ও স্থাপত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। নিউইয়র্কের ন্যাশনাল একাডেমি অফ ডিজাইন তারই চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐসময় চিত্রকলা সম্বন্ধে তিনি ধারাবাহিক বক্তৃতা দেন। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে তিনিই প্রথম এ ধরনের বক্তৃতার সূত্রপাত করেন। কিন্তু টেলিগ্রাফের চিন্তা ক্রমশ আরো বেশি করে তাকে পেয়ে বসে। একটু একটু করে একসময় তিনি একেবারেই আঁকাআঁকি ছেড়ে দেন। ১৮৩৭ সালের পর মোর্সের আঁকা মাত্র একখানি পোর্ট্রেট পাওয়া যায়।
মোর্স যে রাতারাতি টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেছিলেন এমনটি নয়। ১৮২২ সাল থেকেই তড়িৎ সম্পর্কীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি উৎসাহী হয়ে উঠেন। অধ্যাপক বেনজামিন সিলিম্যানের ল্যাবরেটরির পাশেই এক সময় তিনি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন এবং প্রতিদিন সিলিম্যানের ল্যাবরেটরিতে যেতেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ডানার সঙ্গেও তার হৃদ্যতা গড়ে উঠে। ১৮২৭ সালে তিনি ডানার কাছে বিদ্যুৎ সম্বন্ধে ধারাবাহিক পাঠ নেন। তখন তড়িৎ-চুম্বকের বিভিন্ন পরীক্ষা দেখারও সুযোগ পান। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় সেখানকার রসায়নের অধ্যাপক লিওনার্ড গেইল বিদ্যুৎ সম্বন্ধে তার জ্ঞানকে পরিস্ফুরিত করতে সাহায্য করেন।
সুদীর্ঘ কষ্টসাধ্য প্রয়াসে ১৮৩৬ সালে তার ডট ও ড্যাশের বর্ণমালাযুক্ত আবিষ্কারটি পরিশীলিত রূপ পেলেও সেটিকে সর্বসাধারণের সামনে হাজির করতে আরো আট বছর সময় লাগে। যে শিল্পী একদিন রঙ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা করেছেন, কোনো রঙকে দুধে, কোনোটি আবার বিয়ারে মিশিয়ে বিচিত্র রঙের সৃষ্টি করেছেন, সেই তিনিই তার আবিষ্কৃত যন্ত্রের নকশা আঁকতে শুরু করলেন।
১৮৩৮ সালে তিনি নিজের আবিষ্কারের একটি পেটেন্ট নেন। তবে মোর্স যন্ত্র আবিষ্কারে যত পারদর্শী ছিলেন, টেলিগ্রাফের কোড তৈরিতে তিনি ছিলেন ততটাই অনভিজ্ঞ। তাই তার সাহায্য নিতে হয় বন্ধু আলফার্ড ভেইলের। টেলিগ্রাফ যন্ত্রের পেটেন্ট মোর্সের নামে হওয়ায় পেটেন্ট চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত সকল কিছুই মোর্সের নাম পায়। আর তাই ভেইলের তৈরি কোড মোর্স কোড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে এ নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কে কোনোরকম তিক্ততা আসেনি। মোর্সও ভেইলকে কখনও অস্বীকার করেননি ।
১৮৪৪ সালের ৪ঠা মে তারিখে মোর্স তার বন্ধু আলফ্রেড ভেইলকে ওয়াশিংটন থেকে চল্লিশ মাইল দূরে বাল্টিমোরে প্রথম তারবার্তা পাঠান- ‘WHAT HATH GOD WROUGHT’। ডেল ঐ কথাগুলোই তাদের ভাষায় ফিরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোর্সের পরীক্ষা সফল হয়।
অল্প সময়ের মধ্যেই আমেরিকার বড় বড় শহর এবং ইউরোপের অনেক দেশে টেলিগ্রাফের প্রবর্তন হয়। নানা দেশ থেকে মোর্স সম্মান ও পদক লাভ করেন। তুরস্কের সুলতান তাকে ‘নিশান ইফতিকার’ নামে একটি সুদৃশ্য হীরক খচিত পদক উপহার দেন। প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়ার রাজা তাকে উপহার দেন সোনার পদক ও নস্যিদানী। ১৮৫৮ সালে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন ও তুরস্ক সম্মিলিতভাবে চার লক্ষ ফ্রাঁ দিয়ে মোর্সকে সম্মানিত করেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অফ লেটার্স’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৮৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিগ্রাফ কর্মীরা জীবদ্দশাতেই তার একটি মর্মরমূর্তি স্থাপন করে মোর্সের প্রতি অভূতপূর্ব সম্মান দেখেন।
মোর্স পৃথিবীর প্রথম তারবার্তাটি পাঠাবার পর পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে বার্তা প্রেরণের কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে। এখন চাঁদ থেকেও মানুষ পৃথিবীতে খবর পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে। আমরা অনেকেই তাতে চমক ও উত্তেজনা অনুভব করে থাকি। কিন্তু মোর্সের পাঠানো প্রথম বার্তাটি যারা সর্বপ্রথম দূরভাষী যন্ত্রে শোনার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, তাদের সেই বিস্ময় ও উদ্দীপনার তীব্রতার সঙ্গে হয়তো কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। প্রথম বলেই তা অতুলনীয়।
তখনকার দিনে দ্রুত তথ্য আদান প্রদান বেশ কষ্টকর ছিল। তাই টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের পর সেনাবাহিনীর কাছে এবং জাহাজে এই যন্ত্র দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। প্লেন চালানোর ক্ষেত্রেও এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৮৩৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দু’শ বছর টেলিগ্রাফ সারা পৃথিবী জুড়ে তার আধিপত্য বজায় রাখে। টেলিগ্রাফ নিয়ে নানা মজার গল্প রয়েছে। ১৯৪২ সালে টেরি টারনার নামের একজন ব্যক্তি এক মিনিটে ৩৫টি শব্দের পাঠোদ্ধার করে রেকর্ড করেছিলেন।
মোর্স কোডে একটি মজার ব্যাপার হলো, শব্দের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এর মেসেজের দাম নির্ধারণ করা হতো। আর তাই কম কথায় অনেক কিছু বোঝানোর জন্য মানুষ মজার মজার বাক্য লিখতো। যেমন, ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের নৌবাহিনীর একটি মেসেজ ছিল এমন, “Calling all. This is our last cry before our eternal silence.” অর্থাৎ, “সবাইকে বলছি, চিরতরে নিস্তব্ধ হওয়ার আগে এটাই আমাদের শেষ চিৎকার।”
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় টেলিগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হয়েছিল। এই টেলিগ্রামের মাধ্যমেই বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার খবর। বর্তমান বিশ্বে নানা প্রযুক্তিগত বিবর্তন ঘটেছে। বিংশ শতকের শেষের দিকে প্রথমে টেলিফোন, পরবর্তীতে মোবাইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফোন কল ও ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার ও জনপ্রিয়তার কারণে ধীরে ধীরে এই টেলিগ্রাফ যুগের অবসান ঘটে। কিন্তু যোগাযোগের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার শুরু টেলিগ্রাফ যন্ত্রের মধ্য দিয়ে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। আর তার সাথে উচ্চারিত হবে একজন স্যামুয়েল মোর্সের নাম। চিত্রশিল্পী থেকে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই ব্যক্তি টেলিগ্রাফ যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৮৭২ সালের ২ এপ্রিল এই গুনী শিল্পী ও বিজ্ঞানী পরলোক গমন করেন।
ফিচার ইমেজ- Pinterest