দশরথ মাঝি নামটির সাথে আপনারা অনেকেই পরিচিত। তবে কেরালার শশীকে খুব কম মানুষই চেনে। চেনার তেমন কারণ অবশ্য ছিলও না। আর সব মানুষের মতোই খুব সাধারণ শশী। ভাগ্যের ফেরে দশরথ মাঝির জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় সে-ও। এমন না যে তাদের মধ্যে কোনো পরিচয় ছিল। সম্পূর্ণ আলাদা আলাদাভাবেই নিজের প্রয়োজনীয়তা থেকে একই কাজ শুরু করেন তারা। আর সেই কাজটি হলো পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা। নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যান মাঝি। যে পাহাড়ের কারণে স্ত্রীকে হারিয়েছেন, তার শেষ দেখে নেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন তিনি আর সফলও হন। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। লেখাও হয়েছে প্রচুর। তবে সে তুলনায় গুগল ঘাঁটলেও কেরালার শশীকে পাওয়াটা বেশ কষ্টকর। খুব কম মানুষই তাকে নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে, লিখেছে কিংবা কাজ করেছে। পাহাড় কেটেছেন শশীও। তবে সে দিকে মানুষের নজর পড়েছে কম।
শশী গঙ্গাধরন, সংক্ষেপে শশী জি। কেরালার থিরুভানাথাপুরামের বাসিন্দা শশীর ঘরবাড়ি, পরিবার সবকিছুই ছিল। ছোটবেলা থেকে নারকেল গাছে চওড়া আর বাজারে নারকেল বেচা- এছাড়া কোনো কাজ জানা ছিল না শশীর। জীবিকার তাগিদেই নারকেল গাছে উঠতেন শশী। তবে এই নারকেল গাছই একদিন কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। ১৮ বছর আগের কথা। নারকেল গাছে চড়ার সময় পা ফসকে নীচে পড়ে যান শশী। পুরো শরীর অবশ হয়ে যায় তার। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, এভাবেই থাকতে হবে শশীকে। আর গাছে উঠতে পারবেন না তিনি। গাছে ওঠা ছাড়া আর কোনো কাজ জানা ছিল না শশীর। আর সে ক্ষমতাও তখন ছিল না তার। ফলে বাধ্য হয়ে কাজে নামতে হয় শশীর ছেলেকে। বাচ্চা ছেলে, স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে যোগ দেয় সে। চোখের সামনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব দেখছিলেন শশী। কিন্তু কিছু করার ছিল না তার।
অনেকগুলো দিন পেরোনোর পর অবশেষে খানিকটা শক্তি ফিরে আসে শশীর শরীরে। তবে ডান হাত পুরোটাই অবশ থেকে যায়। আর শরীরের বাকী অনেক অংশেও থেকে যায় জড়তা। ফলে আবার নারকেল গাছে উঠবেন এমনটা ভাবার কোনো উপায় ছিল না তার। তবে শশী কিছু করতে চাইছিলেন। পরিবারের সবার এত কষ্ট সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু কীভাবে কী করবেন তিনি? মাথায় এল থিরুভানাথাপুরামের শহরে গিয়ে কাজ করার কথা। সেখানে গেলে কিছু না কিছু একটা কাজ তো মিলেই যাবে।
কিন্তু সে পর্যন্ত যাবেন কী করে শশী? স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে একটি তিন চাকার স্কুটারের আবেদন জানান তিনি। হেসে তার কথা উড়িয়ে দেয় পঞ্চায়েত। কারণ শশীর বাড়ির সামনেই তো বিশাল এক পাহাড়! স্কুটার থাকলেও সেই পাহাড় বেড়ে ওঠা আর নামা শশীর পক্ষে সম্ভব নয়। “আমার ঘরের রাস্তাটা ছিল পাহাড়ের উপরে। আমি সেখান থেকে পিছলে যেতাম, পড়ে যেতাম। আমার কাপড় ছিঁড়ে যেত। এজন্যই আমি পঞ্চায়েতের কাছে অনুরোধ করলাম আমাকে একটা তিন চাকার গাড়ি দিতে, যাতে আমি শহরে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারি। পঞ্চায়েত আমাকে বলল, ‘তোমাকে গাড়ি দিয়ে লাভ কী, তোমার বাড়ির পাশে তো কোনো রাস্তাই নেই!’” শশী বলেন।
এবার শশীর সমস্যা হয়ে দাঁড়াল পাহাড়টিই। আর তাই স্থানীয় গণ্যমান্য মানুষের কাছে গেলেন শশী। অনেক দরজায় ঘুরলেন পাহাড় কাটার, রাস্তা বানানোর আবেদন নিয়ে। সে আবেদন গ্রাহ্য করলো না কেউ। একজন সাধারণ, পঙ্গু মানুষের জন্য পুরো একটি পাহাড় কাটতে হবে- এ চিন্তা কেউ মাথাতেও আনেনি। ফলে নিজের জন্য নিজেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় শশী। তবে এর ভেতরে পেরিয়ে যায় পুরো দশটি বছর। দশ বছর সবার কাছে পাহাড় কাটার আবেদন নিয়ে অনুরোধ করেছিলেন শশী।
২০১৩ সালের কথা। সবার উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেন শশী জি। নিজের হাতে তুলে নেনে কুড়াল। তেমন কিছু ছিল না তার। কিন্তু তাতে কী? অসম্ভব মনোবল ছিল। তিনি পারবেন। আর হ্যাঁ, শশী পেরেছিলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে দুইবেলা কাজ করতে শুরু করেন শশী। সকাল ৮ টার সময় কাজ শুরু করতেন তিনি। মাঝে একটি বিরতি নিতেন দুপুর বেলায়। তারপর খেয়েদেয়ে আবার বিকাল ৩টার দিকে কাজ শুরু হতো। কুড়ালের ঘাগুলো ঠিকভাবে লাগছিল না প্রথমে। ইট, পাথর ছিটকে এসে আহত হচ্ছিলেন শশী মাঝেমাঝেই। তবে সেটা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তার। সব ঠিক হয়ে যাবে, এই বিশ্বাস ছিল তার। আর হ্যাঁ, সব ঠিক হয়েও গিয়েছিল। প্রতিদিন একটু একটু করে কাজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিলেন শশী। একটা সময় কুড়াল আর পিছলে যাচ্ছিলো না। আর কোনো আঘাত লাগছিল না শশীর। পাহাড় কাটার কাজকে নিজের আয়ত্ত্বে এনে ফেলেছিলেন তিনি।
পরিশ্রম চলে দীর্ঘ ৩ বছর। টানা তিন বছর ধরে নিজের এই কাজ চালু রাখেন শশী। ফলে একটা সময় উঁচু পাহাড় হার মেনে যায় তার কাছে, মাথা ঝুঁকাতে বাধ্য হয়। কেবল কুড়াল ব্যবহার করে প্রায় ২০০ মিটারের এক রাস্তা তৈরি করে ফেলেন ৫৯ বছর বয়সী শশী। কাজের পুরোটা সময় নানা রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে শশীকে। প্রথমদিকে সবার হাসি-ঠাট্টার পাত্র হয়েই কাজ করে যেতে হয়েছে শশী জি-কে। কেবল বড়রাই নয়, বাচ্চারাও এসে ভিড় জমাতো শশীর পাশে। যেন খুব হাস্যকর কোনো কাজ করছেন শশী। পরবর্তীতে অনেকে অভিযোগ আনতে শুরু করে শশীর বিরুদ্ধে। স্ত্রী ওমানা জানান-
“পঞ্চায়েত বা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য ছাড়াই এসব কাজ করছিল সে। কিন্তু তাতেও সবাই ঝামেলা বাঁধায়। অনেকেই বলতে শুরু করে যে, মাটি কাটায় তাদের সমস্যা হচ্ছে, মাটি নাকি কেটে অন্য যায়গায় বেচে দিচ্ছে আমার স্বামী।”
শুধু তা-ই নয়, শশীর নামে কেস ঠুকে দেয় প্রতিবেশীরা। তাদের অভিযোগ ছিল এই যে, শশীর এই পাহাড় কাটার ব্যাপারটি খুব শব্দ তৈরি করছে। ফলে তাদের সমস্যা হচ্ছে। তবে তাই বলে সব প্রতিবেশী শশীর বিরুদ্ধে ছিল না। অনেকেই নিজেদের সমর্থন জানায় শশীকে। তবে মূল কাজটা করতে হয় শশীকে একাই। তাকে সাহায্য করার মতন কেউ এ সময় ছিল না।
তবে আর কেউ না হোক, পরিবারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে পুরোপুরি সমর্থন পেয়েছেন শশী। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ব্যাংকের নোটিশের ভয়ে দিন কাটছিল এই গরীব পরিবারটির। আশঙ্কায় ছিলেন শশী নিজের ঘর নিয়ে, নিজের পরিবার নিয়ে। তবে তাই বলে কাজে ঢিল দেন নি তিনি। কাজ করে গিয়েছেন আর টানা তিন বছর কাজের পর তৈরি করতে পেরেছেন এক সত্যিকারের রাস্তা। রাস্তা তো কাটা শেষ। কিন্তু এবার? অপেক্ষায় আছেন শশী। এবার নিশ্চয় তিন চাকার গাড়িটা পাবেন তিনি। অবশেষে পরিবারের জন্য কিছু হলেও করতে পারবেন।
ফিচার ইমেজ: Twitter