২০১২ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল অর্জন করেছিলেন স্টেম কোষ নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানী শিনইয়া ইয়ামানাকা। মানবদেহে থাকা এক অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন কোষের নাম স্টেম কোষ। এই কোষ দিয়ে বানানো যেতে পারে অঙ্গ। সেই অঙ্গ মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে কিংবা গবেষণাগারে এই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যেতে পারে। স্টেম কোষ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা প্রতিনিয়ন মানুষের জন্য এমনই অবারিত সুযোগের দ্বার খুলে দিচ্ছে। আর এই স্টেম কোষ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানী শিনইয়া ইয়ামানাকা বলেছেন তার অভিজ্ঞতা, প্রতিবন্ধকতা আর অনুপ্রেরণার কথা।
ওসাকা, জাপানের শিল্পোন্নত এক শহর। এই শহরেই জন্ম নিয়েছেন ইয়ামানাকা। ওসাকাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্যানাসনিক আর সানইয়ো। ইয়ামানাকার বাবাও নিজে পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী, সেলাই মেশিনের যন্ত্রাংশ তৈরি করতেন। ১০ বছর বয়সে তার পরিবারের সাথে নারা শহরে পাড়ি জমালেন ইয়ামানাকা। খুব ছোটবেলা থেকেই ইয়ামানাকাকে তার বাবা ডাক্তার হতে অনুপ্রেরণা দিতেন। স্কুলে জুডো খেলে হাড় ভেঙে ১০ বারেরও বেশি অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে দৌড়ানো ইয়ামানাকা। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন বড় হয়ে হবেন অর্থোপেডিক সার্জন। ১৯৮১ সালে কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিন থেকে ডাক্তারির দীক্ষা নিলেন। সেই সময় মাস তিনেক গবেষণাগারে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। গবেষণাগারে কাজ করা বেশ উপভোগও করেছিলেন ইয়ামানাকা। নিত্যনতুন জ্ঞানের খোঁজে গবেষণাগারই হবে তার ভবিষ্যতের ঠিকানা, সেই ব্যাপারটি তখনও উপলব্ধি করতে পারেননি ইয়ামানাকা।
ইয়ামানাকার বয়স যখন ছাব্বিশ, যকৃতের সমস্যায় তার বাবা মৃত্যুবরণ করলেন। তিনি মূলত হেপাটাইটিস-সি রোগে ভুগছিলেন, যে রোগের তখনও কোনো প্রতিকার বিজ্ঞানী কিংবা ডাক্তারদের জানা ছিলো না। বাবার মৃত্যুর ঘটনা ইয়ামানাকার চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনে দেয়। ডাক্তার হয়েও বাবাকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ জন্ম নেয় তার মনে। তার বাবার মৃত্যুর পরেই শল্যচিকিৎসা ছেড়ে গবেষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন ইয়ামানাকা। আর সেই উদ্দেশ্যেই ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে ভর্তি হয়ে গেলেন পিএইচডির ছাত্র হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিলো রোগের প্রতিকার খুঁজে বের করে রোগীদের সাহায্য করা।
অন্য অনেক তরুণ গবেষকের মতোই তার গবেষণার শুরুর দিনগুলো সহজ ছিলো না। তার প্রথম প্রজেক্ট ছিলো কীভাবে কুকুরের রক্তে থাকা অণুচক্রিকা সক্রিয়কারী পদার্থের সাথে রক্তচাপের সম্পর্ক। রক্তচাপ বাড়বে এই ধারণা নিয়ে তিনি তার গবেষণা শুরু করেছিলেন, তবে গবেষণা শেষে দেখা গেলো সম্পূর্ণ বিপরীত ফলাফল এসেছিলো। এই ঘটনার পর ইয়ামানাকার প্রতিক্রিয়া ছিলো, “অপ্রত্যাশিত ফলাফল আমাকে দারুণ উত্তেজিত করে। সেই মুহূর্তেই আমি বুঝতে পারি আমার চিকিৎসক হওয়ার চাইতে আমার গবেষক হওয়া উচিত। কারণ আমি গবেষণাকে উপভোগ করি। আমার এই আনন্দ আমার শিক্ষকদেরও উৎফুল্ল করে।”
সেই থেকেই শিনইয়া ইয়ামানাকার অজানার সমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে জ্ঞান আহরণের যাত্রা শুরু। তার প্রথম প্রজেক্টের গভীরে থাকা কলাকৌশল আবিষ্কার করেন। তার গবেষণা ফলাফল গবেষণাপত্র আকারে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। সেই বছর ইয়ামানাকা ওষুধ-গবেষণাবিদ্যায় পিএইচডি সম্পন্ন করেন। আণবিক জীনতত্ত্ব নিয়ে সারা পৃথিবীতে তখন জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।
আর সেই জোয়ারের শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তাই সারা পৃথিবী থেকে শত শত তরুণ বিজ্ঞানীর লক্ষ্য তখন মার্কিন মুল্লুকে গবেষণা করতে পাড়ি জমানো। ইয়ামানাকাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ডজনখানেক মার্কিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক জীনতত্ত্বে পোস্ট ডক্টরাল করার লক্ষ্যে যোগাযোগ শুরু করলেন তিনি।
স্যান ফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্ল্যাডস্টোন ইন্সটিটিউট অফ কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিস থেকে ডাক পেলেন ইয়ামানাকা। সেখানেই অন্য অনেক কাজের পাশাপাশি স্টেম কোষ নিয়েও কাজ করেছেন ইয়ামানাকা। ১৯৯৬ সালে জাপানে ফিরে আসেন, যোগ দেন ওসাকা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৯ সালে তিনি যোগ দেন নারা ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে। তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় তার গবেষণাগারের প্রধান হিসেবে, পেয়েছিলেন নিজের মতো করে গবেষণা করার স্বাধীনতা। ইয়ামানাকার মতে এই একটি পদক্ষেপ তার জীবনকে অনেকখানি বদলে দিয়েছিলো।
ইয়ামানার মতে, একজন গবেষক কখনোই অন্যের কাজের পুনরাবৃত্তি করতে চান না। নিজের মতো করে তার কাজটি করতে চান। কিন্তু বাস্তবে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা বেশ কঠিন। পাহাড় সমান ব্যর্থতা আঘাত করে প্রতিনিয়ত। এই ব্যাপারে ইয়ামানাকা বলেন, “সব ব্যর্থতাকেই আমি দেখি একেকটি সুযোগ হিসেবে। প্রত্যেকটি ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষা দেয় নতুন কিছু।”
‘নোবেল প্রাইজ ইন্সপিরেশন ইনিশিয়েটিভ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “নতুন একটি উদ্ভাবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার অনেকগুলো পন্থা আছে। এর প্রথমটি হলো আইনস্টাইনের মতো জিনিয়াস হওয়া। কিন্তু আমার সেটি ছিলো না। দ্বিতীয় রাস্তাটি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলে হোঁচট খাওয়া। সেখানে আটকে গিয়ে নতুন কিছু খুঁজে বের করা। আর তৃতীয় আরেকটি রাস্তা আছে, সেটি হলো সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কিছু করা। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন। সামনে অনেক বাঁধা বিপত্তি থাকে। কিন্তু ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে ধৈর্য্যের সাথে এই পথে এগিয়ে গেলে সাফল্য আসবেই।”
ইয়ামানাকার নোবেল পুরষ্কারটি এভাবেই এসেছিলো। স্টেম কোষ নিয়ে কাজ করার জন্য প্রতিনিয়তই মানব ভ্রূণ ব্যবহার করা হয়। ভ্রূণ থেকে স্টেম কোষ সংগ্রহ করে সেটি দিয়েই গবেষণা করা হয়। স্টেম কোষের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এর একটি হলো এটি অনির্দিষ্টকাল ধরে বিভাজিত হতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো এদেরকে ব্যবহার করে বিশেষায়িত কোষ বানানো যেতে পারে। তাই তাত্ত্বিকভাবে স্টেম কোষ থেকে বিশেষায়িত কোনো কোষ, যেমন: হৃদকোষ কিংবা যকৃতকোষ বানানো যেতে পারে। তাই সারা দুনিয়াজুড়ে স্টেম কোষ নিয়ে কর্মরত বিজ্ঞানীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্টেম কোষকে বিশেষায়িত কোষে রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে।
কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে ভ্রূণের তাকিয়ে একদিন ইয়ামানাকা ভাবলেন এমন কিছু কি করা যায়, যেখানে ভ্রূণ নষ্ট না করেই স্টেম কোষ তৈরি করা যাবে। সবাই যখন স্টেম কোষ ব্যবহার করে নানা ধরনের রোগ সারানোতে ব্যস্ত, ইয়ামানাকার মাথায় তখন চিন্তা কীভাবে সহজে স্টেম কোষ বানানো যেতে পারে। কিংবা বিশেষায়িত কোষকে কীভাবে স্টেম কোষে রূপান্তর করা যেতে পারে। আর এখানেই বাকি সবার চাইতে আলাদা হয়ে গেলেন তিনি।
ইয়ামানাকা ধারণা করেছিলেন, আমাদের দেহকোষকে ভ্রূণ থেকে পাওয়া স্টেম কোষে রূপান্তর সম্ভব। যেহেতু আমাদের দেহের সব কোষই আসলে ভ্রূণ থেকে তৈরি। এই প্রক্রিয়াকে নাম দেওয়া হয় ‘রিপ্রোগ্রামিং’। ইয়ামানাকার অন্যতম দক্ষতার একটি জায়গা ছিলো জীনতত্ত্ব। তাই তিনি কাজ শুরু করলেন দেহকোষে থাকা জীনের ঠিক কোনগুলোকে উদ্দীপ্ত করলে এই প্রক্রিয়াটি করা সম্ভব তা নিয়ে।
ইয়ামানাকা আর তার ছাত্র কাজুতুশি তাকাহাসি মিলে কাজ শুরু করলেন। কাজের শুরুতে এর ব্যাপ্তি দেখে মনে হয়েছিলো বছর দশেকের আগে এটি শেষ করা মোটেও সম্ভব নয়। তাই কাজের শুরুতেই ইয়ামানাকা তার ছাত্রকে অভয় দিয়েছিলেন, “কাজুতুশি, ভয়ের কিছু নেই। দশ বছরেও যদি ফলাফল না পাওয়া যায় তবে আমি একটি ছোট ক্লিনিক চালু করবো। আমার ডাক্তারি লাইসেন্স তো আছেই, তোমাকে সেখানে অভ্যর্থনাকারী হিসেবেই নিয়োগ দিবো।”
ইয়ামানাকা ছিলেন একজন দৌড়বিদও। ম্যারাথন দৌড়েও অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্রতিটি গবেষণাও ছিলো তার জন্য একেকটি ম্যারাথন। কাজ শুরু করার প্রায় ছয় বছর পর ইয়ামানাকা আর তাকাহাসি ২০০৬ সালে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করলেন। তাদের গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসে কীভাবে একটি দেহকোষকে উদ্দীপ্ত করে স্টেম কোষে রূপান্তর করা যায়।
আবিষ্কারের দশ বছরের মাথায় এ ধরনের স্টেম কোষ চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এ ধরনের স্টেম কোষ ব্যবহার করে বর্তমানে গবেষণাগারেই যেকোনো ধরনের বিশেষায়িত কোষ তৈরি করা সম্ভব। ফলে গবেষকগণ সহজেই একটি নতুন ওষুধের কার্যকারিতা সরাসরি পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছেন। আগে মানব কোষের উপর সরাসরি পরীক্ষা করার কোনো সুযোগ ছিলো না।
ইয়ামানাকাকে ২০১২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তবে ইয়ামানাকা যে দরজা খুলে দিয়েছেন সেই স্টেম কোষ নিয়ে গবেষণা এখনো অব্যাহত। এই স্টেম কোষ ব্যবহার করে তৈরি করা যেতে পারে নতুন অঙ্গ। ভবিষ্যতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আরো নিরাপদ হবে। পাশাপাশি স্টেম কোষ ব্যবহার করে পারকিনসন্স, চোখের কর্নিয়া, হৃদপিণ্ড কিংবা স্পাইনাল কর্ডের রোগ সারানো যেতে পারে। ক্যান্সার আর আর্থ্রাইটিসের মোকাবেলার চেষ্টাও করা হচ্ছে এ ধরনের স্টেম কোষ ব্যবহার করে।
ইয়ামানাকার গবেষণা ফলাফলের আরেকটি দারুণ ব্যাপার হলো, এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করলে স্টেম কোষ তৈরির জন্য মানব ভ্রূণ নষ্ট করার দরকার নেই। ২০১০ সালে ওয়াশিংটনের আদালতের একটি রায়ে বলা হয়, গবেষকরা রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবহার করে মানব ভ্রূণ নষ্ট করে কাজ করতে পারবেন না। তাই ইয়ামানাকার আবিষ্কারটি না থাকলে স্টেম কোষ নিয়ে কাজ করার রাস্তা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে যেতো।
ইয়ামানাকা তার গবেষক জীবন নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “স্বর্গে হয়তো আমার পিতা হয়তো এখনো চিন্তা করছে আমি একজন ডাক্তার, কিন্তু আমি তো একজন গবেষক। তাই আমি চাই আমার এই গবেষণা ব্যবহার করে অনেক রোগীর জীবন বাঁচাতে। আর এই কাজটি সম্ভব হলেই বাবার সাথে দেখা হলে ঠিকঠাক জবাব দিতে পারবো।”