Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্ট্যালিনকন্যা সভেৎলানা: সোভিয়েত ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘ডিফেক্টর’?

বাবা ছিলেন পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সাধারণ সম্পাদক। বাবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইস্পাতদৃঢ় মানসিকতার পরিচয় দিলেও মেয়ের সামনে ছিলেন একদম সাধাসিধে মানুষ, পালন করতেন একদম ‘আদর্শ বাবা’র ভূমিকা। বাবা জোসেফ স্ট্যালিন মেয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘ছােট্ট চড়ুই পাখি’ (Little Sparrow)। পার্টির কাজকর্ম সেরে যখন মেয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন, তখন চুমুতে ভরিয়ে দিতেন মেয়েকে। চিরকাল তার নিজ মতাদর্শের সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকার বিরোধিতা করে এসেছেন, কিন্তু মেয়ের সাথে প্রায়ই হলিউডের চলচ্চিত্র দেখতে একসাথে বসে যেতেন দুজনে, মেয়েকে বিভিন্ন উপহার প্রদানের মাধ্যমে সবসময় খুশি রাখার চেষ্টা করতেন, নিজ হাতে ভালোবাসামিশ্রিত চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিতেন মেয়ের ঠিকানায়। তবে জীবনের প্রথম বছরগুলোতে বাবার রাজনৈতিক অপকর্ম সম্পর্কে কিছু জানতে না পারলেও ধীরে ধীরে একসময় মেয়ে জেনে ফেলেন তার বাবা সোভিয়েত ইউনিয়নের লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য তার বাবা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী!

সননসনসমসমস
জোসেফ স্ট্যালিন, সোভিয়েত লৌহমানব; image source: britannica.com

স্ট্যালিনের কন্যা সভেতলানা যখন খুব ছোট, তখন তার মা মারা যান। স্ট্যালিনের স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিন ক্ষমতা হাতে পাওয়ার নিজ স্ত্রীর প্রতি বেশ উদাসীন হয়ে পড়েন। স্ট্যালিনের স্ত্রী যখন জানতে পারেন স্বামী আরও কিছু নারীর সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, তখন চরম মাত্রায় হতাশ হয়ে পড়েন। হতাশায় শেষ পর্যন্ত নেদেঝদা আলিলুয়েভা নিজের বুকে নিজেই গুলি চালিয়ে বসেন। তবে স্ট্যালিনের স্ত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা তার মেয়ের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল, তার মা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যায় মারা গিয়েছেন। ছোট্ট মেয়ে সভেৎলানা প্রাথমিকভাবে সেটিই বিশ্বাস করে নিয়েছিল, যদিও প্রায় দশ বছর পরে সে সত্য জানতে পারে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়গুলোর একটি ছিল ‘দ্য গ্রেট পার্জ’। এটি ছিল মূলত একটি শুদ্ধি অভিযান, যার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্ট্যালিন নিজের রাজনৈতিক শত্রুদের খতম করতে চেয়েছিলেন। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম নেতা লেনিনের উত্তরসূরীদের তালিকায় জোসেফ স্ট্যালিনের নাম ছিল বেশ পেছনের দিকে, কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাক্রমে শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনই ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। তার ক্ষমতা দখলের ঘটনায় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছিল, এবং এই অসন্তোষ দমনের জন্যই ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ এর মতো ঘৃণ্য রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, নিজেকে ‘কাল্ট ফিগার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই জোসেফ স্ট্যালিন এই অভিযান পরিচালনা করেন। অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে প্রহসনের বিচারে অভিযুক্ত প্রমাণ করে মেরে ফেলা হয়, অসংখ্য মানুষকে শাস্তিস্বরূপ সাইবেরিয়ার কুখ্যাত অঞ্চলগুলোতে অবস্থিত লেবারক্যাম্পে যেতে বাধ্য করা হয়। প্রায় বিশ বছর ধরে চলা এই শুদ্ধিকরণ অভিযানের পর দেখা যায়- প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ মানুষ মারা গিয়েছে, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন নির্দোষ। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির এক-তৃতীয়াংশ নেতা-কর্মী এই অভিযানে প্রাণ হারান।

য়মময়য়ময়ম
কুখ্যাত সোভিয়েত রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ অভিযান, ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ এর মূল হোতা ছিলেন জোসেফ স্ট্যালিন;
image source: history.com

 

সভেৎলানা আলিলুয়েভা যেখানে থাকতেন, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর কিছু উচ্চপদস্থ নেতাও সপরিবারে থাকতেন। ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ এর কারণে কিছু নেতা হঠাৎ হারিয়ে যান, যেটি সভেৎলানাকে বেশ অবাক করেছিল। এমনও হয়েছিল যে- স্ট্যালিন যাকে তার ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করেছিলেন, তাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে অভিযুক্ত করে সপরিবারে ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলেন। সভেৎলানার পরিচিত অনেক ব্যক্তি ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ এর কবলে নিখোঁজ হয়ে যান। একবার সভেৎলানার স্কুলের এক বন্ধুর বাবা রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যান। তখন নিখোঁজ ব্যক্তির মা সভেৎলানাকে একটি চিরকুট দিয়ে বলেছিলেন সেটি যেন সে তার বাবাকে দেয়। হয়তো নিখোঁজ ব্যক্তির মা চেয়েছিলেন সভেৎলানার মাধ্যমে যদি স্ট্যালিনকে চিরকুটের দ্বারা বলা হয়, তাহলে হয়তো নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সভেৎলানা ঠিকমতো সেই চিরকুট স্ট্যালিনের কাছে পৌঁছানোর পর স্ট্যালিন রাগান্বিত হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীতে এ ধরনের কোনো কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। সভেৎলানা ও তার বাবার মধ্যে ধীরে ধীরে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে।

গসমচমচৃ
স্ট্যালিনের স্ত্রীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আড়াল করা হয়েছিল সভেৎলানার কাছ থেকে; image source: foreignpolicyi.org

সভেৎলানার জীবনেও প্রেম এসেছিল। তিনি এক চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রেমে পড়েন। অ্যালেক্সেই ক্যাপলার নামের সেই চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন সভেৎলানার চেয়ে প্রায় ২০ বছরের বড়। স্ট্যালিন যখন মেয়ের এই প্রেমের খবর জানতে পারেন, তখন তিনি কষিয়ে তার মেয়ের গালে দুটো চড় বসান। শুধু তা-ই নয়, তখন ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ চলছিল। চারদিকে কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন মনে হলেই স্ট্যালিনের গোপন পুলিশ বাহিনী তাকে গ্রেফতার করছে। গ্রেফতারের পর শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য একটি বিচারের আয়োজন করা হয়তো, যেখানে রায় আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকত। স্ট্যালিনের নির্দেশে সেই ইহুদি চলচ্চিত্র নির্মাতাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে বিচারের মাধ্যমে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাকে দুর্গম আর্কটিক অঞ্চলের লেবারক্যাম্পে পাঠানো হয়।

যে বছর সভেৎলানার প্রেমিককে স্ট্যালিনের গোপন পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার করে, সেই বছরই আরও দুটি ঘটনা ঘটে। সভেৎলানা নিজের ইংরেজির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটি ইংরেজি দৈনিক পড়ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি তার প্রয়াত মা সম্পর্কে একটি খবর দেখতে পান। সেখানে দাবি লেখা ছিল কীভাবে স্ট্যালিনের স্ত্রী নেদেঝদা আলিলুয়েভা আত্মহত্যা করেছেন। সভেৎলানা বুঝতে পারেন তার মায়ের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বোঝানো হয়েছিল। আরেকটি ঘটনা হচ্ছে- সভেৎলানা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্ট্যালিন ভেবেছিলেন- সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলে দিনশেষে হয়তো তার মেয়ে ভবঘুরে লেখক কিংবা উদাসীন সাহিত্যিকে পরিণত হবে। তাই তিনি মেয়েকে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনায় বাধ্য করেন, যেন তিনি বড় হয়ে একজন শিক্ষিত মার্ক্সিস্ট হতে পারে। এই দুটি ঘটনা তার মানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। তার বাবার প্রতি যে শেষ সম্মানটুকু ছিল, সেটি তিনি হারিয়ে ফেলেন।

সনানানান
বাইরের দেশে পা রাখার পর সভেৎলানাকে ঘিরে আলোকচিত্রীদের ভিড়; image source: taipeitimes.com

১৯৫৩ সালে সভেৎলানার বাবা জোসেফ স্ট্যালিন মারা যান। বাবার মৃত্যুর সময় যে কষ্ট হয়েছিল, সেটি সভেৎলানা খুব কাছ থেকে দেখেন। মস্কো হাসপাতালে যখন টনসিলের জন্য সভেৎলানা ভর্তি হন, তখন তার পরিচয় হয় ব্রাজেশ সিং নামের এক ভারতীয় ব্যক্তির। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার জন্য ব্রাজেশ সিং সোভিয়েত রাশিয়ায় চিকিৎসার জন্য গমন করেন। একসময় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৬৬ সালে ব্রাজেশ সিং শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তারা দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত প্রশাসনের কড়াকড়িতে তাদের আর বিয়ে করা হয়নি। তিনি ব্রাজেশ সিংয়ের মুখ থেকে ভারতের অনেক গল্প শুনে দেশটি ভ্রমণে আগ্রহী হন। সভেৎলানা সোভিয়েত প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তাকে ভারত ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয়, এবং তিনি বলেছিলেন- ভারতে গিয়ে রীতি অনুযায়ী ব্রাজেশ সিংয়ের মৃতদেহের ছাই গঙ্গা নদীতে ফেলে আসবেন। সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে যাবার অনুমতি দেয়।

সভেৎলানা ভারত থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে আসার পর সিদ্ধান্ত নেন- তিনি আমেরিকায় যাবেন এবং সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মস্কোর আমেরিকান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন। আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা প্রথমে তাকে সাহায্য করতে চাননি। কারণ তাদের ধারণা ছিল- হয়তো সভেৎলানা মিথ্যা কথা বলছেন। সিআইএ জানত স্ট্যালিনের কোনো মেয়ে নেই। তাই তারা প্রথমে সাহায্য করতে চায়নি। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে এই তথ্য পৌঁছানোর পর তিনি মানবিকতার খাতিরে সভেৎলানাকে আমেরিকায় আশ্রয় প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে তাকে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, এরপর নিয়ে যাওয়ায় হয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। এরপর তাকে আমেরিকায় নেওয়া হয়। এই সমস্ত কাজ করা হয় অত্যন্ত গোপনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দারা যখন টের পান সভেৎলানা নিখোঁজ হয়েছেন, তখন তারা তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা হাতে নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সেই পরিকল্পনা থেকে আসেন, কারণ তাদের ধারণা ছিল হয়তো তাকে মেরে ফেললে হত্যার দায় ক্রেমলিনের উপর চাপানো হবে। এতে বহির্বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সভেৎলানা যখন নিউ ইয়র্কের জন এফ. কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন, তখন অসংখ্য সাংবাদিক বিমানের গেটে অপেক্ষায় ছিল। বিমান থেকে নামার পর তিনি বলেন, “কী খবর সবার? আমি এখানে এসে খুবই আনন্দবোধ করছি।” এর কিছুক্ষণ পরে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রকাশ্যে তার সোভিয়েত পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেন এবং তার বাবা জোসেফ স্ট্যালিনকে ‘নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দানব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আমেরিকায় এসে সভেৎলানা আলিলুয়েভা নতুন জীবন লাভ করেন। প্রথমদিকে বই লেখা ও অন্যান্য উপায়ে অনেক অর্থ উপার্জন করলেও শেষ বয়সে তিনি সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েন। ২০১১ সালে তিনি আমেরিকায় কোলন ক্যান্সারে মারা যান।

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যেসব ব্যক্তি পালাতে সক্ষম হন, তাদেরকে বলা হতো ‘সোভিয়েত ডিফেক্টর’। স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাল সময়ে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে আমেরিকা ও ইউরোপে গমন করেন। এদের মধ্যে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি-তে কর্মরত ব্যক্তিরাও ছিলেন। পরবর্তীতে এই ব্যক্তিদের দেয়া তথ্যানুযায়ী ব্রিটেন ও আমেরিকার তথ্য পাচারকারীদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ‘সোভিয়েত ডিফেক্টর’দের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল নিঃসন্দেহে স্ট্যালিনকন্যা সভেৎলানা আলিলুয়েভা। আমেরিকায় যাবার পর তার পিতৃভূমি সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হতো, এবং সেসব মন্তব্য সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

Related Articles