তালাত মাহমুদকে চেনা যাচ্ছে? যদি উত্তর না-সূচকও হয়ে থাকে, তবুও তার গান কিন্তু ঠিকই গেঁথে আছে আপনাদের হৃদয়ের গভীরে, হয়ত তার নাম না জেনেও। যেমন ধরুন-
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয় ও ও
চাঁদ হয়ে রব আকাশের ও গায়
বাতায়নে খুলে দিওসেথা জোসনার আলোর ও খনিকা
যেনো সে তোমার প্রেমের ও মনিকা (২বার)
কলঙ্ক সাথে জড়ায়ে রয়েছে
প্রেমের কলঙ্ক সাথে জড়ায়ে রয়েছে
আঁখি ভরে নিড় ও প্রিয় ও ওচাঁদ হয়ে রব আকাশের ও গায়
বাতায়ন খুলে দিও…
কিংবা আরেক বিখ্যাত গান-
তোমারে লেগেছে এত যে ভালো
চাঁদ বুঝি তা জানে,
রাতের বাসরে দোসর হয়ে
তাই সে আমারে টানে।।রাতের আকাশে তারার মিতালী
আমারে দিয়েছে সুরের গীতালীকত যে আশায় তোমারে আমি
জ্বালিয়ে আমি রেখেছি দ্বীপালী
আকুল ভ্রমরা বলে সে কথা
বকুলের কানে কানে।।
তালাত মাহমুদের এসব গান বাংলাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয় দখল করে আছে যুগর পর যুগ। গানের পাশাপাশি যারা একটু-আধটু শিল্পীদেরও খোঁজ রাখেন তারা অবশ্যই তালাত মাহমুদকে এক নামে চিনে থাকবেন। শিল্পী তালাত মাহমুদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি একজন গজল গায়ক। গজল মানে প্রেমের গভীর অভিব্যক্তি, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া দরদী সুর, কোমল মায়াবী কন্ঠস্বর- এসবেরই যেন এক অপূর্ব সমন্বয় শিল্পী তালাত মাহমুদ। এ কারণেই তিনি অর্জন করেছেন ‘দ্য কিং অফ গজল’ বা ‘গজল সম্রাট’ খেতাব; যাকে হিন্দিতে বলা হয়, ‘শাহেনশাহ-ই-গজল’।
১৯৬০ সালে কিছুদিনের জন্য ঢাকাতে বসবাস করেন এই গজল সম্রাট। এ সময়েই তিনি এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রের জন্য ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’ গানটিতে কন্ঠ দেন। তার গাওয়া বাংলা গানের সংখ্যা সর্বমোট ৪৯টি। তিনি বিশ্বের প্রায় ১২টি ভাষায় গান গেয়েছেন, তবে তিনি প্রধানত উর্দু ও হিন্দি ভাষার শিল্পী ছিলেন।
তালাত মাহমুদের জন্ম উত্তর প্রদেশের লাখনউ জেলায়। ১৯২৮ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে এই মহান গজল তারকার আবির্ভাব ঘটে। পিতা মনজুর মাহমুদ ছিলেন একটি বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র দোকানের মালিক। ফলে ছোটবেলা থেকেই তালতের সুযোগ হয়েছিল বাদ্যযন্ত্রের সাথে পরিচিত হওয়ার। পাশাপাশি বাবা মনজুর মাহমুদ নিজেও ছিলেন একজন গায়ক।
তালাত পড়াশোনা করেছেন উত্তর প্রদেশের লাখনউ মরিস কলেজে। সেখানেই তিনি ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের উপর পাঠ নেন পণ্ডিত এসসিআর ভাটের কাছে। পরিবার থেকে তালাতকে বলা হলো অভিনয় অথবা গানের যেকোনো একটিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে বাড়িতে থেকে যাওয়ার জন্য। তিনি দ্বিতীয়টিকে নিজের জন্য পছন্দ করলেন। যদিও ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার অগাধ টান ছিল, তাছাড়া তিনি পড়াশোনাও করেছিলেন সঙ্গীতের উপরে।
সহসাই তৎকালীন অন্যান্য সঙ্গীত শিল্পীদের থেকে তার কণ্ঠ দর্শকদের আলাদাভাবে আকর্ষণ করতে শুরু করলো। কারণ তার কণ্ঠ ছিলো মায়াময়, গম্ভীর, মোলায়েম এবং সুমধুর।
তার গানের ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। সেসময় তিনি লাখনউয়ের অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে মির্জা গালিবের গজল গাওয়ার জন্য ডাক পান। প্রথম গায়কীতেই তিনি গানের সাথে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত এইচএমভি কম্পানি তাকে অভিহিত করলো তরুণ উদীয়মান গজল তারকা হিসাবে।
সে বছরই ‘দাগ’ চলচ্চিত্রের জন্য গালিব আরেকটি গজল গাওয়ার ডাক পান। এই গানটিও তুমুল জনপ্রিয়তা ও আলোচনার জন্ম দেয়।
১৯৪১ সালে এইচএমভি কোম্পানি তালাত মাহমুদের নন-ফিল্মি গজল ‘সাব দিন এক সমান নেহিন থা…..’ গজলটি রেকর্ড করে। এটা সাফল্য পাওয়ায় কোম্পানিটি তালাতকে গানের অ্যালবাম বের করার প্রস্তাব প্রদান করে। সেখান থেকেই ১৯৪১ সালে তার প্রথম গানের অ্যালবাম বের হয়। ‘সাব দিন এক সমান নেহিন থা’ গানটি ছাড়াও অ্যালবামটিতে ছিল, ‘বান জাঁও গিয়া কিয়া সে কিয়া মেঁ’, ‘ইস্কা তো কুচ ধিয়ান নেহিঁ থা’-র মতো বিখ্যাত গান। ১৯৪৪ সালে তার গানের অ্যালবাম সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবাম হিসেবে জায়গা করে নেয়।
দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার সুখ্যাতি। এই অ্যালবামের কারণে সমগ্র সঙ্গীত জগতে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। গানে আরও উন্নতি করার জন্য তালাত লাখনউ ছেড়ে কোলকাতায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল গায়ক উস্তাদ বরকত আলী খান, কে. এল সায়গল এবং এম. এ রৌফের মতো তারকাদের সাহচর্য লাভ করেন।
এ সময়ে তিনি চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ লাভ করেন। যেমন- তিনি ‘শিকাস্ট’ সিনেমার জন্য ‘স্বপ্ন কি সোহানি দুনিয়া’ এবং ‘চাঁদনি কি দেওয়ার’ সিনেমার জন্য ‘লাগে তুজ নেইনা’ গানটি গাওয়ার সুযোগ পান। ১৯৪৪ সালে তার গাওয়া ‘তাজভার তেরি দিল মেরা বেহেলা না সাকেজি’ সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফলে তিনি গানের জগতে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান। ফলস্বরূপ তিনি ডাক পান কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে।
গজল গায়ক হিসেবে তার খ্যাতি ক্রমশ দেশের গন্ডি পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম কোনো ভারতীয় গজল গায়ক হিসেবে তিনি বিদেশি কনসার্টে ডাক পান; ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পশ্চিম আফ্রিকার একটি কনসার্টে তিনি গজল পরিবেশন করেন। এরপর আমেরিকার ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন, ব্রিটেনের রয়েল অ্যালবার্ট হল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেন পিয়েরে কমপ্লেক্সসহ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে গজল পরিবেশন করার সুযোগ পান। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি দর্শকদের গজলের আবিষ্টে মোহিত করে রাখেন।
খ্যাতির সাথে সাথে তার ভক্তদের পরিমাণও বাড়তে থাকে, আসতে থাকে অনেক প্রেমের প্রস্তাবও। কিন্তু এক বাঙালি মেয়ে তার হৃদয় চুরি করতে সক্ষম হলেন। সৌভাগ্যবান মেয়েটির নাম লতিকা মল্লিকা। লতিকা নিজেও একজন অভিনয়শিল্পী ছিলেন। ‘কাশিনাথ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে লতিকা আলোচনায় আসেন। পরে আরো অনেক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন। লতিকা দূর থেকেই তালাতের প্রেমে পড়ে যান। কলকাতার কোনো এক অনুষ্ঠানে তালাতের দেখা পেয়ে যান তিনি। সুযোগের মোক্ষম ব্যবহার করেন লতিকা। প্রেমের প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যান তালাত। দুই হৃদয়ে প্রেমের লাল গোলাপ ফোটে। শুধু প্রেম নয়, বরং তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কিন্তু লতিকা ছিলেন খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান, এছাড়া কারো পরিবার তাদের পছন্দের বিষয়টি জানতেন না। ফলে দুজনেই এ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
এমন পরিস্থিতিতে শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকা গেল না। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়লো তাদের গোপন প্রেমকাহিনী। পত্রিকায় সংবাদ প্রচারিত হলো, “গোপনে বিয়ে করছেন তালাত-লতিকা”। প্রমাণস্বরূপ পত্রিকাগুলো তাদের একত্রে তোলা একটি ছবিও ছেপে দিল। তালাতের বাবা লাখনউতে বসে পত্রিকা মারফত এ সংবাদ জানতে পেরে খুবই মর্মাহত হলেন। কিন্তু কী আর করার! ছেলের যখন পছন্দ করেই ফেলেছে! একপর্যায়ে বাবা তাদের সম্পর্ককে মেনে নিলেন। লতিকাকে তিনি পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে আসলেন। লতিকার নতুন নাম দিলেন নাসরিন মাহমুদ। এভাবেই তাদের প্রেমের কলি প্রস্ফুটিত হয়ে যায়। ১৯৫১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের পর লতিকা অভিনয় বাদ দিয়ে সংসারে মনোযোগী হন। ১৯৫৩ সালে খালিদ এবং ১৯৫৯ সালে সাবিনা নামের দুটি সন্তান তারা লাভ করেন।
গজলের পাশাপাশি তালাত মাহমুদ বোম্বে ও কলকাতার প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান। এর মধ্যে ৩টি চলচ্চিত্র ব্যাপক ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করে। গানের ভুবনে তালাত মাহমুদ ৭৪৭টি গানে কন্ঠপ্রদান করেন। তার উল্লেখযোগ্য অ্যালবাম হচ্ছে ‘গোল্ডেন কালেকশন অব তালাত মাহমুদ’, ‘তালাত মাহমুদ ইন অ্যা সেন্টিমেন্টাল মুড’ এবং ‘এভারগ্রিন হিটস অব তালাত মাহমুদ’।
১৯৪৯ সালে তিনি বোম্বে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে কলকাতা ছেড়ে বোম্বে চলে যান। বোম্বে গিয়ে তিনি মিলিত হন ১৯৪০ এর দশকের সবচেয়ে নামকরা সঙ্গীত পরিচালক এমডি অনিল বিশ্বাসের সাথে। এমডি অনিল আগে থেকেই তালাতের কন্ঠের সাথে পরিচিত ছিলেন। ফলে সহজেই তালাত তার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। এরপর তার একের পর এক সফলতা আসতে থাকে। অনেক গান বিখ্যাত হতে শুরু করে। ফলে তার আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কিংবদন্তী এ ‘গজল সম্রাট’ ভারতের একাধিক রাষ্ট্রীয় পদকে লাভ করেছেন। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করেন। এছাড়াও তিনি মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, লতা লতা মুঙ্গেশকর পুরস্কার, আলামি উর্দু কনফারেন্স অ্যাওয়ার্ড, বোম্বে ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড, গালিব অ্যাওয়ার্ড, নওশাদ আলি অ্যাওয়ার্ড, ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড, বেগম আখতার অ্যাওয়ার্ড, লায়ন্স ক্লাব অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৮ সালের ৯ মে ৭৪ বছর বয়সে ভারতের মুম্বাইয়ে এই মহান শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফিচার ইমেজ: talatmahmood.net