১৯০৪ সাল। মিসরের কায়রো। অ্যালিস্টার ক্রোলি নামের এক লোক হঠাৎ দাবি করে বসলেন, মিসরীয় দেবতা হোরাসের এক দূতের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছেন তিনি। সে দেবদূতের নাম আইওয়াস (Aiwass)। আইওয়াস তাকে যা যা বলেছে, সব ক্রোলি লিখে রাখলেন। সে বইয়ের নাম দিলেন দ্য বুক অফ দ্য ল। প্রতিষ্ঠা করলেন থেলেমা নামের এক নতুন ধর্ম, যে ধর্মের নবী দাবি করলেন নিজেকে।
ক্রোলির বিশ্বাস ছিল, হোরাসের যুগের সূচনা করবার জন্য তাকে নাকি নবী করা হয়েছে। আর তার লেখা সে গ্রন্থমতে, মানুষের ইচ্ছে যখন যা হবে তাই করে ফেলাটা উচিৎ (Do what thou wilt)। ‘প্রকৃত ইচ্ছা’র সাথে একাত্মতা পোষণ করতে হবে, আর এটা করার একমাত্র উপায় ক্রোলির মতে- জাদুবিদ্যা। এবং ক্রোলি বলেছেন, জাদুবিদ্যা বলতে হাতের কারসাজি নয়, বরং জাদুমন্ত্রের সে জাদুবিদ্যা, বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কারসাজির ম্যাজিক (Magic) থেকে তার ‘আসল’ ম্যাজিক আলাদা করতে তিনি বানান পরিবর্তন করলেন- Magick। তার নানা কর্মের কারণে বিভিন্ন মিডিয়ায় তাকে বিশ্বের খারাপতম মানুষ উপাধি দেয়া হয়, তাকে বলা হয় শয়তানের পূজারী। কিন্তু কী কারণে এত মানুষের ঘৃণার পাত্র হয়েছিলেন অ্যালিস্টার ক্রোলি?
জন্ম তার ১৮৭৫ সালের ১২ অক্টোবর, ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ারে। তার আসল নাম ছিল এডওয়ার্ড আলেক্সান্ডার ক্রোলি, বাবার নামও এডওয়ার্ড। বাবা এডওয়ার্ড ক্রোলি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও পারিবারিক ব্যবসার কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং কর্ম থেকে অব্যাহতি নেন পুত্রের জন্মের আগেই। এডওয়ার্ড ছিলেন খুব ধার্মিক, প্রতিদিন নাস্তার টেবিলে খাবার পর বাইবেলের একটা করে অধ্যায় পড়ে শোনানো ছিল তার অভ্যেস। ৮ বছরের শিশু অ্যালিস্টার ক্রোলিকে পাঠানো হয়েছিল ক্রিস্টান বোর্ডিং স্কুল হেস্টিংসে। তবে ক্রোলির যখন বয়স ১১, তখনই বাবা মারা যান জিহ্বার ক্যান্সারে। তখনই জীবনের মোড় ঘুরে যায় ক্রোলির।
বাবা ছিলেন তার ‘হিরো’। পৈত্রিক সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ পাবার পর স্কুলে নিয়ম ভাঙা শুরু হয় তার। সেখান থেকে পরিবার তাকে সরিয়ে আরো দুটো স্কুলে ভর্তি করেছিল, দুটোই ছেড়ে দেন তিনি। খ্রিস্টধর্মের বিষয়ে সে বয়সেই তার সন্দেহ জাগে। কিশোর বয়সে তার শিক্ষকদের তিনি বাইবেলের অসঙ্গতি ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে যত রকমের অধার্মিক কাজ সম্ভব তিনি করতে থাকেন, অতিরিক্ত যৌনতায় শেষমেষ গনোরিয়া বাধিয়ে ফেলেন।
ইস্টবর্ন কলেজে পড়বার সময় রসায়ন পড়তেন তিনি। তখনই দাবা, কবিতা আর পাহাড় বেয়ে ওঠায় আগ্রহ জাগে তার। পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণটা আজীবনই রয়ে যায়।
ছাত্র হিসেবে কিন্তু মেধাবী ছিলেন ক্রোলি। কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়তে শুরু করলেন ১৮৯৫ সালে, তিন বছরের কোর্স। তখনই নিজের এডওয়ার্ড নাম বদলে অ্যালিস্টার রাখেন। কেম্ব্রিজে পড়তেন দর্শন। পরে চলে গেলেন ইংরেজি সাহিত্যে। দিনে দু’ঘণ্টা দাবা খেলা তার অভ্যাস ছিল, ছিলেন কেম্ব্রিজের দাবা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। রিচার্ড বার্টন আর পার্সি বিশি শেলির পাড় ভক্ত ছিলেন। চুরানব্বই থেকে আটানব্বই পর্যন্ত প্রতি বছর ছুটিতে আল্পস পর্বত আরোহণে যেতেন তিনি। এরকম এক সময়েই তিনি আবিষ্কার করেন, তিনি আসলে কেবল মেয়ে নয়, বরং ছেলেদের প্রতিও আকৃষ্ট, মোদ্দাকথা তার বাইসেক্সুয়ালিটি তখনই বুঝতে পারেন তিনি। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত যৌনতা থেকে তিনি ইতোমধ্যে সিফিলিসও বাধিয়ে ফেলেছেন। আর তখন সমকামিতা ছিল আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
কেম্ব্রিজের ড্রামা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট পলিটের সাথে তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে যান, কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন হার্বার্ট তার মতো অলৌকিকতায় বিশ্বাস রাখে না, তখন তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। এরকম এক সময়ের কিছু দিন আগে, ক্রোলির মতে, তার এক অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা হয়- স্টকহোমে।
সাতানব্বই সালে তিনি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে যান। তার দাবি ছিল, তিনি ডিপ্লোম্যাট হতে চান সেখানে। কিন্তু সে বছরই তার এ স্বপ্ন বাদ দেন তিনি। তার নতুন স্বপ্ন, জাদুবিদ্যায় মনোনিবেশ করবেন। সে স্বপ্ন এতই প্রবল যে, কেম্ব্রিজের ডিগ্রি নেয়া মাঝপথে বাদ দিয়ে তিনি সব ছেড়ে চলে গেলেন। তার রেকর্ড বলছিল, তার পরীক্ষাগুলোর ফলাফল ফার্স্ট ক্লাস!
এরপর সুইজারল্যান্ডে যাবার পর তার সাথে দেখা হয় রসায়নবিদ জুলিয়ান বেকারের। সেখানে তারা তাদের আলকেমি নিয়ে আগ্রহ বিষয়ে কথা বললেন। বেকারের এক আত্মীয় তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক ডাকিনিবিদ্যা সংক্রান্ত গোপন সঙ্ঘের সাথে, নাম তার Hermetic Order of the Golden Dawn; এ সঙ্ঘের মূলমন্ত্র ছিল- “আমৃত্যু সহ্য করবো।”
ক্রোলি এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। শীঘ্রই তার সঙ্ঘের সিনিয়র সদস্য অ্যালান বেনেটকে আমন্ত্রণ জানালেন তার সাথে বসবাস করতে। না, পার্টনার হিসেবে নয়। বরং, তার জাদু শিক্ষক হিসেবে। বেনেটের কাছ থেকে ক্রোলি শিখলেন সঙ্ঘের নানা সেরেমনিয়াল ম্যাজিক, আর নানা ড্রাগের ব্যবহার তো ছিলই- অন্তত ক্রোলির জীবনী তাই বলে।
গোল্ডেন ডনের নিচু অর্ডার থেকে ক্রোলি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলেন। কিন্তু ভেতরের অর্ডারে ঢুকতে গিয়ে তিনি শত্রুতার মুখোমুখি হলেন, বিশেষ করে তার উভকামিতার কারণে তার নাম খারাপ হয়েছিল। আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের সাথেও তার শত্রুতা হয়ে যায়। শেষমেষ তিনি ঢুকতে পারলেন না। না পেরে গোল্ডেন ডনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্যারিসের মেথার্স নামের একজনের কাছে চলে গেলেন। তার প্রণয়িনী এলাইন সিম্পসনের সহায়তায় লন্ডনের এক উপাসনাস্থান (টেম্পল স্পেস) দখল নিতে যান, কাজটা মেথার্সের হুকুমেই ছিল। কিন্তু ঘটনাটা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, মেথার্সের বিরুদ্ধেই যায় রায়।
১৯০০ সালে ক্রোলি ঘুরতে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর সাময়িক আবাস করে বসলেন মেক্সিকো সিটিতে। সেখানে এক স্থানীয় নারীকে নিজের প্রণয়িনী (মিস্ট্রেস) করে নিলেন। মেক্সিকোতেও তার জাদুবিদ্যা চলতে লাগলো। ষোড়শ শতকের বিখ্যাত ব্রিটিশ গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও ডাকিনিবিদ জন ডি ফেরেশতাদের সাথে যোগাযোগের মহাজাগতিক ভাষা হিসেবে ইনোখিয়ানের কথা বলে গিয়েছিলেন। সেই আদি ইনোখিয়ান ভাষায় মন্ত্রপাঠ শুরু করে দেন ক্রোলি। পরে মেক্সিকোর ত্যাগ করবার সময় জাহাজে মেরি রজার্স নামের এক বিবাহিতার প্রেমে পড়ে যান, সেখানে সংক্ষিপ্ত প্রেমও সেরে ফেলেন। মেরিকে নিয়ে রয়েছে তার কবিতাসমগ্র।
জাপান ও হংকং হয়ে ক্রোলি এরপর এলেন শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলংকার পর ভারত ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ভারতে এসে তিনি যোগব্যায়াম শুরু করলেন। এরপর তিনি বললেন যোগব্যায়ামের মাধ্যমে তিনি ধ্যানের আত্মিক স্তরে পৌঁছেছেন। তবে ম্যালেরিয়ায় কুপোকাত হয়ে কলকাতায় আর রেঙ্গুনে বিশ্রাম করতে হলো তাকে।
১৯০২ সালে আবার পাহাড় বেয়ে উঠবার নেশা ধরলো। K2 তখনো জয় করা হয়নি, সেটাতে উঠতে গিয়ে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জা আর তুষার-অন্ধত্ব বাঁধালেন। ২০,০০০ ফুট উঠে আবার ফিরে যেতে হলো।
এরপর এ উপমহাদেশ ত্যাগ করে ফিরে ফেলেন প্যারিসে। সেখানে তার সাথে দেখা বিখ্যাত গল্পকার উইলিয়াম সমারসেট মমের। ক্রোলির সাথে দেখা হবার পর মম তার দ্য ম্যাজিসিয়ান উপন্যাসের অলিভার চরিত্রটি ক্রোলির উপর ভিত্তি করে লেখেন। পরের বছর, রোজ কেলি নামের বন্ধু জেরাল্ডের বোন রোজ কেলির ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ’ ঠেকাবার জন্য ক্রোলি তাকে বিয়ে করে ফেলেন। জেরাল্ডের সাথে বন্ধুত্ব তার সেখানেই শেষ।
ক্রোলি হানিমুন করতে গেলেন প্যারিস, কায়রো আর শ্রীলঙ্কায়। হানিমুনে আসলেই প্রেমে পড়ে যান জেদের বশে বিয়ে করা রোজের। তাকে নিয়ে লেখেন অনেক কবিতা এই হানিমুনেই।
১৯০৪ সালে কায়রোতে এসে নিজেদের কোনো এক রাজপুত্র আর রাজকন্যা নামের পরিচয় দেন ক্রোলি। সে পরিচয়েই বাসা ভাড়া করে সেখানে জাদুবিদ্যার জন্য উপাসনালয় বানিয়ে ফেলেন। এরপর প্রাচীন মিসরীয় দেব-দেবীদের আহ্বান করতে থাকেন। কায়রোতে থাকা অবস্থাতেই ক্রোলি ইসলামি আধ্যাত্মিকতা আর আরবি জ্ঞান নেয়া শুরু করেন। এরকম একসময়েই (এপ্রিলের ৮ তারিখ) ক্রোলি দাবি করেন তিনি হোরাস দেবতার বাণী পেয়েছেন। তার স্ত্রী তাকে নিয়ে যান কাছের এক জাদুঘরে, সেখানে সপ্তম শতকের আঁখ-এফ-এন-খঁসু ফলক ছিল। দেখা গেলো, সেটি প্রদর্শনীর ৬৬৬ নং নমুনা; ৬৬৬ হলো বাইবেল মতে শয়তানের সংখ্যা। এ ব্যাপারটি ক্রোলি অলৌকিক হিসেবে নিলেন। এ ফলকের নাম দিলেন ‘উন্মোচন ফলক’।
ক্রোলি যে ঐহী বই দাবি করেছিলেন তা অনুযায়ী মানবজাতি এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে, আর ক্রোলি নাকি তার নবী। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী যে যা-ই করুক না কেন, তাই সঠিক, নিষেধ বলে কিছু নেই। ক্রোলির ধর্মের নাম দেয়া হলো থেলেমা (Thelema)। ক্রোলির দাবি, তার পাওয়া গ্রন্থে তাকে অনেক কিছুই করতে বলা হচ্ছিল যেগুলো তিনি করেননি। যেমন, তাকে নাকি বলা হয়েছিল জাদুঘর থেকে ফলকটি উদ্ধার করতে, এক নতুন দ্বীপকে নিজের করে নিতে, গ্রন্থটি পৃথিবীর সকল ভাষায় অনুবাদ করতে।
১৯০৫ সালের দিকে ক্রোলির মনে হলো মেথার্স তার বিরুদ্ধে জাদু করছে, তাই তাদের সম্পর্ক খারাপ হলো। সে বছর ক্রোলির প্রথম সন্তানের জন্ম হলো, তার নাম রাখলেন তিনি লিলিথ- সকল অশুভ আত্মার জননী যে লিলিথ তার নামে।
ক্রোলির ইচ্ছা হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করবেন, কিন্তু দলের অন্যদের সাথে ঝগড়ায় সে আশায় গুড়ে বালি পড়ে। অভিযানের মাঝেই অধীনস্ত অনেকেই মারা যায়, ফলে অভিযান বাদ দিয়ে ফিরে আসতে হয়। এরপর স্ত্রী রোজ আর মেয়ে লিলিথকে কলকাতা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়, কারণ এক ছিনতাইকারীকে ক্রোলি গুলি করে হত্যা করেন। কলকাতা ত্যাগ করে তারা চীন ভ্রমণে যান, পুরো ভ্রমণ জুড়ে তিনি আফিম ফুঁকছিলেন।
চীন ভ্রমণ সেরে ইউরোপে ফিরলেন লিলিথ আর রোজ, কিন্তু ক্রোলি গেলেন সাংহাই। সেখানে পুরনো প্রেমিকা এলাইন থমসন তার স্বপ্নে পাওয়া বুক অফ ল বই পড়ে মুগ্ধ। একত্রে তারা বিশেষ কিছু জাদুবিদ্যা করবার চেষ্টা করলেন হোরাসের দূতকে আহ্বান করতে।
সাংহাই থেকে জাপান, কানাডা আর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ করলেন ক্রোলি। এরপর ব্রিটেনে ফিরে জানলেন, তার মেয়ে লিলিথ মারা গেছে রেঙ্গুনে টাইফয়েডে। তিনি এর জন্য কোনোভাবে স্ত্রী রোজের মাতলামিকে দায়ী করলেন। মানসিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পাশাপাশি তার স্বাস্থ্যও খারাপ হলো, অনেকগুলো অপারেশন করতে হলো। ওদিকে এক অভিনেত্রী আর এক লেখিকা- এ দুজনের সাথে প্রেম চালিয়ে যেতে লাগলেন। এরকম সময়েই ক্রোলির দ্বিতীয় কন্যা লোলা জাজার জন্ম হলো, ১৯০৭ সালে।
পুরনো জাদুশিক্ষক জর্জ জোন্সের সাথে ক্রোলি জাদু চালিয়ে যেতে লাগলেন। আদি হিব্রু বুক অফ আব্রাহামের জাদুচর্চা সেরে ফেললেন দুজন। তবে তিনি হাশিশ মাদক নিতেন জাদুর সময়, হাশিশ না নিলে নাকি আধ্যাতিকতার চরমে পৌঁছানো যায় না। সে বছরই তিনি দাবি করেন, হোরাসের দূত আবার বাণী নিয়ে এসেছে। নতুন বইগুলোর নাম হলো The Holy Books of Thelema।
ক্রোলির বাপ-দাদার সম্পত্তি শেষ হয়ে আসছিল, টাকা তো উপার্জন করা দরকার এবার। তখন ট্যাঙ্কারভিলের আর্ল জর্জ বেনেট তাকে ভাড়া করলেন জাদুবিদ্যা থেকে তাকে প্রতিরক্ষা দেবার জন্য। আসলে বেনেটের কোকেন আসক্তি ছিল, সেটা থেকেই আজব সব ভীতি তাকে ধরে বসে। কিন্তু আয় হচ্ছিল ক্রোলির, এটাই বড় কথা। বেনেটের টাকায় ক্রোলি তাকে নিয়েই ফ্রান্স আর মরক্কো ঘুরে আসেন অসুখ সারানোর নাম করে।
১৯০৭ সালে ক্রোলি ছাত্র পড়ানো শুরু করেন, জাদুবিদ্যা শেখাতেন। তার সবচেয়ে কাছের শিষ্য ভিক্টর ন্যুবার্গ তার শয্যাসঙ্গীও ছিলেন। তারা Sadomasochism (ব্যথা প্রদানের মাধ্যমে যৌনসুখ অর্জন) চর্চা করতেন। সেই সাথে জাদুবিদ্যা নিয়ে তার লেখালেখিও চলছিল সমানতালে। তবে রোজের মাতলামির জন্য ১৯০৯ সালে তাকে ক্রোলি তালাক দিয়ে দেন।
এরপর থেকে আলজেরিয়ার নানা মরুভূমিতে ঘুরতে থাকেন ক্রোলি- এল আরবা, বৌসাদা, দালেহ আদ্দিন ইত্যাদি। এ সময় প্রতিদিন ক্রোলি কোরআন তিলাওয়াত করতেন বলে তার জীবনী বলে থাকে। পুরো মরুভ্রমণ জুড়ে তিনি নাকি এনোখিয়ান জাদুবিদ্যামাফিক দৃশ্যমান জগতের বাহিরের অদৃশ্য জগতের ত্রিশটি স্তর (Aethyrs) ভেদ করেন। এছাড়া পাহাড়চূড়ায় নিজের উদ্ভাবিত যৌনজাদু করেন তিনি। একইসাথে ‘ব্লাড স্যাক্রিফাইস’ এর মাধ্যমে প্রেতাত্মা কোরোনজোনকে আহ্বান করেছিলেন বলে বর্ণনা আছে। এ মুহূর্তটি ক্রোলির জাদু-ক্যারিয়ারের চরমতম মুহূর্ত ছিল বলা হয়। এ অভিজ্ঞতাগুলো The Equinox-এ প্রকাশিত হয়।
কিন্তু এগুলো প্রকাশিত হবার পর সেগুলোকে গোল্ডেন ডনের গোপন ব্যাপার দাবি করে মেথার্স ক্রোলির নামে মামলা করে দেন। এ মামলাটি মিডিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। ক্রোলি তখন একজন শয়তানপূজারী বা স্যাটানিস্ট হিসেবে পরিচিত হন। ক্রোলি নিজেও ব্যাপারটা উপভোগ করছিলেন, যদিও নিজের মতে তিনি স্যাটানিস্ট ছিলেন না। নরবলির মিথ্যা অপবাদও তাকে দেয়া হয়। তবে মামলায় জেতেন ক্রোলিই।
তবে নতুন পাওয়া এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগান তিনি। ১৯১০ সালের অক্টোবরে ওয়েস্টমিন্সটারের ক্যাক্সটন হলে তিনি মঞ্চায়িত করেন Rites of Eleusis নামের এক প্রদর্শনী। এবার পত্রিকাগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিল। দ্য লুকিং গ্লাস পত্রিকার মতে, “ক্রোলি আধুনিক যুগের সবচেয়ে ধর্মবিরোধী ও ঠাণ্ডা মাথার খলনায়ক।” পত্রিকায় আরো বলা হয় ক্রোলি আর তার শিক্ষক জোন্স একে অন্যের সমকাম সঙ্গী। এতে ক্রোলির কিছু যায় না আসলেও জোন্স মামলা করে দেন। মামলা টেকেনি অবশ্য।
তবে ১৯১৪ সালের দিকে ক্রোলির অবস্থা দিন আনে দিন খায় হয়ে গেল। এ সময় তিনি চলে গেলেন নিউ ইয়র্কে, কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি ভ্যানিটি ফেয়ারের জন্য লিখে টাকা উপার্জন করতেন, আর নিজের আবিষ্কৃত ‘যৌনজাদু’ চর্চা করতেন নানা পতিতা কিংবা তুর্কি গোসলখানার পুরুষদের সাথে। সবগুলো বর্ণনা তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন।
তার শিখর থেকে পতন হতে সময় লাগেনি বেশি, পরের বছরগুলো যাযাবরের মতোই চালিয়ে গেছেন। একবার এ দেশ, তো আরেকবার অন্য দেশ। যেখানেই যেতেন তিনি তার জাদুবিদ্যা চালিয়ে যেতেন, মাঝে একবার পেইন্টিংকে শখ হিসেবে নিয়েছিলেন। খুঁজেছেন সঙ্গী আর সঙ্গিনী, এমনকি তার এক সঙ্গিনীর গর্ভপাতও হয়েছিল। এ ঘটনাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত চলে।
যখন ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, ক্রোলি তখন নিজে চাইলেও নৌবাহিনী তাকে নিতে চায়নি। এরপর তিনি দাবি করেন, চার্চিলের বিখ্যাত দু’আঙুল দিয়ে ‘V’ বিজয় চিহ্নটি তিনিই শিখিয়েছেন, তবে তিনি এটি প্রমাণ করতে পারেননি।
পরের বছর তার অ্যাজমা বেড়ে যায়, কিন্ত ওষুধ না পেয়ে তিনি হিরোইন নিতে শুরু করেন, এবং একপর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেন। অ্যাজমা ভালো হবার পর তিনি জন সাইমন্ডস নামের একজনকে সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু তিনি তাকে বেতন দিতেন না, বেতনের বদলে দিতেন ‘জাদুশিক্ষা’। স্পষ্টত, সাইমন্ডস এর সেটা আদৌ পছন্দ হয়নি। পরে ক্রোলির সমালোচনা করে জীবনী প্রকাশ করেন সাইমন্ডস।
শেষ বয়সে তার পাশে ছিলেন তার ছেলে অ্যালিস্টার আতাতুর্ক। ১৯৪৭ সালের ১ ডিসেম্বর ক্রোলি মারা যান ফুসফুসজনিত দহনে। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ১২ জন মানুষ জড়ো হন, তার বুক অফ দ্য ল থেকে কিছু শ্লোক পড়া হয়। আর, পৌত্তলিক দেবতা প্যানের প্রতি স্তুতিবাক্য পাঠ করা হয়। ট্যাবলয়েডগুলোতে ব্ল্যাক মাস হিসেবে এ অনুষ্ঠানকে নাম দেয়া হয়। অন্যান্য পত্রিকাতেও সমালোচনা হয়। ক্রোলির দেহ দাহ করার পর ভস্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়, এবং সেখানে নিউ জার্সির হ্যাম্পটনে এক বাগানের মাটি খুঁড়ে রাখা হয়।
২ জুলাই ১৯৩৩ সালে তার লেখা একটি রচনা প্রকাশিত হয় লন্ডন সান্ডে ডিসপ্যাচে। তিনি সেখানে লেখেন, “কালো জাদু কোনো অবাস্তব কিছু নয়, এটি আসলে জাদুরই এক আবেগী রূপ, বিজ্ঞান যাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু এর ফলাফল ক্ষণিকের জন্য হলেও বাস্তব। কালো জাদু করতে হলে আপনাকে বিজ্ঞান আর নৈতিকতার সকল নীতি ভাঙতে হবে।”
পপ কালচারে ক্রোলির প্রতি আছে বেশ কিছু ট্রিবিউট। বিটলসের Sgt. Pepper’s Lonely Hearts Club Band অ্যালবামের কভারে আছে ক্রোলির ছবি। আর ক্রোলির থেলেমা ধর্মের মূল কথা ‘do what thou wilt‘ স্থান পেয়েছে লেড জেপেলিনের Led Zeppelin III vinyl-এ। ডেভিড বাওয়ি তার গানের কথায় ক্রোলিকে ‘কুইকস্যান্ড’ (চোরাবালি) এর সাথে তুলনা করেছেন। আর, অজি অজবর্ন ক্রোলিকে নিয়ে গানই করেছেন ‘মিস্টার ক্রোলি’ নামে।
অ্যালিস্টার ক্রোলির কখনো আক্ষেপ ছিল না যে তাকে মানুষ খারাপ বলে। তার ইচ্ছে ছিল কেবল নিজের মতো জাদুচর্চা চালিয়ে যাবার। কোনোরকম নৈতিকতার ধার তিনি কখনোই ধারেননি বা ধারতে চাননি। তাই অবাক হবার কিছু নেই যে তাকে শতাব্দীর খারাপতম মানুষ ডাকা হতো।
ফিচার ফটো: Those Conspiracy Guys