সমুদ্রের গর্জনের মাঝে ইউসরা শুনতে পাচ্ছিল নৌকা থেকে আসা প্রার্থনার শব্দ। নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ। আফগান যুবকটি প্রাণপন চেষ্টা করছে সেটা চালু করার। নিষ্প্রাণ নৌকাটি ভূমধ্যসাগরে অনেকগুলো অসহায় প্রাণ নিয়ে একা ভেসে বেড়াচ্ছে আর প্রতিটি ঢেউয়ের কাছেই নিজেকে আত্মসমর্পণ করছে। যতবারই ঢেউ আঘাত করছে, প্রার্থনার শব্দ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল।
নৌকার পাশের রশিটি শক্ত করে চেপে ধরে সাঁতরাচ্ছে ইউসরা। পাশেই বড় বোন সারাহ যে তখনও তাকে বলছিল নৌকায় ফিরে যেতে। কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত করছে না ইউসরা। মাথা নৌকার দিকে তাকাতেই প্রার্থনারত মানুষদের মাঝে শিশু মুস্তাফার চেহারাটা চোখে পড়ল। সে হাসছে। পুরো বিষয়টি হয়ত তার কাছে কোনো এক মজার খেলার মতোই মনে হচ্ছে। কারণ সে জানে না এই সমুদ্র কত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কত মানুষ এক যুদ্ধকে পেছনে ফেলে নিরাপদ জীবনের লক্ষে এই সমুদ্রের বিপক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টার আরেক যুদ্ধে হার মেনেছে।
নির্দয় এই সাগরের বুকে যখন হঠাৎ করে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ইউসরার মনে হয়েছিল তাকেও হয়ত তাদের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। নৌকাটি এত মানুষের ভার বেশিক্ষণ বইতে পারবে না দেখে পানিতে নেমে যায় মুহান্নাদ এবং সারাহ। উদ্দেশ্য একটাই, নৌকাটি যতটা সম্ভব হাল্কা রাখা। নৌকায় প্রার্থনারত মানুষদের আতংকিত চেহারা দেখে ইউসরা বুঝতে পারলো এভাবে ভীতুর মতো বসে থাকলে হবে না, সেও তার বোনের মতোই একজন সাঁতারু। তাকেও কিছু একটা করতে হবে। তাই সে বোনের নিষেধ আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পানিতে লাফিয়ে পড়ে।
আরেকটি ঢেউ, আরো তীব্র আর্তনাদ। বিষয়টাকে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল ইউসরার। কিন্তু একসময় দুঃস্বপ্নেরও ইতি ঘটে। আরো শক্ত করে রশিটি চেপে ধরলো। সে বুঝতে পেরেছে নৌকার একজন মানুষের কোনো ক্ষতি হলে সে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সে একজন সাঁতারু, তাই আজ কোনভাবেই হার মানা যাবে না।
২০১৫ সালে ভূমধ্যসাগরের এই দূঃসাহসিক অভিজ্ঞতার আগে ইউসরা মারদিনি ছিল একজন সাধারণ সিরিয়ান কিশোরী। অন্য সবার মতো তারও ব্যস্ত দিন কাটত স্কুলে, হাসি গল্পে মেতে থাকত বন্ধুদের আড্ডায়। সিরিয়ার আকাশ তখন ছিল মুক্ত, রাস্তাগুলো ছিল নিরাপদ। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ছোট শহর সেট জায়নাবে ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ ইজ্জাত এবং মারভাত মারদিনির কোলে আসে তাদের দ্বিতীয় সন্তান ইউসরা মারদিনি। জন্ম সেট জায়নাবে হলেও সে বেড়ে উঠে দারায়াতে।
সাঁতারু পরিবারে জন্ম, তাই সাঁতারের সাথে ইউসরার আলাদা করে পরিচিত হবার কোন প্রয়োজন হয়নি। তার বাবা ইজ্জাত মারদিনি মিলিটারিতে যোগ দেয়ার আগে সাতরিয়েছেন সিরিয়ার জাতীয় দলের হয়ে। পরে তিনি আবার সুইমিং পুলে ফিরে আসেন একজন সাঁতারের কোচ হিসেবে। বাবার হাত ধরে চার বছর বয়সী ইউসরা ও তার বড় বোন সাত বছর বয়সী সারাহ যোগ দেয় সাঁতার প্রশিক্ষণে। ইজ্জাত স্বপ্ন দেখতেন তার সন্তানরা হয়ে উঠবে বিশ্বের সেরা সাঁতারু, অথবা সেরাদেরও সেরা। সেই স্বপ্ন পূরণে যা যা প্রয়োজন সব করতে প্রস্তুত ছিলেন ইজ্জাত। সেজন্য মেয়েদের প্রশিক্ষণ নিয়ে বেশ কঠোর ছিলেন তিনি। বাবার চোখ ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা যে করেনি ছোট ইউসরা তা নয়। কিন্তু সে সফল হয়নি।
ইজ্জাত মারদিনির নির্দেশ, বাসায় তাকে বাবা ডাকলেও পুলে তাকে কোচ বলেই ডাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি সবসময় তাদের কোচ ছিলেন। পুল হোক বা বাসা, ট্রেইনিং কখনোই থেমে থাকতো না। ছুটির দিনেও অনুশীলন চলত কখনো ইলাস্টিক ব্যান্ড নিয়ে, কখনো বা টিভির সামনে। হোক সেটা চ্যাম্পিয়ানস লিগ, উইম্বলডন বা অলিম্পিক, ইজ্জাত তার মেয়েদেরকে নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়তেন এবং অ্যাথলেটদের আলাদা কৌশলগুলো তাদের দেখিয়ে দিতেন।
২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে পুরুষদের ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ের ফাইনালের সময়ে বাবার সাথেই বসে ছিল দুইবোন। সেদিন ফেলপস প্রথমদিকে পিছিয়ে থাকলেও একেবারে শেষ মুহুর্তে সবাইকে অবাক করে মাত্র ০.০৪ সেকেন্ড ব্যবধানে জয়ী হয়ে স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয় স্বদেশি ক্রুকারের কাছ থেকে। এর আগে ইউসরার সাঁতারু হবার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। সে চেয়েছিল পাইলট হতে। কিন্তু ফেলপসের এই জয় আর উদযাপনে সে বুঝতে পারে এতদিনের পরিশ্রম বা ত্যাগ এই জয়ের আনন্দের কাছে কিছুই না। তার পুরো শরীর এবং মন নতুন এক উদ্দীপনায় জেগে উঠে, সেও হবে একজন সাঁতারু, সেও জয় করবে অলিম্পিক।
স্কুলে ভর্তি হবার সাথে সাথেই শুরু হয় পেশাদার সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ। যার অর্থ প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর সরাসরি সুইমিং পুলে এবং সেখানে টানা দুই ঘন্টার প্রশিক্ষণ। স্কুলে ব্যস্ত দিন কাটানোর পর আবার সুইমিং পুলে যেতে মাঝেমধ্যে ইউসরার মোটেই ইচ্ছা করত না। কিন্তু বাবার কঠোর দৃষ্টির সামনে সেই ইচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। যদিও আস্তে আস্তে পরিশ্রমের ফল আসতে থাকে। ইউসরা জায়গা করে নেয় সিরিয়ান ইউথ টিমে, আর বারো বছর বয়সী সারাহ প্যান আরব গেইমসে জাতীয় দলে সূযোগ পায়। সেখানে সারাহ এবং তার দল রিলেতে রৌপ্য অর্জন করে সিরিয়াকে পদক তালিকায় পঞ্চম স্থান এনে দেয়। দেশে ফেরার পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পদক জয়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করে যাদের মধ্যে সারাহ ছিল সর্বকনিষ্ঠ। কিন্তু ইজ্জাত এই সাফল্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তার মতে তাদের হতে হবে সবার সেরা, তাদের স্বপ্ন হতে হবে অলিম্পিক জয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে এথলেটের স্বপ্ন অলিম্পিক নয়, সে কোনো এথলেটই নয়। বাবার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে অলিম্পিক জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দুই বোন। কিন্তু সেই স্বপ্নে হানা দেয় এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
টিভি চালু করলেই তখন কেবল লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ আর তাতে প্রাণহানীর খবর। ২০১১ সালের শুরুতেই তিউনিশিয়া, মিশরের পর এবার লিবিয়া, একটা অজানা আতংক ভর করেছিল ইউসরার মনে। কিন্তু তার বাবা অভয় দিয়ে বলতেন এমন কিছুই হবে না সিরিয়ায়। সিরিয়া শান্ত, প্রতিটি মানুষ নিজের জীবন নিয়ে সুখী, এমনটা কেন করতে যাবে?
কিন্তু সিরিয়া অশান্ত হতে সময় নেয়নি। আন্দোলন শুরু হয়, যা একসময় রূপ নেয় গোলাগুলি আর বিষ্ফোরণে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন হয়ে উঠে অসম্ভব। বাতাসে শুধুই আতংক। কারণ ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকলেই হারাতে হতে পারে প্রাণ। এসব কিছুর মাঝেই নিজের স্বপ্ন পূরণের রাস্তায় হাঁটতে থাকে ইউসরা। সবকিছু ভুলে থেকে মনোযোগ দিতে থাকে সাঁতারে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জায়গা করে নেয় সেবছরের ‘চিল্ড্রেন অফ এশিয়া গেমসে’। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই গেমসে ইউসরা আর তার দল ১০০ আর ২০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ জয় করে। কিন্তু প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো আসরে পদক জয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে যায় দেশে ফেরা মাত্রই।
২০১২ সালে দারায়াতে সরকারের আধাসামরিক বাহিনী নিয়োগের পর বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধে পুরো শহর তছনছ হয়ে যায়, মারা যায় কয়েকশত মানুষ। একবার বিদ্রোহিরা ভুল করে ইজ্জাত মারদিনিকে তুলে নিয়ে যায়, সেখানে অল্পের জন্যে তিনি বেঁচে যান। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল তাদেরকে সবকিছু ছেড়ে দামেস্কে চলে যেতে হয়।
আমি কখনোই আমাদের সেই বাসায় ফিরে যেতে পারিনি। শুনেছি সেটি নাকি যুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের ছোটবেলার সকল ছবি, খেলনা, মায়ের হাতে বানানো ছোট ছোট জামা, আমাদের শৈশবের সকল স্মৃতি ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে গিয়েছে।
এক, দুই করে কেটে গেল চারটি বছর, কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। কেউ জানে না কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এই সংঘাতে, যেখানে জাতিসংঘ ২০১৪ সালে প্রাণহানির তথ্য নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ইউসরার দলের দুজন সাঁতারু এবং তার পরিচিত এক ফুটবলার মারা যায় বোমা হামলায়। দামেস্কের যে সুইমিং পুলে সে প্রশিক্ষণ নিত, সেখানেও বোমা আছড়ে পড়ে। জীবন পুরোই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ঘর থেকে বের হবার সময় সবার সাথে এমনভাবে বিদায় নিত হতো যেন এটাই তাদের শেষ দেখা। এর মধ্যেই ইজ্জাত মারদিনি সুইমিং কোচের চাকরিতে চলে যায় জর্ডান। বাবা পাশে না থাকায় আগের মতো মনোবল সঞ্চার করতে পারেনি ইউসরা। তাই একসময় সাঁতারও ছেড়ে দেয় সে।
আস্তে আস্তে ইউসরা এবং সারার উপলব্ধি হল, এই যুদ্ধ আর অনিশ্চয়তার মাঝে থাকা মানে জীবন আর ভবিষ্যতকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া। তারা দুজনেই সিরিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক পদক জিতেছে। অর্থাৎ তারা সুযোগ পেলে আরো বড় কিছুটা একটা করে দেখাতে পারবে। কিন্তু এই যুদ্ধের মাঝে পড়ে থাকলে সেটা কখনোই সম্ভব হবে না। দুবোন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এই মৃত্যুপুরিতে তারা আর থাকবে না। তাদের বন্ধু এবং প্রতিবেশিরা একে একে সবাই অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছিল। তাদের সমবয়সী অনেকেই শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি অনেক সিরিয়ান শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে। সারাহ-ইউসরা ঠিক করলো তারা যাবে জার্মানি। তারা দুজনেই জানে এই যাত্রা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু এটি বাদে মুক্তভাবে বেঁচে থাকার কোনো পথ খোলা নেই।
আমি হয়ত জার্মানি পৌঁছানোর আগেই মারা যেতে পারি। কিন্তু নিজ দেশেই আমি মৃতপ্রায়। আমি এখন যেকোন কিছুই করতে পারি।
তাদের বাবা প্রথমদিকে এই সিদ্ধান্তে সম্মত হন না। শেষে তাদের দুজন আত্মীয় নাবিহ-মাজেদ, যারা একই পথে জার্মান যাবে, তাদের সাথে মেয়েদের পাঠাতে রাজি হন। তাদের সাথেই ২০১৫ সালের ১২ ই আগষ্ট ইউসরা এবং সারাহ অস্রুসিক্ত চোখে মা এবং ছোট বোন সাহেদকে বিদায় জানিয়ে রওনা দেয় লেবাননের দিকে। বাবা-মাকে তারা শিখিয়ে দেয় যদি তারা যোগাযোগ করতে না পারে তাহলে কীভাবে জিপিএসের মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানতে পারবে। লেবানন থেকে তুরস্কে যাওয়ার পর তারা একই পথ অনুসরণ করবে যে পথে তাদের মতোই ৪০ লক্ষ মানুষ সিরিয়া ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
তুরস্কের পর তাদের গ্রিক কোস্টগার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে লেসবোসের রাজধানী মাইটিলিনে। এজন্য তারা ইস্তানবুলে যোগাযোগ করে এক স্মাগলারের সাথে। সেই স্মাগলার তাদের নিয়ে আসে ইজমির শহরে যেখানে তারা পরিচিত হয় মুহান্নাদ, খালিল, মুস্তাফা, ইদ্রিসসহ আরও অনেক শরণার্থীর সাথে যাদের গন্তব্যও জার্মানি। সমুদ্র পাড়ি দিতে সঠিক সময়ের অপেক্ষায় তুরস্কের সমুদ্র সৈকতের পাশের বনে খাবার বাদে শুধু চকলেট খেয়ে তাদের থাকতে হয়েছে চারদিন।
অবশেষে পঞ্চম দিনে স্মাগলারেরা ছোট একটা নৌকায় সবাইকে তুলে রওনা দেয় লেসবোসের দিকে। নৌকা চালানোর দায়িত্বে থাকা আফগান যুবকটি যখন ইঞ্জিন চালু করে তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউসরা গুণে দেখে নৌকায় মোট যাত্রী ২২ জন, যেখানে এই নৌকায় ১০ জনের বেশি মানুষ উঠাই বিপজ্জনক। বোঝাই যাচ্ছে এই নৌকা এত মানুষের ভার সহ্য করতে অভ্যস্ত নয়। গন্তব্য বেশি দূরে না, মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ। কিন্তু ২০ মিনিট যেতে না যেতেই হঠাৎ ইঞ্জিনটি বন্ধ হয়ে যায়।
ইঞ্জিনের শব্দ থামার পর ভারি হয়ে উঠে প্রার্থনার আওয়াজ। নৌকায় বেশির ভাগই নারী আর শিশু যাদের কেউই সাঁতার জানে না। সবাই নিজের ব্যাগ, জুতা ছুড়ে ফেলে দেয় যাতে নৌকাটা একটু হলেও হাল্কা হয়। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শেষে আর কোন উপায় না দেখে মুহান্নাদ নৌকার পাশের রশি চেপে ধরে সমুদ্রে নেমে পড়ে। তার দেখা দেখি নেমে পড়ে সারাহ। এতে নৌকা কিছুটা হাল্কা হয় কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ইউসরা চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় সবার মুখেই আতংক। সবাই সবার আপনজনকে জড়িয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে। ঢেউয়ের আঘাতে যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারে এই নৌকা। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা নয়। আতংক ফেলে বাঁচতেইতো এত পথ পাড়ি দেয়া। অথচ এখন মনে হচ্ছে তাদের জীবন অনেক বেশি তুচ্ছ আজ।
বোনের সাহসীকতায় ইউসরা তার মনোবল ফিরে পেল। এভাবে শিশুর মতো বসে কান্না করার কোনো মানে নেই যেখানে সে একজন সাঁতারু। তাই সে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে একপলক সাগরের দিকে তাকালো। কিছুটা ভয় আছেই কারণ এমন পানিতে আগে কখনো সাঁতরায়নি ইউসরা। তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সারাহ ধমক দিয়ে বললো চুপচাপ নৌকায় বসে থাকতে। কিন্তু বোনের ধমক কানে না নিয়ে সেও ঝাপিয়ে পড়ে সাগরের জলে।
ইউসরা বুঝতে পারছিল সুইমিং পুলে শান্ত জলে সাঁতার আর সমুদ্রে ঢেউয়ের বিপক্ষে সাঁতারে অনেক পার্থক্য। প্রতিটি ঢেউয়ের সাথেই লড়াই করতে হচ্ছে তাকে। নোনা জলের কারণে চোখ জ্বালা করছে যার কারণে চোখ বেশিক্ষণ খুলে রাখতে পারছে না সে। তারপরেও ঢেউয়ের মাঝে হাল্কা মাথা তুলতেই দূরের সেই দ্বীপটি চোখে পড়লো। তার মনে হচ্ছে যতই সময় গড়াচ্ছে দ্বীপটি ততই দূরে সড়ে যাচ্ছে। সূর্য অস্ত যেতেও বেশি দেরি নেই। সারাহ আর ইউসরা বাদে কেউই সাঁতারু নয়, যে কারণে তারা বেশিক্ষণ পানিতে থাকতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পর পর একজন বোটে উঠছে, তার পরিবর্তে আরেকজন পানিতে নামছে। কিন্তু সারাহ-ইউসরা বিরতিহীন ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে।
এভাবেই কেটে গেল তিন ঘন্টা। এতক্ষণ পানিতে থাকতে থাকতে একসময় হাত পা অসাড় হয়ে এল ইউসরার। এখন শুধু রশি আর লাইফজ্যাকেটই তাকে পানির উপর ভাসিয়ে রাখছে। একই অবস্থা সারাহরও। আর থাকতে না পেরে তারা দুজনেই পানি থেকে উঠে আসে। প্রচণ্ড শীতে কাঁপছিল দুবোন। একটু পরেই সবাইকে অবাক করে চালু হয়ে যায় ইঞ্জিন। ভীত সকলের মাঝেই বেঁচে থাকার নতুন আশা সঞ্চার হলো। নৌকা জুড়ে সবাই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। কোনো প্রকার সমস্যা বাদে নৌকা তাদের পৌঁছে দিল গ্রিক ভূখণ্ডে।
গ্রিসে পৌঁছানোর পর ইউসরা বুঝতে পারল তাদের পরিচয় এখন শরণার্থী এবং তারা বর্তমান বিশ্বের অনেক বড় ‘শরণার্থী সংকটের’ একটি অংশ। অনেকেই যে শরণার্থীদের কিছুটা ভিন্ন চোখে দেখে তা নজর এড়ায়নি তার। কেউ কেউ তাদের জামাকাপড় বা আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে আবার অনেক রেস্টুরেন্ট তাদের কাছে খাবার এমন কি পানি বিক্রি করতেও রাজি হয়নি। ইউসরা দেখতে পায় গ্রিসেই তাদের মতো ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রবেশের জন্য হাজার হাজার শরণার্থী অপেক্ষা করছে ।
গ্রিস থেকে তাদের যাত্রা মেসেডোনিয়া হয়ে সার্বিয়া। এরপরেই সবচাইতে কঠিন পথ। জার্মান যেতে তাদের পার হতে হবে হাঙ্গেরি। এদিকে হাঙ্গেরি সরকার শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিপক্ষে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, যতো বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হবে দেশটিতে সন্ত্রাসের ঝুঁকি ততই বাড়বে। সেজন্য তারা সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশির সাথে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। এছাড়া সীমান্তে প্রবেশ ঠেকাতে বাড়তি নজরদারির অংশ হিসেবে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের কাছে ধরা পড়লে জেলেও যেতে হতে পারে আর তাতে তাদের জার্মান যাওয়ার স্বপ্ন সেখানেই শেষ হতে পারে। তাই যে করেই হোক সীমান্ত পার হবার সময় পুলিশের নজরে পড়া যাবে না।
সারাহ-ইউসরাসহ আরো বেশ কয়েকজন মিলে যখন সীমান্ত পার করার পরিকল্পনা করছিল তখন তাদের সাথে দেখা হয় জার্নালিস্ট লাম এবং ম্যাগডালিনার সাথে। তারাও শরণার্থীদের সাথে এক হয় এবং সবাই মিলে একটি শষ্যক্ষেতে লুকিয়ে থাকে আর সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে। বিষয়টা খুব অপমানজনক মনে হয় ইউসরার কাছে।
আমি মাটির দিকে চোখ স্থির করে রেখেছিলাম। কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কারণ এই অবস্থাটি খুবই অপমানজনক। আমরাতো মানুষ, কোনো জীব জন্তু না। কিন্তু এই যে আমরা অপরাধীর মতো লুকিয়ে আছি, এবং পুলিশ আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। সু্যোগ পাওয়া মাত্রই সবাই দৌড় দেয় সীমান্তের দিকে এবং কোন সমস্যা বাদেই সীমান্তে প্রবেশ করে। তাদের এই দলে দুটি শিশু ছিল যাদের একজনের দায়িত্ব নেয় সারাহ এবং তাকে কোলে করেই দৌড়াতে হয় তাকে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাঙ্গেরিতে প্রবেশ মানেই কিন্তু সমস্যার শেষ নয়। তাদেরকে আবার একইভাবে হাঙ্গেরির সীমান্ত পার হয়ে পৌঁছাতে হবে অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ায় পৌঁছাতে পারলেই জার্মানি হাতের নাগালে।
আবারও স্মাগলারদের হাতে মোটা অংকের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে তাদের মাধ্যমে বুদাপেস্ট পৌঁছায় ইউসরারা। সেখানে তাদের দল ভেঙ্গে যায়। কেউ পায়ে হেঁটে আবার কেউ স্মাগলারদের মাধ্যমে সীমান্ত পারের সিদ্ধান্ত নেয়। ইউসরাদের পরিকল্পনা ছিল কেলেতি রেলস্টেশন থেকে অস্ট্রিয়াগামী ট্রেনে চেপে সরাসরি ভিয়েনায় যাওয়া। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন সরকার এত বাড়তি শরণার্থীর চাপ সামলাতে কেলেতি রেলস্টেশন বন্ধ করে দেয়। ফলে রেলস্টেশনেই জার্মানগামী হাজার হাজার শরণার্থীর সাথে আটকা পড়ে ইউসরার দল। কয়েকদিন পর স্টেশন খুলে দিলেও সেটায় নিয়মিত পুলিশ টহল দিত। নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে অনেক ঝুঁকি নিয়ে তারা টিকেট সংগ্রহ করে ট্রেনে চাপে। কিন্তু এবার ভাগ্য আর সহায় হয়নি। হাঙ্গেরিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তারা। তারপর পুরো একদিন তাদের জেলে থাকতে হয় যেটা আদতে একটি আস্তাবল ছিল। তাদের নাম, ছবি এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পরদিন আবার তাদের ছেড়ে দেয়। এরমধ্যেই হাঙ্গেরিয়ান সরকার বিনামূল্যে কিছু বাসের ব্যবস্থা করে যেগুলো কেলেতি স্টেশনে আটকা পড়া শরণার্থীদের অস্ট্রিয়া সীমান্তে পৌঁছে দেবে। সেই বাসে চেপেই হাঙ্গেরির দূঃসহ স্মৃতি পার করে তারা অস্ট্রিয়াতে পৌঁছায়।
অস্ট্রিয়ায় পৌঁছানোর পর সম্পূর্ণ উলটো দৃশ্য দেখতে পেল ইউসরা। মানুষ রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে ফুল ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের আমন্ত্রণ জানাতে। ইউসরা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এই মানুষগুলো তাদের সাহায্য করতে চায়। আনন্দে তার চোখে অশ্রু চলে আসে। বাস থেকে নামার পর সেচ্ছাসেবকের দল তাদের হাতে চা, স্যান্ডউইচ এবং পানির বোতল তুলে দেয় এবং সবাইকে একটি করে গোলাপ উপহার দিয়ে নিজ দেশে স্বাগতম জানায়। সারাহ গোলাপ হাতে নিয়েই সারাহ হাসিমুখে ইউসরার দিকে তাকায়, মুহুর্তেই তাদের চেহারা থেকেই সেই আতংক আর দুশ্চিন্তা চলে যায়। অস্ট্রিয়া থেকে পরদিন ট্রেনে চেপে তারা জার্মানি পৌছায়। সেদিন ছিল ৭ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ জন্মভুমি ছাড়ার ২৫ দিন পর তারা পৌছাতে পেরেছে জার্মানিতে। তারা লড়েছে সাগরের সাথে, সীমান্তের সাথে, সহ্য করেছে শরণার্থীদের দিকে ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টি। অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল ইউসরা।
বার্লিনের শরণার্থী শিবিরে ইউসরা কাটিয়েছে ছয় মাস। সেখানেই এক মিশরীয় অনুবাদকের সাহায্যে ইউসরা-সারাহ খোঁজ পায় বার্লিনের সবচেয়ে পুরোনো সুইমিং ক্লাবের, Wasserfreunde Spandau 04। তাই দুইবোন ভাবলো সেখানে একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। যদিও তাদের গতি আশানুরূপ ছিল না কিন্তু তাদের সাঁতারের কৌশল দেখে মুগ্ধ হন ট্রেইনার সভেন স্প্যানেক্রেবস এবং ক্লাবের প্রধান রেনেইট। সভেন বুঝতে পারেন দুইবোন আগে বেশ ভাল প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তিনি ইউসরাকে প্রশ্ন করেন, তার স্বপ্ন কী? ইউসরা জবাব দেয় অলিম্পিক। সভেন ইউসরার মনোবলে মুগ্ধ হন এবং তিনি দুজনেরই দায়িত্ব নেন। পাশাপাশি জার্মানিতে থাকার সব কাগজপত্র জোগাড়েও সাহায্য করেন।
কাঁধের ইনজুরির জন্য বেশিদূর এগোতে পারেনি সারাহ। কিন্তু নতুন কোচ সভেনের পরামর্শ মতোই পরিশ্রম করে যায় ইউসরা। গোটা দু বছর সাঁতার থেকে দূরে ছিল সে। যেকারণে আগের ফিটনেস অর্জনের জন্যেও খাটতে হয়েছে তাকে। আবার সিরিয়ার চাইতে এখানকার প্রশিক্ষণ আরো বেশি কঠোর। তাই কোচের নির্দেশ অনুযায়ী সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে সুইমিং পুলে ঝাপ এবং সেখানে দু ঘন্টা ট্রেনিং, এরপর বিকালে জিমের পর আবার সুইমিং পুল এভাবেই চলতে থাকলো। সিরিয়াতে ইউসরার সাঁতারের ব্যাক্তিগত রেকর্ড ছিল, ফ্রিস্টাইল, ১০০ মিটার ১:০২ মিনিট, ২০০ মিটার ২:১২ মিনিট; বাটারফ্লাই ১০০ মিটার ১:০৯ মিনিট, ৮০০ মিটার ১০:০৫ মিনিট। কিন্তু বর্তমানে সে অনেক পিছিয়ে আছে। সভেন বুঝতে পারলেন এই অবস্থায় রিও অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি সম্ভব নয়। তাই তিনি ইউসরাকে টোকিও অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুত করতে থাকলেন। এই সময়টাতে ইউসরা তার বাবার তার পাশে তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। তাই বাবা-মাকেও জার্মান নিয়ে আসার জন্য সবরকম চেষ্টা করে যায় সে। যার ফলে কয়েকমাসের মধ্যেই পুরো পরিবার আবার এক হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির (IOC) প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন শরনার্থী এথলেট, যারা নিজ দেশ ছেড়ে আসার কারণে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পারছে না তাদের সাহায্য করবে আইওসি। এটি শোনা মাত্রই সভেন আইওসির কাছে মেইল করে ইউসরার কথা তাদের জানায়। এর কয়েকদিন পরেই আইওসির ডেপুটি ডিরেক্টর একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্বজুড়েই শরণার্থী এথলেটদের খুজছে আইওসি কারণ তারা প্রথমবারের মতো শরণার্থী এথলেটদের নিয়ে আলাদা ‘রিফিউজি অলিম্পিক টিম’ গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে তিনজন এথলেটকে খুঁজেও পেয়েছে। ব্রাজিলে আশ্রয় নেয়া এক কনগোলেজ, বেলজিয়ামে থাকা একজন ইরানি এবং জার্মানিতে আশ্রয় নেয়া এক সিরিয়ান নারী সাঁতারু! তারমানে রিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার সূযোগ পেয়েছে ইউসরা মারদিনি।
যে স্বপ্ন ইউসরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে, সেটা অবশেষে পূরণ হলো, অলিম্পিক। কিন্তু ইউসরা এতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছে না। সে তো নিজেকে প্রমাণ করে, নিজের যোগ্যতায় অলিম্পিকে যাচ্ছে না। সে অলিম্পিকে যাওয়ার সূযোগ পেয়েছে তার কারণ সে একজন শরণার্থী। তাকে সিরিয়ার হয়ে নয়, বরং যেতে হবে ‘রিফিউজি অলিম্পিক টিম’ এর অংশ হয়ে। পুরো বিষয়টি তার কাছে করুণা মনে হলো। কিন্তু এটা নিয়ে একটু ভাবার পরেই তার মনে হতে লাগলো কত কষ্ট আর ত্যাগের মাধ্যমে এই ভিনদেশে এসে পৌঁছেছে সে। সে দেখেছে কত মানুষ একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হন্য হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। এখনো লাখ লাখ নারী পুরুষ এবং ছোট ছোট শিশুরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। শরণার্থী বলে নিজেদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউসরা হতে পারবে তাদের কন্ঠ। সে বুঝতে পারলো অলিম্পিক শুধু একটি ক্রীড়া আসরই নয়, এটি একটি মঞ্চ। যার মাধ্যমে সে বিশ্বের বিভিন্ন কোণে থাকা শরণার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে পারবে। বেঁচে থাকার নতুন স্পৃহা জাগাতে পারবে। তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারবে।
৬ আগস্ট ২০১৬। রিও ডি জেনেইরোর মারাকানা স্টেডিয়াম সেদিন পূর্ণ ছিল প্রায় ৮০ হাজার দর্শকে। যখনই ঘোষণা করা হয় ‘রিফিউজি অলিম্পিক টিম’, গোটা স্টেডিয়াম করতালিতে তাদের স্বাগত জানায়। সোনালী বোতামের নেভি ব্লু জ্যাকেট গায়ে যখন ইউসরা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করল সে যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। এত মানুষ সে আর কখনোই দেখেনি। হাসি মুখে ইউসরা হাতে থাকা ছোট অলিম্পিক পতাকাটি নাড়াতে লাগল। তখন আইওসি প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ এবং জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন দাঁড়িয়ে তাদের অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। এই মুহুর্তে ইউসরা বুঝতে পারল শরণার্থীদের পাশে সে আর একা নয়। সে এবং তার দল প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ্বের ৬ কোটি শরণার্থীদের।
ইউসরা অংশগ্রহণ করেছিল ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে। দুরু দুরু বুকে দাড়িয়েছিল এসে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সাথে। মাথার সেই সাদা ক্যাপে অলিম্পিক রিংয়ের নিচেই বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘R.O.T. Mardini’। বিপ শব্দেই ঝাঁপ দেয় পুলের জলে। সেই হিট সে জিতেলেও সময় নিয়েছিল ১ মিনিট ৯.২১ সেকেন্ড। এই সময় নিয়ে ৪২তম স্থান অর্জন করায় সেমিফাইনাল যাওয়া আর হলো না ইউসরার। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার। সে অলিম্পিকে এসেছিল একটি বার্তা পৌঁছা দিতে, এবং সে সেটা সফলভাবেই পেরেছে।
অলিম্পিকের পর ইউসরার জীবনে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হলো। অলিম্পিক যাত্রার শেষ হতে না হতে সে ছুটে যায় নিউ ইয়র্কে, যেখানে সে বক্তৃতা দেয় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেষণে লিডার সামিট অন রিফিউজিসে। এটি পুরোপুরি অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা ছিল তার জন্য। সেখানে সে বলে,
আমি শরণার্থীদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সাহায্য করতে চাই। সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আসা কোনো সহজ সিদ্ধান্ত না, এবং শরণার্থীরাও সাধারণ মানুষ যারা সঠিক সুযোগ পেলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।
সেই সম্মেলনে ইউসরার সাথে দেখা হয় তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে। ওবামা ইউসরার সাহসের প্রসংশা করেন বলেন ইউসরা তার সাহস, ধৈর্য্য এবং কাজের মাধ্যমে সকল শরণার্থীদের কাছেই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে গিয়েছে।
সেই বছরেই ইউসরা এবং সারাহ মারদিনি ‘আনসাং হিরো’ হিসেবে জিতে নেয় জার্মান মিডিয়ার সবচাইতে সম্মানজনক পুরস্কার বাম্বি অ্যাওয়ার্ডস। সেদিন পুরস্কার গ্রহণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাদের বাবা ইজ্জাত মারদিনিও।
পরের বছর জানুয়ারিতে ইউসরা ডেভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে যায় ইউনাইটেড নেশন হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (UNHCR) এর প্রতিনিধি হিসেবে। এপ্রিলেই ইউএনএইচসিআর তাকে শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মনোনিত করে।
ইউসরা মারদিনির লক্ষ্য এখন টোকিও অলিম্পিক। তাই কঠোর অনুশীলনের পাশাপাশি সে এবং তার বোন সারাহ দুজনেই কাজ করে যাচ্ছে শরণার্থীদের জন্য। রিও অলিম্পিকের পর থেকে শরণার্থী শব্দটিকে আপন করে নিয়েছে সে। শব্দটা এখন আর তার কাছে অপমানজনক কিছু নয়। যতদিন না নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে এটাই তার পরিচয়। সে স্বপ্ন দেখে একদিন থেমে যাবে যুদ্ধ। আবার সে ফিরে যাবে নিজ জন্মভুমিতে। তবে সেই স্বপ্ন সত্যি হবার আগ পর্যন্ত সে শরণার্থীদের পাশেই থাকবে।