এ পর্যন্ত মাত্র চারজন বাঙালি নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন, অমর্ত্য সেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মূলত পুরস্কারটির নাম হলো, “অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে ব্যাংক অব সুইডেন পুরস্কার”, যা ‘অর্থনীতির নোবেল’ নামে পরিচিত। Academic Influence এর তথ্যানুযায়ী- তিনি বর্তমানের অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ। ২০১০ সালে অমর্ত্য সেন বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্থান পান। ২০২১ সালে তার আত্মজীবনী ‘Home in the World’ প্রকাশিত হয়, যেখানে অমর্ত্য সেন তার জীবনের প্রথম ত্রিশ বছরের আলোচনা করেছেন।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে পেঙ্গুইন প্রকাশনীর ইমপ্রিন্ট (কোনো প্রকাশনীর বাণিজ্যিক নাম। একটি প্রকাশনী একাধিক বাণিজ্যিক নামের অধীনে বই প্রকাশ করতে পারে) Allen Lane থেকে। তথ্যভিত্তিক বইগুলো হার্ডকভারে প্রকাশ করার জন্য ১৯৬৭ সালে পেঙ্গুইন প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী নিজের নামে এই ইমপ্রিন্ট চালু করেন। ৪৬৪ পৃষ্ঠার হার্ডকভার বইটির বাঁধাই অত্যন্ত সুন্দর ও টেকসই। এতগুলো পৃষ্ঠা, তবুও বইটি ভারী নয়। মাখনরঙা কাগজের বয়ন একেবারে মসৃণ নয়, কিঞ্চিৎ খসখসে, যা হাতে খুব সুন্দর অনুভূতি দেয়; সাথে আছে হালকা সুবাস, যা কেবল ঘ্রাণ নিলেই পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে বইটির ছাপা ও বাঁধাই একদম উৎকৃষ্ট মানের।
অমর্ত্য সেনের বাবা ও মায়ের পরিবার, এবং তিনি নিজেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তার নামও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া। ‘Home in the World‘ নামটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চলিত ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’-র ইংরেজি অনুবাদ ‘The Home and The World’ থেকে অনুপ্রাণিত। এছাড়াও, এই নামে আমরা অমর্ত্য সেনের ‘বাড়ি’ নিয়ে যে দর্শন তার কিছুটা আভাস পাই।
মোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত এই বইয়ের প্রথম অংশে লেখক আলোচনা করেছেন তার জন্ম, পরিবার ও একেবারেই প্রাথমিক জীবন নিয়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের নদী, বাংলাদেশের জন্ম, দেশভাগ ও ব্রিটিশ উপনিবেশ নিয়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে নিজের কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নরত সময়ের কথা, অর্থনীতি নিয়ে মতাদর্শ গড়ে ওঠার কথা বলেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনা, তখনকার ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির ভাবধারা, নিজের অর্থনীতি নিয়ে কাজ ও আগ্রহের ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে পড়াশোনা শেষে কাজ ও নিজের কাছের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইয়ে অমর্ত্য সেন বাংলা ও সংস্কৃত শব্দগুলো অনুবাদ না করে আসল রূপেই ব্যবহার করেছেন যা এক আলাদা আবেদন সৃষ্টি করেছে।
জন্ম বাংলাদেশে, শৈশব কেটেছে মায়ানমারে, কৈশোর শান্তিনিকেতনে, যৌবনে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা, অতঃপর ভারতে শিক্ষকতা, চিরস্থায়ী নিবাস গেড়েছেন আমেরিকায়। এছাড়াও অর্থনীতির কাজে ও শিক্ষকতার জন্য চষে বেড়িয়েছেন ইউরোপের নানা দেশে। অমর্ত্য সেনকে বিশ্ব-নাগরিক বলা যেতেই পারে। সেজন্যই বইয়ের এমন নামকরণ করেছেন, নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে উদ্বুদ্ধ করেছেন দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত করতে।
অমর্ত্য সেনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে, নানা ক্ষিতিমোহনের নিবাসে। ক্ষিতিমোহন ছিলেন বিশ্ব-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তিনিকেতনের অন্যতম সংগঠক। এরপরে অমর্ত্য সেন চলে আসেন ঢাকায় তার পৈতৃক নিবাসে। বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক ও মা অমিতা সেন ছিলেন সেই সময়ের গুটিকতক নারী নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। অমিতা সেন সরাসরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় গীতিনাট্যে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। অমর্ত্য সেনের পরিবার সমাজের উচুস্তরের বাসিন্দা ছিল, তার বাবা ও মা উভয়েরই পরিবার ছিল শিক্ষিত, মার্জিত ও সহনশীল। ফলে, শৈশব থেকেই অমর্ত্য সেন বেড়ে ওঠার খুব ভালো পরিবেশ যেমন পেয়েছিলেন তেমনি, তার আশেপাশের কৃতবিদ্য মানুষদের মাধ্যমে তার চিন্তাদর্শ বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত হয়েছে।
সাধারণত আত্মজীবনী বলতে বোঝায়- যেখানে কেউ একজন তার জীবনের অলিগলিতে পাঠককে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়, জমিয়ে রাখা গল্পগুলো শোনায়। তবে জাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সে রাস্তায় হাটেননি। এই বইতে ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেনঃ কীভাবে তিনি চিন্তা করেন, সেই চিন্তাদর্শ কীভাবে গড়ে উঠলো এবং তার অর্থনীতি নিয়ে কাজের বিভিন্ন ছোটখাট আলোচনা তো ছিলই। এছাড়াও, অমর্ত্য সেনের জীবনের কাছের বন্ধুদের কথা, তাদের কাজ নিয়েও কিছু আলোচনা করেছেন। বইটি শুধু একটি সাধারণ আত্মজীবনীতে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠেছে এক বিদ্বান মানুষের নিজের ‘থট প্রসেস’ বিশ্লেষণ করার এক অনন্য উপাখ্যান।
শান্তিনিকেতনে জন্মের কিছু সময় পরেই অমর্ত্য সেনকে তার পৈতৃক নিবাস ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এরপর বাবার কর্মসূত্রে কিছুদিন বসবাস করতে হয়েছিল মায়ানমার এর মন্দালয়ে। মন্দালয়ের পাহাড়ি পরিবেশ শিশু অমর্ত্যকে মুগ্ধ করেছিল।
ঢাকায় ফেরার পর তাকে ভর্তি করানো হয় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সেইন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে। তবে, সেই স্কুলের কঠোর নিয়ম-নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, জ্ঞান ভিত্তিক পড়াশোনার চেয়ে ফলাফল ভিত্তিক পড়াশোনার ধরণের সাথে অমর্ত্য সেন কখনোই মানিয়ে নিতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীজ আক্রমণের ভয়ে তাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেওয়া হলে, বলা যেতে পারে, তিনি তার শেকড় খুঁজে পেয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনের পড়াশোনার ধরণ, ফলাফলের চেয়ে শেখার, জানার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া সবকিছুই তার জন্য অনেক অনুকূল ছিল। সাথে যুক্ত হয়েছিল নানা ক্ষিতিমোহন ও নানী কিরণবালার সঙ্গ। তারা দুজনেই তাদের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন, বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও নানার সাথে কিশোর অমর্ত্য সেনের দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, সংস্কৃতি, ভাষা সহ নানা বিষয়ে গভীর আলোচনা হতো। তখনকার অন্যান্য বৃদ্ধ নারীদের মতো সেনের নানী মোটেই গোড়া ছিলেন না, তিনি একই সাথে ছিলেন শিল্পী ও ধাত্রী। এতেই বোঝা যায় কাজের ক্ষেত্রে তিনি সব কাজকেই সমান চোখে দেখতেন। কৈশোরের সেই সময়ে নানা-নানীর সংস্পর্শে অমর্ত্য যেমন সমতার ধারণা পেয়েছিলেন তেমনই; চিন্তা করার ক্ষমতা, গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করার দক্ষতার বীজও সেই সময়েই রোপিত হয়ে গিয়েছিল।
তিনি তার নানা-নানী কীভাবে চিন্তা করতেন, শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ও শিক্ষাব্যবস্থা, নানার সংস্কৃত ভাষা নিয়ে কাজের ধরণ ও রবীন্দ্রনাথের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। যেকোন আলোচনাতেই বৈষয়িক ব্যাপারগুলোর থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে দার্শনিক বিষয়গুলো। কিশোর বয়স থেকেই অমর্ত্য সেন যেভাবে চিন্তা করতে পারতেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। তার পরিবার ও শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের আনুকূল্যে তিনি আরো পরিশীলিত হয়েছিলেন।
অমর্ত্য সেন বইয়ে একটা পুরো অধ্যায় লিখেছেন বাংলাদেশের নদী নিয়ে। শৈশবে পরিবারের সাথে নৌকাভ্রমণে অবলোকন করা সৌন্দর্যের সাথে তার লেখায় উঠে এসেছে বাংলায় নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব, বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অবদান, নদী নিয়ে রচিত সাহিত্যের দর্শন, বাংলার মানুষের নদী-কেন্দ্রিক জীবন সহ আরো নানাবিধ বিষয়। এই অংশেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এর পেছনের কিছু ইতিহাস, ভারতবর্ষের বিভাজন, ব্রিটিশ রাজের উপনিবেশ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে মানুষের কষ্ট অমর্ত্য সেন খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, সেই নিয়ে তিনি আলোচনাও করেছেন। পরবর্তী সময়ে তার জীবনের বড় অংশ ব্যয় করেছেন দুর্ভিক্ষ ও কীভাবে দুর্ভিক্ষমুক্ত একটি পৃথিবী গঠন করা যায় তা নিয়ে গবেষণায়।
১৯৫১ সালের জুনে অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতনের পাট চুকিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি ও গণিত পড়তে। সেই সময় তিনি থাকতেন কলকাতার বিখ্যাত ওয়াই এম সি এ হোস্টেলে। নিজের চিন্তাদর্শ গড়ে ওঠার পেছনে সেই সময়ের কফি হাউজের আড্ডা, শ্রেণীকক্ষের আলোচনা, মার্ক্সিজমের সাথে পরিচিতি সবকিছুরই বেশ ভালো অবদান ছিল। তার লেখা থেকে সেই সময়ের কলকাতার একটি চিত্র যেমন পাওয়া যায় তেমনি, তখনকার দিনে সমাজব্যবস্থা, তরুণদের বৌদ্ধিক চিন্তাবৃত্তি নিয়েও আলোচনা করেছেন।
১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে অমর্ত্য সেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান। সেখান থেকেই তিনি তার বি.এ, এম.এ ও পি.এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। সেখানে তার সখ্য হয় তৎকালীন অর্থনীতির দিকপালদের সাথে। তবে তার সাথে অনেকের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও তিনি সহজেই সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারতেন। তখনকার কেমব্রিজের শিক্ষকমন্ডলী ও তার সহপাঠিদের সাথে আলোচনা সমূহ তার চিন্তা-চেতনাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সেখান থেকেই তিনি নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে কাজ করতে চান সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন। বইয়ের এই অধ্যায়ে তিনি অর্থনীতি, ইউরোপীয় অর্থনীতি, দর্শন, রাজনীতি নিয়ে নিজের ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন।
এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে অমর্ত্য সেন তার জীবনের কাছের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বর্ষীয়ান বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। রেহমান সোবহান নিজেও ট্রিনিটি কলেজে অর্থনীতির শিক্ষার্থী ছিলেন, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অমর্ত্য সেন যেমন তার বন্ধুদের কৃতিত্বের কথা বলেছেন, তেমনি তাদের অনুচিত কর্মের কথাও বলেছেন। যেমন: অং সান সু কির কথা। তিনি ও তার স্বামী উভয়েই সেনের বেশ ভালো বন্ধু ছিলেন। অমর্ত্য সেন যেমন তাদের কাজের কথা বলেছেন, প্রশংসা করেছেন, তেমনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু কির ভূমিকার সমালোচনাও করেছেন। এই বইয়ে অমর্ত্য সেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে নিজের চারপাশের পরিবেশ ও মানুষজনের কথা বলেছেন, তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন নিজের ধ্যান-ধারণা নিয়ে। বইটি থেকে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া না গেলেও তার মতাদর্শ, অর্থনীতি নিয়ে তার ভাবনা, ও সর্বোপরি তিনি কীভাবে চিন্তা করেন সেই সম্পর্কে জানা যায়।
অমর্ত্য সেন নিঃসন্দেহে একজন প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ। দুর্ভিক্ষ, উন্নয়ন তত্ত্ব ও জনকল্যাণ অর্থনীতিতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি তার ৮৮ বছরের জীবনে শতাধিক সম্মানসূচক ডিগ্রী লাভ করেছেন। ঢাকা, বার্মা, শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা, এবং পরবর্তীতে কলকাতা, ইংল্যান্ডে অধ্যয়ন ও ভারত, আমেরিকা, ইউরোপে শিক্ষকতা; তার অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনাকে অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলেছে। এই বইয়ে তিনি অতীতের স্মৃতিচারণের সাথে সাথে বর্তমানের কথা বলে সংযোগ স্থাপন করেছেন, তিনি কীভাবে চিন্তা করেন সেটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। কৃতবিদ্য এই মানুষটি দীর্ঘায়ু লাভ করে নিজের জ্ঞানের মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন সাধন করবেন এই শুভকামনা রইল।