সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে প্রচারণার ধরন। পূর্বের পদ্ধতিতে পণ্য-প্রচারণার কাজ এখনও বেশ প্রচলিত থাকলেও, অনলাইন কিংবা ডিজিটাল মার্কেটিং-এর মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছ থেকে বর্তমানে মিলছে অধিকতর সাড়া।
ফলে আজকাল দেখা যায়, কেউ একটি ব্যবসা শুরু করলে, তার প্রচারণার জন্য প্রথমে ডিজিটাল মার্কেটিংকেই বেছে নেয়। এতে করে অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ ভোক্তার কাছে পৌঁছবার পাশাপাশি কষ্ট এবং খরচও তুলনামূলক কমে যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন, কিন্তু এর দ্বারা প্রভাবিত হন না, এরকম কেউ বোধহয় নেই। তাই ডিজিটাল মার্কেটিংয়েরও মূল ভিত্তি হলো সামাজিক মাধ্যম।
আর ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট, লিঙ্কডইন-এর মতো সামাজিক মাধ্যমে সফলভাবে পণ্য-প্রচারণা চালাতে হলে, সময়ের সাথে এবং ভোক্তার চাহিদার কথা মাথায় রেখে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। ২০১৯ সালে বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড আছে, যেগুলো ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জগতকে পুরো ছেয়ে ফেলেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ট্রেন্ডগুলো।
ভিডিও প্রোমোশন
অনলাইন প্রোমোশনের জন্য অনেকেই এখন ভিডিও বানানোর সুবিধা নিচ্ছে। হোক সেটি কোনো পণ্যের প্রচারণা কিংবা কোনো আয়োজনের জন্য প্রচারণা, ভিডিও বানিয়ে প্রচারণা চালালে ভোক্তাদের মাঝে দ্রুত সাড়া ফেলা সম্ভব।
খেয়াল করলে দেখবেন, আগের টিভি বিজ্ঞাপনগুলোতে কেবল পণ্যের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার ব্যাপারে বেশি জোর দেওয়া হতো। আর এখন জোর দেওয়া হয় পণ্যের গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা, ভোক্তাদের কাছে সেটি তুলে ধরার ব্যাপারে। অনেক ক্ষেত্রে লাইভ ভিডিও করেও ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ফেইসবুক কিংবা ইউটিউবে লাইভ ভিডিওর ব্যবহার এখন বেশ লক্ষ করা যায়।
পণ্যের মোড়ক উন্মোচন কিংবা কোনো আয়োজনের কাজের অগ্রগতি- এসব ব্যাপারে লাইভ ভিডিও দেখতে ভোক্তারা অধিক পছন্দ করে। নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৮৫ শতাংশ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী কোনো প্রচারণার জন্য লাইভ ভিডিও দেখতে বেশি পছন্দ করেন, এবং ৯৫ শতাংশ ব্র্যান্ড মালিক মনে করেন, তাদের প্রচারণার জন্য লাইভ ভিডিও এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো তাদের বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করে থাকে।
চ্যাটবটের ব্যবহার
ফেইসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটবটের ব্যবহার এখন অনেকেই শুরু করেছে। ক্রেতারা পণ্য ক্রয় করার ক্ষেত্রে সরাসরি কথা না বলেও চ্যাটবটের মাধ্যমে অর্ডার করতে পারছে। এতে একদিকে যেমন অনলাইন কেনাকাটা সহজ হয়ে গিয়েছে, অন্যদিকে ভোক্তারাও অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এছাড়া হেল্পলাইনের ক্ষেত্রেও অনেকে চ্যাটবট ব্যবহার করে থাকেন।
কোনো কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের ব্যাপারে পরিচিতিমূলক তথ্য জানানোর জন্য অনেকেই চ্যাটবটের সুবিধা নেন। এতে ভোক্তারা কী ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন, তার উত্তর আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। ফলে কম্পিউটারের সামনে কেউ না থাকলেও, ভোক্তা তার চাহিদার কথা জানাতে পারে এবং সেই অনুযায়ী সমাধানও পেতে পারেন।
স্টোরি শেয়ার করা
আজকাল অনেক ব্যবহারকারী ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম কিংবা স্ন্যাপচ্যাটে তার প্রতিদিনকার কাজকর্ম ‘স্টোরি’তে শেয়ার করছে। অনেকে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টোরি শেয়ার করে যায়। মানুষজন সেগুলো দেখে আবার ‘রিঅ্যাক্ট’ও করে। স্টোরি শেয়ারিং-এর প্রতি মানুষের এই আগ্রহকে কাজে লাগানো যায় ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে।
অনেক ব্র্যান্ডকে দেখা যায়, তাদের অ্যাফিলিয়েট প্রতিষ্ঠান বা তারকাদের দ্বারা তারা তাদের সামাজিক মাধ্যম পেইজে পোস্ট করাচ্ছে। যেহেতু অধিকাংশ মানুষ তারকাদের জীবনযাত্রা অনুকরণ করতে পছন্দ করে, তাই তারকারা যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করে, তার ভক্তরাও সেই পণ্যের ব্যাপারে অধিক আগ্রহ দেখায়। এটি কোনো পণ্যের প্রচারণা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ এখন একে অপরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারছে। এর বেশিরভাগই আসে স্টোরি শেয়ার থেকে। তাই স্টোরি শেয়ার করা এখন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের একটি বড় ট্রেন্ড।
পেইড অ্যাড
ফেইসবুকে প্রচারণার একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, নির্দিষ্ট বয়সসীমা এবং নির্দিষ্ট অঞ্চল ধরে কোনো পণ্যের আলাদা প্রচারণা চালানো যায়। এতে খরচও তুলনামূলক কম হয়। কোনো একটি পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট বয়সের ফেইসবুক ব্যবহারকারীর উদ্দেশে প্রচারণা চালালে, এতে সাড়াও পাওয়া যায় বেশি। কারণ তখন অল্প সময়ে নির্ধারিত ভোক্তাদের নিকট পৌঁছানো যায়।
এই পেইড অ্যাডের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, এতে কষ্ট করে রাস্তায় নেমে প্রচারণা চালাতে হয় না। যেহেতু কমবেশি সব বয়সের মানুষই এখন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে, আর এর বড় একটি অংশ হলো ফেইসবুক ব্যবহারকারী, তাই পেইড অ্যাড দিয়ে যেকোনো পেইজ থেকে অতি দ্রুত ভোক্তাদের নিকট নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া যায়। সময়ের সাথে সাথে এই সেবার ব্যবহার অনেক বেড়ে চলেছে।
ভোক্তাদের কথা শোনা
সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এখন ভোক্তাদের কথা বা তাদের অভিমত সরাসরি শোনা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তারা কী চাচ্ছে, পণ্য ব্যবহার করে তারা কী সুফল পাচ্ছে- এসব কথা কমেন্ট কিংবা মেসেজের মাধ্যমে সহজেই জানা যায়।
ধরুন, আপনি একটি রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন। আপনার ফেইসবুক পেইজে একজন জিজ্ঞেস করলো, আপনার রেস্টুরেন্টে কোনো অফার আছে কিনা। চলতি কোনো অফার না থাকলেও, আপনি চাইলে অল্পদিনের মধ্যেই একটি অফার চালু করতে পারেন। এতে করে, সেই লোকসহ আরও অনেকেই আপনার রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে আগ্রহী হবে। ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে আপনি যদি নতুন কিছু নিয়ে আসেন তাদের সুবিধায়, এতে লাভ আপনারই হবে।
ভোক্তাদের মাধ্যমে অভিমত প্রচার করা
বর্তমান সময়ে মার্কেটিংয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম বোধ হয় এটি। সাধারণ ভোক্তারা পণ্যের ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করলে, সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা বহুগুণে বেড়ে যায়। খাবারের রিভিউ তো এখন বেশ প্রচলিত। কোথাও খেতে গেলে সেখানকার ছবি তুলে ফেইসবুকের বিভিন্ন ফুড ব্লগিং গ্রুপে তার অভিমত দিতে অনেকেই পছন্দ করে।
ভালো রিভিউ বা অভিমত হলে অনেকেই সেখানে যেতে উৎসাহ পায় এবং এতে খাবারের দোকানের প্রচারণার কাজ অনেকটা বিনামূল্যেই হয়ে যায়। আবার খারাপ অভিমত পেলে সেখানে হয়ে যায় নেতিবাচক মার্কেটিং। তাই এই ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হয়। একই কথা বলা যায়, বাজারের অন্যান্য পণ্যের ব্যাপারেও। এই পদ্ধতির জন্য ভোক্তার সাথে বিক্রেতার অবশ্যই ভালো সম্পর্ক থাকা জরুরি।
মার্কেটিং ব্যাপারটা যেহেতু সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়, তাই কোন সময়ে ভোক্তারা কোন ধরনের তথ্য বেশি পছন্দ করছে, এটি জানা জরুরি। একসময় কোনো পণ্যের প্রচারণার জন্য তেমন কিছু বলতে হতো না। কেবল পণ্যটির কাজ কী এবং এর ব্যবহারের সুফল সম্পর্কে বললেই চলতো। কিন্তু বর্তমানে পণ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ভোক্তাদের আস্থা ধরে রাখতে হয়। কারণ পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে ভোক্তারা এখন অধিক সচেতন।
এই সকল বিষয় বিবেচনায় রেখে এখন মার্কেটিংয়ের কাজ করতে হয়। সেই সাথে সময়ের সাথে সাথে মার্কেটিংয়ের ধরনও বদলে যায়। ওপরে বর্ণনা করা ট্রেন্ডগুলো হলো ২০১৯ সালে সাড়া ফেলা ডিজিটাল মার্কেটিং ট্রেন্ডগুলোর কয়েকটি। এগুলো যে সবসময় প্রচলিত থাকবে, এমন না। নতুন কোনো ট্রেন্ড আসলে এগুলোকে প্রতিস্থাপন করে নেবে সেগুলো। দিনশেষে, সময়ের সাথে মানিয়ে চলবার কোনো বিকল্প নেই।