মাল্টি বিলিয়ন ডলার প্রতারক হিসেবে বার্নার্ড মেডঅফ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি কয়েক যুগ ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখে ধুলো দিয়ে বিনিয়োগ জগতে সাফল্যের চূড়ায় উঠেছিলেন। বহু বছর ধরে তার কোম্পানী অত্যন্ত আর্কষণীয় মুনাফা দিয়ে আসায় তাতে বিনিয়োগ করার জন্য গ্রাহকদের ভিড় লেগেই থাকতো। কেউই ধরতে পারেনি যে, এসব মুনাফার সবই প্রতারণার মাধ্যমে কাগজে-কলমে তৈরি করা। সব অপরাধের মতো মেডঅফের প্রতারণাও একদিন ঠিকই ধরা পড়ে। বিচারে তার ১৫০ বছরের সাজাও হয়। কিন্তু মেডঅফের প্রতারণার ফলে পাঁচ মহাদেশ জুড়ে বহু মানুষ দেউলিয়া হয়ে যায়, যাদের অনেকে আত্মহত্যাও করে বসেন। এমন একজন প্রতারকের জন্য ১৫০ বছরের জেল যথেষ্ট কি না সেই প্রশ্ন তোলাই যায়।
মেডঅফের শুরুটা হয় ১৯৬০ সালে। কলেজ পাশ করার পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বার্নার্ড এল মেডঅফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিজ। কলেজে পড়ার সময় লাইফ গার্ডের কাজ করে জমানো ৫,০০০ ডলারের সাথে শ্বশুরের কাছ থেকে ধার করা ৫০,০০০ ডলার দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। শুরুতে তার প্রতিষ্ঠান নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ও আমেরিকান স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে হাতবদল হওয়া বিভিন্ন পেনি স্টক নিয়ে কাজ করেছে।
মেডঅফের প্রথম বড় গ্রাহক ছিলেন ব্যবসায়ী কার্ল সাপিরো, যিনি সেই ষাটের দশকেই মেডঅফের কোম্পানিতে ১,০০,০০০ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। এই বিনিয়োগ পরবর্তীতে বন্ধুত্ব ও ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বে রূপ নেয়। পরের ৫০ বছর ধরে সাপিরো মেডঅফকে নিজের ছেলের মতো দেখেছেন। তিনি মেডঅফকে তার ধনী বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যারা সবাই পরবর্তীতে তার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। অন্য অনেকের মতো সাপিরো নিজেও মেডঅফ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, যার পরিমাণ প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার।
বহু বছর ধরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কখনোই মেডঅফের কোম্পানিতে সত্যিকার বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বুঝতে পারেনি। একজনের নামের আড়ালে অনেকে যৌথভাবে মিলিত হয়ে একক নামে বিনিয়োগ করতো। ফলে কাগজে-কলমে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুব কম থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো মেডঅফের কোম্পানিতে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালাতে সেভাবে আগ্রহী হয়নি।
২০০৮ সালে যখন মেডঅফের প্রতারণা ধরা পড়ে তখন তা এক মাল্টি বিলিয়ন কোম্পানি। মেডঅফের সন্তান ও আত্মীয়রা কোম্পানিতে তখন সরাসরি যুক্ত ছিল। তবে কোম্পানির ভেতরের একটা বিশেষ শাখা সর্ম্পকে তারা সবাই একেবারেই অজ্ঞ ছিল। এই বিশেষ শাখাটি ছিল মেডঅফের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। এর মাধ্যমেই বড় বড় বিনিয়োগকারীদের অর্থ বিনিয়োগের নামে সরাসরি মেডঅফের ব্যক্তিগত একাউন্টসমূহে জমা হতো। এভাবে অর্থ জমা ছিল আইনের সুস্পষ্ট লংঘন, আর এগুলো কখনোই কোনো বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়নি।
শুরুর দিকে বিনিয়োগকারীরা যখন তাদের বিনিয়োগের অর্থসমূহ ফেরত চাইতো, তখন মেডঅফ বিশ্বাস তৈরির জন্য বিনিয়োগের অর্থ ভাল মুনাফাসহ ফেরত দিতেন। সেই সাথে একটি ভুয়া বিনিয়োগ লিস্ট প্রদান করতেন, যাতে দেখানো থাকত কোন বিনিয়োগ থেকে কত লাভ এসেছে। অথচ প্রদত্ত মুনাফা ছিল অন্য কোনো বিনিয়োগকারীর জমাকৃত অর্থ থেকে সরবরাহ করা। চাহিবামাত্র আসল সহ উচ্চ মুনাফা পাওয়ায় বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই মূল টাকা ফেরত চাইতো না। বরং মুনাফা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে শুরু করে।
মেডঅফের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার মতো লোকের অভাব না হওয়ায় তিনি কোনো বড় ধরনের ঝামেলা ছাড়াই নতুন বিনিয়োগকারীর টাকা থেকে পুরাতন বিনিয়োগকারীদেরকে মুনাফা দিতে সক্ষম হন। মুনাফার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে তিনি কাগজে-কলমে বহু ফান্ড তৈরি করেছিলেন। যেমন- একটি ফান্ড ছিল এস এন্ড পি এর ১০০ স্টক ইনডেক্সের বিনিয়োগের জন্য। এই ফান্ডটি টানা সতের বছর ধরে বাৎসরিক ১০.৫% মুনাফা দেখিয়ে এসেছে। এমনকি যখন ২০০৮ সালে মার্কিন শেয়ার বাজার ধসে পড়ে, তখনও ফান্ডটি কাগজে-কলমে বিরাট মুনাফা দেখায়।
যুগের পর যুগ ধরে মানুষ মেডঅফের কোম্পানির ধারাবাহিকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কেবল বড় বড় বিনিয়োগকারীই নয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও তাদের জীবনের সবর্স্ব মেডঅফের হাতে তুলে দিয়েছে। তাদের চোখে মেডঅফের কোম্পানি ছিল বিশ্বাসযোগ্য। মেডঅফকে তারা এসইসি এর উপদেষ্টা আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা একজন ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতেন। তার প্রতারণার শিকার যারা হয়েছিলেন, সেই হাজার হাজার দুর্ভাগার মধ্যে হলিউডের বড় নাম, যেমন- স্টিভেন স্পিলবার্গ, কেভিন বেকন, জন মালকোভিচ সহ ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সুপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তিত্বও আছেন।
ঠিক কখন থেকে মেডঅফ তার প্রতারণা শুরু করেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ২০০৮ সালে মেডঅফ যখন নিজের প্রতারণার কথা স্বীকার করেন, তখন তার জবানীতে জানা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে তিনি মূলত প্রতারণার এই জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। তবে ফেডারেল তদন্তকারীদের মতে, মেডঅফের প্রতারণা ১৯৭০ সাল থেকে শুরু হয়েছে।
সত্যি বলতে, মেডঅফের কোনো বিনিয়োগ কখনোই বৈধ ছিল না। তিনি সব সময় কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে তার বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্যগুলো চেপে রাখতেন। তার সাথে চল্লিশ বছর কাজ করার পরও তার আপন ভাই পিটার কোনোদিনই বিনিয়োগগুলোর সত্যিকার চরিত্র জানতে পারেনি। মেডঅফ একই জিনিসকে বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনের কাছে উপস্থাপন করতেন। ফলে কেউ কখনোই সত্যিটা জানতে পারেনি। আর বছর বছর নিয়মিত মুনাফা পাওয়ায় কেউ সত্যিটা জানতেও তেমন আগ্রহ বোধ করেনি।
১৯৯০ এর শুরুর দিকে মেডঅফের ধারবাহিক মুনাফা নিয়ে হালকা গুঞ্জন হলেও তা দ্রুতই হারিয়ে যায়। ২০০০ সালে ফিনান্সিয়াল এনালিস্ট ও ফ্রড ইনভেস্টার হ্যারি ম্যারকোপলো এসইসি-কে জানান, তিনি গাণিতিকভাবে প্রমাণ করতে পারবেন যে মেডঅফের মুনাফার দাবীগুলো মিথ্যা। ম্যারকোপলোরের দাবীকে এসইসি অগ্রাহ্য করে। তবে ম্যারকোপলোর মতো আরও অনেকেই মেডঅফ সর্ম্পকে সতর্কতা অবলম্বন করেছে। মেডঅফের নিজস্ব ব্যাংক জেপি মরগান ছাড়া ওয়াল স্ট্রিটের অন্য কোনো গূরুত্বপূর্ণ ব্যাংক কিংবা প্রতিষ্ঠান কখনোই মেডঅফের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। তাদের কাছে মেডঅফের ফান্ডগুলোর মুনাফার অংক কখনোই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। মেডঅফের সাথে ব্যবসা করার অপরাধে জেপি মরগানকে ২০১৪ সালে ২ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়, যা ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীদের জন্য গঠিত তহবিলে জমা করা হয়।
২০০৮ সালের আগে এসইসি বেশ কয়েকবার মেডঅফের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে তদন্ত করে। কিন্তু মেডঅফের ব্যক্তিগত তহবিলের বিশাল বিনিয়োগ অর্থ জমা থাকার বিষয়টি তারা কখনোই ধরতে পারেনি। ১৯৯২ সালে তারা অন্য প্রতিষ্ঠানের দুটি ছোট ফান্ড অনিয়মের অভিযোগে বন্ধ করে দেয়, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি সেই ফান্ডগুলো ছিল বেনামে মেডঅফের পরিচালিত অনেকগুলো ফান্ডের দুটি, যাদের কাজ ছিল আকর্ষণীয় বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করে তাদেরকে সরাসরি মেডঅফের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা, অনভিজ্ঞ তদন্ত দল, বিশেষজ্ঞদের অনুপস্থিতির কারণে মেডঅফের উপর পরিচালিত সকল তদন্তই একের পর ব্যর্থ হয়। তাকে ধরা কখনোই হয়ত সম্ভব হয়ে উঠতো না, যদি না ২০০৮ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে ধস না নামতো। ২০০৮ এর শেষের দিকে এসে মেডঅফ বুঝতে পারেন, তার পক্ষে আর কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মার্কিন অর্থনীতিতে ধসের কারণে তার বিনিয়োগকারীরা হঠাৎ করে একযোগে ৭ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ফেরত চেয়ে বসে, যা মেডঅফের পক্ষে ফেরৎ দেয়া সম্ভব ছিল না। তার ফান্ডে তখন সব মিলিয়ে ২০০-৩০০ মিলিয়ন ডলার অবশিষ্ট ছিল। বিনিয়োগ করার জন্য নতুন কোনো বিনিয়োগকারীও তিনি খুঁজে পেলেন না।
২০০৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মেডঅফ তার সন্তানদের কাছে তার এতদিনের প্রতারণার কথা স্বীকার করেন। তিনি অবশিষ্ট টাকার একটা অংশ তাদেরকে বোনাস হিসেবে কোম্পানী থেকে পরিশোধের কথা বলেন। তার সন্তানরা বাবার এই বোনাসকে অস্বীকার করে এবং সেদিনই তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পুরো বিষয়টি অবগত করে। পরদিন এফবিআই মেডঅফকে গ্রেফতার করে, তবে শীঘ্রই তাকে জামিনে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ২০১১ সনে মেডঅফের স্ত্রী রুথ জানান, এই গৃহবন্দী থাকার সময় ২০০৮ এর বড়দিনের বন্ধে তারা দুজন ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, যদিও তা সফল হয়নি।
২০০৯ সালের ১২ মার্চ মেডঅফ তার বিরুদ্ধে আনা ১১টি প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার করে নেন। ২০০৯ সনের ২৯ জুন তার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়। বিচারে তাকে ১৫০ বছরের সাজা দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার আগে মেডঅফ তার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীদের কাছে কৃতর্কমের জন্য ক্ষমা চান। ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেবার জন্য ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন সরকার মেডঅফের বিভিন্ন সম্পত্তি নিলামে তুলতে শুরু করে। সম্পত্তির মধ্য ছিল একটি বিলাসবহুল ইয়ট, দুটো ছোট জাহাজ, নিউ ইয়র্কের বিলাসবহুল পেন্ট হাউজ, সমুদ্রতীরের লোভনীয় ভিলা, ফ্লোরিডার রাজকীয় ম্যানসন, বিখ্যাত শিল্পীদের দামী চিত্রকর্ম, স্ত্রীর মূল্যবান রত্ন ও অলংকার, রোলেক্স কালেকশন সেটসহ অন্যান্য আসবাবপত্র।
মেডঅফের প্রতারণা অর্থনৈতিক দুনিয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় প্রতারণা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তার নিজের পরিবারের পরিণতিও অত্যন্ত দুঃখজনক। তার ৪৬ বছর বয়সী পুত্র মার্ক মেডঅফের জেলে যাবার দ্বিতীয় বর্ষপূতিতে আত্মহত্যা করেন। বিচারে সাজা হলেও মেডঅফের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের এলোমেলো জীবন আর কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি।