অর্থনীতির দিক দিয়ে চীন বর্তমান পৃথিবীর দ্বিতীয় সমৃদ্ধিশালী দেশ। কিন্তু মাত্র ৪০ বছর আগেও তারা ছিল পৃথিবীর গরীব দেশগুলোর তালিকায়। ষাটের দশকে চীন আফ্রিকান অনেক দেশের চেয়েও গরীব ছিল। কিন্তু শেষ এই ৪০ বছরে দেশটি তার অর্থনীতিকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়।
১৯৭৮ সালে চীনের জিডিপি ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১৭ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১২.২৪ ট্রিলিয়নে। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি আট বছরে গড়ে চীন তার অর্থনীতির আকার দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশটির ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠেছে।
আজকে আমরা আলোচনা করব চীন কীভাবে এত স্বল্প সময়ে তার অর্থনীতিকে এতটা শক্তিশালী করে গড়ে তুলল। এজন্য আমাদের যেতে হবে অনেকটা পেছনে।
চীনের গৃহযুদ্ধ
চীনের গৃহযুদ্ধ চলে ১৯২৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। চাইনিজ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (Chinese Nationalist Party – CNP) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না (Communist Party of China – CPC) এর মধ্যকার এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি জয়লাভ করে এবং গঠিত হয় পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির লিডার ছিলেন মাও সে-তুং। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। তার শাসনামলে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বেশ ভঙ্গুর।
তার আমলেই চীনে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত চলা এই দুর্ভিক্ষে শুধুমাত্র সরকারি হিসেবেই ১৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং বেসরকারি হিসেবে মারা যায় প্রায় ১৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ। মাও সে-তুং এর অর্থনৈতিক নীতিমালা ছিল ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ। তার আমলে চীনের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্যের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না অন্যান্য দেশের সাথে। কৃষিতেও পিছিয়ে ছিল চীন।সেই সময় চীন সরকার কৃষকের উৎপাদিত শস্য যা ইচ্ছা মূল্যে কিনে নিত। ফলে কৃষক শোষণের শিকার হয় এবং অর্থনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে।
এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
১৯৭৮ সালে চীনের ক্ষমতায় আসেন দেং জিয়াওপিং। তিনি ক্ষমতায় এসে চীনের ভঙ্গুর অর্থনীতির হাল ধরেন। তিনি চীনের ভুল অর্থনৈতিক নীতিগুলো ধরতে পারেন এবং অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেন। বর্তমান চীনের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আমরা দেখি, সেটি শুরু হয় দেং জিয়াওপিং-এর হাত ধরেই। তিনি চীনের বিশাল জনসংখ্যাকে দক্ষ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করেন, যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ৭৮ কোটির বেশি দক্ষ জনশক্তি রয়েছে চীনে। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘এক দম্পতি এক সন্তান’ নীতি প্রয়োগ করেন।
জিয়াওপিং প্রথমেই কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেন। তখন থেকে কৃষকরা নিজেদের পছন্দমতো শস্য চাষ করতে পারত এবং উৎপাদিত শস্য তারা খোলা বাজারে বিক্রি করতে পারত। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় এবং কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায়। ফলশ্রুতিতে কৃষকদের অবস্থা আস্তে আস্তে উন্নত হয়।
এর সাথে সাথে জিয়াওপিং নজর দেন ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের দিকেও। ১৯৮০ সালে ব্যক্তি বিনিয়োগের অনুমোদন দেয় চীন সরকার। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব পণ্যের যোগান দিতে ব্যর্থ হত সেসব পণ্যের যোগান দেয়া শুরু করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলো। ফলে শিল্পক্ষেত্রেও চীন আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়।
দেং জিয়াওপিং পরিবর্তন আনেন চীনের ব্যাংকিং ব্যবস্থাতেও। ১৯৭৮ সালের আগে চীনে পিপলস ব্যাংক অফ চায়না নামে একটি মাত্র ব্যাংক ছিল, যেটি একইসাথে কেন্দ্রীয় এবং ব্যবসায়িক ব্যাংক হিসেবে কাজ করত। ১৯৭৮ সালের পর ব্যাংকটি একটি আধুনিক ব্যাংকিং নীতিমালা তৈরি করে এবং গঠিত হয় ব্যবসায় ব্যাংক, বিনিয়োগ ব্যাংক, ট্রাস্ট এবং বীমা সংস্থা। ফলে অর্থনৈতিক চাকা আরো গতিশীল হয়।
দেং জিয়াওপিং বৈদেশিক বানিজ্যের নীতিতেও পরিবর্তন আনেন। তখনকার চীনে শ্রম সস্তা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগের প্রতি আকৃষ্ট হয়। দেং জিয়াওপিং চীনকে আরো বিনিয়োগ-বান্ধব করে গড়ে তোলেন। ফলে আস্তে আস্তে কৃষিনির্ভর দেশটির অর্থনীতি শিল্পনির্ভর হয়ে ওঠে।
চীনকে বিনিয়োগ-বান্ধব করার জন্য চীন সরকার বিভিন্ন জোন তৈরি করে। তৈরি হয় অর্থনৈতিক জোন, টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট জোন, উপকূলীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোন প্রভৃতি। ফলে চীনের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আরো আকৃষ্ট হয় এবং চীন পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে পায় এক অভাবনীয় সাফল্য। তারা যে পণ্য রপ্তানিতে এক অকল্পনীয় পরিবর্তন এনেছে তা নিচের এই গ্রাফ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
আশির দশকে চীনে শিল্পায়ন ও নগরায়ন ব্যাপকভাবে শুরু হয়। ১৯৬০-৭৮ সাল পর্যন্ত দেশটির ১৬.২% – ১৮.৬% মানুষ শহরে বাস করত। ২০০০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫.৯% এবং ২০১১ সালে হয় ৫০.৫%। দ্রুত শিল্পায়নের ফলে মানুষ শহরমুখী হয় এবং মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পায়।
চীনের দ্রুত উন্নয়নের আরেকটি কারণ এর Gross Domestic Saving এর উচ্চ মান। এটি মোট জিডিপি ও মোট খরচ/ব্যয় এর মধ্যকার পার্থক্য। অর্থাৎ মোট জিডিপি যদি হয় ১০০ টাকা আর মোট খরচ যদি হয় ৬০ টাকা, তাহলে Gross Domestic Saving হবে ৪০ টাকা। এর মান যত উচ্চ হবে মানুষের বিনিয়োগের ক্ষমতা তত বাড়বে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, চীনের Gross Domestic Saving এর মান অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি।
এছাড়াও চীনের সরকারব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক হওয়ার ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কম, তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হয়। এছড়াও চীনের কেন্দ্রীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত খুব কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
অর্থাৎ কৃষি বাজার উন্মুক্তকরণ, কুটির শিল্পের উন্নতি, ব্যক্তি বিনিয়োগের স্বাধীনতা, বৈদেশিক বিনিয়োগ, আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ন, অর্থনৈতিক জোন তৈরি, দক্ষ জনশক্তি, Gross Domestic Saving এর উচ্চমান- এসব কারণেই চীন গত চল্লিশ বছরে অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভে সক্ষম হয়েছে।
চীনের বৃহৎ শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, অপরিশোধিত তেল উৎপাদন, সিমেন্ট, আয়রন, স্টিল, কয়লা শিল্প, অটোমোবাইল শিল্প প্রভৃতি। উল্লেখ্য, চীন পুরো পৃথিবীর প্রায় ৬০% সিমেন্ট একাই তৈরি করে। এছাড়াও চীন পৃথিবীর এক নাম্বার রপ্তানিকারক দেশ।
বর্তমানে অবশ্য চীনে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে আমেরিকার সাথে বাণিজ্যিক যুদ্ধের কারণে। তবে ভবিষ্যত পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরাশক্তি কে হতে যাচ্ছে সেটা সময়ই বলে দেবে।